পাকিস্তানি মডেল রুখতেই সংলাপ দরকার by মইনুল ইসলাম
গত
২২ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজধানীর খামারবাড়িতে প্রদত্ত
এক বক্তব্যে বিএনপির নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি সরাসরি সাবধানবাণী
উচ্চারণ করলেন, ‘উত্তরপাড়ার দিকে তাকিয়ে থেকে লাভ নেই’। এ সম্পর্কে
খোলামেলা আরও অনেক মন্তব্য করেছেন তিনি। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী মোতাবেক
ভবিষ্যতে কেউ অসাংবিধানিক পথে ক্ষমতা দখল করলে তাঁর ‘ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট’
হয়ে যাবে, তা-ও মনে করিয়ে দিয়েছেন তিনি। বেগম জিয়াকে উদ্দেশ করে বলা
হলেও প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য কতটা বিজ্ঞতার পরিচয় হলো, বুঝতে পারছি না।
তবে বাংলাদেশের রাজনীতির একটা দুরারোগ্য ব্যাধির প্রতি তিনি দেশের জনগণের
দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন বলে ধারণা করা যায়। পাকিস্তান থেকে এই ব্যাধিটি
উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিল বাংলাদেশ।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নারকীয়ভাবে হত্যা করে রাষ্ট্রক্ষমতা জবরদখলের যে ন্যক্কারজনক ধারার সূচনা ঘটানো হয়েছিল, তার পুনরাবৃত্তি যেকোনো মূল্যে রোধ হবে। দুই মাস ধরে দেশের চলমান পেট্রলবোমা ও ককটেল-সন্ত্রাস অব্যাহত রেখে শতাধিক মানুষকে পুড়িয়ে মেরে ও পঙ্গুত্ববরণে বাধ্য করে যে পৈশাচিক তাণ্ডব চালানো হচ্ছে, তার ফলে দেশের অর্থনীতি এবং সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জীবন ও জীবিকা মারাত্মক বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হয়েছে। এই সন্ত্রাসী তাণ্ডবে জনগণের সাড়া দেওয়ার আলামতই দেখা যাচ্ছে না, অতএব গণ-অভ্যুত্থান ঘটানোর ক্ষমতা ২০-দলীয় জোটের নেই, সেটা বোঝাই যাচ্ছে। অন্যদিকে একাদশ সংসদ নির্বাচন যখনই হোক, সেই নির্বাচনকে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণমূলক ও জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য করতে হলে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থার সংস্কার এবং নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে একটি ‘জাতীয় সংলাপ’ শুরু করার যে আশু প্রয়োজন রয়েছে, তা অস্বীকার করা গোঁয়ার্তুমি ছাড়া কিছু নয়।
সামরিক শাসনের ব্যাপারে এখনো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন পাকিস্তান। রাষ্ট্রটির ওপর এখনো সামরিক এস্টাবলিশমেন্টের যে প্রবল আধিপত্য বহাল রয়ে গেছে, সেটাকে অনুন্নয়নের রাজনৈতিক অর্থনীতির তত্ত্বে আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের (ব্যুরোক্রেটিক স্টেট) ক্ল্যাসিক নজির হিসেবে ১৯৭৫ সালেই তুলে ধরেছেন বিশ্বখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী হামজা আলাভী। কার্ল মার্ক্সের ‘রিলেটিভ অটোনমি অব দ্য স্টেট’ ধারণার ভিত্তিতে ঔপনিবেশিক দখলদারি থেকে স্বাধীন হওয়া উত্তর-ঔপনিবেশিক তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোতে কেন সামরিক একনায়কেরা কিছুদিন পর পর রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে থাকেন, তার যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা হিসেবে হামজা আলাভীর ওই তত্ত্বে ‘অতিবিকশিত রাষ্ট্রের পাশাপাশি শ্রেণিসমূহের অনুন্নয়ন’কে ফোকাসে নিয়ে আসা হয়েছে।
