‘এই বিএনপি দিয়ে হবে না’ by সেলিম জাহিদ ও রিয়াদুল করিম
‘শোনাে
বলি, এই বিএনপি দিয়ে হবে না। এটুকু জেনে রাখো।...জিয়াউর রহমানের বিএনপি
যদি করতে পারো...।’ এটি সম্প্রতি ইউটিউবে ফাঁস হওয়া বিএনপির নীতিনির্ধারণী
পর্যায়ের একজন নেতার ফোনালাপের অংশবিশেষ।
দলটির নেতা-কর্মী-সমর্থক ও হিতাকাঙ্ক্ষীরা বলছেন, ১৬ শব্দের এই তিনটি বাক্যে কার্যত ৩৭ বছরের বিএনপির ভেতরকার হালচিত্র প্রকাশ পেয়েছে। তিন মাস পর আগামী ১ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠার ৩৭ বছর পূর্ণ হবে দলটির। আর কাল ৩০ মে দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ৩৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। তার কিছুদিন আগে একান্ত আলাপে ‘এই বিএনপি দিয়ে হবে না’ বলে মন্তব্য করলেন দলের জ্যেষ্ঠ নেতা ও স্থায়ী কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য মওদুদ আহমদ।
দলটির নেতা-কর্মীরা মনে করেন, বিএনপির প্রতিষ্ঠা এবং প্রতিষ্ঠাতার মৃত্যুর তিন যুগের মাথায় এসে দলটি এখন এক ক্রান্তিকাল পার করছে। বিশেষ করে গত জানুয়ারি থেকে টানা চার মাসের আন্দোলন এবং তিন সিটি নির্বাচনে প্রায় খালি হাতেই ঘরে ফিরেছে বিএনপি। এর মধ্যে দীর্ঘ সময়ের আন্দোলনের ক্লান্তির সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হামলা-মামলা, খুন, গুম-আতঙ্ক নেতা-কর্মীদের ছন্নছাড়া করে দিয়েছে। এমন নাজুক অবস্থা থেকে বিএনপি শিগগির সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে কি না, রাজনৈতিক মহলে সে প্রশ্ন আছে। এ নিয়ে সংশয়-সন্দেহ আছে বিএনপির ভেতরেও।
কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে, ছাত্রদলের সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি বজলুল করিম চৌধুরী (আবেদ) মুঠোফোনে আন্দোলনোত্তর বিএনপির নীতি-কৌশল নিয়ে আলোচনার একপর্যায়ে মওদুদ ওই মন্তব্য করেন। ফোনালাপটি হয় ৪ মে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ মনে করেন, জিয়াউর রহমানের জীবদ্দশার বিএনপি আর বর্তমান বিএনপির মধ্যে অনেকগুলো বিষয়ে ঘাটতি আছে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, জিয়াউর রহমান তরুণ ও যুবকদের ফ্রন্ট লাইনে রেখে দূরদর্শিতার সঙ্গে দলকে সংগঠিত করেছেন। কিন্তু বর্তমানে তরুণদের সংগঠিত করা সম্ভব হয়নি। ছাত্র ও শ্রমিক সমাজ যেন দল থেকে আলগা হয়ে গেছে।
বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানায়, দলের নীতি-কৌশলের ‘ভুল-শুদ্ধ’ নিয়ে নীতিনির্ধারণী ফোরাম বা অন্য কোনো স্তরে খোলামেলা আলোচনার সুযোগ কমে যাওয়ায় নেতারা ব্যক্তিগত বা ঘরোয়া আলাপে এ ধরনের কথা বলছেন। ওই সূত্রগুলো বলছে, টানা তিন মাসের অবরোধ-হরতাল কর্মসূচি, এরপর সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ, এর কোনোটিই দলীয় ফোরামে আলোচনার ভিত্তিতে হয়নি। আবার চার মাসের আন্দোলন-নির্বাচনে নিষ্ফল ঘরে ফেরার পর এক মাস পার হলো। এখন পর্যন্ত দলের স্থায়ী কমিটি বা অন্য কোনো পর্যায়ের সভা হয়নি। দীর্ঘ আন্দোলন ও নির্বাচনে দলের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির মূল্যায়ন বা পর্যালোচনা তো অনেক দূরের কথা।
