ঘরে ঘরে দুধভাত by রহিদুল মিয়া ও আলতাফ হোসেন
রংপুরের পীরগাছা উপজেলার যাদুলস্কর গ্রামে নিজ খামারে দুধ দোহনে ব্যস্ত সান্ত্বনা রানী l ছবি: প্রথম আলো |
আরও
পড়ার ইচ্ছা ছিল মেয়েটির। কিন্তু গরিব বাবার সংসারে তা আর হয়ে উঠল না।
মাত্র ১৪ বছর বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হলো। দিনমজুর স্বামীর সংসারে এসেও
অভাব পিছু ছাড়ল না। একসময় কোলজুড়ে এল ফুটফুটে একটা মেয়ে। মেয়েটার মুখের
দিকে তাকিয়ে অন্যের বাড়িতে কাজ নেন। দৈনিক পাঁচ মুষ্টি করে চাল জমিয়ে কেনেন
কয়েকটি হাঁস-মুরগি। পরে ছাগল। বছর কয়েক পর সেগুলো বিক্রি করে একটি গাভি
কিনলেন। দেখতে দেখতে কয়েক বছরে ছোটখাটো একটি খামার হয়ে গেল তাঁর। সঙ্গে
সংসারের দৈন্যদশাও ধীরে ধীরে কাটতে থাকল।
আজকের বিশেষ প্রতিবেদনের সংগ্রামী ওই মেয়েটি হলো রংপুরের পীরগাছা উপজেলার যাদুলস্কর গ্রামের গৃহবধূ সান্ত্বনা রানী। বয়স সাঁইত্রিশের কোঠায়। তাঁর দেখানো পথে ওই গ্রামের অন্তত¯দেড় শ পরিবার এখন দাঁড়িয়েছে নিজের পায়ে। তাদের ঘরে ঘরে এখন আছে দুধভাত।
সান্ত্বনার খোঁজে: সান্ত্বনার বাড়ি যাওয়ার পথে ওই গ্রামে ঢুকতেই বিভিন্ন মাঠজুড়ে অসংখ্য গাভি আর বাছুর চরে বেড়াতে দেখা যায়। কাউকে কাউকে গাভির জন্য মাঠ থেকে ঘাস কেটে বস্তায় ভরে বাড়ি ফিরতে দেখা গেল। কয়েকটি বাড়িতে দেখা গেল গৃহবধূরা বিচালি (খড়) কেটে গম, মাষকলাইয়ের ভুসির সঙ্গে মিশিয়ে গাভিকে খাওয়াচ্ছেন।
সান্ত্বনার বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, তিনি গাভির দুধ দোহাতে ব্যস্ত। কিছুক্ষণ পর খামার থেকে বেরিয়ে এলেন। বাড়ির সামনে লিচুগাছের ছায়ায় বসতে দিলেন। শোনালেন তাঁর সংগ্রামী জীবনের কথা।
সংগ্রামী সান্ত্বনা: সান্ত্বনার বাবার বাড়ি লালমনিরহাট সদর উপজেলার পাকজান গ্রামে। নয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। অভাবের সংসার বলে নবম শ্রেণিতেই বন্ধ হয়ে যায় লেখাপড়া। ১৯৯২ সালের বিয়ে হয় যাদুলস্কর গ্রামের স্বপন কুমারের সঙ্গে। স্বামীর বাড়িতে এসেও অভাব পিছু ছাড়েনি। খেয়ে না-খেয়ে থাকতে হতো তাঁদের।
সান্ত্বনা জানালেন, অভাব আর সহ্য হচ্ছিল না। তাই প্রতিজ্ঞা করলেন অভাব ঠেকাতে কিছু একটা করতে হবে। সেই ভাবনা থেকে অন্যের বাড়িতে কাজ নেন ধান ভানার। এতে দৈনিক দেড় থেকে দুই কেজি চাল পান। ১৯৯৫ সালে তাঁর কোলজুড়ে আসে মেয়ে ঝর্ণা রানী। মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সেই চাল থেকে প্রতিদিন পাঁচ মুষ্টি চাল সঞ্চয় করা শুরু করেন তিনি।
