সমঝোতাই পারে সংবিধান ও গণতন্ত্র রক্ষা করতে by জাকির মজুমদার
চলমান
সংকট উত্তরণে নাগরিক সমাজ একটি উদ্যোগ নিয়েছে। পাশাপাশি গ্রহণযোগ্য
সমাধানে পৌঁছতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। জাতীয় ও
আন্তর্জাতিক পর্যায়ের এসব উদ্যোগের ইতিবাচক ফলই আমরা আশা করছি। যদিও বিষয়টি
নিয়ে ক্ষমতাসীনরা নেতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন। তবে এটিই যে সরকারের চূড়ান্ত
অবস্থান, তা আমরা মনে করছি না। সংবিধান ও গণতন্ত্র রক্ষায় ক্ষমতাসীনরা
বরাবরই সিদ্ধহস্ত (!)। অথচ শাসকবর্গ না স্বাভাবিক বা নিয়মতান্ত্রিক পন্থায়,
না জনআকাক্সক্ষা মোতাবেক সাংবিধানিক প্রয়োগ নিশ্চিত করেছেন, না জনগণকে
গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতায়িত করেছেন। আবার সেই ক্ষমতাবানরা যখন গদিচ্যুত হয়ে
বিরোধী দল বা জনতার কাতারে আসেন, তখন গণতান্ত্রিক অধিকারের ধারক-বাহক হয়ে
ওঠেন, রাজপথ কাঁপান- এটি দেশের গত আড়াই দশকের চিত্র।
সরকার সংবিধান রক্ষার নামে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমতকে উপেক্ষা করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ভোটারবিহীন দশম সংসদ নির্বাচন করে নিয়েছে। ১৫৪ আসনে ভোট হয়নি, এমপিরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত। বাকি আসনগুলোতে নামমাত্র ভোটারের উপস্থিতি ছিল। বিভিন্ন মাধ্যম বলেছে, ভোটের হার ৫ ভাগ। ভোটের দুদিন পর সরকার হিসাব দিল ৪০ ভাগ। সংবিধান রক্ষার নির্বাচনের পর যখন বলা শুরু হল পাঁচ বছরের আগে আর পরবর্তী নির্বাচন নয়; তখনই সরকারের ভোটের হিসাবের চাতুর্য স্পষ্ট হয়েছে। প্রমাণও হল, ক্ষমতা রক্ষায় বা নিজেদের ক্ষমতায় রাখতেই একতরফা ভোটহীন নির্বাচন করে নিয়েছে সরকার। সবচেয়ে বড় কথা, জাতির সঙ্গে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছেন তারা। উন্নত দেশ হলে এজন্য আইন এবং জনগণের আদালতে দাঁড়াতে হতো সংশ্লিষ্টদের।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর গত হয়েছে একটি বছর। কিন্তু উপেক্ষিত থেকে গেছে জনগণের ভোট ও গণতান্ত্রিক অধিকার। তাই সরকারবিরোধী জোট এখন রাজপথে। তারা সংকট সমাধানে সমঝোতায় পৌঁছতে সংলাপ চাইছে। সরকারবিরোধী জোটের নেতৃত্বদানকারী বিএনপিও সংবিধান রক্ষার নামে ১৯৯৬ সালে একটি একতরফা নির্বাচন করেছিল। অবশ্য সে সময় তারা কথা রেখেছিলেন। জনতার দাবি মেনে নিয়ে দ্রুত ষষ্ঠ সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু বর্তমান ক্ষমতাসীনরা তাদের কথা তো রাখেনইনি, বরং বিরোধী জোটকে সভা-সমাবেশ করতেও বাধা দিয়েছেন। ক্ষমতাসীনরা বলছেন, সরকারবিরোধীরা জঙ্গি, সন্ত্রাসী ও নাশকতাকারী; তাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা নয়, বরং তাদের কঠোরভাবে দমন করা হবে। রাষ্ট্রশক্তির অব্যাহত বল প্রয়োগে এর প্রমাণও মিলেছে। জাতির সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আকাক্সক্ষার বিপরীত দাঁড়িয়ে কীভাবে সংবিধান ও গণতন্ত্র রক্ষা হয় এটিই এখন বড় প্রশ্ন।
