সংকট মোচন কোন পথে? by আবুল মোমেন
বর্তমান
সংকট শুরু হয়েছিল দ্রুত নির্বাচনের দাবি আদায়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির
জন্য প্রধান বিরোধী পক্ষ বিএনপি-জামায়াত জোটের ডাকে। দুই মাসেও আন্দোলন
গতি পায়নি বরং লক্ষ্যচ্যুত হয়ে পড়েছে। তবে এযাবৎ সব মিলিয়ে ১১৮ জন মানুষ
প্রাণ হারিয়েছে আর অগ্নিদগ্ধ হয়ে অসহ্য যন্ত্রণায় ভুগছে শতাধিক মানুষ।
অর্থনীতির ক্ষতির সঠিক পরিমাপ না হলেও অর্থমন্ত্রীর ভাষ্যমতে, সোয়া লাখ
কোটি টাকা। তবে সমূহ ক্ষতি হচ্ছে শিক্ষার।
সরকার গত বছরের নির্বাচনকালীন বিএনপি-জামায়াতের সহিংস আন্দোলন মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছিল। সেবারও কোনো ছাড় দেয়নি সরকার। এর আগের হেফাজতে ইসলামের অভাবিত বড় সমাবেশের সম্ভাব্য হুমকিও শক্ত হাতে সফলভাবে সামলেছিল। বোঝা যায়, সরকারের হাত আগের চেয়ে অনেক শক্তিশালী। বৈরী পরিস্থিতিতে টিকে থাকা, এমনকি এগিয়ে যাওয়ার শক্তি আওয়ামী লীগ অর্জন করেছে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। আওয়ামী লীগ পাকিস্তানি স্বৈরশাসন ও ব্যাপক নিপীড়ন এবং বাংলাদেশ আমলে জিয়া-এরশাদের মতো সামরিক শাসক ও ২০০১-২০০৬-এর বিএনপি শাসনের প্রচণ্ড চাপ সামলেছে ও সামনে এগিয়েছে মূলত সাংগঠনিক শক্তি ও নেতৃত্বের সঠিক কৌশলী চালে। পাকিস্তান আমলে দলের দীর্ঘ কঠিন সংগ্রামী ভূমিকায় নেতৃত্ব দিয়ে শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন দলের পরানেতা (আপার লিডার) আর বাংলাদেশ আমলে দলে শেখ হাসিনার অবস্থান এখন তা-ই। বলে রাখা প্রয়োজন, বিএনপিতে গঠনতান্ত্রিকভাবেই চেয়ারপারসন একজন সর্বশক্তিমান পরানেতা। শেখ মুজিব পরে জাতীয় নেতা, বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতায় উন্নীত হয়েছিলেন, শেখ হাসিনার সামনেও নতুন শতাব্দীতে নতুন বাংলাদেশের নির্মাতা হওয়ার সুযোগ এসেছে। সাধারণভাবে সংকট মোচন করে দেশকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ দুই নেত্রীর জন্যই খোলা ছিল, কিন্তু একের পর এক ভুল সিদ্ধান্তে বেগম জিয়া আপাতত পিছিয়ে পড়েছেন বলে মনে হয়। পরানেতার কর্তৃত্ব দল কিংবা দেশের গণতন্ত্রের জন্য অনুকূল হয় না, কিন্তু দীর্ঘদিন দারিদ্র্যের বৃত্তে আবদ্ধ জাতি উন্নয়নের বিনিময়ে অনুদার গণতন্ত্র ও কর্তৃত্ববাদী নেতৃত্বও মেনে নেয়। এমনটা আমরা মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুরে দেখেছি। এমনকি উদার গণতান্ত্রিক দেশেও এক দলের দীর্ঘ শাসনের নজির আছে, যেমন ভারত।
কেবল সরকারে থাকায় ক্ষমতার জোরে আওয়ামী লীগ বর্তমানে বিএনপি ও জামায়াতকে সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগ করতে পারছে ভাবলে ভুল হবে। বরং দেশের জঙ্গি ইসলামি শক্তিগুলোর প্রতি বিএনপির সহনশীল দুর্বলতা এর বড় কারণ। জামায়াত এ জোটের প্রধান দল নয়। অথচ দেখা যাচ্ছে জঙ্গি-সম্পৃক্ত যত নেতা-কর্মী ধরা পড়ছেন, তাঁদের উৎস এই দলটি। এ ছাড়া ক্ষমতায় থাকার সময় বেগম জিয়া জেএমবিসহ বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের নাশকতার প্রতি দুর্বলতা দেখিয়েছিলেন। বিএনপির এই জঙ্গি রাজনীতি বিরোধী নেতাদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যাঁরা