বলে যান সান্ত্বনা, এক বছর পরে জমানো চাল বিক্রি করে পান ৩ হাজার ৮০০ টাকা। সেই টাকায় কেনেন ২০টি হাঁস-মুরগি আর চারটি ছাগল। ছাগল বাচ্চা দেয়, হাঁস-মুরগি দেয় ডিম। তা বিক্রি করে ১৯৯৮ সালে কেনেন সংকর জাতের দুটি বকনা বাছুর। বছর তিনেক পর বাছুর দুটি গাভিতে পরিণত হয়। বাচ্চা দেয়। প্রতিদিন ২০ লিটার করে দুধ দিতে শুরু করে। এ দুধ বিক্রি করে দিনে প্রায় ৩০০ টাকা আয় হতো। গোবর দিয়ে জ্বালানি তৈরি করে বাজারে বিক্রি করেও কিছু টাকা পান। এভাবে তিন বছরে সংকর জাতের আরও চারটি গাভি কেনেন। হয়ে যায় ছোটখাটো একটা খামার। সব মিলেয়ে বর্তমানে সান্ত্বনার খামারে দেশি-বিদেশি মিলে ১৮টি গরু আছে। প্রতিদিন খামার থেকে গড়ে ৮০ থেকে ৮৫ লিটার দুধ পান। প্রতি লিটার দুধ ৪০ টাকা দরে বিক্রি করে খরচ বাদে দৈনিক ১ হাজার ৩০০ টাকা লাভ থাকে। বছরে এক লাখ টাকার গাভিও বিক্রি করেন তিনি।
এ আয়ের টাকায় সান্ত্বনা খড়ের ঘরের জায়গায় আধা পাকা টিনের বাড়ি করেছেন। কিনেছেন আবাদি জমি। মাছ চাষের জন্য খনন করেছেন পুকুর। গাভির খামারও করেছেন আধা পাকা। দামি কাঠের আসবাবে সাজিয়েছেন ঘর। বাড়ির চারদিকে আম, কাঁঠাল, লিচু, পেঁপের গাছ ও শাকসবজি লাগিয়েছেন।
তাঁর দেখানো পথে: নিজের সংসারের সচ্ছলতা আনার পাশাপাশি প্রতিবেশীদের গাভি পালনে উৎসাহিত করেছেন। সান্ত্বনার কাছে পরামর্শ নিয়ে অনেকে গাভি পালন করে ভাগ্য বদল করেছেন। গ্রামের রঞ্জিনা খাতুন, আবদুস সালাম, মোছলেমা খাতুন, হাবিবুর রহমান, জাহিদুল ইসলাম, মেহেনা বেগমসহ দেড় শতাধিক পরিবার সাত থেকে আট বছর ধরে গাভি পালন করে অভাব তাড়িয়েছে।
গ্রামের সাইফুল ইসলাম এইচএসসি পাস করার পর বেকার ঘুরে বেড়িয়েছেন চার বছর। মাঝে ছোটখাটো ব্যবসা করেও সুবিধা করতে পারেননি। সাইফুল জানালেন, সান্ত্বনার পরামর্শে দুটি বিদেশি জাতের গাভি দিয়ে খামার শুরু করে এখন দৈনিক আয় করছেন হাজার টাকা। পাকা বাড়ি করেছেন। তিন বিঘা আবাদি জমিও কিনেছেন।
সাইফুলের স্ত্রী ময়না খাতুন বললেন, ‘এসবই পরিশ্রমের ফল। গ্রামের অন্যদেরও তাই। আগের মতো কষ্ট কারও নাই। সবাই এখন দুধেভাতে সুখী। এ কৃতিত্ব সান্ত্বনা আপার।’
সান্ত্বনার স্বপ্ন: অভাবের বিরুদ্ধে জয়ী হলেও সান্ত্বনা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে না পারার কষ্ট এখনো তাঁর বুকে বাজে। তাই স্বপ্ন, ছেলেমেয়েকে শিক্ষিত ও যোগ্য করে গড়ে তোলা। বললেন, ‘মেয়ে ঝর্ণা রানী যখন কলেজে ও ছেলে সবুজ চন্দ্র যখন স্কুলে যায়, খুব শান্তি পাই।’ জানালেন, এ খামারটি অন্তত দেড় শ গাভির বড় খামারে পরিণত করার ইচ্ছা আছে তাঁর।
সান্ত্বনার স্বামী স্বপন কুমার বলেন, ‘আগোত গ্রামের কেউ হামাক দেইখবার পাইছিল না। সবায় মোক পেটভুকা (অভাবী) স্বপন কয়া ডাকাইছিল। সান্ত্বনার জন্যে এলা কেউ সেটা কবার পায় না।’
তাঁদের কথা: গ্রামের স্কুলশিক্ষক মকবুল হোসেন বলেন, সান্ত্বনা অমানুষিক পরিশ্রম করে আজকের এ জায়গায় এসেছেন।
অন্নদানগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মুঠোফোনে বলেন, গাভি পালনকে ঘিরে এখানে অনেকের কর্মসংস্থান হয়েছে। গাভির পরিচর্যা, গাভির খাদ্য, ওষুধের ব্যবসা করে অনেকে সংসার চালাচ্ছেন।
