জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, ইসলাম ও বিশ্বশান্তি by জি. মুনীর
দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত
ও বিশ্বশান্তি ইত্যাদি প্রসঙ্গ নিয়ে মুসলমান ও অমুসলমান অনেকেই কথা
বলেছেন, বই লিখেছেন ইসলামি পরিপ্রেক্ষিতকে সামনে রেখে। বিষয়টি অবশ্যই কোনো
অ্যাকাডেমিক বিষয় নয়। তবে বিশ্বে বিদ্যমান নানা দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত বিষয়টির
প্রায়োগিক প্রভাবের সংশ্লিষ্টতার কারণে এর আলোচনা পরিব্যাপক। কারণ, বিশ্বের
নানা অংশে চলমান সন্ত্রাসে ক্ষতবিক্ষত আমাদের এই ধরিত্রী। মানবিকতা
বিপর্যস্ত। মানুষের শান্তি বিদূরিত। মানুষের বিরুদ্ধে মানুষের অমানবিক আচরণ
ও মানবসৃষ্ট দুর্ভোগে গোটা মানবসভ্যতার জন্য রচনা করছে নানা কলঙ্ক। এ
কথাও অস্বীকার করার উপায় নেই, বিশ্বের নানা দেশে অনেক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী
ইসলামের নাম ভাঙিয়ে ভয়াবহ সন্ত্রাস পরিচালনা করছে। তবে এ কথাও ঠিক,
সন্ত্রাস একচেটিয়াভাবে মুসলমানেরাই করছে তেমনটি নয়। কিছু কিছু গোষ্ঠী যেমন
ইসলামের নাম ভাঙিয়ে সন্ত্রাসকে জায়েজ করতে চাইছে, তেমনি অন্যান্য ধর্মের
অনুসারীদের মধ্যেও এমন অনেক গোষ্ঠী আছে, যারা তাদের ধর্মের নামেই সন্ত্রাস
পরিচালনা করছে। এরা দাবি করছে তাদের ধর্মের অনুসারীরাই ইশ্বরের চোজেন পিপল।
আর ইসলাম বলে, মানুষের কর্মই মানুষকে আল্লাহর কাছে তাকে প্রিয় পাত্র করে
তোলে। তবে এমনটিও অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, বিশ্বের বিপুলসংখ্যক
অমুসলমান ইসলাম ও মুসলমানদের নেতিবাচক আলোয় দেখতে বেশি পছন্দ করেন। ফলে
যেসব মুসলিম জনগোষ্ঠী নিজেদের দেশ দখলমুক্ত করার, কিংবা
আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছে, তাদেরকেও মহলবিশেষ
সন্ত্রাসী বলে আখ্যায়িত করছে। এর একটি কারণ, বিশ্বে যেসব ভয়াবহ সন্ত্রাসী
ঘটনা ঘটে, সেগুলো চালানোর চেষ্টা চলে ইসলামের নামে। ফলে ইসলাম ও মুসলিম
বিদ্বেষীদের পক্ষে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে কলঙ্ক লেপনের কাজটি সহজতর
হয়। বিশেষ করে যখন এদের হাতে রয়েছে শক্তিশালী গণমাধ্যম। তা মুদ্রণ বা
ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম, যাই বলি না কেন।
এই প্রচার-প্রচারণাটি এমন, যদি ইসলাম না থাকত, নবী মুহাম্মদ সা: দুনিয়ায় না আসতেনÑ তবে বিশ্বে এই সন্ত্রাস, এই জঙ্গিপনা থাকত না। থাকত না সভ্যতার সঙ্ঘাত তথা ক্যাশ অব সিভিলাইজেশন। কিন্তু সাবেক সিআইএ কর্মকর্তা ও ইতিহাসবিদ গ্রাহাম ফুলার বলেন, আজকের পৃথিবীটা যেন আছে, ইসলাম না থাকলেও ঠিক এমনই থাকত। এরচেয়ে ভিন্ন কিছু হতো না। তিনি তার লেখা বহুল আলোচিত ‘অ্যা ওয়ার্ল্ড উইদাউট ইসলাম’ নামের বইটিতে এই সারকথাই তুলে ধরেছেন। না, নিছক এ ধরনের একটি অভিমত ছুড়ে দিয়েই থেমে যাননি তিনি। তিনি ইতিহাসের আনাচ-কানাচ থেকে নানা ঘটনা টেনে এনে প্রমাণ করে ছেড়েছেন, ইসলাম আবির্ভাব হওয়ার আগেই, মধ্যপ্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যকার ভূ-রাজনৈতিক টানাপড়েনের শিকড় প্রোথিত ছিল। যেমন ফুলার উল্লেখ করেছেন, প্রাচীন গ্রিকেরা প্রাচীন পারসিয়ানদের সাথে কয়েক শ’ বছর ধরে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলÑ সেই ৫০০ থেকে ৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত। পরবর্তী সময়ে যারা এদের ওপর দখল প্রতিষ্ঠার জন্য এসেছিল তারা হলো বাইজেন্টাইন খ্রিষ্টান, এরাও লিপ্ত ছিল একই যুদ্ধে। তারও পরে এলো তুরষ্কের মুসলমানেরা, লড়ল একই যুদ্ধে।
গ্রাহাম ফুলার তার এই বইয়ে উল্লেখ করেছেন, আমরা ইতিহাসের পুনর্লিখন করতে পারি না। এমনকি আন্দাজ-অনুমান করতে পারি না, ইতিহাসের সুনির্দিষ্ট ঘটনা না ঘটলে কী হতোÑ নাইন-ইলেভেনের ঘটনা না ঘটলে কী হতো? ১৯১৪ সালে সারায়েভোতে আর্চডিউক ফার্ডিন্যান্ড খুন না হলে কী হতো? রুশ বিপ্লবের প্রাক্কালে জার্মানরা একটি সিল করা ট্রেনে করে লেলিনকে কখনো যদি রাশিয়ায় না পাঠাত, তখন কী হতো? আমেরিকার গৃহযুদ্ধে কনফেডারেসি জয়লাভ করলে কী হতো? Ñতেমন সব ঘটলে আমাদের পৃথিবীটা কি আজকের চেয়ে ভিন্ন কিছু হতো, না ঠিক আজকের মতোই থাকত? এসব প্রশ্ন অন্তর্নিহিতভাবে জবাবযোগ্য। একই ধরনের চেতনা থেকে গ্রাহাম ফুলার আলোকপাত করেছেন মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসের ওপর। এর মাধ্যমে তিনি সফল প্রয়াস চালিয়েছেন এটুকু দেখাতে, সেখানকার ইতিহাসের কোন ঘটনার পেছনে কোন কোন শক্তি কাজ করেছে, যেখানে ইসলামের কিছুই করার ছিল না। অতএব মধ্যপ্রাচ্যে দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতের জন্য ইসলাম আর মুসলমানদের দায়ী করা ইতিহাস-সমর্থিত কোনো ব্যাপার নয়। আর সব সন্ত্রাসের মূলে ইসলাম আর মুসলমান, এমন ধারণা ফেরি করাও অমূলক।
