বিজ্ঞান চাই, বিজ্ঞানবাদিতা চাই না by ফরহাদ মজহার
আমরা
নিত্যদিন পৃথিবীকে সূর্যের চারদিকে ঘুরে আসতে দেখি; সূর্য পূব আকাশে ওঠে,
আর বিকালে পশ্চিমে ডুবে যায়। হ্যাঁ, ‘ডুবে’ যায়। বিকালে সূর্যের কী ঘটে তার
অভিজ্ঞতাটা কোনো কিছু পানিতে ডুবে যাওয়ার মতো। লাল হয়ে আছে সন্ধ্যার আকাশ,
আর দিগন্তরেখার নিচে ডুবে যাচ্ছে সূর্য! ডুবে যাওয়া কথাটা সূর্য সম্পর্কে
খাটে কিনা, তর্ক হতে পারে। কিন্তু অভিজ্ঞতার জগতে ‘ডোবা’ বা ‘ডুবে যাওয়া’
নামক একটা ব্যাপার আছে, যাকে বিকালে পশ্চিমাকাশে সূর্যের নিষ্ক্রান্ত হওয়ার
ঘটনাকে উপলব্ধি ও ব্যক্ত করতে আমরা ব্যবহার করি। বিজ্ঞান বলে, এটা ঠিক
নয়। সূর্য ডোবে না। আমরা পশ্চিমের কোনো দেশে গেলে দেখব সূর্য ডোবেনি। আরও
দূরে গেলে দেখব সূর্য সবে পুবাকাশ থেকে উদিত হচ্ছে। উড়োজাহাজে যারা নানান
দেশে ভ্রমণ করেন, তাদের এমন অভিজ্ঞতা হয় যে অনেক সময় প্লেনের সঙ্গে সঙ্গে
সূর্য চলছে, ঘড়িতে জানান দিচ্ছে বাংলাদেশে রাত; কিন্তু জাহাজের জানালা
খুললে রোদ। এ এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা!
কিন্তু একটা সময় ছিল যখন মানুষ এক দেশ থেকে আরেক দেশে এত সহজে যেতে পারত না। এমন মানুষ বাংলাদেশে এখনও সম্ভবত পাওয়া যাবে যারা নিজের গ্রাম থেকে বাইরের কোনো এলাকায় যায়নি। সূর্য না, বরং পৃথিবীটাই সূর্যের চারদিকে ঘোরে- বিজ্ঞানের এই সত্য আধুনিক মানুষের দাপট, আধিপত্য ও সাফল্যের কারণে সিধা সরল সাধারণ মানুষ মেনে নেয়। সূর্যসহ গ্রহ-নক্ষত্রের সঙ্গে শরীর ও জীবনের সম্পর্কজাত অভিজ্ঞতা ধীরে ধীর মানুষের জীবনে গৌণ হয়ে পড়ে। খাদ্যাভ্যাস, চাষাবাদের পদ্ধতি, প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিসহ সবকিছুতেই পরিবর্তন আসে। একটা সময় ছিল যখন প্রকৃতির নিয়মের মধ্যে নিজেকে বিলীন রাখার মধ্যে পরমার্থ খোঁজা হতো, সেই ভারকেন্দ্রচ্যুত হয়ে মানুষের সংকল্প হয়ে ওঠে প্রকৃতিকে জয় করা, প্রকৃতির ওপর মানুষের দখলদারি কায়েম করা। প্রকৃতি, পরিবেশ, প্রাণ ও প্রাণবৈচিত্র্যের বিনাশ সত্ত্বেও প্রকৃতির ওপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব কায়েমই আধুনিকতার পরমার্থ হয়ে উঠল। কিন্তু সূর্য পুবে ওঠা আর পশ্চিমে গমন বন্ধ হয় না। অন্তত আজ ২০১৫ সালের মার্চ মাসের ৬ তারিখেও সূর্য পুবেই উঠেছে এবং পশ্চিমের দিকে চলেছে তার রথ।
মানুষ তার দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় দেখে, বিজ্ঞানের বই যাই বলুক, সূর্যমামা পূব থেকে পশ্চিমে যাওয়া ত্যাগ তো করল না। সে সন্দিহান হয়ে পড়ে। তার অভিজ্ঞতার সঙ্গে বিজ্ঞানের দাবি মেলে না। এই অসঙ্গতি অনেকের সারা জীবন থেকে যায়। সূর্য ডোবে, রাত আসে। যেসব শিক্ষিত মানুষ বিজ্ঞানের কথা বলে, তারাও প্রাচীন অভিজ্ঞতাকে ত্যাগ করার কথা বলে না। সূর্য ডুবুক না ডুবুক, যে প্রাচীন সূর্য নিত্যদিন পশ্চিমাকাশে ডোবে, শিক্ষিত ও সভ্য মানুষ তার জন্য লেখা রবীন্দ্রসঙ্গীতও গায় : পাখি এলো ফিরে, তরী এলো তীরে...। ইত্যাদি। সেই নদী নাই, সেই তরী নাই, সেই সব পাখিও প্রায় বিলুপ্ত; কিন্তু বিজ্ঞানের অভিজ্ঞতার বাইরে আমাদের নিত্যদিনের যে অভিজ্ঞতার সত্য, তার শক্তি এত প্রবল যে, এ ধরনের গান কাষ্ঠবৎ বিজ্ঞানীকেও আপ্লুত করে। কারণ মানুষ বিচিত্র!