সাংবিধানিকভাবে প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার মালিক জনগণ। আর গণতন্ত্র রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক নীতি। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা কখনোই জনগণের ক্ষমতায়ন চাননি, মেনে নেননি। কোনো মৌলিক সিদ্ধান্ত বা নীতি-নির্ধারণী বিষয়ে জনঅংশগ্রহণকে উৎসাহিত করেননি; বরং জনআকাক্সক্ষাকে অগ্রাহ্য করেছেন ক্ষমতা আরও পাকাপোক্ত করতে।
বর্তমান সংকটের মূল কারণ পঞ্চদশ সংশোধনী। এ সংশোধনীতে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি বা জনমতের প্রতিফলন ঘটেনি। বরং গণতন্ত্রের ধারণাকে সংকুচিত করা হয়েছে। সংকট প্রশমনে গণভোটের মতো জনঅংশগ্রহণমূলক মৌলিক বিষয়কেও আমলে নেয়া হয়নি। সংবিধান সংশোধনের জন্য সরকার জনগণের রায় নেয়নি। অথচ এক্ষেত্রে জনরায় অবধারিত ছিল। ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার ইচ্ছা থেকেই পরিকল্পিতভাবে সংবিধান কাটাছেঁড়া করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ক্ষমতাসীনরা প্রমাণ করেছে তারাই প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার মালিক, জনগণ নয়। কারণ যদি তাই হতো, তাহলে সংবিধান সংশোধনের জন্য জনগণের রায় নেয়া হতো। তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জনগণ ভোট চায় নাকি ক্ষমতাসীনদের অধীনে নির্বাচন চায়, সে রায় নেয়া হতো। এমনকি ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বিষয়েও জনগণই ফয়সালা করত। কিন্তু এসব বিষয়ে সাংবিধানিক ক্ষমতা বা গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের সুযোগ থেকে জনগণকে বঞ্চিত করা হয়েছে। ক্ষমতাসীনরা চায়নি জনগণ ক্ষমতাবান হোক; এজন্যই তা সম্ভব হয়েছে।
বলা হয়ে থাকে, আমাদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও চর্চা এখনও নির্বাচন কেন্দ্রিক। সত্যিই তাই। রাষ্ট্রের সাংবিধানিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসহ গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা, রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক গণতন্ত্রের মৌলিক চর্চার নৈতিক ভিত্তি এখনও গড়ে ওঠেনি। আমরা গণতন্ত্র চর্চার নিুস্তরে অবস্থান করছি। কিন্তু নির্বাচন কেন্দ্রিক গণতন্ত্রও কি আজ বিদ্যমান আছে? ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ এবং পরবর্তী সময়ের স্থানীয় নির্বাচন সে ধারণাও তো ভেঙে দিয়েছে। দুর্ভাগ্য, সাংবিধানিকভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রের সব ক্ষমতার মালিক জনগণ আজ নির্বাচন কেন্দ্রিক গণতান্ত্রিক অধিকারটুকু থেকেও বঞ্চিত।
নাগরিকদের উদ্বেগ ও অস্বস্তি বোঝার ক্ষমতা ভালো শাসক বা জনসম্পৃক্ত সরকারের বৈশিষ্ট্য। আমরা দেখতে চাই না যে, রাষ্ট্রশক্তিই সরকারের ক্ষমতার প্রধান নিয়ামক হয়ে উঠছে এবং গণতন্ত্রকে সরকার তার প্রধান প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলছে। আমরা এখনও আশা করছি, চলমান সংকট নিরসনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তাগিদ এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সংলাপের উদ্যোগ সরকার ইতিবাচকভাবে নেবে। গণতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্যই হল, জনআকাঙ্ক্ষা ধারণ করে রাষ্ট্র তার কর্মপরিধি নির্ণয় করবে। সংলাপ-সমঝোতা গণতন্ত্রের অন্যতম সামাজিক চুক্তিও বটে। যার মাধ্যমে জনআকাক্সক্ষাকে ধারণ করা হয়।
