নারীকে যেতে হবে আরও বহুদূর by রাশেদা কে চৌধূরী
আজ
আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এ উপলক্ষে পৃথিবীর সব নারীকে জানাই অভিবাদন। নারীর
অর্জন আজ এত দৃশ্যমান যে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। অর্জনের দিক থেকে
দেখলে বলতে হয়, বাংলাদেশের সামাজিক উন্নয়নের সব সূচকেই বিশাল অবদান রাখছে
নারী। অর্থনীতির কথা দিয়েই শুরু করি। বাংলাদেশে পোশাক খাতের আজকের এই
অবস্থানে আসার পেছনে নারী শ্রমিকদের অবদানই সর্বাধিক।
এ ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের ভূমিকা আছে, এ কথাও অস্বীকার করার উপায় নেই। তাঁরা বিনিয়োগ করেছেন বলেই এ খাত গড়ে উঠেছে। এর ফলে মানবসম্পদও বিকশিত হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির বড় ক্ষেত্র হচ্ছে কৃষি। গবেষণায় দেখা গেছে, ধান উৎপাদনের ২১টি কাজের মধ্যে ১৭টি কাজই করে নারী। কিন্তু তার কাজের মূল্যায়ন সেভাবে হচ্ছে না। তৃতীয় বিষয় হচ্ছে ক্ষুদ্রঋণ। এ মুহূর্তে মাঠে ১০ হাজার কোটি টাকার ওপরে ক্ষুদ্রঋণ আছে। এই ক্ষুদ্রঋণও পরিচালিত হচ্ছে মূলত নারীর মাধ্যমে। বলা বাহুল্য, ক্ষুদ্রঋণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সারা বিশ্বের মডেল। একই সঙ্গে দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাত বা এসএমই নামে আরেকটি খাত গড়ে উঠেছে। এর ফলে অনেকে ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতা থেকে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তায় পরিণত হয়েছে। এই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদেরও বেশির ভাগই নারী। নারীদের এ খাতে উৎসাহিত করতে সরকারি-বেসরকারিভাবে বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে।
সামাজিক বনায়নের ক্ষেত্রেও নারীরা ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে। যদিও আমরা নানা কারণে প্রাকৃতিক বনসম্পদ রক্ষা করতে পারছি না, সামাজিক বনায়নে আমরা বেশ সফলতা অর্জন করেছি। সে ক্ষেত্রেও নারীর ভূমিকা মুখ্য। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বিস্ময়ের সঙ্গে বলেছেন, বাংলাদেশের মতো তথাকথিত একটি ‘পিছিয়ে পড়া’ দেশের নারীরা কীভাবে এতটা এগিয়ে গেল! ভারতসহ আমাদের অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে তুলনা করলে এ অর্জন বিস্ময়করই বটে।
বাংলাদেশে শিক্ষার প্রসারে নারীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। সন্তানের পড়াশোনা দেখভাল থেকে সবকিছুই করে নারী। তাদের আগ্রহের কারণে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে ছেলেমেয়ের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে সমতা অর্জিত হয়েছে। সব সরকারই মেয়েদের শিক্ষায় আগ্রহী করতে ইতিবাচক নীতি গ্রহণ করেছে। সে কারণে এটা সম্ভব হয়েছে। বস্তুত, মাধ্যমিকে এখন মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। এরপর বিভিন্ন পেশাভিত্তিক শিক্ষায়ও নারীরা এগিয়ে এসেছে। যেমন: চিকিৎসা, প্রকৌশল, আইন, সাংবাদিকতা প্রভৃতি পেশায় নারীর অংশগ্রহণ ব্যাপক হারে বেড়েছে। তবে কোন শ্রেণির নারীরা এসব পেশায় আসছে, সেই প্রশ্ন উঠতেই পারে।