নেত্রী কিংবা তাঁর প্রভাবশালী পুত্রকে বর্তমান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির হালচাল বুঝে দলের অবস্থান স্পষ্ট করা ও তা পাল্টানোর গুরুত্ব বুঝিয়ে বলবেন। উল্টো ক্রমাগত ভোঁতা অস্ত্র চালিয়ে তাঁরা হরতাল-অবরোধকে অকেজো করেছেন। পেট্রলবোমা কেবল দলের জন্য ঋণাত্মক হচ্ছে না, সরকারকে মাঠে মারমুখী ভূমিকায় নামতে সহায়তা করছে। তাদের আরও মনে রাখা দরকার, ক্ষমতায় বসে দলছুট ও নানা মতের লোক নিয়ে গঠিত পার্টি ক্ষমতার বাইরে বেশি দিন টেকে না, মুসলিম লীগও পারেনি—যদিও এই পক্ষে দেশে প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ নিশ্চিত ভোট রয়েছে। এভাবে সরকারকে ধ্বংস করতে গিয়ে বিএনপি না নিজের ধ্বংস ডেকে আনে, সেটাই শঙ্কার বিষয়। ইতিমধ্যেই তার পক্ষ নিয়ে রাজনীতির বাইরের শক্তিকে কাজে লাগানোর চিন্তাভাবনার প্রকাশও ঘটছে।
আপাতত শেখ হাসিনার অবস্থান শক্তই আছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সংকটের আবর্ত থেকে দেশকে বের করে আনা তাঁর পক্ষে সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে। এর কারণ, একদিকে সচেতন নাগরিকদের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব বেড়েছে আর অন্যদিকে জনগণ বর্তমানে রাজনীতির প্রতি বিমুখ, এমনকি রাজনীতি নিয়ে বিতৃষ্ণায় ভুগছে।
মনে হয়, শেখ হাসিনা বুদ্ধিজীবীদের কাছে—যাঁদের তিনি সুশীল সমাজ নামে বিদ্রূপ করে থাকেন—দুটি বিবেচনা প্রত্যাশা করেছিলেন। প্রথমত, তিনি আশা করেছিলেন তাঁরা জাতির পিতার—যিনি তাঁরও পিতা—হত্যাকারীদের পৃষ্ঠপোষকতাদানকারী ব্যক্তি অর্থাৎ জেনারেল জিয়া ও তাঁর উত্তরসূরিদের অন্যায়গুলো বিবেচনায় নিয়ে জাতীয় প্রয়োজন মাথায় রেখে তাঁর ভূমিকা বিচার করবেন এবং নিজেদের ভূমিকা নির্ধারণ করবেন। এ প্রত্যাশা অন্যায্য নয় এবং এটা বিবেকসম্মত কাজ, যা বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকে কাম্য।
দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা। এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই যে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নেতারা সেদিন হত্যার লক্ষ্যস্থল ছিলেন। এ ঘটনা নিয়ে তৎকালীন খালেদা জিয়া সরকারের ভূমিকায় অস্পষ্টতা ছিল এবং তারেক জিয়াসহ দলীয় নেতা ও আমলা-সমর্থকদের বেশ কয়েকজনের যোগসাজশ সম্পর্কে জোরালো সন্দেহের কারণ ঘটেছিল। দুটি ঘটনাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের ওপর বড় আঘাত হেনেছিল। কিন্তু বুদ্ধিজীবীদের প্রতিক্রিয়ায় ধারাবাহিকতার অভাব নিয়ে অভিযোগ উঠলে তা খারিজ করা মুশকিল। তবে বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়, ক্ষমতার রাজনীতির চাপান-উতোর রাজনীতিকে যে জায়গায় নিয়ে গেছে, সেখানে কি তাঁদের পক্ষে নিজ ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রেখে অংশীদার হওয়া সম্ভব? তেমন বাস্তবতা কি আছে? দেখা যাচ্ছে, যেসব বুদ্ধিজীবী নেত্রী ও আওয়ামী লীগকে সন্তুষ্ট করতে পেরেছেন, তাঁরা পরিস্থিতির কারণে আওয়ামী লীগের ধামাধরার অপবাদে চিহ্নিত হচ্ছেন। সামগ্রিকভাবে রাজনীতি ও সেই সঙ্গে তাঁর নিজের দলের এই অবক্ষয়কে বিশেষ বিবেচনায় না নিয়ে শেখ হাসিনা যেন নিজের দুটি উপলব্ধি থেকেই কাজ করে যাচ্ছেন: এক. তিনি বুঝেছেন ইতিহাসের দায় নিষ্পত্তির এবং ইতিহাস বিকৃতি রোধের কাজ তাঁকেই সম্পন্ন করতে হবে এবং দুই. বিএনপি-জামায়াত জোটকে সক্রিয় রেখে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিরাপদ হবে না।