বিজ্ঞানীও সূর্য ডোবে না জানেন; কিন্তু রাতে জেগে থাকেন না, বিছানায় ঠিকই ঘুমাতে যান, অবশ্য ইনসমনিয়া থাকলে ভিন্ন কথা। বিজ্ঞানীর দিনের পরিকল্পনা সকালের সূর্য মেপে, ঘড়ি ধরেই চলে। রাতদিনের অভিজ্ঞতার যে দৈনন্দিন সত্য তার রেজিস্টার আলাদা, বিজ্ঞানের হিসাব ভিন্ন। বিজ্ঞানের দাবির কারণে মানুষের নিত্যদিনের অভিজ্ঞতা বিজ্ঞানীর জীবন থেকে উবে যায় না। সেটা পুরোমাত্রায় হাজির থাকে। মানুষ রক্তমাংসের তৈরি, আর ভাগ্য ভালো যে তার সারপদার্থ শুধু বুদ্ধি বা বিজ্ঞানভাবনা নয়। মানুষের মধ্যে বুদ্ধির কুঠুরি যেমন আছে, তেমনি আছে আরও সাত কুঠুরি ও নয় দরোজা। বুদ্ধি নিয়ে আট কোঠা। আক্ষরিকভাবে কথাগুলো বোঝার দরকার নাই, এর চিন্তাশীল ইঙ্গিতটুকু অসামান্য। অর্থাৎ মানুষ একটা মাত্র কুঠুরি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না, বাঁচেও না। মানুষের তাই রয়েছে বুদ্ধির অতীত বিষয় নিয়ে ভাবার, কল্পনা করার, বাস্তব/অবাস্তব নানান আকাক্সক্ষা জপার ও অন্যদের মধ্যে তা সঞ্চারিত করানোর অসাধারণ ক্ষমতা। যারা নদিয়ার ভাবের সঙ্গে পরিচিত, তারা এই দোলে ফকির লালন শাহের ‘আট কুঠুরি নয় দরজা আঁটা/ মধ্যে মধ্যে ঝরকা কাটা/ তার ওপরে সদর কোঠা আয়না মহল তায়/ কমনে আসে যায়...!- গানটি এখন মানুষ ভজনা করার কর্তব্য পালনের আনন্দে গাইতে পারেন।
আধুনিক মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি হচ্ছে সে তার মিথ বা পুরাণকে হত্যা করেছে। এবং নিত্যদিন নিজেকেই নিজে সে শহীদ করে, নিজেই সে জানে না। রক্তে তার শরীর ভিজে যায়। কিশোরকালে নোয়াখালীর মতো একটি মফস্বল শহরে পুরাণের দেবতা সূর্যের যে কাহিনী শুনেছি, আজও কল্পনায় তা ভেসে উঠলে এক বিশাল জগৎ সামনে এসে দাঁড়ায়। ভালো লাগত ভাবতে যে সূর্যের চুল আর হাত সোনার। তাই তার আলো থেকে সোনা ঠিকরে পড়ে। সূর্য দেবতা; কিন্তু তিনিই একমাত্র দেবতা যিনি প্রত্যহ মানুষের চোখের সামনে দেখা দিয়ে থাকেন এবং তিনি দেখা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে জগৎ উদ্ভাসিত হয়। তিনি রোববারের অধিকর্তা, শিবের স্বরূপ ও বিষ্ণুভক্তদের নারায়ণ। তিনি ইন্দ্রের কিংবা মতান্তরে কশ্যপ ও অদিতির পুত্র। তার সঙ্গিনী বা বউ চারজন- সরন্যু, রাজ্ঞী, ছায়া ও প্রভা। তিনি তার সাত ঘোড়ার রথে করে প্রতিদিন আকাশ দিয়ে ছুটে বেড়ান এবং সন্ধ্যাবেলায় স্বর্গে ফিরে আসেন। এই হল পৃথিবীতে দিন-রাত্রির কারণ।
কিছু কী আসে যায় এটা বিজ্ঞানের সত্য কিনা? ঠিক আছে, বিজ্ঞান থেকে জানলাম, সূর্য হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র। পৃথিবীর চেয়ে প্রায় ১০৯ গুণ বড়। হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম ভর্তি এক গ্যাসের বিশাল ফুটবল যার তাপমাত্রা প্রায় ৫০০০ ডিগ্রি সে.। এই নক্ষত্রটিকে কেন্দ্র করেই পৃথিবী ২৯.৭৮৩/সে. গতিতে ঘুরছে। জানলাম, এবং মানলামও। অসুবিধা তো নাই। কিন্তু পুরাণ, কল্পনা ও সংকল্পের ভূমিকা আর কোনো কিছু জানার ভূমিকা তো এক নয়।