কথা হচ্ছে, একদম বিত্তহীন শ্রেণির নারী বা পুরুষ, কারও পক্ষেই কিন্তু এসব পেশায় আসা সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র সেই সমতাভিত্তিক সুযোগ সৃষ্টি করতে পারেনি। তার পরও কিন্তু নারী থেমে থাকেনি। এখন ক্রিকেট ও ফুটবল থেকে শুরু করে নানা খেলায়ই আমাদের নারী দল রয়েছে। এককথায় বলা যায়, বাংলাদেশের তৃণমূল থেকে হিমালয় শিখর—সবখানেই নারীর দৃপ্ত পদচারণ দৃশ্যমান। সুযোগ পাওয়ামাত্রই নারীরা এগিয়ে এসেছে।
ক্ষমতায়নের তিনটি কাঠামো রয়েছে: প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক। আমাদের পুলিশ বাহিনী, প্রশাসনিক পদ ও জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতেও নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ দৃশ্যমান। নারীরা এখন যুদ্ধবিমান চালাচ্ছে, প্যারাট্রুপারও হয়েছে। এ জন্য নীতিনির্ধারকদের ধন্যবাদ। রাজনৈতিক নেতৃত্বে বাংলাদেশের নারীরা শীর্ষ স্থানে আসীন। আমাদের বর্তমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বর্তমান সংসদের বিরোধীদলীয় নেত্রী—সবাই নারী। জাতীয় সংসদের স্পিকারও একজন নারী। প্রত্যাশা ছিল, নারী সাংসদেরা সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। কিন্তু সেটা এখনো হয়নি। তার পরও নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো অঙ্গীকার করেছিল, দলীয় কাঠামোর মধ্যে নারীর অংশগ্রহণ বাড়বে, তাদের বিভিন্ন স্থানীয় কমিটিতে শুধু অংশগ্রহণই বাড়বে না, তারা নেতৃত্ব বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্যায়ে আসবে। কিন্তু সেটা আদতে হয়নি। যেকোনো নির্বাচনে দলের পক্ষ থেকে এক-তৃতীয়াংশ আসনে নারীকে মনোনয়ন দেওয়ার কথা ছিল, তা-ও বাস্তবায়িত হয়নি।
বেসরকারি খাতে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা থেকে শুরু করে বড় উদ্যোক্তাদের মধ্যেও নারীরা আছে। আমার বিশ্বাস, এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব নেই। কিন্তু সামাজিক ক্ষেত্রে নারীকে অনেক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। ফলে প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক—এ তিনটি ক্ষেত্রে ক্ষমতায়নের জন্য নারীকে আরও বহুদূর যেতে হবে।
নারীর প্রতি সহিংসতা মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে, তার নিরাপত্তাহীনতাও বেড়েছে। সমাজের আরেকটি ব্যাধি হচ্ছে বাল্যবিবাহ, এগুলোকে আমি ব্যাধিই বলব। বাল্যবিবাহের একটি বড় কারণ হচ্ছে, মেয়েটি বড় হলে তাকে বোঝা মনে করা হয়। অথচ মেয়েটিকে স্কুলে পাঠালে যে কত লাভ, তা বলাই বাহুল্য। এর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে নিরাপত্তাহীনতা। এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভেতরেও মেয়েরা নানাভাবে নিগৃহীত হয়। ইভ টিজিং থেকে শুরু করে নানা রকম নিগ্রহের শিকার হয়ে মেয়েরা আত্মহত্যা পর্যন্ত করছে। এই ব্যাধির মূলোৎপাটন এখনো সম্ভব হয়নি। নারীর মানবাধিকার আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। জন্মের পর থেকেই মেয়েশিশু বৈষম্যের শিকার হয়। অনেক সময় মা-বাবা নিজেদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ছেলেশিশুর জন্ম যেভাবে উদ্যাপন করে, মেয়েশিশুর জন্ম সেভাবে করে না। এটা বিশেষ করে নিম্নবিত্ত পরিবারে বেশি দেখা যায়।