পাকিস্তানের ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার সময় ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের সেনাবাহিনীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ পাকিস্তানের ভাগে পড়েছিল। আর এলিট আইসিএস আমলা যাঁরা পাকিস্তানে যাওয়ার অপশন দিয়েছিলেন, তাঁরা অতি দ্রুত জেনারেলদের সঙ্গে গোপন আঁতাত গড়ে তুলে রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন। ফলে স্বাধীনতা লাভের কয়েক মাসের মধ্যেই প্রথম কাশ্মীরযুদ্ধের পটভূমিতে এবং মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর যক্ষ্মারোগ মারাত্মক পর্যায়ে চলে যাওয়ার সুযোগ নিয়ে তাঁকে বেলুচিস্তানের জেয়ারতের শৈলনিবাসে স্বাস্থ্য উদ্ধারের নামে নির্বাসনে পাঠিয়ে ১৯৪৮ সালের এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে ব্যবহার করে পাকিস্তানের আর্মি এস্টাবলিশমেন্ট ও সিভিল আমলাতন্ত্র রাষ্ট্রক্ষমতার নেপথ্য নিয়ন্ত্রণ কবজা করে নিয়েছিল। ওই পর্যায়ে নেপথ্য নায়ক ছিলেন দুজন জেনারেল আইয়ুব খান ও ইসকান্দার মির্জা এবং চিফ সেক্রেটারি গুলাম মোহাম্মদ। কিছুদিনের মধ্যেই লিয়াকত আলী খানও ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে ছিটকে পড়েছিলেন। সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার আততায়ীর গুলিতে ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর তিনি নিহত হয়েছিলেন এই বলে, ‘খোদা পাকিস্তান কো হেফাজত করে’। (ওই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত রহস্যজনকভাবে মাঝপথেই থামিয়ে দেওয়া হয়েছিল।)
১৯৪৮ সাল থেকে এক দশক পাকিস্তানের রাজনীতিকে পর্দার আড়াল থেকে এ দুই গোষ্ঠী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুরব্বিয়ানায় কীভাবে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল এবং পাকিস্তানের বাঘা বাঘা রাজনীতিবিদকে তাঁদের ইচ্ছামতো খেলিয়েছিল, সেই ইতিহাস এখন সারা বিশ্বের জানা হয়ে গেছে। একই সঙ্গে স্বাধীনতা অর্জনকারী ভারত ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি নিজেদের সংবিধানের অধীনে প্রজাতন্ত্রে পরিণত হলেও ওই নেপথ্যের কুশীলবদের চাণক্য-চালের শিকার হয়ে পাকিস্তানের সংবিধান চালু হয়েছিল ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ। তা-ও ওই সংবিধানের অধীনে গঠিত ইসলামি প্রজাতন্ত্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন ওই ইসকান্দার মির্জা। এরপর যখন সংবিধান মোতাবেক সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি ক্রমেই জোরদার হয়ে উঠছিল, তা ভণ্ডুল করার জন্য ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর ইসকান্দার মির্জা ও আইউব খান সামরিক শাসন জারি করে সরাসরি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নিয়েছিলেন। ওই ঘটনার ২০ দিনের মাথায় ১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর আইউব খান ইসকান্দার মির্জাকে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজেই প্রেসিডেন্টের গদিতে আসীন হয়েছিলেন। (নিয়তির পরিহাসে পাকিস্তানের রাজনীতির এই দুজন প্রধান খলনায়কের একজন ইসকান্দার মির্জা শেষ বয়সে বিলেতের একটি রেস্তোরাঁর ম্যানেজার হিসেবে নির্বাসিত জীবন অতিবাহিত করেছিলেন।)
দুঃখজনক হলো, এর ফলে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট থেকে ১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত ১১ বছর আড়াই মাসে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের লীলাক্ষেত্র পাকিস্তানে চারজন গভর্নর জেনারেল, সাতজন প্রধানমন্ত্রী ও দুজন প্রেসিডেন্ট প্রকাশ্য রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হলেও ১৯৪৮ সালের এপ্রিল থেকে রাষ্ট্রক্ষমতার প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ কখনোই সামরিক এস্টাবলিশমেন্ট ও সিভিল আমলাতন্ত্রের হাতছাড়া হয়নি। এর পরের ১৩ বছরের ইতিহাস আইউব খান ও ইয়াহিয়া খানের সরাসরি সামরিক একনায়কত্বের ইতিহাস। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ওই দুই গোষ্ঠীর করতলগত রাখার জন্য সুপরিকল্পিত ছক সাজিয়েছিলেন, কিন্তু স্বাধীনতার জন্য বাঙালি জাতির চেতনার জোয়ার যে কতখানি প্রবল হয়ে উঠেছিল, তা হিসাব করতে তাঁদের ভুল হয়ে গিয়েছিল।