বিজ্ঞান যদি তার নিজের জগতে বিরাজ করে, তাহলে এখানে কোনো দ্বন্দ্ব তৈরির কারণ ঘটে না। কিন্তু বিজ্ঞান যদি বলে, পুরাণ বা মানুষের মিথ বা কল্পনার জগৎ স্রেফ কুসংস্কার, সূর্যের আবার ঘোড়া কী? তার আবার চার সঙ্গিনী কোথা থেকে? তার আবার রথ কিসের? ছাড়ো এসব অবৈজ্ঞানিক চিন্তা; মানুষের প্রগতি মানে মিথ, কল্পনা ও কুসংস্কার থেকে মুক্তি। যদি বিজ্ঞান দাবি করে, আমাদের কল্পনা ও চিন্তাশক্তি বাদ দিয়ে শুধু বিজ্ঞানকেই বিশ্বাস করতে হবে, আর কিছুকে না, তারপর বিজ্ঞান দিন আর রাত্রি কেন হয় তার বৈজ্ঞানিক কারণ ব্যাখ্যা করল। এমনভাবে ব্যাখ্যা করল যেন আমাদের মাথা ধোলাই হয়ে পারফেক্ট বৈজ্ঞানিক মস্তিষ্কে পরিণত হয়; আমরা চিরকালের জন্য সূর্যের সোনার রথ দেখা ভুলে গেলাম। ভয়ে এসব গল্প কাউকে বলারই আর সাহস পেলাম না। কতো সহজে আমাদের কৈশোর বিজ্ঞানের হাতে নিহত হয়েছে। কতো কিশোর-কিশোরী বিজ্ঞানের নামে শহীদ হচ্ছে প্রতিদিন- কে তার খবর রাখে? তারপর সমাজে যখন এই হতাহতের ঘটনা ভিন্ন এক ব্যাধি হিসেবে ধরা পড়ে, ততদিনে দেরি হয়ে যায়।
বিজ্ঞানের এই সন্ত্রাস ভয়ানক। বিজ্ঞানের সম্ভাবনা বা অর্জন এখানে তর্কের বিষয় নয়। অবশ্যই বিজ্ঞান মানবেতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। এই সন্ত্রাস বিজ্ঞানের সম্ভাবনা বা অর্জনের কারণে ঘটে না। বরং সেটা ঘটে বিজ্ঞানবাদিতার কারণে। বিজ্ঞানবাদিতা একটি মতাদর্শ। এই মতাদর্শ দাবি করে, আমাদের অন্য কোনো বৃত্তির দরকার নাই। সত্য নির্ণয়ের একটাই মানদণ্ড, সেটা হচ্ছে বিজ্ঞান। শুধু বিজ্ঞান অতএব আমাদের চিন্তা ও চেতনা অধিকার করে রাখুক। আমাদের সমাজ, নীতিনৈতিকতা, রাষ্ট্রনীতি সব বিজ্ঞান দ্বারা ঠিক হোক।
বিজ্ঞানবাদিতার নানান রূপ আছে। রূপভেদে তার ক্ষতির মাত্রাও ভিন্ন। তার কারণেই এই বিপদ ঘটে। বিজ্ঞানের প্রধান চরিত্র হচ্ছে প্রত্যক্ষ অন্বেষণ ও অভিজ্ঞতার আলোকে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যকে জানা। তার ডমেইন বা সীমানা চিহ্নিত ও নির্দিষ্ট। কিন্তু বিজ্ঞানবাদিতা হচ্ছে এমন এক ব্যাধি যা মানুষের সব বৃত্তিকে নির্বিচারে বিজ্ঞানের অধিকারে ও দখলে নিয়ে আসতে চায়। যেমন ঈশ্বর আছেন কী নাই সেটাও বিজ্ঞানবাদীরা তাদের ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে প্রমাণ করতে চায়। যখন পায় না, তখন নাই বলে ফতোয়া দেয়। যা বিজ্ঞানের অধীনস্থ করা সম্ভব না, তাকে অজ্ঞানতা, কুসংস্কার, পশ্চাৎপদতা ইত্যাদি বলে বাতিল করে দেয়। মানুষের অপরাপর বৃত্তি- যাকে গণিত, ফর্মাল সিস্টেম কিংবা কোনো ল্যাবরেটরির পরীক্ষা-নিরীক্ষার অধীনস্থ করা যায় না, সম্ভবও নয়, তাকে জ্ঞান কিংবা বিজ্ঞানবাদিতা নষ্ট করে। আমাদের কল্পনাশক্তি ক্ষয়ে যায়, যান্ত্রিক বা বিধিবদ্ধ চিন্তার বাইরে সৃষ্টিশীল চিন্তার চর্চা রুগ্ন হয়ে পড়ে। আমরা কল্পনা করতে ভুলে যাই, আমরা যান্ত্রিক বিধিবিধানের বাইরে আর ভবিষ্যৎ দেখি না। সবকিছুই গণিত ও যন্ত্রের নিয়মে চলে।