পীরগাছা উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা সহিদুল ইসলাম জানান, উপজেলার নয়টি ইউনিয়নের মধ্যে যাদুলস্কর গ্রামেই সবচেয়ে বেশি গাভি পালন করা হয়। এ গ্রামের উৎপাদিত দুধ বিভিন্ন এলাকায় যাচ্ছে। তাঁরা এ পর্যন্ত গ্রামটির ৪০ জন গাভি পালনকারীকে হাতেকলমে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।
আজকের বিশেষ প্রতিবেদনের সংগ্রামী ওই মেয়েটি হলো রংপুরের পীরগাছা উপজেলার যাদুলস্কর গ্রামের গৃহবধূ সান্ত্বনা রানী। বয়স সাঁইত্রিশের কোঠায়। তাঁর দেখানো পথে ওই গ্রামের অন্তত¯দেড় শ পরিবার এখন দাঁড়িয়েছে নিজের পায়ে। তাদের ঘরে ঘরে এখন আছে দুধভাত।
সান্ত্বনার খোঁজে: সান্ত্বনার বাড়ি যাওয়ার পথে ওই গ্রামে ঢুকতেই বিভিন্ন মাঠজুড়ে অসংখ্য গাভি আর বাছুর চরে বেড়াতে দেখা যায়। কাউকে কাউকে গাভির জন্য মাঠ থেকে ঘাস কেটে বস্তায় ভরে বাড়ি ফিরতে দেখা গেল। কয়েকটি বাড়িতে দেখা গেল গৃহবধূরা বিচালি (খড়) কেটে গম, মাষকলাইয়ের ভুসির সঙ্গে মিশিয়ে গাভিকে খাওয়াচ্ছেন।
সান্ত্বনার বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, তিনি গাভির দুধ দোহাতে ব্যস্ত। কিছুক্ষণ পর খামার থেকে বেরিয়ে এলেন। বাড়ির সামনে লিচুগাছের ছায়ায় বসতে দিলেন। শোনালেন তাঁর সংগ্রামী জীবনের কথা।
সংগ্রামী সান্ত্বনা: সান্ত্বনার বাবার বাড়ি লালমনিরহাট সদর উপজেলার পাকজান গ্রামে। নয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। অভাবের সংসার বলে নবম শ্রেণিতেই বন্ধ হয়ে যায় লেখাপড়া। ১৯৯২ সালের বিয়ে হয় যাদুলস্কর গ্রামের স্বপন কুমারের সঙ্গে। স্বামীর বাড়িতে এসেও অভাব পিছু ছাড়েনি। খেয়ে না-খেয়ে থাকতে হতো তাঁদের।
সান্ত্বনা জানালেন, অভাব আর সহ্য হচ্ছিল না। তাই প্রতিজ্ঞা করলেন অভাব ঠেকাতে কিছু একটা করতে হবে। সেই ভাবনা থেকে অন্যের বাড়িতে কাজ নেন ধান ভানার। এতে দৈনিক দেড় থেকে দুই কেজি চাল পান। ১৯৯৫ সালে তাঁর কোলজুড়ে আসে মেয়ে ঝর্ণা রানী। মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সেই চাল থেকে প্রতিদিন পাঁচ মুষ্টি চাল সঞ্চয় করা শুরু করেন তিনি।
বলে যান সান্ত্বনা, এক বছর পরে জমানো চাল বিক্রি করে পান ৩ হাজার ৮০০ টাকা। সেই টাকায় কেনেন ২০টি হাঁস-মুরগি আর চারটি ছাগল। ছাগল বাচ্চা দেয়, হাঁস-মুরগি দেয় ডিম। তা বিক্রি করে ১৯৯৮ সালে কেনেন সংকর জাতের দুটি বকনা বাছুর। বছর তিনেক পর বাছুর দুটি গাভিতে পরিণত হয়। বাচ্চা দেয়। প্রতিদিন ২০ লিটার করে দুধ দিতে শুরু করে। এ দুধ বিক্রি করে দিনে প্রায় ৩০০ টাকা আয় হতো। গোবর দিয়ে জ্বালানি তৈরি করে বাজারে বিক্রি করেও কিছু টাকা পান। এভাবে তিন বছরে সংকর জাতের আরও চারটি গাভি কেনেন। হয়ে যায় ছোটখাটো একটা খামার। সব মিলেয়ে বর্তমানে সান্ত্বনার খামারে দেশি-বিদেশি মিলে ১৮টি গরু আছে। প্রতিদিন খামার থেকে গড়ে ৮০ থেকে ৮৫ লিটার দুধ পান। প্রতি লিটার দুধ ৪০ টাকা দরে বিক্রি করে খরচ বাদে দৈনিক ১ হাজার ৩০০ টাকা লাভ থাকে। বছরে এক লাখ টাকার গাভিও বিক্রি করেন তিনি।