ফুলার তার বইয়ে ইতিহাস ঘেঁটে অনেক কিছুর মাঝে দু’টি বিষয় ভালো করে প্রমাণ করেছেন : প্রথমত, তিনি অত্যন্ত সাফল্যের সাথে প্রমাণ করেছেন পাশ্চাত্য ও মধ্যপ্রাচ্যের যে দ্বন্দ্ব তা ধর্মের দ্বন্দ্ব নয়, কারণ এ দ্বন্দ্বের সূচনা ইসলামের প্রসার ঘটার আগে। দ্বিতীয়ত, মধ্যপ্রাচ্য ও অন্যান্য অঞ্চলের মুসলমানদের দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতে ঠেলে দিয়েছে পাশ্চাত্যের, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি-অবস্থান। তাই মধ্যপ্রাাচ্যের কথিত ইসলামি সন্ত্রাসের মাত্রা কমিয়ে আনার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের করণীয় রয়েছে। তিনি তার বইয়ের শেষাংশে স্পষ্ট করে এসব করণীয় উল্লেখ করেছেন। তিনি এটাও উল্লেখ করেছেনÑ সন্ত্রাস পুরোপুরি অবসান হবে, এমনটি আশা করা ঠিক নয়। তবে এটি সীমত করা সম্ভব।
বইটির শেষ অধ্যায়ে অতি পাণ্ডিত্যপূর্ণভাবে গ্রাহাম ফুলার উল্লেখ করেছেনÑ মুসলিম বিশ্ব ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার বিদ্যমান দ্বন্দ্ব অবসানে যেসব সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে, সেগুলোর মধ্যে আছে : ০১. মুসলমানদের প্রকোপিত করে, মুসলিম জগতে পাশ্চাত্যকে এ ধরনের সব সামরিক ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে, যাতে এরা শান্ত হওয়ার কাজটি শুরু করতে পারে। ০২. সন্ত্রাসী ও নিরোধ-অবরোধ কর্মকাণ্ড চিহ্নিত করার পদক্ষেপ পরিচালিত করতে হবে গোয়েন্দা ও পুলিশিকর্মের মাধ্যমে; সন্ত্রাসী ধরায় প্রাধিকার পাবে আন্তর্জাতিক সংস্থা ও স্থানীয় দেশগুলা। যুক্তরাষ্ট্র অবৈধভাবে কোনো দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করে ইচ্ছামতো কাউকে ধরতে ও হত্যা করতে পারবে না। ০৩. আমেরিকার জন্য বদনাম বয়ে আনে ও গণতন্ত্রের প্রতি আমেরিকার প্রতিশ্রুতিকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে, রাজনৈতিক বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতির জন্ম দেয় এবং আমেরিকার প্রতি ক্ষোভ সৃষ্টি করেÑ যুক্তরাষ্ট্রকে এমন আমেরিকাপন্থী স্বৈরশাসকদের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করতে হবে। ০৪. মুসলিম দুনিয়ায় গণতন্ত্রায়নকে এগিয়ে যেতে দিতে হবে, তবে সেখানে গণতন্ত্র প্রোথিত করায় আমেরিকা চালিকাশক্তি হবে না। আদর্শগতভাবে আমেরিকা এ প্রক্রিয়ায় তার হস্তক্ষেপ বন্ধ রাখবে, যাতে অতীতের মতো যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের সংশ্লিষ্টতায় গণতন্ত্র নিষ্প্রভ না হয়। অতীতে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনে গণতন্ত্রায়নে যুক্তরাষ্ট্রের সিলেকটিভ ও ইনস্ট্রুমেন্টাল ব্যবহার সংশ্লিষ্ট দেশটির গণতন্ত্রায়ন কর্মসূচির ধারণাকে কলঙ্কিত করেছে। ০৫. যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই মেনে নিতে হবেÑ বেশির ভাগ মুসলিম দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ইসলামপন্থী দলগুলোকে আইনিভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার সুযোগ দিতে হবে। ইসলামপন্থী দলগুলো এক বছরের মধ্যে জনগণকে দেয়া তাদের প্রতিশ্রুতি পালনে কিংবা জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হলে সমালোচনার মুখে পড়বে। এর অর্থ, এরা শূন্যগর্ভ সাম্রাজ্যবিরোধী রিটোরিকে নয়, জরুরি অথনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা দূর করায় ব্যর্থ হবে। ০৬. দ্রুত ফিলিস্তিন সমস্যার একটি সমাধান বের করতে হবে। মুসলিম জগৎজুড়ে ধরে নেয়া হয়, এ সমস্যা হচ্ছে বিদেশী সাম্র্াজ্যবাদের সবচেয়ে কুখ্যাত ঘটনা, যা স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে স্থানচ্যুত করে এদেরকে ঠেলে দিয়েছে শরণার্থী শিবিরের নিদারুণ জীবনযাপনের অবস্থায়; ইসরাইলে এদের ওপর আরোপ করা হয়েছে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকত্ব কিংবা এদের ঠেলে দেয়া হয়েছে নির্বাসনেÑ ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে। র্যাডিকেলাইজেশনের সাথে ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগ বেড়েছে, যা ছড়িয়ে পড়েছে ফিলিস্তিনের বাইরেও। এ সঙ্কট দ্রুত একটি সমাধান দাবি করে, এর সাধারণ সমাধান সব পক্ষের কাছে সুপরিচিত। ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরাইলি উপনিবেশায়নের অবসান এবং এ পরিবর্তন অবশ্যই দরকার। ০৭. ওয়াশিংটন মধ্যপ্রাচ্যে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের পেছনে যে এক ট্রিলিয়নেরও বেশি ডলার অপব্যয় করে, যদি এর এক-দশমাংশও স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, কিনিক, প্রশিক্ষণপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পেছনে ভালোভাবে খরচ করত, তবে এই অঞ্চলের চেহারা বদলে যেত। যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমর্যাদা অনেক উঁচুতে উঠে যেত। এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাপনের মানে অগ্রগতি আসত। ০৮. যুক্তরাষ্ট্র আলোকিত নীতি-অবস্থান নিলে দ্রুত বন্ধ হয়ে যেত ভায়োল্যান্স ও র্যাডিক্যালিজমের যাবতীয় ইন্টারন্যাশনাল ও ট্রান্সন্যাশনাল উৎস; দেশ বিশেষের অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসের উৎসের প্রশ্নে প্রয়োজন স্থানীয় পরিস্থিতিসাপেক্ষে আলাদা ব্যাখ্যা ও পদক্ষেপ এবং যেকোনো ক্ষেত্রে এ সমস্যা তখন কমে আসত। ০৯. শুধু মুসলমানেরা (অর্থাৎ স্থানীয়রা) তখন সক্ষম হবে স্থানীয় ইসলামিক র্যাডিক্যালিজম মোকাবেলা করতে।
যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে গ্রাহাম ই. ফুলারের দেয়া এ করণীয় তালিকাটি প্রণয়ন করেছেন বিদ্যমান বিশ্বদ্বন্দ্ব ও সংশ্লিষ্ট ধর্মগুলোর ধর্মতত্ত্ব ও সামগ্রিক ইতিাসের গভীরে পৌঁছে। ধর্মতত্ত্ব ও ইতিহাসের নির্মোহ বিশ্লেষণসূত্রেই তিনি এসব সমাধানসূত্র উপস্থাপন করেছেন। বিশ্বকে দ্বান্দ্বিক অবস্থান থেকে উত্তরণকামী বিবেকবান ও সচেতন মানুষ মাত্রই তার এই সমাধানসূত্রের প্রতি সমর্থন জানাবেন, এমনটি বিশ্বাস এই লেখকের।
এখানে বলা দরকার ইসলাম সহিষ্ণু একটি ধর্ম। ইসলাম কোনো আগ্রাসী ধর্ম নয়। কোনো আগ্রাসী যুদ্ধের অনুমতি নেই ইসলামে। শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিরোধ নিষ্পত্তির কোনো উপায় না থাকলে ও শুধু আক্রান্ত হলেই নিজেদের প্রতিরক্ষার জন্য যুদ্ধের অনুমতি আছে ইসলামে। ইতিহাস বলে, মক্কায় কাফিরেরা ১৩ বছর ধরে মুমিনদের ওপর অবর্ণনীয় অত্যাচার চালানো সত্ত্বেও তাদেরকে প্রতিরোধ যুদ্ধ করার অনুমতি দেয়া হয়নি। মুহাম্মদ সা: মদিনায় হিজরত করার পর আত্মরক্ষার জন্য প্রতিরোধের অনুমতি দেয়া হয়েছে। ইসলাম যুদ্ধকে বিবেচনায় আনে প্রতিরক্ষার সর্বশেষ অবলম্বন হিসেবে। পবিত্র কুরআনের ২২ নম্বর সূরার তথা অধ্যায়ের ৩৯ নম্বর আয়াত বা বাক্যে সে নীতিরই উল্লেখ রয়েছে সুস্পষ্টভাবে : ‘যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হলো তাদেরকে, যারা আক্রান্ত হয়েছে; কারণ তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে। আর নিশ্চয়ই তাদেরকে সাহায্য করতে সক্ষম আল্লাহ।’ একই নীতির উল্লেখ আছে সূরা বাকারার ১৯০ নম্বর আয়াতে : ‘যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, তোমরাও আল্লাহর পথে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো; কিন্তু সীমা লঙ্ঘন কোরো না। নিশ্চয় আল্লাহ সীমা লঙ্ঘনকারীদের ভালোবাসেন না।’ একই সূরার ২৫৬ নম্বর আয়াতে বললা আছে : ‘ধর্মের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই।’ আর সূরাহ নিসার ১৭১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে : ‘হে আহলে কিতাব, তোমরা ধর্মের ব্যাপারে বাড়বাড়ি কোরো না।’ Ñএই যে কুরআনে বলা হলো ধর্মের ব্যাপারে কোনো বাড়াবাড়ি নেই, এর স্পষ্ট অর্থ হচ্ছেÑ অস্ত্রের বলে তথাকথিত জিহাদের নামে ইসলাম প্রতিষ্ঠার কোনো বৈধ পথ ইসলামে একেবারেই নেই। বরং ইসলামের আদর্শকে অন্তরে লালন করে স্বেচ্ছায় যারা ইসলাম গ্রহণ করবে না, তাদেরকে মুসলমানদের পক্ষ থেকে ইসলাম শুধু এইটুকুই বলার সুযোগ দেয় : ‘তোমার জন্য তোমার ধর্ম, আমার জন্য আমার ধর্ম।’