তবে মধ্যবিত্তের মধ্যে ইদানীং এ ধারণা অনেকটাই বদলে গেছে। এখন মেয়েরাও পরিবারে আর্থিকভাবে অবদান রাখছে, এমনকি নিম্নবিত্ত পরিবারেও অনেক নারী সংসারের হাল ধরছে। স্বামী বা ছেলে দেশের বাইরে থাকলে দেখা যায়, মা বা স্ত্রীই পরিবারের হাল ধরে রেখেছে। আমরা ক্ষতে প্রলেপ দিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু এখন পর্যন্ত মূল কারণটা দূর করতে পারিনি—সামাজিক বৈষম্য। আর নিরাপত্তার বিষয়টি তো রয়েছেই। গার্মেন্টস থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গ্রামগঞ্জ—কোনোখানেই যে মেয়েরা নির্যাতনের শিকার হবে না, এ কথা হলফ করে বলার উপায় নেই। তবে আশার কথা হচ্ছে, মেয়েরাই এখন বাল্যবিবাহ রোধে এগিয়ে আসছে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যম খুবই ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে। সে কারণে তাদের ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। গণমাধ্যমের জন্য এখন আর কিছু চাপা থাকে না। নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে তা বেরিয়ে আসবেই। বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থাগুলোও এসব বিষয়ে চোখ রাখছে। আবার আদালতের দ্বারস্থ হওয়ারও সুযোগ আছে। এর মাধ্যমে এটা ধীরে ধীরে কমবে বলে আমার বিশ্বাস।
তবে নারীর প্রতি সহিংসতার বিষয়টি কোনো বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নয়। এটা যেকোনো দেশেরই অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল। সমাজে অর্থনৈতিক অস্থিরতা বা বেকারত্ব থাকলে, মূল্যবোধের অবক্ষয় থাকলে তার সহজ শিকারে পরিণত হয় নারী। অন্যদিকে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে বেশি ব্যস্ত থাকেন, তাহলে নারী নির্যাতনসহ যেকোনো মানুষেরই মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বেড়ে যায়। অথবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি সর্বসাধারণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেয়ে অন্য কাজে ব্যস্ত থাকে, তাহলে এমন অপরাধের প্রবণতা বাড়তে থাকে। তখন আদালতই হয় শেষ ভরসা। কিন্তু আদালতেও এত মামলার জট রয়েছে যে তাঁরা হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন। যদিও বাংলাদেশের মহামান্য আদালত নারীর অধিকার সুরক্ষায় অনেক যুগান্তকারী রায় দিয়েছেন। আমরা তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ।
ধর্মের অপব্যাখ্যার মাধ্যমে নারীর মানবাধিকার খর্ব করার প্রয়াসও অনেক সময় মাখাচাড়া দিয়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রযন্ত্রের সুদৃঢ়, আপসহীন, যথাযথ পদক্ষেপ নারীর ক্ষমতায়ন ত্বরান্বিত করতে পারে।
আরেকটি বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। সম্প্রতি নারীদের গৃহকর্মী হিসেবে সৌদি আরবে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু যেখানে আমাদের পুরুষ শ্রমিকেরাই বিদেশে কাজ করতে গিয়ে নানা ঝক্কি-ঝামেলায় পড়ছে, নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, সেখানে নারীদের নিরাপত্তার ব্যাপারে সুনিশ্চিত না হয়ে তাদের বিদেশে পাঠানো ঠিক হবে না। তারা গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করবে, কারখানা বা প্রতিষ্ঠানে নয়। এ কারণে তাদের নিগৃহীত হওয়ার আশঙ্কা বেশি।
নারী-পুরুষের বিদ্যমান বৈষম্য হ্রাসে সবাই এগিয়ে এলে সহজ হবে ক্ষমতায়নের পথ। এ জন্য প্রয়োজন সুদৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার—নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়ে দলমত-নির্বিশেষে মতৈক্য।
অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। তাদের অর্জনও কম নয়। কিন্তু ক্ষমতায়নের জায়গায় নারীকে আরও বহুদূর যেতে হবে। সে ক্ষেত্রে আমাদের রাজনৈতিক-সামাজিক-প্রশাসনিক-ব্যবসায়িক নেতৃত্ব—সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
রাশেদা কে চৌধূরী: নির্বাহী পরিচালক, গণসাক্ষরতা অভিযান।
এ ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের ভূমিকা আছে, এ কথাও অস্বীকার করার উপায় নেই। তাঁরা বিনিয়োগ করেছেন বলেই এ খাত গড়ে উঠেছে। এর ফলে মানবসম্পদও বিকশিত হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির বড় ক্ষেত্র হচ্ছে কৃষি। গবেষণায় দেখা গেছে, ধান উৎপাদনের ২১টি কাজের মধ্যে ১৭টি কাজই করে নারী। কিন্তু তার কাজের মূল্যায়ন সেভাবে হচ্ছে না। তৃতীয় বিষয় হচ্ছে ক্ষুদ্রঋণ। এ মুহূর্তে মাঠে ১০ হাজার কোটি টাকার ওপরে ক্ষুদ্রঋণ আছে। এই ক্ষুদ্রঋণও পরিচালিত হচ্ছে মূলত নারীর মাধ্যমে। বলা বাহুল্য, ক্ষুদ্রঋণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সারা বিশ্বের মডেল। একই সঙ্গে দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাত বা এসএমই নামে আরেকটি খাত গড়ে উঠেছে। এর ফলে অনেকে ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতা থেকে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তায় পরিণত হয়েছে। এই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদেরও বেশির ভাগই নারী। নারীদের এ খাতে উৎসাহিত করতে সরকারি-বেসরকারিভাবে বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে।
সামাজিক বনায়নের ক্ষেত্রেও নারীরা ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে। যদিও আমরা নানা কারণে প্রাকৃতিক বনসম্পদ রক্ষা করতে পারছি না, সামাজিক বনায়নে আমরা বেশ সফলতা অর্জন করেছি। সে ক্ষেত্রেও নারীর ভূমিকা মুখ্য। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বিস্ময়ের সঙ্গে বলেছেন, বাংলাদেশের মতো তথাকথিত একটি ‘পিছিয়ে পড়া’ দেশের নারীরা কীভাবে এতটা এগিয়ে গেল! ভারতসহ আমাদের অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে তুলনা করলে এ অর্জন বিস্ময়করই বটে।
বাংলাদেশে শিক্ষার প্রসারে নারীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। সন্তানের পড়াশোনা দেখভাল থেকে সবকিছুই করে নারী। তাদের আগ্রহের কারণে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে ছেলেমেয়ের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে সমতা অর্জিত হয়েছে। সব সরকারই মেয়েদের শিক্ষায় আগ্রহী করতে ইতিবাচক নীতি গ্রহণ করেছে। সে কারণে এটা সম্ভব হয়েছে। বস্তুত, মাধ্যমিকে এখন মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। এরপর বিভিন্ন পেশাভিত্তিক শিক্ষায়ও নারীরা এগিয়ে এসেছে। যেমন: চিকিৎসা, প্রকৌশল, আইন, সাংবাদিকতা প্রভৃতি পেশায় নারীর অংশগ্রহণ ব্যাপক হারে বেড়েছে। তবে কোন শ্রেণির নারীরা এসব পেশায় আসছে, সেই প্রশ্ন উঠতেই পারে।
কথা হচ্ছে, একদম বিত্তহীন শ্রেণির নারী বা পুরুষ, কারও পক্ষেই কিন্তু এসব পেশায় আসা সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র সেই সমতাভিত্তিক সুযোগ সৃষ্টি করতে পারেনি। তার পরও কিন্তু নারী থেমে থাকেনি। এখন ক্রিকেট ও ফুটবল থেকে শুরু করে নানা খেলায়ই আমাদের নারী দল রয়েছে। এককথায় বলা যায়, বাংলাদেশের তৃণমূল থেকে হিমালয় শিখর—সবখানেই নারীর দৃপ্ত পদচারণ দৃশ্যমান। সুযোগ পাওয়ামাত্রই নারীরা এগিয়ে এসেছে।
