মানব পাচার- মালয়েশিয়ার বৈধ পথ সীমিত, অবৈধ অবারিত by শরিফুল হাসান
১৪ মে আন্দামান সাগরে ভাসমান নৌকায় অন্যদের সঙ্গে দুই বাংলাদেশি সাইদুল ও আবু বকর। উদ্ধারের পর ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশের আশ্রয়শিবিরে গত বৃহস্পতিবার ওই দুজন l ছবি: এএফপি |
বাংলাদেশ
থেকে বৈধভাবে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক হিসেবে যাওয়ার সুযোগ একেবারেই সীমিত।
সাড়ে ১৪ লাখ লোক নিবন্ধন করেও যেতে পারছেন না। কিন্তু অবৈধভাবে যাওয়ার
সুযোগ অবারিত। যাওয়ার আগে টাকা লাগে না, আবার কোনো রকমে পৌঁছালেই কাজ
মিলছে—দালালদের এমন প্রলোভনে পা দিচ্ছে সহজ-সরল মানুষ।
বাংলাদেশ থেকে সরকারিভাবে শ্রমিক নিতে (গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট —জিটুজি) তিন বছর আগে চুক্তি করলেও কর্মী নিয়োগে সেভাবে চাহিদাপত্র পাঠাচ্ছে না মালয়েশিয়া। তবে সমুদ্রপথে কিংবা ছাত্র-পর্যটক সেজে অবৈধভাবে যাঁরা দেশটিতে পৌঁছাচ্ছেন, তাঁরা কাজও পেয়ে যাচ্ছেন। এ জন্য সেখানে যেমন দালাল চক্র গড়ে উঠেছে, তেমনি বাংলাদেশ থেকেও অবৈধভাবে লোক পাঠানোর কাজটি করছে মানব পাচারকারীরা।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সালের ২৬ নভেম্বর চুক্তি হওয়ার পর মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য সাড়ে ১৪ লাখ লোক নিবন্ধন করেন। কিন্তু গত তিন বছরে মাত্র সাড়ে সাত হাজার কর্মী নিয়েছে দেশটি। বাংলাদেশও এ ব্যাপারে কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারেনি। অথচ একই সময়ে সাগরপথে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করেছেন দেড় লাখ লোক। ছাত্র ও পর্যটক সেজে গেছেন আরও অন্তত এক লাখ। এ অবৈধ যাত্রা ঠেকাতেও পারেনি বাংলাদেশ।
জনশক্তি রপ্তানিকারক ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথ সংকুচিত হওয়ার কারণেই অবৈধভাবে কর্মী পাঠানোর সুযোগ নিচ্ছে দালালেরা। সরকার এই দাবি না মানলেও জিটুজি চুক্তি করেও কাঙ্ক্ষিত চাহিদাপত্র না পাঠানোর কারণে হতাশ।
প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মালয়েশিয়ার আগ্রহের কারণেই সরকারিভাবে লোক পাঠানোর চুক্তি হয়েছিল। দেশটি যত লোকের চাহিদা দেবে, আমরা তত লোক দিতে পারব। কিন্তু তারা কাঙ্ক্ষিত চাহিদাপত্র পাঠাচ্ছে না। আমরা তো আর এ নিয়ে মারামারি করতে পারি না। তাদের সঙ্গে তিনবার বৈঠক করে এ বিষয়ে কথা বলেছি। সামনের বৈঠকে আবারও এ নিয়ে কথা হবে।’
দালালদের মাধ্যমেই অবৈধভাবে মানুষ মালয়েশিয়া গিয়ে কাজ পাচ্ছে বলে স্বীকার করে মন্ত্রী বলেন, সবার উচিত দালালদের বিরুদ্ধে কথা বলা।
মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে গত মাসে ঢাকায় পাঠানো একটি চিঠিতে বলা হয়েছে, ওই দেশে একদিকে যেমন অবৈধ বাংলাদেশির সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে, তেমনি কোম্পানিগুলো অবৈধ শ্রমিক দিয়ে কাজ করানোয় বৈধ শ্রমিকের চাহিদা কমে যাচ্ছে।
জনশক্তি রপ্তানিকারকেরা বলছেন, জিটুজি প্রক্রিয়ায় কর্মী নিতে মালয়েশিয়ার একটি কোম্পানিকে প্রথমে দেশটির মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়ে চাহিদাপত্র দিতে হয়। এরপর একেকজন কর্মীর জন্য ২৫-২৬ হাজার টাকা লেভি বা কর দিতে হয়। এ প্রক্রিয়া জটিল ও সময়সাপেক্ষ। এসব কারণে অনেক নিয়োগকর্তাই এ প্রক্রিয়ায় যেতে চান না। আর এ সুযোগটাই নেয় দালাল চক্র।