এদিকে গতকাল ঢাকায় বিএনপির এক আলোচনা সভায় জিয়াউর রহমানের কাজ, নীতি ও জীবনাদর্শ থেকে বিএনপির বিস্মৃত হওয়ার অনুযোগ করেন জিয়ার রাজনৈতিক সহকর্মী ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। ‘বিএনপির আত্ম-অনুসন্ধান প্রয়োজন’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সাবেক রাষ্ট্রপতির এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান। গত রাতে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘জিয়াউর রহমানের ব্যক্তি চরিত্র, তাঁর আদর্শ, চেতনা এবং গণতান্ত্রিক মানসিকতা আমরা ঠিক ওভাবে অনুসরণ করতে পারিনি। তাঁর চিন্তা-চেতনা থেকে আমরা দূরে সরে গেছি, এটা তো ঠিক। আন্দোলনে বিফলতাও এর জন্য দায়ী।’
জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে বদরুদ্দোজা চৌধুরীর এই বক্তব্যকে ইতিবাচক বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, এ ধরনের আলোচনা আগে থেকেই হওয়া উচিত ছিল। কারণ, সরকারি দলের চেয়ে বিরোধী দলকে আরও বেশি গণতান্ত্রিক হতে হয়। না হলে জনগণ তার দিকে ভিড়বে না। এখন বিএনপির গণতান্ত্রিক কাঠামোকে শক্তিশালী করতে হবে। তাদের মাথায় যদি আগের পরিবারতান্ত্রিক চিন্তা ও দুর্নীতি থাকে এবং তারা যদি ভাবে যে নেতিবাচক ভোটে তারা জিতে যাবে, তাহলে জনগণ তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হবে না।
এখন দলের ভেতরে আত্মসমালোচনা শুরু হওয়ায় বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব দল পুনর্গঠনের কথা বলছে। আগামী নভেম্বর-ডিসেম্বর নাগাদ দলের কেন্দ্রীয় সম্মেলন অনুষ্ঠানের চিন্তা মাথায় রেখে তার আগে মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের ‘ইচ্ছানুযায়ী’ কমিটি গঠনের কথাও বলা হচ্ছে। কিন্তু নানামুখী হস্তক্ষেপে অতীতের মতো এবারের উদ্যোগও এগোবে না বলে মনে করছে নীতিনির্ধারকদের একটি অংশ। দলটির তিনজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা বলেন, দল পুনর্গঠনের উদ্যোগ আসলে কথার কথা। অন্য দুজন বলেছেন, দলে শুদ্ধি অভিযান চালানো গেলে পরিস্থিতি ঘুরে যাবে। তবে সবাই একটি বিষয়ে একমত যে দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের নীতি-আদর্শ থেকে বিএনপি সরে গেছে। এ কারণেই দলের এই বিপর্যয়, নেতাদের এত বিপদ। এর সঙ্গে আন্দোলনে বিএনপির নীতি-কৌশলেও ‘ভুল’ ছিল।
জানতে চাইলে ‘রাষ্ট্রযন্ত্রের চাপে বিএনপি কিছুটা বিপর্যয়ের মুখে আছে’ বলে স্বীকার করেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান। তবে তিনি বলেন, এটা সাময়িক। ছয় দফার আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগেরও এমন অবস্থা ছিল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির নেতৃস্থানীয় একাধিক নেতা প্রথম আলোকে বলেন, জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত বিএনপি উদার গণতান্ত্রিক মধ্যপন্থী রাজনৈতিক দল। কিন্তু এখন দেশে-বিদেশের অনেকে মনে করে, বিএনপি ডানপন্থী রাজনৈতিক দল। প্রতিষ্ঠাকালে দলের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল সব মতের সম্মিলন ঘটানো, সে অবস্থান এখন একেবারেই দুর্বল। বিশেষ করে, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী জোট এর জন্য দায়ী। নেতাদের একটি অংশ মনে করছে, জামায়াতের সঙ্গে আন্দোলনে থাকায় আওয়ামী লীগ দেশে-বিদেশে বিএনপির আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রচারে সুবিধা পেয়ে আসছে। এর পাশাপাশি বিএনপি আমলে জঙ্গিবাদের উত্থান, ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধার, পরে প্রকাশ্যে হেফাজতে ইসলামকে সমর্থন দেওয়া—এ বিষয়গুলো বিএনপির রাজনীতি সম্পর্কে আন্তর্জাতিক মহলে ধোঁয়াশা তৈরি করেছে।
এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে বিএনপি অবস্থান স্পষ্ট করেনি। অথচ এ দলের প্রতিষ্ঠাতা মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন, দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের একটি অংশও মুক্তিযোদ্ধা।
বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, প্রতিষ্ঠাকালে জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা কর্মসূচি ছিল বিএনপির ভিত্তি। এখন দল সেগুলোও যথাযথভাবে অনুসরণ করে না। নেতা-কর্মীদের অনেকে ১৯ দফা সম্পূর্ণভাবে জানেনও না। আবার যুগের সঙ্গে মিলিয়ে জনগণের সামনে জনসম্পৃক্ত কর্মসূচিও উপস্থাপন করতে পারছে না দল।
জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, ‘কিছু কিছু ক্ষেত্রে জিয়াউর রহমানের আদর্শ থেকে যে বিচ্যুতি হয়নি, তা বলব না। তবে বিএনপি জিয়ার আদর্শের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ওনার সময়ে নেতাদের ত্যাগ, দেশপ্রেম, সততা যে পর্যায়ে ছিল, এখন তাতে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। কমিটমেন্টের জায়গায় দুর্বলতা আছে।’ এর জন্য তিনি সমাজব্যবস্থা ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ‘বৈষয়িক’ পরিবর্তনকে দায়ী করেন।
ব্যক্তি জিয়াউর রহমানের একটি ঘটনা উদ্ধৃত করে এক নেতা বলেন, তাঁর কাছে চাটুকারিতা খুব একটা জায়গা পেত না। একদিন একটি অনুষ্ঠান শেষে একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জিয়ার হাতে কফি তুলে দিতে গিয়েছিলেন। জিয়া তা না নিয়ে ওই কর্মকর্তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলেছিলেন, ‘ওয়েটার্স আর দিয়ার, ইটস নট ইউর জব’। ওই নেতা বলেন, জিয়াউর রহমান যোগ্য ব্যক্তিদের সম্মিলনের চেষ্টা করতেন। কিন্তু এখন দলে সে অবস্থা নেই। এখন চাটুকারেরাই খালেদা জিয়াকে ঘিরে রেখেছেন। এ জন্য খালেদা জিয়াকেই দায়ী করেন আরেক নেতা। তাঁর মতে, খালেদা জিয়া সুযোগ দিচ্ছেন বলেই এমনটি হচ্ছে। এখন বেশির ভাগ প্রবীণ নেতা নিজে থেকে খালেদা জিয়ার কাছে যেতে চান না।
বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের একটি অংশ মনে করে, কয়েক বছর ধরে বিএনপির মূল দাবি হচ্ছে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন। অর্থাৎ বিএনপি ক্ষমতায় যেতে চায়। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না, তা প্রমাণ করা গেছে।
এ মুহূর্তে দলটির ৮০ শতাংশ ভোট আছে বলে বিএনপি দাবি করলেও শীর্ষস্থানীয় নেতাদের ওই অংশটি মনে করে, ভোট থাকা, ভোটে জেতা আর রাজনীতি এক কথা নয়। তাই বিএনপিকে ক্ষমতায় নিতে মানুষ রাস্তায় নামছে না। কারণ, এতে জনগণের কী লাভ? মানুষ মনে করে, বিএনপি ক্ষমতায় গেলেও অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হবে না। বিএনপি কতটুকু গণতন্ত্র ও আইনের শাসন দেবে, কীভাবে দেবে, এ বিষয়গুলো পরিষ্কার করতে পারছে না।
এ ছাড়াও শুরুতে বিএনপির নীতি ছিল বিদেশি কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে বিরোধিতা নয়। সবার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। কিন্তু পরে দেখা গেছে, বিএনপির রাজনীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে ভারত বিরোধিতা। এ অবস্থানের জন্য দলকে মূল্য দিতে হচ্ছে। যদিও এখন দলের ভারত বিরোধিতা স্তিমিত হয়ে পড়েছে। আবার যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা অব্যাহত থাকলেও সেসব জায়গা থেকে কার্যত এখন পর্যন্ত আশানুরূপ কিছু পায়নি বিএনপি।
নীতিগত এসব বিষয়ের পাশাপাশি আছে দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা ও আস্থার সংকট। দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে পারস্পরিক বিশ্বাসের অভাব প্রকট। এমনকি দলের স্থায়ী কমিটির সভায় মোবাইল ফোন নিয়ে যেতে বারণ করা হয়েছিল। এতে অনেকে ক্ষুব্ধ হন। সম্প্রতি ২০-দলীয় জোটের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের একটি সভায় খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের সভাকক্ষে জুতা খুলে ঢুকতে বলা হয়। এতে অনেকে মনঃক্ষুণ্ন হয়েছেন বলে একটি শরিক দলের প্রধান প্রথম আলোকে জানান।
বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা জানান, দলের বেশির ভাগ সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্থায়ী কমিটির কোনো ভূমিকা থাকে না। চেয়ারপারসন নিজে অথবা ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেন। এসব সিদ্ধান্ত জানা যায় গণমাধ্যমের বদৌলতে। বিএনপির তরুণদের মধ্যে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের যথেষ্ট গ্রহণযোগ্যতা থাকলেও দলটির জ্যেষ্ঠ নেতাদের একটি বড় অংশ তাঁকে মন থেকে মানতে পারে না। কেউ কেউ মনে করেন, সাম্প্রতিক সময়ের আন্দোলনের যে কৌশল ও পরিকল্পনা করা হয়েছিল, তা তারেক রহমানের ইচ্ছার প্রতিফলন। ফলে জ্যেষ্ঠ নেতাদের অনেকে দায়িত্ববোধ উপলব্ধি করেন না।
দলটির নেতা-কর্মী-সমর্থক ও হিতাকাঙ্ক্ষীরা বলছেন, ১৬ শব্দের এই তিনটি বাক্যে কার্যত ৩৭ বছরের বিএনপির ভেতরকার হালচিত্র প্রকাশ পেয়েছে। তিন মাস পর আগামী ১ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠার ৩৭ বছর পূর্ণ হবে দলটির। আর কাল ৩০ মে দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ৩৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। তার কিছুদিন আগে একান্ত আলাপে ‘এই বিএনপি দিয়ে হবে না’ বলে মন্তব্য করলেন দলের জ্যেষ্ঠ নেতা ও স্থায়ী কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য মওদুদ আহমদ।
দলটির নেতা-কর্মীরা মনে করেন, বিএনপির প্রতিষ্ঠা এবং প্রতিষ্ঠাতার মৃত্যুর তিন যুগের মাথায় এসে দলটি এখন এক ক্রান্তিকাল পার করছে। বিশেষ করে গত জানুয়ারি থেকে টানা চার মাসের আন্দোলন এবং তিন সিটি নির্বাচনে প্রায় খালি হাতেই ঘরে ফিরেছে বিএনপি। এর মধ্যে দীর্ঘ সময়ের আন্দোলনের ক্লান্তির সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হামলা-মামলা, খুন, গুম-আতঙ্ক নেতা-কর্মীদের ছন্নছাড়া করে দিয়েছে। এমন নাজুক অবস্থা থেকে বিএনপি শিগগির সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে কি না, রাজনৈতিক মহলে সে প্রশ্ন আছে। এ নিয়ে সংশয়-সন্দেহ আছে বিএনপির ভেতরেও।
কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে, ছাত্রদলের সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি বজলুল করিম চৌধুরী (আবেদ) মুঠোফোনে আন্দোলনোত্তর বিএনপির নীতি-কৌশল নিয়ে আলোচনার একপর্যায়ে মওদুদ ওই মন্তব্য করেন। ফোনালাপটি হয় ৪ মে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ মনে করেন, জিয়াউর রহমানের জীবদ্দশার বিএনপি আর বর্তমান বিএনপির মধ্যে অনেকগুলো বিষয়ে ঘাটতি আছে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, জিয়াউর রহমান তরুণ ও যুবকদের ফ্রন্ট লাইনে রেখে দূরদর্শিতার সঙ্গে দলকে সংগঠিত করেছেন। কিন্তু বর্তমানে তরুণদের সংগঠিত করা সম্ভব হয়নি। ছাত্র ও শ্রমিক সমাজ যেন দল থেকে আলগা হয়ে গেছে।
বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানায়, দলের নীতি-কৌশলের ‘ভুল-শুদ্ধ’ নিয়ে নীতিনির্ধারণী ফোরাম বা অন্য কোনো স্তরে খোলামেলা আলোচনার সুযোগ কমে যাওয়ায় নেতারা ব্যক্তিগত বা ঘরোয়া আলাপে এ ধরনের কথা বলছেন। ওই সূত্রগুলো বলছে, টানা তিন মাসের অবরোধ-হরতাল কর্মসূচি, এরপর সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ, এর কোনোটিই দলীয় ফোরামে আলোচনার ভিত্তিতে হয়নি। আবার চার মাসের আন্দোলন-নির্বাচনে নিষ্ফল ঘরে ফেরার পর এক মাস পার হলো। এখন পর্যন্ত দলের স্থায়ী কমিটি বা অন্য কোনো পর্যায়ের সভা হয়নি। দীর্ঘ আন্দোলন ও নির্বাচনে দলের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির মূল্যায়ন বা পর্যালোচনা তো অনেক দূরের কথা।
এদিকে গতকাল ঢাকায় বিএনপির এক আলোচনা সভায় জিয়াউর রহমানের কাজ, নীতি ও জীবনাদর্শ থেকে বিএনপির বিস্মৃত হওয়ার অনুযোগ করেন জিয়ার রাজনৈতিক সহকর্মী ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। ‘বিএনপির আত্ম-অনুসন্ধান প্রয়োজন’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সাবেক রাষ্ট্রপতির এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান। গত রাতে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘জিয়াউর রহমানের ব্যক্তি চরিত্র, তাঁর আদর্শ, চেতনা এবং গণতান্ত্রিক মানসিকতা আমরা ঠিক ওভাবে অনুসরণ করতে পারিনি। তাঁর চিন্তা-চেতনা থেকে আমরা দূরে সরে গেছি, এটা তো ঠিক। আন্দোলনে বিফলতাও এর জন্য দায়ী।’
জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে বদরুদ্দোজা চৌধুরীর এই বক্তব্যকে ইতিবাচক বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, এ ধরনের আলোচনা আগে থেকেই হওয়া উচিত ছিল। কারণ, সরকারি দলের চেয়ে বিরোধী দলকে আরও বেশি গণতান্ত্রিক হতে হয়। না হলে জনগণ তার দিকে ভিড়বে না। এখন বিএনপির গণতান্ত্রিক কাঠামোকে শক্তিশালী করতে হবে। তাদের মাথায় যদি আগের পরিবারতান্ত্রিক চিন্তা ও দুর্নীতি থাকে এবং তারা যদি ভাবে যে নেতিবাচক ভোটে তারা জিতে যাবে, তাহলে জনগণ তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হবে না।
এখন দলের ভেতরে আত্মসমালোচনা শুরু হওয়ায় বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব দল পুনর্গঠনের কথা বলছে। আগামী নভেম্বর-ডিসেম্বর নাগাদ দলের কেন্দ্রীয় সম্মেলন অনুষ্ঠানের চিন্তা মাথায় রেখে তার আগে মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের ‘ইচ্ছানুযায়ী’ কমিটি গঠনের কথাও বলা হচ্ছে। কিন্তু নানামুখী হস্তক্ষেপে অতীতের মতো এবারের উদ্যোগও এগোবে না বলে মনে করছে নীতিনির্ধারকদের একটি অংশ। দলটির তিনজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা বলেন, দল পুনর্গঠনের উদ্যোগ আসলে কথার কথা। অন্য দুজন বলেছেন, দলে শুদ্ধি অভিযান চালানো গেলে পরিস্থিতি ঘুরে যাবে। তবে সবাই একটি বিষয়ে একমত যে দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের নীতি-আদর্শ থেকে বিএনপি সরে গেছে। এ কারণেই দলের এই বিপর্যয়, নেতাদের এত বিপদ। এর সঙ্গে আন্দোলনে বিএনপির নীতি-কৌশলেও ‘ভুল’ ছিল।
