নারী লাঞ্ছনা- আমরা তোমার পাশে আছি by সঞ্জীব দ্রং

ঘরে-বাইরে কোথাও নারী নিরাপদ নয়। একের পর এক নারী নিগ্রহের ঘটনা ঘটলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অপরাধীদের ধরতে পারছে না। অনেক ক্ষেত্রে তাদের দ্বারাও নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। এই প্রেক্ষাপটে নারী নিগ্রহ নিয়ে লিখেছেন আদিবাসী নেতা সঞ্জীব দ্রং
আমি আক্রান্ত গারো আদিবাসী মেয়েকে হাসপাতালে দেখতে গেলাম। হাসপাতালে অনেক আত্মীয়স্বজন এসেছেন। মেয়েটিকে যেখানে রাখা হয়েছে, বলা হলো ওখানে সবার প্রবেশাধিকার নেই। পুরুষের প্রবেশাধিকার তো নেই-ই। তবু দেখলাম দু-একজন বের হলেন। আমি পুলিশ ভাইকে বিনীতভাবে বললাম, মেয়েটি আমার আত্মীয়, স্বজন আমাদের সবার। বললাম, মেয়েটির বড় বোনও আছে আমার সঙ্গে। আমরা তাকে একটু দেখতে চাই। একটু সহানুভূতি জানানো, একটু সাহস দেওয়া প্রয়োজন। পুলিশ ভাইটি ভালো আচরণ করলেন এবং অনুমতি দিলেন। মেয়েটিকে বারান্দায় নিয়ে আসা হলো। অনেকক্ষণ পরে সম্ভবত দুই বোনের দেখা হলো। আবেগময় ওরা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে ছিল। যাতে এখনই ওরা কেঁদে না ফেলে, তার জন্য আমাদের মান্দি ভাষায় ওদের বোঝালাম। আক্রান্ত (ধর্ষিতা শব্দটি ব্যবহার করতে চাই না। গারো ভাষায় ‘ধর্ষণ’ শব্দের প্রতিশব্দ নেই) মেয়েটির পাশে দাঁড়িয়ে তাকে বললাম—শোনো, সব ঠিক আছে, কিছুই হয়নি তোমার। তোমার বোনেরা আছে, মা আছেন গ্রামে, বাড়ির পাশে অবারিত সবুজ বন, যাদের ফেলে শহরে এসেছিলে, সবাই আছে। মেয়েটিকে বললাম, আমি তো তোমাদের গ্রামে গিয়েছি। অনেক সুন্দর গ্রাম। গ্রামের পাশে অনেক বড় বিল আছে। সারি সারি আনারসের বাগান। বললাম, সব ঠিক আছে। মান্দি ভাষায় বললাম, তোমার কিছুই হারায়নি, আমরা আছি। মেয়েটি থরথর করে কাঁপছিল। ভয় পেলাম যদি পড়ে যায়! বড় বোন ওর হাত ধরল। বললাম, তোমার আরেক বোন বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, তোমার বাবা এসেছেন, মামা এসেছেন, অনেক ছেলে এসেছে জগন্নাথ হল থেকে। বললাম, মান্দি সমাজ অনেক ভালো সমাজ। এখন তোমার বন্ধু ও স্বজন বেড়ে গেছে। মেয়েটি তাকিয়ে ছিল। মহিলা পুলিশ সদস্য কঠিন মনোভাব দেখিয়ে মেয়েটিকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। আমি এই পুলিশ বোনটির কোনো দোষ দেখি না। অতিরিক্ত ডিউটি করতে করতে এবং চাপ নিতে নিতে মনে হয় তাঁর কোমল মানবিক সত্তা হারিয়ে যেতে বসেছে। মহিলা পুলিশ সদস্য বললেন, আপনারা চিন্তা করবেন না, এখানে সে নিরাপদে থাকবে। আমি ফিরে এলাম। হাসপাতালের নিচে এসে অনেক গারো স্বজনের সঙ্গে কথা বললাম। তরুণ গারো ছাত্রদের বললাম, তোমরা রাতে এসে একটু ঘুরে যেয়ো। পরে শুনেছি গারো ছেলেরা প্রশংসনীয় কাজ করেছে।