মানুষ নিজের এই রক্তপাত দীর্ঘকাল ধরেই দেখছে এবং ফিরে আসছে আবার নিজের পূর্ণতার আস্বাদনের তাগিদে। না, বিজ্ঞানকে অস্বীকার করে নয়; কিন্তু বিজ্ঞানসর্বস্ব আর অতিশয় বুদ্ধিমান হওয়ার ভুল শুধরে। এ কারণে সেই বুদ্ধিকেই একালে ‘মুক্তবুদ্ধি’ বলা হয়, যে বুদ্ধি বুদ্ধিসর্বস্বতার সীমা সম্পর্কে হুঁশিয়ার থাকে। বিজ্ঞানবাদিতা পরিহার করা এবং যুক্তি ও বিজ্ঞানের সীমা সম্পর্কে হুঁশে থাকাটাই মুক্তবুদ্ধির চর্চা। মানুষকে একটা খোপের মধ্যে পুরে ফেলা অজ্ঞতা তো বটেই, বরং চরম একটি কুসংস্কার ও অতিশয় বদ্ধ চিন্তার ফল, যা এই আধুনিককালে রীতিমতো অসুখ হিসেবে দেখা দিয়েছে এবং প্রজাতি হিসেবে মানুষের ধ্বংসের কারণ হয়ে উঠেছে। প্রকৃতি ও মানুষের সমূহ অর্জনের জন্য এই ভয়াবহ বিপদ সম্পর্কে মানুষ গত শতক থেকেই সচেতন হতে শুরু করেছে। একালে পরিবেশ, প্রাণ ও প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষার আন্দোলন প্রধানত এই উপলব্ধি থেকেই গড়ে উঠেছে। বিজ্ঞান পর্যালোচনা বিজ্ঞান, দর্শন ও রাজনীতি মানুষের এই তিন শাখার জন্য অতি আবশ্যিক ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। বিজ্ঞান এখন আরও নিবিড়ভাবে পর্যালোচনার অধীন, কারণ একালের বিজ্ঞান নির্দোষ চর্চা নয়। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে কর্পোরেট স্বার্থ, বহুজাতিক কোম্পানির মুনাফা, যুদ্ধকৌশল ও প্রযুক্তি।
এটাও একালে দর্শনের কাছে অনেক পরিচ্ছন্ন হয়ে উঠেছে যে, মানুষের চিন্তাশীলতার অর্থ যুক্তিবাদিতা নয়। যুক্তি দিয়ে বড়জোর ফর্মাল সিস্টেম গড়া যায়। সেই সিস্টেম আমরা যেসব এক্সিয়ম সরবরাহ করি, সেই সরবরাহ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত তৈরি করতে পারে। কিন্তু সিস্টেম নিজে সেই এক্সিয়ম ঠিক নাকি বেঠিক সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। কুর্ট গোডেলের (১৯০৬-১৯৭৮) ইনকমপ্লিটনেস থিওরম গত শতকের ত্রিশ দশকে আবিষ্কৃত হওয়ার পর যুক্তি, গণিত ও বুদ্ধির সীমা বিজ্ঞানের নিজেরও জানা হয়ে গেছে। এতে বিজ্ঞান ছোট হয়ে যায়নি। কিন্তু বিজ্ঞান যা না, নিজেকে সেভাবে হাজির করার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অস্বস্তি বেড়েছে। বিজ্ঞানের যে অহংকার উনবিংশ ও বিংশ শতকে মহামারীর মতো দেখা গিয়েছিল, বিশ শতকের শেষের দিকে তার তেজ কমতে শুরু করে। বিজ্ঞান নিজেই উপলব্ধি ও বুঝতে শুরু করে যে, বিজ্ঞান সার্বভৌম সত্য প্রকাশক নয়। আর ‘সত্য’ নিজেও এমন একটি ধারণা, যা এখনও দর্শনে তর্কাধীন। নিজেই বিজ্ঞান উপলব্ধি করতে শিখেছে যে, দেশকালের অধীন ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ বিষয় নিয়ে বিজ্ঞানের কারবার, হোক তা দ্বিমাত্রিক, ত্রিমাত্রিক, চার কিংবা তারও অধিক। কিন্তু তার বাইরেও জগত আছে, তার বাইরেও বিষয় আছে, মানুষ যেসব বিষয়ে ভাবতে সক্ষম। বিজ্ঞান যেখানে যায় না বা যেতে পারে না; কিন্তু মানুষের কল্পনা ও চিন্তার শক্তি সেখানে যেতে পারে, মানুষ দেশকালে সীমিত হয়েও অসীমকে তার চিন্তা, ভাব, কল্পনা ও সংকল্পের বিষয়ে পরিণত করতে পারে। নইলে শিল্প-সাহিত্য থাকে না, দর্শনের সমুদ্র শুকিয়ে যায় এবং নতুন জগতের কল্পনায় বিদ্যমান ব্যবস্থার রূপান্তর ঘটানোর জন্য বিপ্লবও অসম্ভব হয়ে পড়ে। যে সত্য নির্ণয়ের পদ্ধতি বিজ্ঞানের অজানা, সেই সত্য প্রতিষ্ঠা করার দাবি সত্যিকারের বিজ্ঞানীরা এখন আর করেন না। কিন্তু পৃথিবীতে সব সময়ই আহাম্মকেরা ছিল এবং তাদের সংখ্যাও কম নয় যারা নিজেদের বিজ্ঞানী বলে পরিচয় দেয়াকে অভিজাত ব্যাপার বলে গণ্য করে। সত্য ও আভিজাত্যের দাবি তখন একাকার হয়ে যায়।
বিজ্ঞান চাই, কিন্তু বিজ্ঞানবাদিতা চাই না। বুদ্ধি চাই, কিন্তু বুদ্ধিসর্বস্বতা নয়; কারণ অতি বুদ্ধি আমাদের বুদ্ধিমান নয়, আহাম্মকে পরিণত করে। অতি বুদ্ধির গলায় দড়ি কথাটা বোধ হয় এ কারণেই আমরা বলি।
২২ ফাল্গুন ১৪২১/ ৬ মার্চ ২০১৫, শ্যামলী।
কিন্তু একটা সময় ছিল যখন মানুষ এক দেশ থেকে আরেক দেশে এত সহজে যেতে পারত না। এমন মানুষ বাংলাদেশে এখনও সম্ভবত পাওয়া যাবে যারা নিজের গ্রাম থেকে বাইরের কোনো এলাকায় যায়নি। সূর্য না, বরং পৃথিবীটাই সূর্যের চারদিকে ঘোরে- বিজ্ঞানের এই সত্য আধুনিক মানুষের দাপট, আধিপত্য ও সাফল্যের কারণে সিধা সরল সাধারণ মানুষ মেনে নেয়। সূর্যসহ গ্রহ-নক্ষত্রের সঙ্গে শরীর ও জীবনের সম্পর্কজাত অভিজ্ঞতা ধীরে ধীর মানুষের জীবনে গৌণ হয়ে পড়ে। খাদ্যাভ্যাস, চাষাবাদের পদ্ধতি, প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিসহ সবকিছুতেই পরিবর্তন আসে। একটা সময় ছিল যখন প্রকৃতির নিয়মের মধ্যে নিজেকে বিলীন রাখার মধ্যে পরমার্থ খোঁজা হতো, সেই ভারকেন্দ্রচ্যুত হয়ে মানুষের সংকল্প হয়ে ওঠে প্রকৃতিকে জয় করা, প্রকৃতির ওপর মানুষের দখলদারি কায়েম করা। প্রকৃতি, পরিবেশ, প্রাণ ও প্রাণবৈচিত্র্যের বিনাশ সত্ত্বেও প্রকৃতির ওপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব কায়েমই আধুনিকতার পরমার্থ হয়ে উঠল। কিন্তু সূর্য পুবে ওঠা আর পশ্চিমে গমন বন্ধ হয় না। অন্তত আজ ২০১৫ সালের মার্চ মাসের ৬ তারিখেও সূর্য পুবেই উঠেছে এবং পশ্চিমের দিকে চলেছে তার রথ।
মানুষ তার দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় দেখে, বিজ্ঞানের বই যাই বলুক, সূর্যমামা পূব থেকে পশ্চিমে যাওয়া ত্যাগ তো করল না। সে সন্দিহান হয়ে পড়ে। তার অভিজ্ঞতার সঙ্গে বিজ্ঞানের দাবি মেলে না। এই অসঙ্গতি অনেকের সারা জীবন থেকে যায়। সূর্য ডোবে, রাত আসে। যেসব শিক্ষিত মানুষ বিজ্ঞানের কথা বলে, তারাও প্রাচীন অভিজ্ঞতাকে ত্যাগ করার কথা বলে না। সূর্য ডুবুক না ডুবুক, যে প্রাচীন সূর্য নিত্যদিন পশ্চিমাকাশে ডোবে, শিক্ষিত ও সভ্য মানুষ তার জন্য লেখা রবীন্দ্রসঙ্গীতও গায় : পাখি এলো ফিরে, তরী এলো তীরে...। ইত্যাদি। সেই নদী নাই, সেই তরী নাই, সেই সব পাখিও প্রায় বিলুপ্ত; কিন্তু বিজ্ঞানের অভিজ্ঞতার বাইরে আমাদের নিত্যদিনের যে অভিজ্ঞতার সত্য, তার শক্তি এত প্রবল যে, এ ধরনের গান কাষ্ঠবৎ বিজ্ঞানীকেও আপ্লুত করে। কারণ মানুষ বিচিত্র!
বিজ্ঞানীও সূর্য ডোবে না জানেন; কিন্তু রাতে জেগে থাকেন না, বিছানায় ঠিকই ঘুমাতে যান, অবশ্য ইনসমনিয়া থাকলে ভিন্ন কথা। বিজ্ঞানীর দিনের পরিকল্পনা সকালের সূর্য মেপে, ঘড়ি ধরেই চলে। রাতদিনের অভিজ্ঞতার যে দৈনন্দিন সত্য তার রেজিস্টার আলাদা, বিজ্ঞানের হিসাব ভিন্ন। বিজ্ঞানের দাবির কারণে মানুষের নিত্যদিনের অভিজ্ঞতা বিজ্ঞানীর জীবন থেকে উবে যায় না। সেটা পুরোমাত্রায় হাজির থাকে। মানুষ রক্তমাংসের তৈরি, আর ভাগ্য ভালো যে তার সারপদার্থ শুধু বুদ্ধি বা বিজ্ঞানভাবনা নয়। মানুষের মধ্যে বুদ্ধির কুঠুরি যেমন আছে, তেমনি আছে আরও সাত কুঠুরি ও নয় দরোজা। বুদ্ধি নিয়ে আট কোঠা। আক্ষরিকভাবে কথাগুলো বোঝার দরকার নাই, এর চিন্তাশীল ইঙ্গিতটুকু অসামান্য। অর্থাৎ মানুষ একটা মাত্র কুঠুরি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না, বাঁচেও না। মানুষের তাই রয়েছে বুদ্ধির অতীত বিষয় নিয়ে ভাবার, কল্পনা করার, বাস্তব/অবাস্তব নানান আকাক্সক্ষা জপার ও অন্যদের মধ্যে তা সঞ্চারিত করানোর অসাধারণ ক্ষমতা। যারা নদিয়ার ভাবের সঙ্গে পরিচিত, তারা এই দোলে ফকির লালন শাহের ‘আট কুঠুরি নয় দরজা আঁটা/ মধ্যে মধ্যে ঝরকা কাটা/ তার ওপরে সদর কোঠা আয়না মহল তায়/ কমনে আসে যায়...!- গানটি এখন মানুষ ভজনা করার কর্তব্য পালনের আনন্দে গাইতে পারেন।
আধুনিক মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি হচ্ছে সে তার মিথ বা পুরাণকে হত্যা করেছে। এবং নিত্যদিন নিজেকেই নিজে সে শহীদ করে, নিজেই সে জানে না। রক্তে তার শরীর ভিজে যায়। কিশোরকালে নোয়াখালীর মতো একটি মফস্বল শহরে পুরাণের দেবতা সূর্যের যে কাহিনী শুনেছি, আজও কল্পনায় তা ভেসে উঠলে এক বিশাল জগৎ সামনে এসে দাঁড়ায়। ভালো লাগত ভাবতে যে সূর্যের চুল আর হাত সোনার। তাই তার আলো থেকে সোনা ঠিকরে পড়ে। সূর্য দেবতা; কিন্তু তিনিই একমাত্র দেবতা যিনি প্রত্যহ মানুষের চোখের সামনে দেখা দিয়ে থাকেন এবং তিনি দেখা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে জগৎ উদ্ভাসিত হয়। তিনি রোববারের অধিকর্তা, শিবের স্বরূপ ও বিষ্ণুভক্তদের নারায়ণ। তিনি ইন্দ্রের কিংবা মতান্তরে কশ্যপ ও অদিতির পুত্র। তার সঙ্গিনী বা বউ চারজন- সরন্যু, রাজ্ঞী, ছায়া ও প্রভা। তিনি তার সাত ঘোড়ার রথে করে প্রতিদিন আকাশ দিয়ে ছুটে বেড়ান এবং সন্ধ্যাবেলায় স্বর্গে ফিরে আসেন। এই হল পৃথিবীতে দিন-রাত্রির কারণ।
কিছু কী আসে যায় এটা বিজ্ঞানের সত্য কিনা? ঠিক আছে, বিজ্ঞান থেকে জানলাম, সূর্য হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র। পৃথিবীর চেয়ে প্রায় ১০৯ গুণ বড়। হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম ভর্তি এক গ্যাসের বিশাল ফুটবল যার তাপমাত্রা প্রায় ৫০০০ ডিগ্রি সে.। এই নক্ষত্রটিকে কেন্দ্র করেই পৃথিবী ২৯.৭৮৩/সে. গতিতে ঘুরছে। জানলাম, এবং মানলামও। অসুবিধা তো নাই। কিন্তু পুরাণ, কল্পনা ও সংকল্পের ভূমিকা আর কোনো কিছু জানার ভূমিকা তো এক নয়।