যারা সংলাপ চায় তারা পাগল বা দেশের শত্রু বলে ক্ষমতাসীনদের কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন। নাগরিক সমাজের সংলাপের উদ্যোগ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিও উঠে এসেছে। কার সঙ্গে আলোচনা, খুনির সঙ্গে?- এ ধরনের মন্তব্যও করেছেন তিনি। এছাড়া নাগরিক সমাজের সংলাপের উদ্যোক্তাদের এক-এগারোর কুশীলব বলেও মন্তব্য করেছে সরকার ও তার দলের নীতিনির্ধারক মহল। তর্কের খাতিরে বলতে হয়, এক-এগারো পরিস্থিতির সুবিধাভোগী কিন্তু বর্তমান ক্ষমতাসীনরাই। এক-এগারো তাদের আন্দোলনের ফসল বলেও সে সময় মন্তব্য করেছিলেন আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা।
সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী বলেছেন, নাগরিক সমাজের সংলাপের উদ্যোগ অবাস্তব, অগ্রহণযোগ্য এবং সন্ত্রাসকে আড়ালের চেষ্টা। এখন প্রশ্ন হল, এই সন্ত্রাসকে কি সরকার মোকাবেলা করতে পেরেছে? প্রতিদিনই তো জীবন-সম্পদ ক্ষয় হচ্ছে। সরকারের মধ্যকার এই উন্নাসিকতার (সব কিছুকে তুচ্ছ জ্ঞান করা) যবনিকাপাত না ঘটলে দীর্ঘমেয়াদে দেশ ও জনগণের নিরাপত্তা, শিক্ষা ও অর্থনীতির কী বিপর্যয় ঘটবে, সরকার নিশ্চয়ই সে বিষয়ে বেখেয়াল নয়।
কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ বিশ্বাস করতে চায় না, বর্তমান পরিস্থিতিতে এটিই সরকারের চূড়ান্ত অবস্থান। মানুষ মনে করে, সরকার জনদুর্ভোগ আমলে নেবে এবং অভিভাবক হিসেবে সংকট সমাধানে একটা সমঝোতায় পৌঁছতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য বিএনপি জোটের পক্ষ থেকেও সরকারকে সুযোগ দিতে হবে। চলমান অবরোধ-হরতাল স্থগিত ঘোষণা করে সে বার্তাটিই দিতে পারে তারা।
জাকির মজুমদার : সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক
jm.bd1979@gmail.com
সরকার সংবিধান রক্ষার নামে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমতকে উপেক্ষা করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ভোটারবিহীন দশম সংসদ নির্বাচন করে নিয়েছে। ১৫৪ আসনে ভোট হয়নি, এমপিরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত। বাকি আসনগুলোতে নামমাত্র ভোটারের উপস্থিতি ছিল। বিভিন্ন মাধ্যম বলেছে, ভোটের হার ৫ ভাগ। ভোটের দুদিন পর সরকার হিসাব দিল ৪০ ভাগ। সংবিধান রক্ষার নির্বাচনের পর যখন বলা শুরু হল পাঁচ বছরের আগে আর পরবর্তী নির্বাচন নয়; তখনই সরকারের ভোটের হিসাবের চাতুর্য স্পষ্ট হয়েছে। প্রমাণও হল, ক্ষমতা রক্ষায় বা নিজেদের ক্ষমতায় রাখতেই একতরফা ভোটহীন নির্বাচন করে নিয়েছে সরকার। সবচেয়ে বড় কথা, জাতির সঙ্গে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছেন তারা। উন্নত দেশ হলে এজন্য আইন এবং জনগণের আদালতে দাঁড়াতে হতো সংশ্লিষ্টদের।