ক্ষমতায়নের তিনটি কাঠামো রয়েছে: প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক। আমাদের পুলিশ বাহিনী, প্রশাসনিক পদ ও জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতেও নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ দৃশ্যমান। নারীরা এখন যুদ্ধবিমান চালাচ্ছে, প্যারাট্রুপারও হয়েছে। এ জন্য নীতিনির্ধারকদের ধন্যবাদ। রাজনৈতিক নেতৃত্বে বাংলাদেশের নারীরা শীর্ষ স্থানে আসীন। আমাদের বর্তমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বর্তমান সংসদের বিরোধীদলীয় নেত্রী—সবাই নারী। জাতীয় সংসদের স্পিকারও একজন নারী। প্রত্যাশা ছিল, নারী সাংসদেরা সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। কিন্তু সেটা এখনো হয়নি। তার পরও নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো অঙ্গীকার করেছিল, দলীয় কাঠামোর মধ্যে নারীর অংশগ্রহণ বাড়বে, তাদের বিভিন্ন স্থানীয় কমিটিতে শুধু অংশগ্রহণই বাড়বে না, তারা নেতৃত্ব বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্যায়ে আসবে। কিন্তু সেটা আদতে হয়নি। যেকোনো নির্বাচনে দলের পক্ষ থেকে এক-তৃতীয়াংশ আসনে নারীকে মনোনয়ন দেওয়ার কথা ছিল, তা-ও বাস্তবায়িত হয়নি।
বেসরকারি খাতে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা থেকে শুরু করে বড় উদ্যোক্তাদের মধ্যেও নারীরা আছে। আমার বিশ্বাস, এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব নেই। কিন্তু সামাজিক ক্ষেত্রে নারীকে অনেক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। ফলে প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক—এ তিনটি ক্ষেত্রে ক্ষমতায়নের জন্য নারীকে আরও বহুদূর যেতে হবে।
নারীর প্রতি সহিংসতা মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে, তার নিরাপত্তাহীনতাও বেড়েছে। সমাজের আরেকটি ব্যাধি হচ্ছে বাল্যবিবাহ, এগুলোকে আমি ব্যাধিই বলব। বাল্যবিবাহের একটি বড় কারণ হচ্ছে, মেয়েটি বড় হলে তাকে বোঝা মনে করা হয়। অথচ মেয়েটিকে স্কুলে পাঠালে যে কত লাভ, তা বলাই বাহুল্য। এর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে নিরাপত্তাহীনতা। এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভেতরেও মেয়েরা নানাভাবে নিগৃহীত হয়। ইভ টিজিং থেকে শুরু করে নানা রকম নিগ্রহের শিকার হয়ে মেয়েরা আত্মহত্যা পর্যন্ত করছে। এই ব্যাধির মূলোৎপাটন এখনো সম্ভব হয়নি। নারীর মানবাধিকার আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। জন্মের পর থেকেই মেয়েশিশু বৈষম্যের শিকার হয়। অনেক সময় মা-বাবা নিজেদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ছেলেশিশুর জন্ম যেভাবে উদ্যাপন করে, মেয়েশিশুর জন্ম সেভাবে করে না। এটা বিশেষ করে নিম্নবিত্ত পরিবারে বেশি দেখা যায়।
তবে মধ্যবিত্তের মধ্যে ইদানীং এ ধারণা অনেকটাই বদলে গেছে। এখন মেয়েরাও পরিবারে আর্থিকভাবে অবদান রাখছে, এমনকি নিম্নবিত্ত পরিবারেও অনেক নারী সংসারের হাল ধরছে। স্বামী বা ছেলে দেশের বাইরে থাকলে দেখা যায়, মা বা স্ত্রীই পরিবারের হাল ধরে রেখেছে। আমরা ক্ষতে প্রলেপ দিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু এখন পর্যন্ত মূল কারণটা দূর করতে পারিনি—সামাজিক বৈষম্য। আর নিরাপত্তার বিষয়টি তো রয়েছেই। গার্মেন্টস থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গ্রামগঞ্জ—কোনোখানেই