এ আয়ের টাকায় সান্ত্বনা খড়ের ঘরের জায়গায় আধা পাকা টিনের বাড়ি করেছেন। কিনেছেন আবাদি জমি। মাছ চাষের জন্য খনন করেছেন পুকুর। গাভির খামারও করেছেন আধা পাকা। দামি কাঠের আসবাবে সাজিয়েছেন ঘর। বাড়ির চারদিকে আম, কাঁঠাল, লিচু, পেঁপের গাছ ও শাকসবজি লাগিয়েছেন।
তাঁর দেখানো পথে: নিজের সংসারের সচ্ছলতা আনার পাশাপাশি প্রতিবেশীদের গাভি পালনে উৎসাহিত করেছেন। সান্ত্বনার কাছে পরামর্শ নিয়ে অনেকে গাভি পালন করে ভাগ্য বদল করেছেন। গ্রামের রঞ্জিনা খাতুন, আবদুস সালাম, মোছলেমা খাতুন, হাবিবুর রহমান, জাহিদুল ইসলাম, মেহেনা বেগমসহ দেড় শতাধিক পরিবার সাত থেকে আট বছর ধরে গাভি পালন করে অভাব তাড়িয়েছে।
গ্রামের সাইফুল ইসলাম এইচএসসি পাস করার পর বেকার ঘুরে বেড়িয়েছেন চার বছর। মাঝে ছোটখাটো ব্যবসা করেও সুবিধা করতে পারেননি। সাইফুল জানালেন, সান্ত্বনার পরামর্শে দুটি বিদেশি জাতের গাভি দিয়ে খামার শুরু করে এখন দৈনিক আয় করছেন হাজার টাকা। পাকা বাড়ি করেছেন। তিন বিঘা আবাদি জমিও কিনেছেন।
সাইফুলের স্ত্রী ময়না খাতুন বললেন, ‘এসবই পরিশ্রমের ফল। গ্রামের অন্যদেরও তাই। আগের মতো কষ্ট কারও নাই। সবাই এখন দুধেভাতে সুখী। এ কৃতিত্ব সান্ত্বনা আপার।’
সান্ত্বনার স্বপ্ন: অভাবের বিরুদ্ধে জয়ী হলেও সান্ত্বনা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে না পারার কষ্ট এখনো তাঁর বুকে বাজে। তাই স্বপ্ন, ছেলেমেয়েকে শিক্ষিত ও যোগ্য করে গড়ে তোলা। বললেন, ‘মেয়ে ঝর্ণা রানী যখন কলেজে ও ছেলে সবুজ চন্দ্র যখন স্কুলে যায়, খুব শান্তি পাই।’ জানালেন, এ খামারটি অন্তত দেড় শ গাভির বড় খামারে পরিণত করার ইচ্ছা আছে তাঁর।
সান্ত্বনার স্বামী স্বপন কুমার বলেন, ‘আগোত গ্রামের কেউ হামাক দেইখবার পাইছিল না। সবায় মোক পেটভুকা (অভাবী) স্বপন কয়া ডাকাইছিল। সান্ত্বনার জন্যে এলা কেউ সেটা কবার পায় না।’
তাঁদের কথা: গ্রামের স্কুলশিক্ষক মকবুল হোসেন বলেন, সান্ত্বনা অমানুষিক পরিশ্রম করে আজকের এ জায়গায় এসেছেন।
অন্নদানগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মুঠোফোনে বলেন, গাভি পালনকে ঘিরে এখানে অনেকের কর্মসংস্থান হয়েছে। গাভির পরিচর্যা, গাভির খাদ্য, ওষুধের ব্যবসা করে অনেকে সংসার চালাচ্ছেন।
পীরগাছা উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা সহিদুল ইসলাম জানান, উপজেলার নয়টি ইউনিয়নের মধ্যে যাদুলস্কর গ্রামেই সবচেয়ে বেশি গাভি পালন করা হয়। এ গ্রামের উৎপাদিত দুধ বিভিন্ন এলাকায় যাচ্ছে। তাঁরা এ পর্যন্ত গ্রামটির ৪০ জন গাভি পালনকারীকে হাতেকলমে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।
No comments