মালয়েশিয়া আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক এবং বেসরকারি জনশক্তি রপ্তানিকারক রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘মালয়েশিয়ায় অনেক ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান আছে। তারা এত টাকা লেভি দিয়ে জিটুজি প্রক্রিয়ায় লোক আনতে চায় না। এর বদলে তারা অবৈধভাবে আসা লোকদের কম বেতনে কাজ দেয়। আর দালালেরাও অবৈধভাবে আসা লোকদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ দেয়। বেতনের একটা অংশও দালালেরা রেখে দেয়। এ পুরো চেইন ভাঙতে হলে বাংলাদেশ থেকে জিটুজির পাশাপাশি বেসরকারিভাবে লোক পাঠানো শুরু করতে হবে। সেটি হলে বাংলাদেশ থেকে বছরে কয়েক লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে মালয়েশিয়ায়। তাঁরা প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রীকে বিভিন্ন সময়ে এ বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করেছেন বলে জানান।
টাইম সাময়িকী ও যুক্তরাজ্যের গার্ডিয়ান পত্রিকার একাধিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, থাইল্যান্ডের চিংড়ি ও সি ফুড শিল্পে কর্মরত সাড়ে ছয় লাখ শ্রমিকের মধ্যে তিন লাখই ক্রীতদাস হিসেবে কাজ করছেন। এঁদের বেশির ভাগই বাংলাদেশি, যাঁদের সাগরপথে মালয়েশিয়া নেওয়ার কথা বলে এখানে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। আবার যাঁরা মালয়েশিয়ায় যেতে পারছেন, তাঁরাও খুব সস্তায় শ্রম দিচ্ছেন। মালয়েশিয়ায় অবৈধ সংখ্যা কত, তা বাংলাদেশ হাইকমিশনও জানে না।
অভিবাসনবিষয়ক এশিয়ার বেসরকারি সংস্থাগুলোর জোট কারাম এশিয়া। এর সদর দপ্তর মালয়েশিয়ায়। প্রতিষ্ঠানটির সমন্বয়ক হারুন আল রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে লোক পাঠানো, এখানে এনে তাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ দেওয়া—এ পুরো প্রক্রিয়ায় কয়েক হাজার দালাল জড়িত। এদের মধ্যে বাংলাদেশি যেমন আছে, তেমনি মালয়েশিয়ার লোকজনও আছে। এ যেন এক দাসপ্রথা। তাঁরা মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এ চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন বলে জানান।
বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির অন্যতম বাজার মালয়েশিয়া। ২০০৭ সালে ২ লাখ ৭৩ হাজার ২০১ জন এবং ২০০৮ সালে ১ লাখ ৩১ হাজার ৭৬২ জন লোক মালয়েশিয়া গেছেন। ২০০৯ সালে দেশটি বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়া বন্ধ করে দেয়। এরপর জনশক্তি রপ্তানিকারকদের বাদ দিয়ে সরকারিভাবে দেশটিতে কর্মী পাঠাতে জিটুজি চুক্তি করা হয়। ওই চুক্তি করার পর দেশটি বলেছিল, প্রথম দফায় তারা ৫০ হাজার লোক নেবে। আর প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছিলেন, বছরে অন্তত এক লাখ লোক মালয়েশিয়া যাবে। পাঁচ বছরে যাবে পাঁচ লাখ। ২০১২ সালের ৩১ ডিসেম্বর মন্ত্রী জানান, বনায়ন খাতে ১০ হাজার কর্মী নেওয়ার চাহিদাপত্র পাঠিয়েছে মালয়েশিয়া। কিন্তু গত আড়াই বছরেও ১০ হাজার কর্মী নেয়নি দেশটি।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দুই দেশের যৌথ কমিটির বৈঠকে বিভিন্ন সময় মালয়েশিয়াকে চাহিদাপত্র বাড়ানোর কথা বলা হলেও তারা শুধু আশ্বাসই দিয়েছে। গত বছরের আগস্টে মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রী রিচার্ড রায়ত জায়েমের নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিনিধিদল ঢাকা সফরে আসে। এরপর সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, মালয়েশিয়া সব খাতে কর্মী নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু এক বছর হতে চললেও খাতগুলো উন্মুক্ত হয়নি। এ ছাড়া গত বছরের ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মালয়েশিয়া সফর করেন। এর আগে-পরে বিভিন্ন সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, সারওয়াক প্রদেশে ১২ হাজার লোক নেবে মালয়েশিয়া। এরপর জানুয়ারি মাসে পাঁচ হাজার ও ফেব্রুয়ারি মাসে তিন হাজার লোকের তথ্য পাঠানো হলেও কোনো সাড়া দেয়নি দেশটি।
মালয়েশিয়া সরকার জিটুজির মাধ্যমে কর্মী পাঠানোর চাহিদাপত্র না দিলেও গত মাসেই সারওয়াকের একটি কোম্পানি বেসরকারিভাবে ২০৬ জন লোক নিতে চেয়েছিল। কিন্তু ঢাকা থেকে আবার সেই অনুমতি দেওয়া হয়নি। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অনেক কর্মকর্তাই মনে করছেন, জিটুজির পাশাপাশি বেসরকারিভাবেও মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি চালু করা দরকার। প্রাথমিকভাবে আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে ভিসা পেয়েছেন এমন লোকদের যাওয়ার সুযোগ দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রণালয়ে আলোচনাও হয়েছে। এর সূত্র ধরে আবার মালয়েশিয়ার বাজার জনশক্তি রপ্তানিকারকদের কাছে যাচ্ছে এমন কথাও শোনা যাচ্ছে।
তবে প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন সেটি নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মালয়েশিয়া যখন জিটুজির বাইরে লোক চাইবে, তখনই লোক দেওয়া হবে। তার আগে নয়। কাজেই বেসরকারিভাবে লোক পাঠানোর সুযোগ দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।
বাংলাদেশ থেকে সরকারিভাবে শ্রমিক নিতে (গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট —জিটুজি) তিন বছর আগে চুক্তি করলেও কর্মী নিয়োগে সেভাবে চাহিদাপত্র পাঠাচ্ছে না মালয়েশিয়া। তবে সমুদ্রপথে কিংবা ছাত্র-পর্যটক সেজে অবৈধভাবে যাঁরা দেশটিতে পৌঁছাচ্ছেন, তাঁরা কাজও পেয়ে যাচ্ছেন। এ জন্য সেখানে যেমন দালাল চক্র গড়ে উঠেছে, তেমনি বাংলাদেশ থেকেও অবৈধভাবে লোক পাঠানোর কাজটি করছে মানব পাচারকারীরা।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সালের ২৬ নভেম্বর চুক্তি হওয়ার পর মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য সাড়ে ১৪ লাখ লোক নিবন্ধন করেন। কিন্তু গত তিন বছরে মাত্র সাড়ে সাত হাজার কর্মী নিয়েছে দেশটি। বাংলাদেশও এ ব্যাপারে কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারেনি। অথচ একই সময়ে সাগরপথে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করেছেন দেড় লাখ লোক। ছাত্র ও পর্যটক সেজে গেছেন আরও অন্তত এক লাখ। এ অবৈধ যাত্রা ঠেকাতেও পারেনি বাংলাদেশ।
জনশক্তি রপ্তানিকারক ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথ সংকুচিত হওয়ার কারণেই অবৈধভাবে কর্মী পাঠানোর সুযোগ নিচ্ছে দালালেরা। সরকার এই দাবি না মানলেও জিটুজি চুক্তি করেও কাঙ্ক্ষিত চাহিদাপত্র না পাঠানোর কারণে হতাশ।
প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মালয়েশিয়ার আগ্রহের কারণেই সরকারিভাবে লোক পাঠানোর চুক্তি হয়েছিল। দেশটি যত লোকের চাহিদা দেবে, আমরা তত লোক দিতে পারব। কিন্তু তারা কাঙ্ক্ষিত চাহিদাপত্র পাঠাচ্ছে না। আমরা তো আর এ নিয়ে মারামারি করতে পারি না। তাদের সঙ্গে তিনবার বৈঠক করে এ বিষয়ে কথা বলেছি। সামনের বৈঠকে আবারও এ নিয়ে কথা হবে।’
দালালদের মাধ্যমেই অবৈধভাবে মানুষ মালয়েশিয়া গিয়ে কাজ পাচ্ছে বলে স্বীকার করে মন্ত্রী বলেন, সবার উচিত দালালদের বিরুদ্ধে কথা বলা।
মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে গত মাসে ঢাকায় পাঠানো একটি চিঠিতে বলা হয়েছে, ওই দেশে একদিকে যেমন অবৈধ বাংলাদেশির সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে, তেমনি কোম্পানিগুলো অবৈধ শ্রমিক দিয়ে কাজ করানোয় বৈধ শ্রমিকের চাহিদা কমে যাচ্ছে।
জনশক্তি রপ্তানিকারকেরা বলছেন, জিটুজি প্রক্রিয়ায় কর্মী নিতে মালয়েশিয়ার একটি কোম্পানিকে প্রথমে দেশটির মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়ে চাহিদাপত্র দিতে হয়। এরপর একেকজন কর্মীর জন্য ২৫-২৬ হাজার টাকা লেভি বা কর দিতে হয়। এ প্রক্রিয়া জটিল ও সময়সাপেক্ষ। এসব কারণে অনেক নিয়োগকর্তাই এ প্রক্রিয়ায় যেতে চান না। আর এ সুযোগটাই নেয় দালাল চক্র।
মালয়েশিয়া আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক এবং বেসরকারি জনশক্তি রপ্তানিকারক রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘মালয়েশিয়ায় অনেক ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান আছে। তারা এত টাকা লেভি দিয়ে জিটুজি প্রক্রিয়ায় লোক আনতে চায় না। এর বদলে তারা অবৈধভাবে আসা লোকদের কম বেতনে কাজ দেয়। আর দালালেরাও অবৈধভাবে আসা লোকদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ দেয়। বেতনের একটা অংশও দালালেরা রেখে দেয়। এ পুরো চেইন ভাঙতে হলে বাংলাদেশ থেকে জিটুজির পাশাপাশি বেসরকারিভাবে লোক পাঠানো শুরু করতে হবে। সেটি হলে বাংলাদেশ থেকে বছরে কয়েক লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে মালয়েশিয়ায়। তাঁরা প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রীকে বিভিন্ন সময়ে এ বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করেছেন বলে জানান।
টাইম সাময়িকী ও যুক্তরাজ্যের গার্ডিয়ান পত্রিকার একাধিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, থাইল্যান্ডের চিংড়ি ও সি ফুড শিল্পে কর্মরত সাড়ে ছয় লাখ শ্রমিকের মধ্যে তিন লাখই ক্রীতদাস হিসেবে কাজ করছেন। এঁদের বেশির ভাগই বাংলাদেশি, যাঁদের সাগরপথে মালয়েশিয়া নেওয়ার কথা বলে এখানে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। আবার যাঁরা মালয়েশিয়ায় যেতে পারছেন, তাঁরাও খুব সস্তায় শ্রম দিচ্ছেন। মালয়েশিয়ায় অবৈধ সংখ্যা কত, তা বাংলাদেশ হাইকমিশনও জানে না।
অভিবাসনবিষয়ক এশিয়ার বেসরকারি সংস্থাগুলোর জোট কারাম এশিয়া। এর সদর দপ্তর মালয়েশিয়ায়। প্রতিষ্ঠানটির সমন্বয়ক হারুন আল রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে লোক পাঠানো, এখানে এনে তাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ দেওয়া—এ পুরো প্রক্রিয়ায় কয়েক হাজার দালাল জড়িত। এদের মধ্যে বাংলাদেশি যেমন আছে, তেমনি মালয়েশিয়ার লোকজনও আছে। এ যেন এক দাসপ্রথা। তাঁরা মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এ চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন বলে জানান।
বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির অন্যতম বাজার মালয়েশিয়া। ২০০৭ সালে ২ লাখ ৭৩ হাজার ২০১ জন এবং ২০০৮ সালে ১ লাখ ৩১ হাজার ৭৬২ জন লোক মালয়েশিয়া গেছেন। ২০০৯ সালে দেশটি বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়া বন্ধ করে দেয়। এরপর জনশক্তি রপ্তানিকারকদের বাদ দিয়ে সরকারিভাবে দেশটিতে কর্মী পাঠাতে জিটুজি চুক্তি করা হয়। ওই চুক্তি করার পর দেশটি বলেছিল, প্রথম দফায় তারা ৫০ হাজার লোক নেবে। আর প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছিলেন, বছরে অন্তত এক লাখ লোক মালয়েশিয়া যাবে। পাঁচ বছরে যাবে পাঁচ লাখ। ২০১২ সালের ৩১ ডিসেম্বর মন্ত্রী জানান, বনায়ন খাতে ১০ হাজার কর্মী নেওয়ার চাহিদাপত্র পাঠিয়েছে মালয়েশিয়া। কিন্তু গত আড়াই বছরেও ১০ হাজার কর্মী নেয়নি দেশটি।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দুই দেশের যৌথ কমিটির বৈঠকে বিভিন্ন সময় মালয়েশিয়াকে চাহিদাপত্র বাড়ানোর কথা বলা হলেও তারা শুধু আশ্বাসই দিয়েছে। গত বছরের আগস্টে মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রী রিচার্ড রায়ত জায়েমের নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিনিধিদল ঢাকা সফরে আসে। এরপর সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, মালয়েশিয়া সব খাতে কর্মী নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু এক বছর হতে চললেও খাতগুলো উন্মুক্ত হয়নি। এ ছাড়া গত বছরের ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মালয়েশিয়া সফর করেন। এর আগে-পরে বিভিন্ন সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, সারওয়াক প্রদেশে ১২ হাজার লোক নেবে মালয়েশিয়া। এরপর জানুয়ারি মাসে পাঁচ হাজার ও ফেব্রুয়ারি মাসে তিন হাজার লোকের তথ্য পাঠানো হলেও কোনো সাড়া দেয়নি দেশটি।
মালয়েশিয়া সরকার জিটুজির মাধ্যমে কর্মী পাঠানোর চাহিদাপত্র না দিলেও গত মাসেই সারওয়াকের একটি কোম্পানি বেসরকারিভাবে ২০৬ জন লোক নিতে চেয়েছিল। কিন্তু ঢাকা থেকে আবার সেই অনুমতি দেওয়া হয়নি। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অনেক কর্মকর্তাই মনে করছেন, জিটুজির পাশাপাশি বেসরকারিভাবেও মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি চালু করা দরকার। প্রাথমিকভাবে আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে ভিসা পেয়েছেন এমন লোকদের যাওয়ার সুযোগ দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রণালয়ে আলোচনাও হয়েছে। এর সূত্র ধরে আবার মালয়েশিয়ার বাজার জনশক্তি রপ্তানিকারকদের কাছে যাচ্ছে এমন কথাও শোনা যাচ্ছে।
তবে প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন সেটি নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মালয়েশিয়া যখন জিটুজির বাইরে লোক চাইবে, তখনই লোক দেওয়া হবে। তার আগে নয়। কাজেই বেসরকারিভাবে লোক পাঠানোর সুযোগ দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।
No comments