কল্পনা চাকমা অপহরণ- ১৯ বছর পর শুনানি by জোবাইদা নাসরীন

মাসটি জুড়েই নারীর ওপর নিপীড়নের খবর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুলের ঘটনার পর সর্বশেষ গারো মেয়েটির মাইক্রোবাসে গণধর্ষণ—কোনোটিই বিচ্ছিন্ন নয়। বরং সবই নারীর ওপর ধারাবাহিক নিপীড়নের চিত্র। বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং তদন্তে গড়িমসি, সময়ক্ষেপণ এ ধরনের নির্যাতনের অনুঘটকগুলোকে ধারালো করে। যার কারণে নিপীড়ন বন্ধ হওয়ার পরিবর্তে আরও বেশি শক্তি নিয়ে এগিয়ে চলে। এই বিচারহীনতার সংস্কৃতির একটি বড় উদাহরণ কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলা। ১৯ বছর ধরে চলছে এই মামলার কাজ। মামলার ২২তম শুনানি হবে আজ ২৭ মে।
কল্পনা চাকমা আমার বন্ধু ছিল। ছিল বললে ভুল হবে। কারণ, পার্বত্য চট্টগ্রাম মানেই আমার কাছে এখনো কল্পনা চাকমা। অপহরণের দিন পর্যন্ত কল্পনা চাকমা ছিলেন অবিভক্ত হিল উইমেন ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক, পাহাড়ের প্রতিবাদী মুখ। বলার অপেক্ষা রাখে না কেন তাকে অপহৃত হতে হয়েছে। পাহাড়ে নির্যাতন আর আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়ছিল কল্পনা। ঘনিয়ে এল ১৯৯৬-এর সাধারণ নির্বাচন। কল্পনা জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে এসেছিল ইপিজেডে একটি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষা দিতে। অপহৃত হওয়ার সপ্তাহ খানেক আগে সেই সময়ে আমার সঙ্গে তার দেখা। ১১ জুন নির্বাচনের রাতেই কল্পনাকে অপহরণ করা হয় তার গ্রামের বাড়ি রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার নিউ লাল্যাঘোনা গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে। অপহরণের পরদিন কল্পনা চাকমার ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বড় ভাই কালিন্দী কুমার চাকমা বাদী হয়ে স্থানীয় থানায় একটি মামলা করেন। কল্পনার অপহরণ নিয়ে দেশের ভেতরে ও বাইরে তোলপাড় চলে। প্রতিবাদ ওঠে। সেই প্রতিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় স্মারক নং স্ব.ম.(রাজ-২) পার্বত্য ৩/৫ (অংশ) ৭/৯/৯৬ তারিখে দ্য কমিশন অব ইনকোয়ারি অ্যাক্ট ১৯৫৬-এর ৩ প্যারার ক্ষমতাবলে তিন সদস্যের তদন্ত কমিশন গঠন করে। এই কমিটি ১৯৯৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি রিপোর্ট পেশ করে। কিন্তু কোনো সরকারই এই রিপোর্ট প্রকাশ করেনি। ১৯৯৬ সাল থেকে এই পর্যন্ত ৩৫ জন কর্মকর্তার হাতে ঘুরেছে মামলা। নেওয়া হয়েছে ৯৪ জনের সাক্ষ্য।
মামলা দায়ের করার ১৪ বছর পর ২০১০ সালের ২১ মে মামলাটির প্রথম চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। ১৪ বছর তদন্তাধীন থাকার পর চূড়ান্ত প্রতিবেদনে আসামিদের ‘অজ্ঞাতনামা’ উল্লেখ করে প্রতিবেদন পেশ করা হয়। বাদী ওই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে নারাজি দিলে পরবর্তী সময়ে অধিকতর তদন্তের জন্য আদালত মামলাটি সিআইডির কাছে হস্তান্তর করেন। সিআইডি দুই বছর সময় নিয়ে অবশেষে ২০১২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করে। এই রিপোর্টের ভিত্তিতে গত ১৩ জানুয়ারি ২০১৩ রাঙামাটি মুখ্য হাকিম আদালতে মামলাটির প্রথম দফা শুনানি হয় এবং ১৬ জানুয়ারি আদালত অধিকতর তদন্তের জন্য রাঙামাটি জেলা এসপিকে আদেশ দেন। সেই নতুন তদন্তের পরিপ্রেক্ষিতেই অনুষ্ঠেয় শুনানি। এই মামলার সর্বশেষ তদন্ত করেছেন রাঙামাটিতে দায়িত্বে থাকা সাবেক এসপি আমেনা বেগম। এখন তিনি আবার বদলি হয়ে গেছেন। নিয়মমাফিক নতুন তদন্ত কর্মকর্তা আসবেন। আবারও আবেদন পড়বে নতুন তদন্তের। আর এভাবেই ফাইলের ফিতা খোলা হবে, বন্ধ করা হবে।