আমার ধারণা, তাঁর এ দুটি উপলব্ধি ভুল নয়। কিন্তু দেশের বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে—তাঁর ভাষায় সুশীল সমাজ—দূরত্ব তৈরি করে কাজটা সম্পাদন করা, বলা যায়, একপ্রকার অসম্ভব। প্রথমত, তাঁর এই আকাঙ্ক্ষার মধ্যে রয়েছে সমাজের ও রাষ্ট্রের গুণগত রূপান্তরের চেতনা ও প্রণোদনা। যে কাজ গণসম্পৃক্তি ও গণজাগরণ ছাড়া সম্ভব নয়। আর তার সূচনাকারী হবেন রাজনীতিক নন, শিল্প-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীরা। বায়ান্ন থেকে পরবর্তী প্রতিটি আন্দোলনের ইতিহাস সেই সাক্ষ্য দেয়। বস্তুতপক্ষে পৃথিবীর কোনো দেশেই গুণগত রূপান্তরের ক্ষেত্রে এর অন্যথা হয়নি।
ফলে শেখ হাসিনা যদি মুক্তিযুদ্ধের আরব্ধ কাজ সম্পাদনের এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের চূড়ান্ত সংগ্রাম শুরু করে থাকেন, তাহলে তাঁকেই ভাবতে হবে এই ফাঁকটুকু তিনি কীভাবে পূরণ করবেন। তার আগে তাঁকে এ-ও মাথায় রাখতে হবে যে আজ ছাত্ররাজনীতি চূড়ান্ত অবক্ষয়ে সম্পূর্ণ অকার্যকর হয়ে পড়েছে, শ্রমিক রাজনীতি দুর্নীতিতে আচ্ছন্ন ও অকার্যকর, বাম প্রগতিশীল শক্তি অস্তাচলে। যেটুকু কাজ হচ্ছে, তা শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী ও প্রগতি চেতনায় সমৃদ্ধ নির্দলীয় তরুণসমাজের মাধ্যমেই হচ্ছে। তাদের বিষয়ে উদাসীন থেকে ও তাদের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করে শেখ হাসিনার লক্ষ্য পূরণ সম্ভব কি না, সে বিষয়ে সংশয় প্রকাশ না করে পারা যায় না।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
সরকার গত বছরের নির্বাচনকালীন বিএনপি-জামায়াতের সহিংস আন্দোলন মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছিল। সেবারও কোনো ছাড় দেয়নি সরকার। এর আগের হেফাজতে ইসলামের অভাবিত বড় সমাবেশের সম্ভাব্য হুমকিও শক্ত হাতে সফলভাবে সামলেছিল। বোঝা যায়, সরকারের হাত আগের চেয়ে অনেক শক্তিশালী। বৈরী পরিস্থিতিতে টিকে থাকা, এমনকি এগিয়ে যাওয়ার শক্তি আওয়ামী লীগ অর্জন করেছে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। আওয়ামী লীগ পাকিস্তানি স্বৈরশাসন ও ব্যাপক নিপীড়ন এবং বাংলাদেশ আমলে জিয়া-এরশাদের মতো সামরিক শাসক ও ২০০১-২০০৬-এর বিএনপি শাসনের প্রচণ্ড চাপ সামলেছে ও সামনে এগিয়েছে মূলত সাংগঠনিক শক্তি ও নেতৃত্বের সঠিক কৌশলী চালে। পাকিস্তান আমলে দলের দীর্ঘ কঠিন সংগ্রামী ভূমিকায় নেতৃত্ব দিয়ে শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন দলের পরানেতা (আপার লিডার) আর বাংলাদেশ আমলে দলে শেখ হাসিনার অবস্থান এখন তা-ই। বলে রাখা প্রয়োজন, বিএনপিতে গঠনতান্ত্রিকভাবেই চেয়ারপারসন একজন সর্বশক্তিমান পরানেতা। শেখ মুজিব পরে জাতীয় নেতা, বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতায় উন্নীত হয়েছিলেন, শেখ হাসিনার সামনেও নতুন শতাব্দীতে নতুন বাংলাদেশের নির্মাতা হওয়ার সুযোগ এসেছে। সাধারণভাবে সংকট মোচন করে দেশকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ দুই নেত্রীর জন্যই খোলা ছিল, কিন্তু একের পর এক ভুল সিদ্ধান্তে বেগম জিয়া আপাতত পিছিয়ে পড়েছেন বলে মনে হয়। পরানেতার কর্তৃত্ব দল কিংবা দেশের গণতন্ত্রের জন্য অনুকূল হয় না, কিন্তু দীর্ঘদিন দারিদ্র্যের বৃত্তে আবদ্ধ জাতি উন্নয়নের বিনিময়ে অনুদার গণতন্ত্র ও কর্তৃত্ববাদী নেতৃত্বও মেনে নেয়। এমনটা আমরা মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুরে দেখেছি। এমনকি উদার গণতান্ত্রিক দেশেও এক দলের দীর্ঘ শাসনের নজির আছে, যেমন ভারত।
কেবল সরকারে থাকায় ক্ষমতার জোরে আওয়ামী লীগ বর্তমানে বিএনপি ও জামায়াতকে সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগ করতে পারছে ভাবলে ভুল হবে। বরং দেশের জঙ্গি ইসলামি শক্তিগুলোর প্রতি বিএনপির সহনশীল দুর্বলতা এর বড় কারণ। জামায়াত এ জোটের প্রধান দল নয়। অথচ দেখা যাচ্ছে জঙ্গি-সম্পৃক্ত যত নেতা-কর্মী ধরা পড়ছেন, তাঁদের উৎস এই দলটি। এ ছাড়া ক্ষমতায় থাকার সময় বেগম জিয়া জেএমবিসহ বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের নাশকতার প্রতি দুর্বলতা দেখিয়েছিলেন। বিএনপির এই জঙ্গি রাজনীতি বিরোধী নেতাদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যাঁরা নেত্রী কিংবা তাঁর প্রভাবশালী পুত্রকে বর্তমান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির হালচাল বুঝে দলের অবস্থান স্পষ্ট করা ও তা পাল্টানোর গুরুত্ব বুঝিয়ে বলবেন। উল্টো ক্রমাগত ভোঁতা অস্ত্র চালিয়ে তাঁরা হরতাল-অবরোধকে অকেজো করেছেন। পেট্রলবোমা কেবল দলের জন্য ঋণাত্মক হচ্ছে না, সরকারকে মাঠে মারমুখী ভূমিকায় নামতে সহায়তা করছে। তাদের আরও মনে রাখা দরকার, ক্ষমতায় বসে দলছুট ও নানা মতের লোক নিয়ে গঠিত পার্টি ক্ষমতার বাইরে বেশি দিন টেকে না, মুসলিম লীগও পারেনি—যদিও এই পক্ষে দেশে প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ নিশ্চিত ভোট রয়েছে। এভাবে সরকারকে ধ্বংস করতে গিয়ে বিএনপি না নিজের ধ্বংস ডেকে আনে, সেটাই শঙ্কার বিষয়। ইতিমধ্যেই তার পক্ষ নিয়ে রাজনীতির বাইরের শক্তিকে কাজে লাগানোর চিন্তাভাবনার প্রকাশও ঘটছে।
আপাতত শেখ হাসিনার অবস্থান শক্তই আছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সংকটের আবর্ত থেকে দেশকে বের করে আনা তাঁর পক্ষে সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে। এর কারণ, একদিকে সচেতন নাগরিকদের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব বেড়েছে আর অন্যদিকে জনগণ বর্তমানে রাজনীতির প্রতি বিমুখ, এমনকি রাজনীতি নিয়ে বিতৃষ্ণায় ভুগছে।
মনে হয়, শেখ হাসিনা বুদ্ধিজীবীদের কাছে—যাঁদের তিনি সুশীল সমাজ নামে বিদ্রূপ করে থাকেন—দুটি বিবেচনা প্রত্যাশা করেছিলেন। প্রথমত, তিনি আশা করেছিলেন তাঁরা জাতির পিতার—যিনি তাঁরও পিতা—হত্যাকারীদের পৃষ্ঠপোষকতাদানকারী ব্যক্তি অর্থাৎ জেনারেল জিয়া ও তাঁর উত্তরসূরিদের অন্যায়গুলো বিবেচনায় নিয়ে জাতীয় প্রয়োজন মাথায় রেখে তাঁর ভূমিকা বিচার করবেন এবং নিজেদের ভূমিকা নির্ধারণ করবেন। এ প্রত্যাশা অন্যায্য নয় এবং এটা বিবেকসম্মত কাজ, যা বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকে কাম্য।
দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা। এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই যে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নেতারা সেদিন হত্যার লক্ষ্যস্থল ছিলেন। এ ঘটনা নিয়ে তৎকালীন খালেদা জিয়া সরকারের ভূমিকায় অস্পষ্টতা ছিল এবং তারেক জিয়াসহ দলীয় নেতা ও আমলা-সমর্থকদের বেশ কয়েকজনের যোগসাজশ সম্পর্কে জোরালো সন্দেহের কারণ ঘটেছিল। দুটি ঘটনাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের ওপর বড় আঘাত হেনেছিল। কিন্তু বুদ্ধিজীবীদের প্রতিক্রিয়ায় ধারাবাহিকতার অভাব নিয়ে অভিযোগ উঠলে তা খারিজ করা মুশকিল। তবে বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়, ক্ষমতার রাজনীতির চাপান-উতোর রাজনীতিকে যে জায়গায় নিয়ে গেছে, সেখানে কি তাঁদের পক্ষে নিজ ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রেখে অংশীদার হওয়া সম্ভব? তেমন বাস্তবতা কি আছে? দেখা যাচ্ছে, যেসব বুদ্ধিজীবী নেত্রী ও আওয়ামী লীগকে সন্তুষ্ট করতে পেরেছেন, তাঁরা পরিস্থিতির কারণে আওয়ামী লীগের ধামাধরার অপবাদে চিহ্নিত হচ্ছেন। সামগ্রিকভাবে রাজনীতি ও সেই সঙ্গে তাঁর নিজের দলের এই অবক্ষয়কে বিশেষ বিবেচনায় না নিয়ে শেখ হাসিনা যেন নিজের দুটি উপলব্ধি থেকেই কাজ করে যাচ্ছেন: এক. তিনি বুঝেছেন ইতিহাসের দায় নিষ্পত্তির এবং ইতিহাস বিকৃতি রোধের কাজ তাঁকেই সম্পন্ন করতে হবে এবং দুই. বিএনপি-জামায়াত জোটকে সক্রিয় রেখে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিরাপদ হবে না।
আমার ধারণা, তাঁর এ দুটি উপলব্ধি ভুল নয়। কিন্তু দেশের বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে—তাঁর ভাষায় সুশীল সমাজ—দূরত্ব তৈরি করে কাজটা সম্পাদন করা, বলা যায়, একপ্রকার অসম্ভব। প্রথমত, তাঁর এই আকাঙ্ক্ষার মধ্যে রয়েছে সমাজের ও রাষ্ট্রের গুণগত রূপান্তরের চেতনা ও প্রণোদনা। যে কাজ গণসম্পৃক্তি ও গণজাগরণ ছাড়া সম্ভব নয়। আর তার সূচনাকারী হবেন রাজনীতিক নন, শিল্প-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীরা। বায়ান্ন থেকে পরবর্তী প্রতিটি আন্দোলনের ইতিহাস সেই সাক্ষ্য দেয়। বস্তুতপক্ষে পৃথিবীর কোনো দেশেই গুণগত রূপান্তরের ক্ষেত্রে এর অন্যথা হয়নি।
ফলে শেখ হাসিনা যদি মুক্তিযুদ্ধের আরব্ধ কাজ সম্পাদনের এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের চূড়ান্ত সংগ্রাম শুরু করে থাকেন, তাহলে তাঁকেই ভাবতে হবে এই ফাঁকটুকু তিনি কীভাবে পূরণ করবেন। তার আগে তাঁকে এ-ও মাথায় রাখতে হবে যে আজ ছাত্ররাজনীতি চূড়ান্ত অবক্ষয়ে সম্পূর্ণ অকার্যকর হয়ে পড়েছে, শ্রমিক রাজনীতি দুর্নীতিতে আচ্ছন্ন ও অকার্যকর, বাম প্রগতিশীল শক্তি অস্তাচলে। যেটুকু কাজ হচ্ছে, তা শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী ও প্রগতি চেতনায় সমৃদ্ধ নির্দলীয় তরুণসমাজের মাধ্যমেই হচ্ছে। তাদের বিষয়ে উদাসীন থেকে ও তাদের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করে শেখ হাসিনার লক্ষ্য পূরণ সম্ভব কি না, সে বিষয়ে সংশয় প্রকাশ না করে পারা যায় না।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
No comments