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর গত হয়েছে একটি বছর। কিন্তু উপেক্ষিত থেকে গেছে জনগণের ভোট ও গণতান্ত্রিক অধিকার। তাই সরকারবিরোধী জোট এখন রাজপথে। তারা সংকট সমাধানে সমঝোতায় পৌঁছতে সংলাপ চাইছে। সরকারবিরোধী জোটের নেতৃত্বদানকারী বিএনপিও সংবিধান রক্ষার নামে ১৯৯৬ সালে একটি একতরফা নির্বাচন করেছিল। অবশ্য সে সময় তারা কথা রেখেছিলেন। জনতার দাবি মেনে নিয়ে দ্রুত ষষ্ঠ সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু বর্তমান ক্ষমতাসীনরা তাদের কথা তো রাখেনইনি, বরং বিরোধী জোটকে সভা-সমাবেশ করতেও বাধা দিয়েছেন। ক্ষমতাসীনরা বলছেন, সরকারবিরোধীরা জঙ্গি, সন্ত্রাসী ও নাশকতাকারী; তাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা নয়, বরং তাদের কঠোরভাবে দমন করা হবে। রাষ্ট্রশক্তির অব্যাহত বল প্রয়োগে এর প্রমাণও মিলেছে। জাতির সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আকাক্সক্ষার বিপরীত দাঁড়িয়ে কীভাবে সংবিধান ও গণতন্ত্র রক্ষা হয় এটিই এখন বড় প্রশ্ন।
সাংবিধানিকভাবে প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার মালিক জনগণ। আর গণতন্ত্র রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক নীতি। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা কখনোই জনগণের ক্ষমতায়ন চাননি, মেনে নেননি। কোনো মৌলিক সিদ্ধান্ত বা নীতি-নির্ধারণী বিষয়ে জনঅংশগ্রহণকে উৎসাহিত করেননি; বরং জনআকাক্সক্ষাকে অগ্রাহ্য করেছেন ক্ষমতা আরও পাকাপোক্ত করতে।
বর্তমান সংকটের মূল কারণ পঞ্চদশ সংশোধনী। এ সংশোধনীতে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি বা জনমতের প্রতিফলন ঘটেনি। বরং গণতন্ত্রের ধারণাকে সংকুচিত করা হয়েছে। সংকট প্রশমনে গণভোটের মতো জনঅংশগ্রহণমূলক মৌলিক বিষয়কেও আমলে নেয়া হয়নি। সংবিধান সংশোধনের জন্য সরকার জনগণের রায় নেয়নি। অথচ এক্ষেত্রে জনরায় অবধারিত ছিল। ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার ইচ্ছা থেকেই পরিকল্পিতভাবে সংবিধান কাটাছেঁড়া করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ক্ষমতাসীনরা প্রমাণ করেছে তারাই প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার মালিক, জনগণ নয়। কারণ যদি তাই হতো, তাহলে সংবিধান সংশোধনের জন্য জনগণের রায় নেয়া হতো। তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জনগণ ভোট চায় নাকি ক্ষমতাসীনদের অধীনে নির্বাচন চায়, সে রায় নেয়া হতো। এমনকি ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বিষয়েও জনগণই ফয়সালা করত। কিন্তু এসব বিষয়ে সাংবিধানিক ক্ষমতা বা গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের সুযোগ থেকে জনগণকে বঞ্চিত করা হয়েছে। ক্ষমতাসীনরা চায়নি জনগণ ক্ষমতাবান হোক; এজন্যই তা সম্ভব হয়েছে।