কিন্তু মামলার সুরাহা হবে না। বরং নতুন মামলাটি চালিয়ে নিচ্ছেন যাঁরা, তাঁরা বলছেন, ভিকটিমকে না পেলে তদন্ত শেষ করতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা। ফলে এখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে পুরো তদন্ত প্রক্রিয়াই। গত বছরের জুনে আদালতে জমা দেওয়া এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘মামলার ঘটনাটি যেহেতু দেড় যুগ আগের, ১৮ বছরে ভিকটিমের চেহারার পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। যেহেতু এই মামলার মূল সাক্ষী ভিকটিম কল্পনা নিজেই, তাই ওই কল্পনা উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত কিংবা তার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না পাওয়া পর্যন্ত মামলার তদন্ত শেষ করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে মামলার ভিকটিম কল্পনা চাকমাকে উদ্ধারের জোর তৎপরতা অব্যাহত আছে।’ (সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন, ২৫ মে ২০১৫) কল্পনাকে খুঁজে পাওয়ার জন্য যে মামলা, অপহরণের বিচারের জন্য যে মামলা, সেই মামলায় এখন কল্পনাই একমাত্র সাক্ষী? তার সাক্ষ্যই একমাত্র অবলম্বন?
যেকোনো অপরাধের ঘটনা তদন্তে প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্যকেই সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়ার কথা। অথচ তদন্ত কমিটি আশ্চর্যজনকভাবে প্রত্যক্ষদর্শী কালিন্দকুমার ও লালবিহারী চাকমার সাক্ষ্যকে গুরুত্ব দেয়নি। বরং খারিজ করা হয়েছে নানা ছুতায়। লালবিহারী চাকমা (তদন্ত রিপোর্টের ২ নম্বর সাক্ষী) স্পষ্টভাবেই অপহরণকারীদের মধ্যে তিনজনকে চিনতে পেরেছিলেন এবং তাদের সঙ্গে থাকা জিনিসপত্রের বিবরণ দিয়েছিলেন। কল্পনার ভাইদের অভিযোগ, মামলার আলামত নষ্ট করা হয়েছে অপহরণকারীদের অব্যাহতি দেওয়ার জন্য। কিন্তু পুলিশের এফআইআরে এই চিনতে পারা অপরাধীদের নাম না লিখে ‘অজ্ঞাত’ লেখা হয়।
বর্তমানে কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলাটি রাঙামাটি জেলা পুলিশ সুপারের অধীনে পুনঃ তদন্তাধীন। গত মে মাসে মামলার প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করার কথা থাকলেও তদন্ত কর্মকর্তা তা দিতে সমর্থ হননি। বরং তিনি এ মামলার তদন্তভার থেকে অব্যাহতি চেয়ে মামলাটি আবারও সিআইডির কাছে হস্তান্তরের জন্য আবেদন করেছেন। তদন্ত কমিশন, পুলিশ, সিআইডি—ফাইল ঘুরছে, ঘুরবে…তারপর?
আমরা চাই ধর্ষণের শিকার গারো নারীটি বিচার পাক। আজ থেকে ২০ বছর আগে ঢাকায় ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন আরেক গারো নারী মারিয়া মারাক। বিচার হয়নি সেটিরও। গিদিতা রেমাকেও আমরা ভুলিনি। মরিয়ম মুর্মুকে ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত ছিল না ওরা। গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখেছিল তাঁর লাশ। একাত্তরের তিন লাখ নারী ধর্ষণকে আমরা এখনো সবচেয়ে কষ্টের জায়গা হিসেবে মনে করি এবং ‘হায়েনা’দের নির্যাতন হিসেবে চিহ্নিত করি। কিন্তু স্বাধীন দেশেই প্রতিদিনই যৌন হয়রানি, ধর্ষণ ঘটছে। সেখানে ১৯ বছর পর অপহরণের শিকার পাহাড়ি যোদ্ধা কল্পনার তদন্তকারী কর্মকর্তা বলছেন, এই মামলার ভিকটিম কল্পনা নিজেই, তাই তাকেই সাক্ষ্য দিতে হবে। তাই মনে হয়, ‘তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে।’
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
zobaidanasreen@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.