গত রোববার আমরা ৩০টির অধিক আদিবাসী ও মানবাধিকারকামী সংগঠন মিলে যে বড় প্রতিবাদ সমাবেশ করেছি, সেখানে আক্রান্ত মেয়েটির বড় বোন এসেছিল। অনেক টিভি চ্যানেল ওর সাক্ষাৎকার নিতে চেয়েছিল এবং আমাকে অনুরোধ করেছিল। অনেক টিভি রিপোর্টার বলেছেন, তাঁরা বড় বোনকে ক্যামেরায় দেখাবেন না, পেছন থেকে কথা রেকর্ড করবেন। আমি জানলাম, মেয়েটির মন ভালো নেই। ও কথা বলতে চায় না ক্যামেরার সামনে। এমন কোনো পদ্ধতি কি বের করা যায় না, ভিকটিম বা তার পরিবারের কারও সঙ্গে ক্যামেরা ছাড়া কথা বলে তথ্যানুসন্ধান করা যায়? সেটি হলে ভালো হয়।
আমি অবাক হই, এখনো সরকারের পক্ষ থেকে নির্দিষ্টভাবে কোনো বক্তব্য আসেনি। বিএনপি অভিযোগ করেছে, আদিবাসী নারী ধর্ষণের ঘটনায় সরকার নীরব ভূমিকা পালন করছে। কেন এখনো স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মেয়েটিকে দেখতে গেলেন না? নারী ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি হাসপাতালে গেছেন, তাঁকে ধন্যবাদ।
আমার অভিজ্ঞতা বলে, এই আদিবাসী মেয়েটিকে অন্যান্য ঘটনার মতো দীর্ঘ মামলা–প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। এত দীর্ঘ পথ সে পাড়ি দেবে কীভাবে? আমরা আদিবাসী সংগঠনসমূহ সামান্য শক্তি নিয়ে তার পাশে থাকব। কিন্তু রাষ্ট্রকে তো মূল দায়িত্ব পালন করতে হবে। আমি চাই, রাষ্ট্র এই আদিবাসী মেয়েটির নিরাপত্তাসহ সব দায়িত্ব গ্রহণ করুক।
আর আসুন, আমরা সবাই আজ মমতার হাত বাড়িয়ে দিই। সবার স্নেহ-মায়া-মমতায় যেন আদিবাসী মেয়েটি নতুন স্বপ্ন দেখতে পারে। মেয়েটির গ্রাম ছিল মধুপুর বনাঞ্চলের অংশ। এত সুন্দর গ্রাম ছেড়ে একটু ভালো থাকা ও সুন্দর জীবনের আশায় মেয়েটি এই শহরে এসেছিল। তাহলে এই শহর কি ওর সব স্বপ্ন ছারখার করে দিল? নিশ্চয় আমরা এটি বিশ্বাস করতে চাই না। নিষ্ঠুর এই শহরে ২১ বছরের মেয়েটি কি একাকী হয়ে যাবে? আমি শুনে খুব খুশি হয়েছি, এই আক্রান্ত মেয়েটিকে দেখতে নতুন মেয়র আনিসুল হক ও তাঁর স্ত্রী ছুটে গিয়েছিলেন। সান্ত্বনা দিয়েছেন, হয়তো একটু সাহস জুগিয়েছেন, সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
দিনে কিংবা রাতে এই শহর যেন সব নারীর জন্য নিরাপদ হয়। মেয়েরা যেন বলতে পারে, এ শহর তাদেরও।
সঞ্জীব দ্রং: কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী।
sanjeebdrong@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.