বিজ্ঞান যদি তার নিজের জগতে বিরাজ করে, তাহলে এখানে কোনো দ্বন্দ্ব তৈরির কারণ ঘটে না। কিন্তু বিজ্ঞান যদি বলে, পুরাণ বা মানুষের মিথ বা কল্পনার জগৎ স্রেফ কুসংস্কার, সূর্যের আবার ঘোড়া কী? তার আবার চার সঙ্গিনী কোথা থেকে? তার আবার রথ কিসের? ছাড়ো এসব অবৈজ্ঞানিক চিন্তা; মানুষের প্রগতি মানে মিথ, কল্পনা ও কুসংস্কার থেকে মুক্তি। যদি বিজ্ঞান দাবি করে, আমাদের কল্পনা ও চিন্তাশক্তি বাদ দিয়ে শুধু বিজ্ঞানকেই বিশ্বাস করতে হবে, আর কিছুকে না, তারপর বিজ্ঞান দিন আর রাত্রি কেন হয় তার বৈজ্ঞানিক কারণ ব্যাখ্যা করল। এমনভাবে ব্যাখ্যা করল যেন আমাদের মাথা ধোলাই হয়ে পারফেক্ট বৈজ্ঞানিক মস্তিষ্কে পরিণত হয়; আমরা চিরকালের জন্য সূর্যের সোনার রথ দেখা ভুলে গেলাম। ভয়ে এসব গল্প কাউকে বলারই আর সাহস পেলাম না। কতো সহজে আমাদের কৈশোর বিজ্ঞানের হাতে নিহত হয়েছে। কতো কিশোর-কিশোরী বিজ্ঞানের নামে শহীদ হচ্ছে প্রতিদিন- কে তার খবর রাখে? তারপর সমাজে যখন এই হতাহতের ঘটনা ভিন্ন এক ব্যাধি হিসেবে ধরা পড়ে, ততদিনে দেরি হয়ে যায়।
বিজ্ঞানের এই সন্ত্রাস ভয়ানক। বিজ্ঞানের সম্ভাবনা বা অর্জন এখানে তর্কের বিষয় নয়। অবশ্যই বিজ্ঞান মানবেতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। এই সন্ত্রাস বিজ্ঞানের সম্ভাবনা বা অর্জনের কারণে ঘটে না। বরং সেটা ঘটে বিজ্ঞানবাদিতার কারণে। বিজ্ঞানবাদিতা একটি মতাদর্শ। এই মতাদর্শ দাবি করে, আমাদের অন্য কোনো বৃত্তির দরকার নাই। সত্য নির্ণয়ের একটাই মানদণ্ড, সেটা হচ্ছে বিজ্ঞান। শুধু বিজ্ঞান অতএব আমাদের চিন্তা ও চেতনা অধিকার করে রাখুক। আমাদের সমাজ, নীতিনৈতিকতা, রাষ্ট্রনীতি সব বিজ্ঞান দ্বারা ঠিক হোক।
বিজ্ঞানবাদিতার নানান রূপ আছে। রূপভেদে তার ক্ষতির মাত্রাও ভিন্ন। তার কারণেই এই বিপদ ঘটে। বিজ্ঞানের প্রধান চরিত্র হচ্ছে প্রত্যক্ষ অন্বেষণ ও অভিজ্ঞতার আলোকে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যকে জানা। তার ডমেইন বা সীমানা চিহ্নিত ও নির্দিষ্ট। কিন্তু বিজ্ঞানবাদিতা হচ্ছে এমন এক ব্যাধি যা মানুষের সব বৃত্তিকে নির্বিচারে বিজ্ঞানের অধিকারে ও দখলে নিয়ে আসতে চায়। যেমন ঈশ্বর আছেন কী নাই সেটাও বিজ্ঞানবাদীরা তাদের ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে প্রমাণ করতে চায়। যখন পায় না, তখন নাই বলে ফতোয়া দেয়। যা বিজ্ঞানের অধীনস্থ করা সম্ভব না, তাকে অজ্ঞানতা, কুসংস্কার, পশ্চাৎপদতা ইত্যাদি বলে বাতিল করে দেয়। মানুষের অপরাপর বৃত্তি- যাকে গণিত, ফর্মাল সিস্টেম কিংবা কোনো ল্যাবরেটরির পরীক্ষা-নিরীক্ষার অধীনস্থ করা যায় না, সম্ভবও নয়, তাকে জ্ঞান কিংবা বিজ্ঞানবাদিতা নষ্ট করে। আমাদের কল্পনাশক্তি ক্ষয়ে যায়, যান্ত্রিক বা বিধিবদ্ধ চিন্তার বাইরে সৃষ্টিশীল চিন্তার চর্চা রুগ্ন হয়ে পড়ে। আমরা কল্পনা করতে ভুলে যাই, আমরা যান্ত্রিক বিধিবিধানের বাইরে আর ভবিষ্যৎ দেখি না। সবকিছুই গণিত ও যন্ত্রের নিয়মে চলে।
মানুষ নিজের এই রক্তপাত দীর্ঘকাল ধরেই দেখছে এবং ফিরে আসছে আবার নিজের পূর্ণতার আস্বাদনের তাগিদে। না, বিজ্ঞানকে অস্বীকার করে নয়; কিন্তু বিজ্ঞানসর্বস্ব আর অতিশয় বুদ্ধিমান হওয়ার ভুল শুধরে। এ কারণে সেই বুদ্ধিকেই একালে ‘মুক্তবুদ্ধি’ বলা হয়, যে বুদ্ধি বুদ্ধিসর্বস্বতার সীমা সম্পর্কে হুঁশিয়ার থাকে। বিজ্ঞানবাদিতা পরিহার করা এবং যুক্তি ও বিজ্ঞানের সীমা সম্পর্কে হুঁশে থাকাটাই মুক্তবুদ্ধির চর্চা। মানুষকে একটা খোপের মধ্যে পুরে ফেলা অজ্ঞতা তো বটেই, বরং চরম একটি কুসংস্কার ও অতিশয় বদ্ধ চিন্তার ফল, যা এই আধুনিককালে রীতিমতো