জানতে চাইলে ‘রাষ্ট্রযন্ত্রের চাপে বিএনপি কিছুটা বিপর্যয়ের মুখে আছে’ বলে স্বীকার করেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান। তবে তিনি বলেন, এটা সাময়িক। ছয় দফার আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগেরও এমন অবস্থা ছিল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির নেতৃস্থানীয় একাধিক নেতা প্রথম আলোকে বলেন, জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত বিএনপি উদার গণতান্ত্রিক মধ্যপন্থী রাজনৈতিক দল। কিন্তু এখন দেশে-বিদেশের অনেকে মনে করে, বিএনপি ডানপন্থী রাজনৈতিক দল। প্রতিষ্ঠাকালে দলের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল সব মতের সম্মিলন ঘটানো, সে অবস্থান এখন একেবারেই দুর্বল। বিশেষ করে, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী জোট এর জন্য দায়ী। নেতাদের একটি অংশ মনে করছে, জামায়াতের সঙ্গে আন্দোলনে থাকায় আওয়ামী লীগ দেশে-বিদেশে বিএনপির আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রচারে সুবিধা পেয়ে আসছে। এর পাশাপাশি বিএনপি আমলে জঙ্গিবাদের উত্থান, ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধার, পরে প্রকাশ্যে হেফাজতে ইসলামকে সমর্থন দেওয়া—এ বিষয়গুলো বিএনপির রাজনীতি সম্পর্কে আন্তর্জাতিক মহলে ধোঁয়াশা তৈরি করেছে।
এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে বিএনপি অবস্থান স্পষ্ট করেনি। অথচ এ দলের প্রতিষ্ঠাতা মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন, দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের একটি অংশও মুক্তিযোদ্ধা।
বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, প্রতিষ্ঠাকালে জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা কর্মসূচি ছিল বিএনপির ভিত্তি। এখন দল সেগুলোও যথাযথভাবে অনুসরণ করে না। নেতা-কর্মীদের অনেকে ১৯ দফা সম্পূর্ণভাবে জানেনও না। আবার যুগের সঙ্গে মিলিয়ে জনগণের সামনে জনসম্পৃক্ত কর্মসূচিও উপস্থাপন করতে পারছে না দল।
জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, ‘কিছু কিছু ক্ষেত্রে জিয়াউর রহমানের আদর্শ থেকে যে বিচ্যুতি হয়নি, তা বলব না। তবে বিএনপি জিয়ার আদর্শের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ওনার সময়ে নেতাদের ত্যাগ, দেশপ্রেম, সততা যে পর্যায়ে ছিল, এখন তাতে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। কমিটমেন্টের জায়গায় দুর্বলতা আছে।’ এর জন্য তিনি সমাজব্যবস্থা ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ‘বৈষয়িক’ পরিবর্তনকে দায়ী করেন।
ব্যক্তি জিয়াউর রহমানের একটি ঘটনা উদ্ধৃত করে এক নেতা বলেন, তাঁর কাছে চাটুকারিতা খুব একটা জায়গা পেত না। একদিন একটি অনুষ্ঠান শেষে একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জিয়ার হাতে কফি তুলে দিতে গিয়েছিলেন। জিয়া তা না নিয়ে ওই কর্মকর্তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলেছিলেন, ‘ওয়েটার্স আর দিয়ার, ইটস নট ইউর জব’। ওই নেতা বলেন, জিয়াউর রহমান যোগ্য ব্যক্তিদের সম্মিলনের চেষ্টা করতেন। কিন্তু এখন দলে সে অবস্থা নেই। এখন চাটুকারেরাই খালেদা জিয়াকে ঘিরে রেখেছেন। এ জন্য খালেদা জিয়াকেই দায়ী করেন আরেক নেতা। তাঁর মতে, খালেদা জিয়া সুযোগ দিচ্ছেন বলেই এমনটি হচ্ছে। এখন বেশির ভাগ প্রবীণ নেতা নিজে থেকে খালেদা জিয়ার কাছে যেতে চান না।
বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের একটি অংশ মনে করে, কয়েক বছর ধরে বিএনপির মূল দাবি হচ্ছে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন। অর্থাৎ বিএনপি ক্ষমতায় যেতে চায়। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না, তা প্রমাণ করা গেছে।
এ মুহূর্তে দলটির ৮০ শতাংশ ভোট আছে বলে বিএনপি দাবি করলেও শীর্ষস্থানীয় নেতাদের ওই অংশটি মনে করে, ভোট থাকা, ভোটে জেতা আর রাজনীতি এক কথা নয়। তাই বিএনপিকে ক্ষমতায় নিতে মানুষ রাস্তায় নামছে না। কারণ, এতে জনগণের কী লাভ? মানুষ মনে করে, বিএনপি ক্ষমতায় গেলেও অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হবে না। বিএনপি কতটুকু গণতন্ত্র ও আইনের শাসন দেবে, কীভাবে দেবে, এ বিষয়গুলো পরিষ্কার করতে পারছে না।
এ ছাড়াও শুরুতে বিএনপির নীতি ছিল বিদেশি কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে বিরোধিতা নয়। সবার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। কিন্তু পরে দেখা গেছে, বিএনপির রাজনীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে ভারত বিরোধিতা। এ অবস্থানের জন্য দলকে মূল্য দিতে হচ্ছে। যদিও এখন দলের ভারত বিরোধিতা স্তিমিত হয়ে পড়েছে। আবার যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা অব্যাহত থাকলেও সেসব জায়গা থেকে কার্যত এখন পর্যন্ত আশানুরূপ কিছু পায়নি বিএনপি।
নীতিগত এসব বিষয়ের পাশাপাশি আছে দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা ও আস্থার সংকট। দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে পারস্পরিক বিশ্বাসের অভাব প্রকট। এমনকি দলের স্থায়ী কমিটির সভায় মোবাইল ফোন নিয়ে যেতে বারণ করা হয়েছিল। এতে অনেকে ক্ষুব্ধ হন। সম্প্রতি ২০-দলীয় জোটের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের একটি সভায় খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের সভাকক্ষে জুতা খুলে ঢুকতে বলা হয়। এতে অনেকে মনঃক্ষুণ্ন হয়েছেন বলে একটি শরিক দলের প্রধান প্রথম আলোকে জানান।
বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা জানান, দলের বেশির ভাগ সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্থায়ী কমিটির কোনো ভূমিকা থাকে না। চেয়ারপারসন নিজে অথবা ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেন। এসব সিদ্ধান্ত জানা যায় গণমাধ্যমের বদৌলতে। বিএনপির তরুণদের মধ্যে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের যথেষ্ট গ্রহণযোগ্যতা থাকলেও দলটির জ্যেষ্ঠ নেতাদের একটি বড় অংশ তাঁকে মন থেকে মানতে পারে না। কেউ কেউ মনে করেন, সাম্প্রতিক সময়ের আন্দোলনের যে কৌশল ও পরিকল্পনা করা হয়েছিল, তা তারেক রহমানের ইচ্ছার প্রতিফলন। ফলে জ্যেষ্ঠ নেতাদের অনেকে দায়িত্ববোধ উপলব্ধি করেন না।
No comments