যে মেয়েরা নির্যাতনের শিকার হবে না, এ কথা হলফ করে বলার উপায় নেই। তবে আশার কথা হচ্ছে, মেয়েরাই এখন বাল্যবিবাহ রোধে এগিয়ে আসছে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যম খুবই ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে। সে কারণে তাদের ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। গণমাধ্যমের জন্য এখন আর কিছু চাপা থাকে না। নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে তা বেরিয়ে আসবেই। বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থাগুলোও এসব বিষয়ে চোখ রাখছে। আবার আদালতের দ্বারস্থ হওয়ারও সুযোগ আছে। এর মাধ্যমে এটা ধীরে ধীরে কমবে বলে আমার বিশ্বাস।
তবে নারীর প্রতি সহিংসতার বিষয়টি কোনো বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নয়। এটা যেকোনো দেশেরই অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল। সমাজে অর্থনৈতিক অস্থিরতা বা বেকারত্ব থাকলে, মূল্যবোধের অবক্ষয় থাকলে তার সহজ শিকারে পরিণত হয় নারী। অন্যদিকে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে বেশি ব্যস্ত থাকেন, তাহলে নারী নির্যাতনসহ যেকোনো মানুষেরই মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বেড়ে যায়। অথবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি সর্বসাধারণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেয়ে অন্য কাজে ব্যস্ত থাকে, তাহলে এমন অপরাধের প্রবণতা বাড়তে থাকে। তখন আদালতই হয় শেষ ভরসা। কিন্তু আদালতেও এত মামলার জট রয়েছে যে তাঁরা হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন। যদিও বাংলাদেশের মহামান্য আদালত নারীর অধিকার সুরক্ষায় অনেক যুগান্তকারী রায় দিয়েছেন। আমরা তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ।
ধর্মের অপব্যাখ্যার মাধ্যমে নারীর মানবাধিকার খর্ব করার প্রয়াসও অনেক সময় মাখাচাড়া দিয়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রযন্ত্রের সুদৃঢ়, আপসহীন, যথাযথ পদক্ষেপ নারীর ক্ষমতায়ন ত্বরান্বিত করতে পারে।
আরেকটি বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। সম্প্রতি নারীদের গৃহকর্মী হিসেবে সৌদি আরবে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু যেখানে আমাদের পুরুষ শ্রমিকেরাই বিদেশে কাজ করতে গিয়ে নানা ঝক্কি-ঝামেলায় পড়ছে, নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, সেখানে নারীদের নিরাপত্তার ব্যাপারে সুনিশ্চিত না হয়ে তাদের বিদেশে পাঠানো ঠিক হবে না। তারা গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করবে, কারখানা বা প্রতিষ্ঠানে নয়। এ কারণে তাদের নিগৃহীত হওয়ার আশঙ্কা বেশি।
নারী-পুরুষের বিদ্যমান বৈষম্য হ্রাসে সবাই এগিয়ে এলে সহজ হবে ক্ষমতায়নের পথ। এ জন্য প্রয়োজন সুদৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার—নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়ে দলমত-নির্বিশেষে মতৈক্য।
অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। তাদের অর্জনও কম নয়। কিন্তু ক্ষমতায়নের জায়গায় নারীকে আরও বহুদূর যেতে হবে। সে ক্ষেত্রে আমাদের রাজনৈতিক-সামাজিক-প্রশাসনিক-ব্যবসায়িক নেতৃত্ব—সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
রাশেদা কে চৌধূরী: নির্বাহী পরিচালক, গণসাক্ষরতা অভিযান।
No comments