বলা হয়ে থাকে, আমাদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও চর্চা এখনও নির্বাচন কেন্দ্রিক। সত্যিই তাই। রাষ্ট্রের সাংবিধানিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসহ গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা, রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক গণতন্ত্রের মৌলিক চর্চার নৈতিক ভিত্তি এখনও গড়ে ওঠেনি। আমরা গণতন্ত্র চর্চার নিুস্তরে অবস্থান করছি। কিন্তু নির্বাচন কেন্দ্রিক গণতন্ত্রও কি আজ বিদ্যমান আছে? ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ এবং পরবর্তী সময়ের স্থানীয় নির্বাচন সে ধারণাও তো ভেঙে দিয়েছে। দুর্ভাগ্য, সাংবিধানিকভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রের সব ক্ষমতার মালিক জনগণ আজ নির্বাচন কেন্দ্রিক গণতান্ত্রিক অধিকারটুকু থেকেও বঞ্চিত।
নাগরিকদের উদ্বেগ ও অস্বস্তি বোঝার ক্ষমতা ভালো শাসক বা জনসম্পৃক্ত সরকারের বৈশিষ্ট্য। আমরা দেখতে চাই না যে, রাষ্ট্রশক্তিই সরকারের ক্ষমতার প্রধান নিয়ামক হয়ে উঠছে এবং গণতন্ত্রকে সরকার তার প্রধান প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলছে। আমরা এখনও আশা করছি, চলমান সংকট নিরসনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তাগিদ এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সংলাপের উদ্যোগ সরকার ইতিবাচকভাবে নেবে। গণতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্যই হল, জনআকাঙ্ক্ষা ধারণ করে রাষ্ট্র তার কর্মপরিধি নির্ণয় করবে। সংলাপ-সমঝোতা গণতন্ত্রের অন্যতম সামাজিক চুক্তিও বটে। যার মাধ্যমে জনআকাক্সক্ষাকে ধারণ করা হয়।
যারা সংলাপ চায় তারা পাগল বা দেশের শত্রু বলে ক্ষমতাসীনদের কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন। নাগরিক সমাজের সংলাপের উদ্যোগ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিও উঠে এসেছে। কার সঙ্গে আলোচনা, খুনির সঙ্গে?- এ ধরনের মন্তব্যও করেছেন তিনি। এছাড়া নাগরিক সমাজের সংলাপের উদ্যোক্তাদের এক-এগারোর কুশীলব বলেও মন্তব্য করেছে সরকার ও তার দলের নীতিনির্ধারক মহল। তর্কের খাতিরে বলতে হয়, এক-এগারো পরিস্থিতির সুবিধাভোগী কিন্তু বর্তমান ক্ষমতাসীনরাই। এক-এগারো তাদের আন্দোলনের ফসল বলেও সে সময় মন্তব্য করেছিলেন আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা।
সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী বলেছেন, নাগরিক সমাজের সংলাপের উদ্যোগ অবাস্তব, অগ্রহণযোগ্য এবং সন্ত্রাসকে আড়ালের চেষ্টা। এখন প্রশ্ন হল, এই সন্ত্রাসকে কি সরকার মোকাবেলা করতে পেরেছে? প্রতিদিনই তো জীবন-সম্পদ ক্ষয় হচ্ছে। সরকারের মধ্যকার এই উন্নাসিকতার (সব কিছুকে তুচ্ছ জ্ঞান করা) যবনিকাপাত না ঘটলে দীর্ঘমেয়াদে দেশ ও জনগণের নিরাপত্তা, শিক্ষা ও অর্থনীতির কী বিপর্যয় ঘটবে, সরকার নিশ্চয়ই সে বিষয়ে বেখেয়াল নয়।
কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ বিশ্বাস করতে চায় না, বর্তমান পরিস্থিতিতে এটিই সরকারের চূড়ান্ত অবস্থান। মানুষ মনে করে, সরকার জনদুর্ভোগ আমলে নেবে এবং অভিভাবক হিসেবে সংকট সমাধানে একটা সমঝোতায় পৌঁছতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য বিএনপি জোটের পক্ষ থেকেও সরকারকে সুযোগ দিতে হবে। চলমান অবরোধ-হরতাল স্থগিত ঘোষণা করে সে বার্তাটিই দিতে পারে তারা।
জাকির মজুমদার : সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক
jm.bd1979@gmail.com
No comments