উপরন্তু, নির্বাচনী প্রচারের শেষ পর্যায়ে ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের মৃত্যু এবং অচিন্তনীয় ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও সরকারের অমানবিক অবহেলা দেখে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল যে ভোটের মাধ্যমে তারা এই অবহেলা ও অপমানের প্রতিশোধ নেবে। এরই প্রতিফলন ছিল আওয়ামী লীগের ভূমিধস নির্বাচনী বিজয়; ইয়াহিয়ার সাজানো ছক তছনছ হয়ে গিয়েছিল ওই চেতনার প্লাবনের সঙ্গে গণরোষ যুক্ত হওয়ার ফলে উত্থিত আওয়ামী লীগের প্রবল জনসমর্থনের সুনামিতে। এতৎসত্ত্বেও সামরিক জান্তাকে নিজের উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার খেলায় জুলফিকার আলী ভুট্টো ব্যবহার করতে সমর্থ হওয়ার কারণেই যে বাংলাদেশকে ভুট্টো সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঠেলে দিতে সফল হয়েছিলেন, সেই ইতিহাসও যেন আমরা বিস্মৃত না হই। অতএব, ১৯৪৮ সালের এপ্রিল থেকে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানের ইতিহাস পুরোটাই ছিল প্রকৃত বিবেচনায় রাষ্ট্রক্ষমতা সামরিক এস্টাবলিশমেন্ট এবং ছোট তরফ হিসেবে সিভিল আমলাতন্ত্রের করায়ত্ত থাকারই ইতিহাস।
১৯৭২-৭৫ পর্বে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনী পাকিস্তানের মতো রাষ্ট্রক্ষমতা-নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করতে পারেনি। বরং তখনকার যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতির বাস্তবতায় অপ্রতুল ব্যয় বরাদ্দ সামরিক বাহিনীতে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি করছিল। ওই ক্ষোভ আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল রক্ষীবাহিনীর মতো একটি প্যারা-মিলিশিয়া ফোর্স গড়ে তোলার ভুল সিদ্ধান্ত। ১৫ আগস্টের ঘাতকেরা যে সামরিক বাহিনীর ওই ধূমায়িত অসন্তোষকে তাদের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ সফল করার জন্য ব্যবহার করতে পেরেছিল, তা সবারই জানা। ঘাতকদের অভ্যুত্থান পরিকল্পনায় বাকশাল গঠন, আওয়ামী লীগের দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক নিপীড়নের মতো ইস্যুগুলো মোটেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, যদিও ক্ষমতা দখলের পর প্রোপাগান্ডার হাতিয়ার হিসেবে এগুলো ব্যবহৃত হয়েছে। মূল ইস্যু ছিল বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানি ধারায় ফিরিয়ে নেওয়া, এটা প্রমাণিত।
জিয়াউর রহমান যে ঘাতকদের পরিকল্পনা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন, তা-ও কর্নেল রশীদের বয়ানে সারা বিশ্ব এখন জানতে পেরেছে। রাষ্ট্রপতি পদে ক্ষমতাসীন থেকে দেশের সামরিক এস্টাবলিশমেন্টকে ব্যবহার করে জিয়াউর রহমান যে বিএনপি গড়ে তুলেছেন, তার রাজনীতি এখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে কট্টর আওয়ামী লীগ-বিরোধিতা, পাকিস্তান–প্রীতি, মার্কিন-প্রীতি, সাম্প্রদায়িকতা, স্বাধীনতাবিরোধী ও ধর্মান্ধ গোষ্ঠীনির্ভরতা এবং সন্ত্রাসী জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোকে ছত্রচ্ছায়া প্রদানের মতো নেতিবাচক কৌশলের ওপর। সে জন্য এসব নেতিবাচক কারণেই বিএনপির একটা বিশাল ভোট ব্যাংক গড়ে উঠলেও তাদের ক্ষমতাদর্শিক ভিত্তি আগাগোড়াই নড়বড়ে রয়ে গেছে। ক্ষমতাসীন জোটকে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উৎখাত করার স্বপ্ন সে জন্যই অধরা থেকে যাবে তাদের জন্য। এরই পরিপ্রেক্ষিতে দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, পাকিস্তানি মডেল রুখতে চাইলে সংলাপের নীতিগত সম্মতি দিতে শেখ হাসিনার বিলম্ব করা
উচিত হবে না। তবে প্রথম পদক্ষেপ হতেই হবে অবরোধ ও হরতালের নামে পেট্রলবোমা আর ককটেল-সন্ত্রাস বন্ধ। অগণতান্ত্রিক সরকারকে ক্ষমতায় আনার ষড়যন্ত্র যে চলতে পারে, তা সন্দেহ করার পরও শেখ হাসিনা কি গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে সংলাপ শুরুর উদ্যোগ নেবেন না?
মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নারকীয়ভাবে হত্যা করে রাষ্ট্রক্ষমতা জবরদখলের যে ন্যক্কারজনক ধারার সূচনা ঘটানো হয়েছিল, তার পুনরাবৃত্তি যেকোনো মূল্যে রোধ হবে। দুই মাস ধরে দেশের চলমান পেট্রলবোমা ও ককটেল-সন্ত্রাস অব্যাহত রেখে শতাধিক মানুষকে পুড়িয়ে মেরে ও পঙ্গুত্ববরণে বাধ্য করে যে পৈশাচিক তাণ্ডব চালানো হচ্ছে, তার ফলে দেশের অর্থনীতি এবং সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জীবন ও জীবিকা মারাত্মক বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হয়েছে। এই সন্ত্রাসী তাণ্ডবে জনগণের সাড়া দেওয়ার আলামতই দেখা যাচ্ছে না, অতএব গণ-অভ্যুত্থান ঘটানোর ক্ষমতা ২০-দলীয় জোটের নেই, সেটা বোঝাই যাচ্ছে। অন্যদিকে একাদশ সংসদ নির্বাচন যখনই হোক, সেই নির্বাচনকে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণমূলক ও জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য করতে হলে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থার সংস্কার এবং নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে একটি ‘জাতীয় সংলাপ’ শুরু করার যে আশু প্রয়োজন রয়েছে, তা অস্বীকার করা গোঁয়ার্তুমি ছাড়া কিছু নয়।
সামরিক শাসনের ব্যাপারে এখনো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন পাকিস্তান। রাষ্ট্রটির ওপর এখনো সামরিক এস্টাবলিশমেন্টের যে প্রবল আধিপত্য বহাল রয়ে গেছে, সেটাকে অনুন্নয়নের রাজনৈতিক অর্থনীতির তত্ত্বে আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের (ব্যুরোক্রেটিক স্টেট) ক্ল্যাসিক নজির হিসেবে ১৯৭৫ সালেই তুলে ধরেছেন বিশ্বখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী হামজা আলাভী। কার্ল মার্ক্সের ‘রিলেটিভ অটোনমি অব দ্য স্টেট’ ধারণার ভিত্তিতে ঔপনিবেশিক দখলদারি থেকে স্বাধীন হওয়া উত্তর-ঔপনিবেশিক তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোতে কেন সামরিক একনায়কেরা কিছুদিন পর পর রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে থাকেন, তার যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা হিসেবে হামজা আলাভীর ওই তত্ত্বে ‘অতিবিকশিত রাষ্ট্রের পাশাপাশি শ্রেণিসমূহের অনুন্নয়ন’কে ফোকাসে নিয়ে আসা হয়েছে।
পাকিস্তানের ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার সময় ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের সেনাবাহিনীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ পাকিস্তানের ভাগে পড়েছিল। আর এলিট আইসিএস আমলা যাঁরা পাকিস্তানে যাওয়ার অপশন দিয়েছিলেন, তাঁরা অতি দ্রুত জেনারেলদের সঙ্গে গোপন আঁতাত গড়ে তুলে রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন। ফলে স্বাধীনতা লাভের কয়েক মাসের মধ্যেই প্রথম কাশ্মীরযুদ্ধের পটভূমিতে এবং মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর যক্ষ্মারোগ মারাত্মক পর্যায়ে চলে যাওয়ার সুযোগ নিয়ে তাঁকে বেলুচিস্তানের জেয়ারতের শৈলনিবাসে স্বাস্থ্য উদ্ধারের নামে নির্বাসনে পাঠিয়ে ১৯৪৮ সালের এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে ব্যবহার করে পাকিস্তানের আর্মি এস্টাবলিশমেন্ট ও সিভিল আমলাতন্ত্র রাষ্ট্রক্ষমতার নেপথ্য নিয়ন্ত্রণ কবজা করে নিয়েছিল। ওই পর্যায়ে নেপথ্য নায়ক ছিলেন দুজন জেনারেল আইয়ুব খান ও ইসকান্দার মির্জা এবং চিফ সেক্রেটারি গুলাম মোহাম্মদ। কিছুদিনের মধ্যেই লিয়াকত আলী খানও ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে ছিটকে পড়েছিলেন। সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার আততায়ীর গুলিতে ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর তিনি নিহত হয়েছিলেন এই বলে, ‘খোদা পাকিস্তান কো হেফাজত করে’। (ওই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত রহস্যজনকভাবে মাঝপথেই থামিয়ে দেওয়া হয়েছিল।)