অসুখ হিসেবে দেখা দিয়েছে এবং প্রজাতি হিসেবে মানুষের ধ্বংসের কারণ হয়ে উঠেছে। প্রকৃতি ও মানুষের সমূহ অর্জনের জন্য এই ভয়াবহ বিপদ সম্পর্কে মানুষ গত শতক থেকেই সচেতন হতে শুরু করেছে। একালে পরিবেশ, প্রাণ ও প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষার আন্দোলন প্রধানত এই উপলব্ধি থেকেই গড়ে উঠেছে। বিজ্ঞান পর্যালোচনা বিজ্ঞান, দর্শন ও রাজনীতি মানুষের এই তিন শাখার জন্য অতি আবশ্যিক ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। বিজ্ঞান এখন আরও নিবিড়ভাবে পর্যালোচনার অধীন, কারণ একালের বিজ্ঞান নির্দোষ চর্চা নয়। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে কর্পোরেট স্বার্থ, বহুজাতিক কোম্পানির মুনাফা, যুদ্ধকৌশল ও প্রযুক্তি।
এটাও একালে দর্শনের কাছে অনেক পরিচ্ছন্ন হয়ে উঠেছে যে, মানুষের চিন্তাশীলতার অর্থ যুক্তিবাদিতা নয়। যুক্তি দিয়ে বড়জোর ফর্মাল সিস্টেম গড়া যায়। সেই সিস্টেম আমরা যেসব এক্সিয়ম সরবরাহ করি, সেই সরবরাহ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত তৈরি করতে পারে। কিন্তু সিস্টেম নিজে সেই এক্সিয়ম ঠিক নাকি বেঠিক সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। কুর্ট গোডেলের (১৯০৬-১৯৭৮) ইনকমপ্লিটনেস থিওরম গত শতকের ত্রিশ দশকে আবিষ্কৃত হওয়ার পর যুক্তি, গণিত ও বুদ্ধির সীমা বিজ্ঞানের নিজেরও জানা হয়ে গেছে। এতে বিজ্ঞান ছোট হয়ে যায়নি। কিন্তু বিজ্ঞান যা না, নিজেকে সেভাবে হাজির করার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অস্বস্তি বেড়েছে। বিজ্ঞানের যে অহংকার উনবিংশ ও বিংশ শতকে মহামারীর মতো দেখা গিয়েছিল, বিশ শতকের শেষের দিকে তার তেজ কমতে শুরু করে। বিজ্ঞান নিজেই উপলব্ধি ও বুঝতে শুরু করে যে, বিজ্ঞান সার্বভৌম সত্য প্রকাশক নয়। আর ‘সত্য’ নিজেও এমন একটি ধারণা, যা এখনও দর্শনে তর্কাধীন। নিজেই বিজ্ঞান উপলব্ধি করতে শিখেছে যে, দেশকালের অধীন ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ বিষয় নিয়ে বিজ্ঞানের কারবার, হোক তা দ্বিমাত্রিক, ত্রিমাত্রিক, চার কিংবা তারও অধিক। কিন্তু তার বাইরেও জগত আছে, তার বাইরেও বিষয় আছে, মানুষ যেসব বিষয়ে ভাবতে সক্ষম। বিজ্ঞান যেখানে যায় না বা যেতে পারে না; কিন্তু মানুষের কল্পনা ও চিন্তার শক্তি সেখানে যেতে পারে, মানুষ দেশকালে সীমিত হয়েও অসীমকে তার চিন্তা, ভাব, কল্পনা ও সংকল্পের বিষয়ে পরিণত করতে পারে। নইলে শিল্প-সাহিত্য থাকে না, দর্শনের সমুদ্র শুকিয়ে যায় এবং নতুন জগতের কল্পনায় বিদ্যমান ব্যবস্থার রূপান্তর ঘটানোর জন্য বিপ্লবও অসম্ভব হয়ে পড়ে। যে সত্য নির্ণয়ের পদ্ধতি বিজ্ঞানের অজানা, সেই সত্য প্রতিষ্ঠা করার দাবি সত্যিকারের বিজ্ঞানীরা এখন আর করেন না। কিন্তু পৃথিবীতে সব সময়ই আহাম্মকেরা ছিল এবং তাদের সংখ্যাও কম নয় যারা নিজেদের বিজ্ঞানী বলে পরিচয় দেয়াকে অভিজাত ব্যাপার বলে গণ্য করে। সত্য ও আভিজাত্যের দাবি তখন একাকার হয়ে যায়।
বিজ্ঞান চাই, কিন্তু বিজ্ঞানবাদিতা চাই না। বুদ্ধি চাই, কিন্তু বুদ্ধিসর্বস্বতা নয়; কারণ অতি বুদ্ধি আমাদের বুদ্ধিমান নয়, আহাম্মকে পরিণত করে। অতি বুদ্ধির গলায় দড়ি কথাটা বোধ হয় এ কারণেই আমরা বলি।
২২ ফাল্গুন ১৪২১/ ৬ মার্চ ২০১৫, শ্যামলী।
No comments