আর আল্লাহর নবী মোহাম্মাদ সা: তাঁর জীবন ও কর্মের মধ্য দিয়ে এর প্রমাণ করে গেছেন, বাস্তবে এসব নীতি-আদর্শ বাস্তবায়ন সম্ভব। ইতিহাস বলেÑ মহানবী সা:-কে ইসলাম ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্য তাঁর তেইশ বছরের নবুয়তি জীবনে ৬৪টি যুদ্ধের মুখোমখি হতে হয়েছিল। এসব যুদ্ধে দুই পক্ষের মাত্র ৯১৮ জন নিহত হয়। এর মধ্যে নবী সা:-এর পক্ষের ৪৫৯ জন এবং প্রতিপক্ষের ৪৫৯ জন। যুদ্ধবন্দ্বীদের সাথে ভালো ব্যবহারের উৎকৃষ্ট উদাহরণ নবী সা: সৃষ্টি করে গেছেন। নিরক্ষর মুসলমানদের লেখাপড়া শেখানোর বিনিময়ে বন্দিমুক্তির উদাহরণ তো তাঁরই সৃষ্টি। এ ছাড়া রাসূল সা: বলে গেছেন : ‘মুমিন থাকা অবস্থায় কেউ ব্যভিচারে লিপ্ত হয় না। মুমিন থাকা অবস্থায় কেউ হত্যা করে না। মুমিন থাকা অবস্থায় কেউ মদ পান করে না’Ñ অতএব, মুসলমানদের সন্ত্রাসী হওয়ার সুযোগ কোথায়? কারণ, সন্ত্রাস মানেই তো অপরাধী-নিরপরাধী নির্বিশেষে জানমালের ক্ষতিসাধন। যারা জিহাদের নামে, ইসলামের নামে সন্ত্রাস অবলম্বন করে, এরা কখনোই ইসলাম নয়, ভিন্ন কিছু প্রতিষ্ঠা করে। এর পেছনে থাকে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির অভিলাষ। কিন্তু ভুললে চলবে না, যাদের ভূখণ্ড দখলের শিকার, বাস্তুচ্যুত হওয়ার শিকার, তাদের শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধ করার অধিকার নিশ্চয়ই রয়েছে। এর জায়মান উদাহরণ ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাযুদ্ধ। এরা লড়ছে এদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করার জন্য। তাই ওপরে উল্লিখিত গ্রাহাম ফুলারের তাগিদ হচ্ছেÑ দ্রুত ফিলিস্তিন সমস্যার একটি সমাধান বের করতে হবে। মুসলিম জগৎজুড়ে ধরে নেয়া হয়, এ সমস্যা হচ্ছে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদের সবচেয়ে কুখ্যাত ঘটনা, যা স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে স্থানচ্যুত করে এদেরকে ঠেলে দিয়েছে শরণার্থী শিবিরের নিদারুণ জীবনযাপনের অবস্থায়, ইসরাইলে এদের ওপর আরোপ করা হয়েছে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকত্ব কিংবা এদের ঠেলে দিয়েছে নির্বাসনেÑ ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে। র্যাডিকেলাইজেশনের সাথে ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগ বেড়েছে, যা ছড়িয়ে পড়েছে ফিলিস্তিনের বাইরেও। এ সঙ্কট দ্রুত একটি সমাধান দাবি করে, এর সাধারণ সমাধান সব পক্ষের কাছে সুপরিচিত। ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরাইলি উপনিবেশায়নের অবসান এবং এ পরিবর্তন অবশ্যই দরকার।
কুরআনেরÑ যে বৈধ কারণ ছাড়া একজন মানুষকে হত্যা করল, সে যেন গোটা মানবজাতিকেই হত্যা করল; আর যে একজন মানুষের জীবন রক্ষা করল, সে যেন গোটা মানবজাতিকেই রক্ষা করল। অতএব ইসলামে সন্ত্রাসের কোনো স্থান স্পষ্টতই নেই। অথচ ধর্মরিপেক্ষ আর বামপন্থী রাজনীতির অনুসারীদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে এমন ভাবটাই প্রাধান্য পায় যে, সব সন্ত্রাসের মূলে ইসলাম আর ইসলামপন্থী রাজনীতি। অতএব ইসলামী আদর্শের নামে কোনো রাজনীতি চলতে পারে না। ধর্মের নামে যারা রাজনীতি করে এরা মৌলবাদী। এরা জঙ্গি। এদের নির্মূল করতে হবে। এদের সাথে আছেন একশ্রেণীর নাস্তিক। এদের বক্তব্যও এই ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের মতোই। এরাও সুযোগ পেলেই আমাদের দেশে ইসলামপন্থী রাজনীতির অবসান দাবি করেন। এরা সক্রিয় ইসলামের বিরুদ্ধে নানা কুৎসা রচনায়। নাস্তিক হওয়ার অধিকার তাদের আছে। তাই বলে ইসলামবিরোধী কুৎসা রচনার অধিকার এরা রাখেন না।
ইসলাম কারো ধর্ম মানা বা না মানার পুরো অধিকার স্বীকার করে। ইসলাম একটি জীবনাদর্শ। এই আদর্শের বাস্তবায়ন কামনা করে কেউ রাজনীতি করতে চাইলে তাতে বাধা দেয়ার অধিকার কারো নেই। তেমনি অন্য কোনো ধর্ম বা ধর্মরিপেক্ষ নীতির অনুসারীরাও রাজনীতি করার সমঅধিকার রাখেন। সে অধিকারে যখন বাধা আসে তখন তা যেমনি গণতন্ত্রের বাইরে যায়, তেমনি তা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সবাইকে যার যার প্রকাশ্য নীতি-আদর্শ নিয়ে জনগণের কাছে যাওয়ার সুযোগ দিতে হবে। জনগণই বুঝবে, তারা কোন নীতি-আদর্শের দল বা জোটকে বেছে নেবে। এ সুযোগ যত বেশি অবারিত হবে, সামাজিক অস্থিরতা দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত তত সহনশীল মাত্রায় কমে আসবে। এ সহজ সত্য উপলব্ধি করতে আমাদের দেশের বামপন্থী রাজনীতির ধারক-বাহকেরা সবচেয়ে বেশি মাত্রায় অনাগ্রহী। এদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্তু ইসলাম। কারণ, ইসলাম যেখানে শুধু আক্রান্ত হলেই যুদ্ধে যাওয়ার ইতিহাস রচনা করে, সেখানে এদের ইতিহাস শ্রেণীশত্রু অবসানের নামে দেশে দেশে বিপ্লব ফেরি করে চলার ইতিহাস। এদের বিপ্লবের নামে গণহত্যার উপাখ্যান ইতিহাসে বিস্তর। সে কলঙ্ক ঢাকতেই হয়তো আজকের দিনে এদের ঘুম ভাঙে ইসলামপন্থী মানেই জঙ্গিবাদী বলে গালি মুখে নিয়ে, ঘুমোতেও যায় একই গালি জপে।
এই প্রচার-প্রচারণাটি এমন, যদি ইসলাম না থাকত, নবী মুহাম্মদ সা: দুনিয়ায় না আসতেনÑ তবে বিশ্বে এই সন্ত্রাস, এই জঙ্গিপনা থাকত না। থাকত না সভ্যতার সঙ্ঘাত তথা ক্যাশ অব সিভিলাইজেশন। কিন্তু সাবেক সিআইএ কর্মকর্তা ও ইতিহাসবিদ গ্রাহাম ফুলার বলেন, আজকের পৃথিবীটা যেন আছে, ইসলাম না থাকলেও ঠিক এমনই থাকত। এরচেয়ে ভিন্ন কিছু হতো না। তিনি তার লেখা বহুল আলোচিত ‘অ্যা ওয়ার্ল্ড উইদাউট ইসলাম’ নামের বইটিতে এই সারকথাই তুলে ধরেছেন। না, নিছক এ ধরনের একটি অভিমত ছুড়ে দিয়েই থেমে যাননি তিনি। তিনি ইতিহাসের আনাচ-কানাচ থেকে নানা ঘটনা টেনে এনে প্রমাণ করে ছেড়েছেন, ইসলাম আবির্ভাব হওয়ার আগেই, মধ্যপ্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যকার ভূ-রাজনৈতিক টানাপড়েনের শিকড় প্রোথিত ছিল। যেমন ফুলার উল্লেখ করেছেন, প্রাচীন গ্রিকেরা প্রাচীন পারসিয়ানদের সাথে কয়েক শ’ বছর ধরে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলÑ সেই ৫০০ থেকে ৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত। পরবর্তী সময়ে যারা এদের ওপর দখল প্রতিষ্ঠার জন্য এসেছিল তারা হলো বাইজেন্টাইন খ্রিষ্টান, এরাও লিপ্ত ছিল একই যুদ্ধে। তারও পরে এলো তুরষ্কের মুসলমানেরা, লড়ল একই যুদ্ধে।
গ্রাহাম ফুলার তার এই বইয়ে উল্লেখ করেছেন, আমরা ইতিহাসের পুনর্লিখন করতে পারি না। এমনকি আন্দাজ-অনুমান করতে পারি না, ইতিহাসের সুনির্দিষ্ট ঘটনা না ঘটলে কী হতোÑ নাইন-ইলেভেনের ঘটনা না ঘটলে কী হতো? ১৯১৪ সালে সারায়েভোতে আর্চডিউক ফার্ডিন্যান্ড খুন না হলে কী হতো? রুশ বিপ্লবের প্রাক্কালে জার্মানরা একটি সিল করা ট্রেনে করে লেলিনকে কখনো যদি রাশিয়ায় না পাঠাত, তখন কী হতো? আমেরিকার গৃহযুদ্ধে কনফেডারেসি জয়লাভ করলে কী হতো? Ñতেমন সব ঘটলে আমাদের পৃথিবীটা কি আজকের চেয়ে ভিন্ন কিছু হতো, না ঠিক আজকের মতোই থাকত? এসব প্রশ্ন অন্তর্নিহিতভাবে জবাবযোগ্য। একই ধরনের চেতনা থেকে গ্রাহাম ফুলার আলোকপাত করেছেন মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসের ওপর। এর মাধ্যমে তিনি সফল প্রয়াস চালিয়েছেন এটুকু দেখাতে, সেখানকার ইতিহাসের কোন ঘটনার পেছনে কোন কোন শক্তি কাজ করেছে, যেখানে ইসলামের কিছুই করার ছিল না। অতএব মধ্যপ্রাচ্যে দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতের জন্য ইসলাম আর মুসলমানদের দায়ী করা ইতিহাস-সমর্থিত কোনো ব্যাপার নয়। আর সব সন্ত্রাসের মূলে ইসলাম আর মুসলমান, এমন ধারণা ফেরি করাও অমূলক।
ফুলার তার বইয়ে ইতিহাস ঘেঁটে অনেক কিছুর মাঝে দু’টি বিষয় ভালো করে প্রমাণ করেছেন : প্রথমত, তিনি অত্যন্ত সাফল্যের সাথে প্রমাণ করেছেন পাশ্চাত্য ও মধ্যপ্রাচ্যের যে দ্বন্দ্ব তা ধর্মের দ্বন্দ্ব নয়, কারণ এ দ্বন্দ্বের সূচনা ইসলামের প্রসার ঘটার আগে। দ্বিতীয়ত, মধ্যপ্রাচ্য ও অন্যান্য অঞ্চলের মুসলমানদের দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতে ঠেলে দিয়েছে পাশ্চাত্যের, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি-অবস্থান। তাই মধ্যপ্রাাচ্যের কথিত ইসলামি সন্ত্রাসের মাত্রা কমিয়ে আনার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের করণীয় রয়েছে। তিনি তার বইয়ের শেষাংশে স্পষ্ট করে এসব করণীয় উল্লেখ করেছেন। তিনি এটাও উল্লেখ করেছেনÑ সন্ত্রাস পুরোপুরি অবসান হবে, এমনটি আশা করা ঠিক নয়। তবে এটি সীমত করা সম্ভব।
বইটির শেষ অধ্যায়ে অতি পাণ্ডিত্যপূর্ণভাবে গ্রাহাম ফুলার উল্লেখ করেছেনÑ মুসলিম বিশ্ব ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার বিদ্যমান দ্বন্দ্ব অবসানে যেসব সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে, সেগুলোর মধ্যে আছে : ০১. মুসলমানদের প্রকোপিত করে, মুসলিম জগতে পাশ্চাত্যকে এ ধরনের সব সামরিক ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে, যাতে এরা শান্ত হওয়ার কাজটি শুরু করতে পারে। ০২. সন্ত্রাসী ও নিরোধ-অবরোধ কর্মকাণ্ড চিহ্নিত করার পদক্ষেপ পরিচালিত করতে হবে গোয়েন্দা ও পুলিশিকর্মের মাধ্যমে; সন্ত্রাসী ধরায় প্রাধিকার পাবে আন্তর্জাতিক সংস্থা ও স্থানীয় দেশগুলা। যুক্তরাষ্ট্র অবৈধভাবে কোনো দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করে ইচ্ছামতো কাউকে ধরতে ও হত্যা করতে পারবে না। ০৩. আমেরিকার জন্য বদনাম বয়ে আনে ও গণতন্ত্রের প্রতি আমেরিকার প্রতিশ্রুতিকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে, রাজনৈতিক বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতির জন্ম দেয় এবং আমেরিকার প্রতি ক্ষোভ সৃষ্টি করেÑ যুক্তরাষ্ট্রকে এমন আমেরিকাপন্থী স্বৈরশাসকদের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করতে হবে। ০৪. মুসলিম দুনিয়ায় গণতন্ত্রায়নকে এগিয়ে যেতে দিতে হবে, তবে সেখানে গণতন্ত্র প্রোথিত করায় আমেরিকা চালিকাশক্তি হবে না। আদর্শগতভাবে আমেরিকা এ প্রক্রিয়ায় তার হস্তক্ষেপ বন্ধ রাখবে, যাতে অতীতের মতো যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের সংশ্লিষ্টতায় গণতন্ত্র নিষ্প্রভ না হয়। অতীতে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনে গণতন্ত্রায়নে যুক্তরাষ্ট্রের সিলেকটিভ ও ইনস্ট্রুমেন্টাল ব্যবহার সংশ্লিষ্ট দেশটির গণতন্ত্রায়ন কর্মসূচির ধারণাকে কলঙ্কিত করেছে। ০৫. যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই মেনে নিতে হবেÑ বেশির ভাগ মুসলিম দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ইসলামপন্থী দলগুলোকে আইনিভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার সুযোগ দিতে হবে। ইসলামপন্থী দলগুলো এক বছরের মধ্যে জনগণকে দেয়া তাদের প্রতিশ্রুতি পালনে কিংবা জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হলে সমালোচনার মুখে পড়বে। এর অর্থ, এরা শূন্যগর্ভ সাম্রাজ্যবিরোধী রিটোরিকে নয়, জরুরি অথনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা দূর করায় ব্যর্থ হবে। ০৬. দ্রুত ফিলিস্তিন সমস্যার একটি সমাধান বের করতে হবে। মুসলিম জগৎজুড়ে ধরে নেয়া হয়, এ সমস্যা হচ্ছে বিদেশী সাম্র্াজ্যবাদের সবচেয়ে কুখ্যাত ঘটনা, যা স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে স্থানচ্যুত করে এদেরকে ঠেলে দিয়েছে শরণার্থী শিবিরের নিদারুণ জীবনযাপনের অবস্থায়; ইসরাইলে এদের ওপর আরোপ করা হয়েছে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকত্ব কিংবা এদের ঠেলে দেয়া হয়েছে নির্বাসনেÑ ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে। র্যাডিকেলাইজেশনের সাথে ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগ বেড়েছে, যা ছড়িয়ে পড়েছে ফিলিস্তিনের বাইরেও। এ সঙ্কট দ্রুত একটি সমাধান দাবি করে, এর সাধারণ সমাধান সব পক্ষের কাছে সুপরিচিত। ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরাইলি উপনিবেশায়নের অবসান এবং এ পরিবর্তন অবশ্যই দরকার। ০৭. ওয়াশিংটন মধ্যপ্রাচ্যে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের পেছনে যে এক ট্রিলিয়নেরও বেশি ডলার অপব্যয় করে, যদি এর এক-দশমাংশও স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, কিনিক, প্রশিক্ষণপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পেছনে ভালোভাবে খরচ করত, তবে এই অঞ্চলের চেহারা বদলে যেত। যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমর্যাদা অনেক উঁচুতে উঠে যেত। এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাপনের মানে অগ্রগতি আসত। ০৮. যুক্তরাষ্ট্র আলোকিত নীতি-অবস্থান নিলে দ্রুত বন্ধ হয়ে যেত ভায়োল্যান্স ও র্যাডিক্যালিজমের যাবতীয় ইন্টারন্যাশনাল ও ট্রান্সন্যাশনাল উৎস; দেশ বিশেষের অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসের উৎসের প্রশ্নে প্রয়োজন স্থানীয় পরিস্থিতিসাপেক্ষে আলাদা ব্যাখ্যা ও পদক্ষেপ এবং যেকোনো ক্ষেত্রে এ সমস্যা তখন কমে আসত। ০৯. শুধু মুসলমানেরা (অর্থাৎ স্থানীয়রা) তখন সক্ষম হবে স্থানীয় ইসলামিক র্যাডিক্যালিজম মোকাবেলা করতে।
যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে গ্রাহাম ই. ফুলারের দেয়া এ করণীয় তালিকাটি প্রণয়ন করেছেন বিদ্যমান বিশ্বদ্বন্দ্ব ও সংশ্লিষ্ট ধর্মগুলোর ধর্মতত্ত্ব ও সামগ্রিক ইতিাসের গভীরে পৌঁছে। ধর্মতত্ত্ব ও ইতিহাসের নির্মোহ বিশ্লেষণসূত্রেই তিনি এসব সমাধানসূত্র উপস্থাপন করেছেন। বিশ্বকে দ্বান্দ্বিক অবস্থান থেকে উত্তরণকামী বিবেকবান ও সচেতন মানুষ মাত্রই তার এই সমাধানসূত্রের প্রতি সমর্থন জানাবেন, এমনটি বিশ্বাস এই লেখকের।
এখানে বলা দরকার ইসলাম সহিষ্ণু একটি ধর্ম। ইসলাম কোনো আগ্রাসী ধর্ম নয়। কোনো আগ্রাসী যুদ্ধের অনুমতি নেই ইসলামে। শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিরোধ নিষ্পত্তির কোনো উপায় না থাকলে ও শুধু আক্রান্ত হলেই নিজেদের প্রতিরক্ষার জন্য যুদ্ধের অনুমতি আছে ইসলামে। ইতিহাস বলে, মক্কায় কাফিরেরা ১৩ বছর ধরে মুমিনদের ওপর অবর্ণনীয় অত্যাচার চালানো সত্ত্বেও তাদেরকে প্রতিরোধ যুদ্ধ করার অনুমতি দেয়া হয়নি। মুহাম্মদ সা: মদিনায় হিজরত করার পর আত্মরক্ষার জন্য প্রতিরোধের অনুমতি দেয়া হয়েছে। ইসলাম যুদ্ধকে বিবেচনায় আনে প্রতিরক্ষার সর্বশেষ অবলম্বন হিসেবে। পবিত্র কুরআনের ২২ নম্বর সূরার তথা অধ্যায়ের ৩৯ নম্বর আয়াত বা বাক্যে সে নীতিরই উল্লেখ রয়েছে সুস্পষ্টভাবে : ‘যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হলো তাদেরকে, যারা আক্রান্ত হয়েছে; কারণ তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে। আর নিশ্চয়ই তাদেরকে সাহায্য করতে সক্ষম আল্লাহ।’ একই নীতির উল্লেখ আছে সূরা বাকারার ১৯০ নম্বর আয়াতে : ‘যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, তোমরাও আল্লাহর পথে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো; কিন্তু সীমা লঙ্ঘন কোরো না। নিশ্চয় আল্লাহ সীমা লঙ্ঘনকারীদের ভালোবাসেন না।’ একই সূরার ২৫৬ নম্বর আয়াতে বললা আছে : ‘ধর্মের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই।’ আর সূরাহ নিসার ১৭১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে : ‘হে আহলে কিতাব, তোমরা ধর্মের ব্যাপারে বাড়বাড়ি কোরো না।’ Ñএই যে কুরআনে বলা হলো ধর্মের ব্যাপারে কোনো বাড়াবাড়ি নেই, এর স্পষ্ট অর্থ হচ্ছেÑ অস্ত্রের বলে তথাকথিত জিহাদের নামে ইসলাম প্রতিষ্ঠার কোনো বৈধ পথ ইসলামে একেবারেই নেই। বরং ইসলামের আদর্শকে অন্তরে লালন করে স্বেচ্ছায় যারা ইসলাম গ্রহণ করবে না, তাদেরকে মুসলমানদের পক্ষ থেকে ইসলাম শুধু এইটুকুই বলার সুযোগ দেয় : ‘তোমার জন্য তোমার ধর্ম, আমার জন্য আমার ধর্ম।’
আর আল্লাহর নবী মোহাম্মাদ সা: তাঁর জীবন ও কর্মের মধ্য দিয়ে এর প্রমাণ করে গেছেন, বাস্তবে এসব নীতি-আদর্শ বাস্তবায়ন সম্ভব। ইতিহাস বলেÑ মহানবী সা:-কে ইসলাম ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্য তাঁর তেইশ বছরের নবুয়তি জীবনে ৬৪টি যুদ্ধের মুখোমখি হতে হয়েছিল। এসব যুদ্ধে দুই পক্ষের মাত্র ৯১৮ জন নিহত হয়। এর মধ্যে নবী সা:-এর পক্ষের ৪৫৯ জন এবং প্রতিপক্ষের ৪৫৯ জন। যুদ্ধবন্দ্বীদের সাথে ভালো ব্যবহারের উৎকৃষ্ট উদাহরণ নবী সা: সৃষ্টি করে গেছেন। নিরক্ষর মুসলমানদের লেখাপড়া শেখানোর বিনিময়ে বন্দিমুক্তির উদাহরণ তো তাঁরই সৃষ্টি। এ ছাড়া রাসূল সা: বলে গেছেন : ‘মুমিন থাকা অবস্থায় কেউ ব্যভিচারে লিপ্ত হয় না। মুমিন থাকা অবস্থায় কেউ হত্যা করে না। মুমিন থাকা অবস্থায় কেউ মদ পান করে না’Ñ অতএব, মুসলমানদের সন্ত্রাসী হওয়ার সুযোগ কোথায়? কারণ, সন্ত্রাস মানেই তো অপরাধী-নিরপরাধী নির্বিশেষে জানমালের ক্ষতিসাধন। যারা জিহাদের নামে, ইসলামের নামে সন্ত্রাস অবলম্বন করে, এরা কখনোই ইসলাম নয়, ভিন্ন কিছু প্রতিষ্ঠা করে। এর পেছনে থাকে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির অভিলাষ। কিন্তু ভুললে চলবে না, যাদের ভূখণ্ড দখলের শিকার, বাস্তুচ্যুত হওয়ার শিকার, তাদের শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধ করার অধিকার নিশ্চয়ই রয়েছে। এর জায়মান উদাহরণ ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাযুদ্ধ। এরা লড়ছে এদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করার জন্য। তাই ওপরে উল্লিখিত গ্রাহাম ফুলারের তাগিদ হচ্ছেÑ দ্রুত ফিলিস্তিন সমস্যার একটি সমাধান বের করতে হবে। মুসলিম জগৎজুড়ে ধরে নেয়া হয়, এ সমস্যা হচ্ছে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদের সবচেয়ে কুখ্যাত ঘটনা, যা স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে স্থানচ্যুত করে এদেরকে ঠেলে দিয়েছে শরণার্থী শিবিরের নিদারুণ জীবনযাপনের অবস্থায়, ইসরাইলে এদের ওপর আরোপ করা হয়েছে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকত্ব কিংবা এদের ঠেলে দিয়েছে নির্বাসনেÑ ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে। র্যাডিকেলাইজেশনের সাথে ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগ বেড়েছে, যা ছড়িয়ে পড়েছে ফিলিস্তিনের বাইরেও। এ সঙ্কট দ্রুত একটি সমাধান দাবি করে, এর সাধারণ সমাধান সব পক্ষের কাছে সুপরিচিত। ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরাইলি উপনিবেশায়নের অবসান এবং এ পরিবর্তন অবশ্যই দরকার।
কুরআনেরÑ যে বৈধ কারণ ছাড়া একজন মানুষকে হত্যা করল, সে যেন গোটা মানবজাতিকেই হত্যা করল; আর যে একজন মানুষের জীবন রক্ষা করল, সে যেন গোটা মানবজাতিকেই রক্ষা করল। অতএব ইসলামে সন্ত্রাসের কোনো স্থান স্পষ্টতই নেই। অথচ ধর্মরিপেক্ষ আর বামপন্থী রাজনীতির অনুসারীদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে এমন ভাবটাই প্রাধান্য পায় যে, সব সন্ত্রাসের মূলে ইসলাম আর ইসলামপন্থী রাজনীতি। অতএব ইসলামী আদর্শের নামে কোনো রাজনীতি চলতে পারে না। ধর্মের নামে যারা রাজনীতি করে এরা মৌলবাদী। এরা জঙ্গি। এদের নির্মূল করতে হবে। এদের সাথে আছেন একশ্রেণীর নাস্তিক। এদের বক্তব্যও এই ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের মতোই। এরাও সুযোগ পেলেই আমাদের দেশে ইসলামপন্থী রাজনীতির অবসান দাবি করেন। এরা সক্রিয় ইসলামের বিরুদ্ধে নানা কুৎসা রচনায়। নাস্তিক হওয়ার অধিকার তাদের আছে। তাই বলে ইসলামবিরোধী কুৎসা রচনার অধিকার এরা রাখেন না।
ইসলাম কারো ধর্ম মানা বা না মানার পুরো অধিকার স্বীকার করে। ইসলাম একটি জীবনাদর্শ। এই আদর্শের বাস্তবায়ন কামনা করে কেউ রাজনীতি করতে চাইলে তাতে বাধা দেয়ার অধিকার কারো নেই। তেমনি অন্য কোনো ধর্ম বা ধর্মরিপেক্ষ নীতির অনুসারীরাও রাজনীতি করার সমঅধিকার রাখেন। সে অধিকারে যখন বাধা আসে তখন তা যেমনি গণতন্ত্রের বাইরে যায়, তেমনি তা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সবাইকে যার যার প্রকাশ্য নীতি-আদর্শ নিয়ে জনগণের কাছে যাওয়ার সুযোগ দিতে হবে। জনগণই বুঝবে, তারা কোন নীতি-আদর্শের দল বা জোটকে বেছে নেবে। এ সুযোগ যত বেশি অবারিত হবে, সামাজিক অস্থিরতা দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত তত সহনশীল মাত্রায় কমে আসবে। এ সহজ সত্য উপলব্ধি করতে আমাদের দেশের বামপন্থী রাজনীতির ধারক-বাহকেরা সবচেয়ে বেশি মাত্রায় অনাগ্রহী। এদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্তু ইসলাম। কারণ, ইসলাম যেখানে শুধু আক্রান্ত হলেই যুদ্ধে যাওয়ার ইতিহাস রচনা করে, সেখানে এদের ইতিহাস শ্রেণীশত্রু অবসানের নামে দেশে দেশে বিপ্লব ফেরি করে চলার ইতিহাস। এদের বিপ্লবের নামে গণহত্যার উপাখ্যান ইতিহাসে বিস্তর। সে কলঙ্ক ঢাকতেই হয়তো আজকের দিনে এদের ঘুম ভাঙে ইসলামপন্থী মানেই জঙ্গিবাদী বলে গালি মুখে নিয়ে, ঘুমোতেও যায় একই গালি জপে।
No comments