১৯৪৮ সাল থেকে এক দশক পাকিস্তানের রাজনীতিকে পর্দার আড়াল থেকে এ দুই গোষ্ঠী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুরব্বিয়ানায় কীভাবে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল এবং পাকিস্তানের বাঘা বাঘা রাজনীতিবিদকে তাঁদের ইচ্ছামতো খেলিয়েছিল, সেই ইতিহাস এখন সারা বিশ্বের জানা হয়ে গেছে। একই সঙ্গে স্বাধীনতা অর্জনকারী ভারত ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি নিজেদের সংবিধানের অধীনে প্রজাতন্ত্রে পরিণত হলেও ওই নেপথ্যের কুশীলবদের চাণক্য-চালের শিকার হয়ে পাকিস্তানের সংবিধান চালু হয়েছিল ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ। তা-ও ওই সংবিধানের অধীনে গঠিত ইসলামি প্রজাতন্ত্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন ওই ইসকান্দার মির্জা। এরপর যখন সংবিধান মোতাবেক সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি ক্রমেই জোরদার হয়ে উঠছিল, তা ভণ্ডুল করার জন্য ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর ইসকান্দার মির্জা ও আইউব খান সামরিক শাসন জারি করে সরাসরি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নিয়েছিলেন। ওই ঘটনার ২০ দিনের মাথায় ১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর আইউব খান ইসকান্দার মির্জাকে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজেই প্রেসিডেন্টের গদিতে আসীন হয়েছিলেন। (নিয়তির পরিহাসে পাকিস্তানের রাজনীতির এই দুজন প্রধান খলনায়কের একজন ইসকান্দার মির্জা শেষ বয়সে বিলেতের একটি রেস্তোরাঁর ম্যানেজার হিসেবে নির্বাসিত জীবন অতিবাহিত করেছিলেন।)
দুঃখজনক হলো, এর ফলে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট থেকে ১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত ১১ বছর আড়াই মাসে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের লীলাক্ষেত্র পাকিস্তানে চারজন গভর্নর জেনারেল, সাতজন প্রধানমন্ত্রী ও দুজন প্রেসিডেন্ট প্রকাশ্য রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হলেও ১৯৪৮ সালের এপ্রিল থেকে রাষ্ট্রক্ষমতার প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ কখনোই সামরিক এস্টাবলিশমেন্ট ও সিভিল আমলাতন্ত্রের হাতছাড়া হয়নি। এর পরের ১৩ বছরের ইতিহাস আইউব খান ও ইয়াহিয়া খানের সরাসরি সামরিক একনায়কত্বের ইতিহাস। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ওই দুই গোষ্ঠীর করতলগত রাখার জন্য সুপরিকল্পিত ছক সাজিয়েছিলেন, কিন্তু স্বাধীনতার জন্য বাঙালি জাতির চেতনার জোয়ার যে কতখানি প্রবল হয়ে উঠেছিল, তা হিসাব করতে তাঁদের ভুল হয়ে গিয়েছিল।
উপরন্তু, নির্বাচনী প্রচারের শেষ পর্যায়ে ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের মৃত্যু এবং অচিন্তনীয় ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও সরকারের অমানবিক অবহেলা দেখে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল যে ভোটের মাধ্যমে তারা এই অবহেলা ও অপমানের প্রতিশোধ নেবে। এরই প্রতিফলন ছিল আওয়ামী লীগের ভূমিধস নির্বাচনী বিজয়; ইয়াহিয়ার সাজানো ছক তছনছ হয়ে গিয়েছিল ওই চেতনার প্লাবনের সঙ্গে গণরোষ যুক্ত হওয়ার ফলে উত্থিত আওয়ামী লীগের প্রবল জনসমর্থনের সুনামিতে। এতৎসত্ত্বেও সামরিক জান্তাকে নিজের উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার খেলায় জুলফিকার আলী ভুট্টো ব্যবহার করতে সমর্থ হওয়ার কারণেই যে বাংলাদেশকে ভুট্টো সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঠেলে দিতে সফল হয়েছিলেন, সেই ইতিহাসও যেন আমরা বিস্মৃত না হই। অতএব, ১৯৪৮ সালের এপ্রিল থেকে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানের ইতিহাস পুরোটাই ছিল প্রকৃত বিবেচনায় রাষ্ট্রক্ষমতা সামরিক এস্টাবলিশমেন্ট এবং ছোট তরফ হিসেবে সিভিল আমলাতন্ত্রের করায়ত্ত থাকারই ইতিহাস।
১৯৭২-৭৫ পর্বে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনী পাকিস্তানের মতো রাষ্ট্রক্ষমতা-নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করতে পারেনি। বরং তখনকার যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতির বাস্তবতায় অপ্রতুল ব্যয় বরাদ্দ সামরিক বাহিনীতে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি করছিল। ওই ক্ষোভ আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল রক্ষীবাহিনীর মতো একটি প্যারা-মিলিশিয়া ফোর্স গড়ে তোলার ভুল সিদ্ধান্ত। ১৫ আগস্টের ঘাতকেরা যে সামরিক বাহিনীর ওই ধূমায়িত অসন্তোষকে তাদের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ সফল করার জন্য ব্যবহার করতে পেরেছিল, তা সবারই জানা। ঘাতকদের অভ্যুত্থান পরিকল্পনায় বাকশাল গঠন, আওয়ামী লীগের দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক নিপীড়নের মতো ইস্যুগুলো মোটেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, যদিও ক্ষমতা দখলের পর প্রোপাগান্ডার হাতিয়ার হিসেবে এগুলো ব্যবহৃত হয়েছে। মূল ইস্যু ছিল বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানি ধারায় ফিরিয়ে নেওয়া, এটা প্রমাণিত।
জিয়াউর রহমান যে ঘাতকদের পরিকল্পনা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন, তা-ও কর্নেল রশীদের বয়ানে সারা বিশ্ব এখন জানতে পেরেছে। রাষ্ট্রপতি পদে ক্ষমতাসীন থেকে দেশের সামরিক এস্টাবলিশমেন্টকে ব্যবহার করে জিয়াউর রহমান যে বিএনপি গড়ে তুলেছেন, তার রাজনীতি এখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে কট্টর আওয়ামী লীগ-বিরোধিতা, পাকিস্তান–প্রীতি, মার্কিন-প্রীতি, সাম্প্রদায়িকতা, স্বাধীনতাবিরোধী ও ধর্মান্ধ গোষ্ঠীনির্ভরতা এবং সন্ত্রাসী জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোকে ছত্রচ্ছায়া প্রদানের মতো নেতিবাচক কৌশলের ওপর। সে জন্য এসব নেতিবাচক কারণেই বিএনপির একটা বিশাল ভোট ব্যাংক গড়ে উঠলেও তাদের ক্ষমতাদর্শিক ভিত্তি আগাগোড়াই নড়বড়ে রয়ে গেছে। ক্ষমতাসীন জোটকে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উৎখাত করার স্বপ্ন সে জন্যই অধরা থেকে যাবে তাদের জন্য। এরই পরিপ্রেক্ষিতে দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, পাকিস্তানি মডেল রুখতে চাইলে সংলাপের নীতিগত সম্মতি দিতে শেখ হাসিনার বিলম্ব করা
উচিত হবে না। তবে প্রথম পদক্ষেপ হতেই হবে অবরোধ ও হরতালের নামে পেট্রলবোমা আর ককটেল-সন্ত্রাস বন্ধ। অগণতান্ত্রিক সরকারকে ক্ষমতায় আনার ষড়যন্ত্র যে চলতে পারে, তা সন্দেহ করার পরও শেখ হাসিনা কি গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে সংলাপ শুরুর উদ্যোগ নেবেন না?
মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments