প্রতিবাদী by মাহবুব তালুকদার
... ২৪ ঘণ্টা গাছের ওপর অবস্থান ধর্মঘট পালনকারী জালাল উদ্দিন ... |
... গাছের ওপর অবস্থান ধর্মঘট পালনকারী জালাল মাটিতে নেমেই আটক ... |
আমি বললাম, চাচা! দেশটা একটা মহাদুর্যোগ থেকে বেঁচে গেছে। এই মহাদুর্যোগ সত্যি সত্যি ঘটলে বাংলাদেশ একেবারে তলিয়ে যেত।
কই? তেমন কিছুর কোনো আলামত তো দেখতে পেলাম না।
আপনি আলামত না দেখলে কী হবে? ব্যাপারটা চিন্তা করে এখনও আমার বুক ধড়াস ধড়াস করছে।
কি হয়েছে খুলে বলবে তো?
সেদিন বিভিন্ন দেশের ১৬ জন রাষ্ট্রদূত একসঙ্গে খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন, তারা সরকারের অনুমতিক্রমেই সেখানে যান। তাদের সেখানে যেতে দেওয়া সরকারের মোটেই উচিত হয়নি।
তাতে হলোটা কী?
খালেদা জিয়ার ঐ আস্তানা মোটেই নিরাপদ জায়গা নয়। তারা যে ভালোয় ভালোয় ফিরে এসেছেন, সে জন্য আল্লাহর কাছে শোকরানা আদায় করছি।
তুমি সেখানে নিরাপত্তার ঘাটতি কোথায় দেখলে?
আমি দেখিনি। দেখেছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। তিনি খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে চিরুনি অভিযান চালাতে বলেছেন। নগর আওয়ামী লীগের এক সভায় তিনি বলেছেন, ‘সব সন্ত্রাসী ও উগ্রপন্থি সেখানে (বিএনপি নেত্রীর কার্যালয়ে) আছে’। কি সাংঘাতিক ব্যাপার! এসব জেনেও সরকার কূটনীতিকদের সেখানে যেতে দিল কী করে?
কথাটা কি ঠিক?
এ খবর পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। আমি বললাম, দুর্যোগ বা মহাদুর্যোগের আপৎকালীন খবর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রীরই আগে জানার কথা। এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকারের একজন মন্ত্রী হয়ে তিনি তো আর মিথ্যা বলতে পারেন না।
আমার কথা শুনে চাচাকে তেমন বিচলিত মনে হলো না। তিনি আমার কথার কোন উত্তর দিলেন না।
এই সময়ে চাচি ঘরে এলেন। চা ও নাশতা প্লেটে সাজিয়ে নিয়ে এসেছেন। সোফায় বসতে বসতে বললেন, তোমাদের আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু কী?
আমরা খালেদা জিয়ার সঙ্গে কূটনীতিকদের বৈঠকের বিষয়ে আলোচনা করছি। আমি জানালাম।
চাচা বললেন, কূটনীতিকরা খালেদা জিয়ার সঙ্গে যা-ই আলোচনা করুন না কেন, সরকারের তাতে কিছুই যায় আসে না।
কিছু তো নিশ্চয়ই যায় আসে। চাচি মৃদু হেসে বললেন, আদালতের ভাষ্যে খালেদা জিয়া একজন ‘পলাতক’ আসামি। তার নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে। তার গুলশান কার্যালয়, যেখানে তিনি অবস্থান করছেন, সেখানে তল্লাশির হুকুমও দিয়েছেন আদালত। অসংখ্য হত্যা মামলার হুকুমের আসামি তিনি। তার সঙ্গে বিভিন্ন দেশের ১৬ জন রাষ্ট্রদূত দুই ঘণ্টা ধরে বৈঠক করলেন, সরকার তাতে বাধা দিল না কেন? নৈতিকতার দিক বিবেচনায় এটা সরকারের মেনে নেয়া উচিত হয়নি। কিন্তু বিদেশী দূতদের এই মেগা বৈঠকের ব্যাপারে সরকারের কিছুই করার ছিল না।
আমি বললাম, আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশে খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করার কথা। কিন্তু অনেক দিন হয়ে গেলেও নির্দেশটি আদালত থেকে থানায় গিয়ে পৌঁছায়নি।
সময় হলেই তাকে গ্রেপ্তার করা হবে। চাচা জানালেন, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলে দিয়েছেন, আইন সবার জন্য সমান।
উত্তরে চাচি বললেন, এটা পুঁথিগত বিদ্যার কথা, বাস্তবের কথা নয়। প্রবাদে বলা হয়ে থাকে- আইন কারও কারও জন্য বেশি সমান।
তোমার বাস্তবের কথাটা কি?
বাস্তব অবস্থা হচ্ছে, আইন সবার জন্য সমান নয়।
এর কোনো প্রমাণ আছে কি?
প্রমাণ অবশ্যই আছে। বিগত ৩রা মার্চ, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীরই অধীনস্থ কর্মকর্তা রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের সহকারী কমিশনার রফিকুল আলম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রগতিশীল ছাত্র জোটের প্রতিবাদ র্যালি ভণ্ডুল করে দেন। সংগঠনটি অভিজিৎ হত্যার প্রতিবাদ জানাচ্ছিল। সহকারী কমিশনার ছাত্রদের জানান, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যে কোনো সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ রয়েছে। কেবল ছাত্রলীগ এখানে মিছিল করতে পারে, তাদের ক্ষেত্রে এই সমাবেশ নিষিদ্ধের নির্দেশ প্রযোজ্য নয়।’ চাচি মৃদু হেসে আবার বললেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ‘আইনের চোখে সবাই সমান’ কথাটি পুলিশের সহকারী কমিশনার যে অমান্য করেছেন, সে জন্য তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানা যায়নি।
চাচির কথার পর এ বিষয়ে আমার আর কোনো মন্তব্যের অবকাশ নেই। চাচাও এ বিষয়ে আর কথা না বাড়িয়ে প্রসঙ্গান্তরে যেতে চাইলেন। আমি আগেও লক্ষ্য করেছি, কোনো বিষয়ে চাচা যদি হেরে যান বা বিব্রতবোধ করেন, তখন তিনি অন্য প্রসঙ্গ টেনে আনেন। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে চাচা বললেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঔদার্য দেখে আমি বিস্মিত। আসলে এক-এগারোর সময় খালেদা জিয়া ও তিনি পাশাপাশি বন্দী জীবনযাপন করেছেন কিনা! বেগম খালেদা জিয়ার মনের পাঠ তিনিই সবচাইতে ভালো বুঝতে পারেন।
তাই নাকি! চাচি ও আমি সবিস্ময়ে তাকালাম তার মুখের দিকে।
তোমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলে আমার বক্তব্যের মর্মার্থ বুঝতে পারবে।
প্রধানমন্ত্রী কি বলেছেন? চাচির জিজ্ঞাসা।
প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে বলেছেন, খালেদা জিয়া জনরোষ থেকে বাঁচতেই এখন জেলে যেতে চান। নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে কারাগারে থাকাই তার কাছে শ্রেয় মনে হয়। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মনের ভাষা জেনেই কথাটা বলেছেন।
তুমি কি মনে করো খালেদা জিয়া নিরাপত্তার ঝুঁকিতে আছেন? চাচি জানতে চাইলেন।
অবশ্যই। তিনি যখন প্রথম গুলশান কার্যালয়ে আশ্রয় নেন, তখন অনেকগুলো বালির ট্রাক ফেলে তার নিরাপত্তা দেয়া হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে মন্ত্রী শাজাহান খানের মিছিল যখন তার কার্যালয় অভিমুখে যায়, তখন পুলিশ তাদের নিরাপদ দূরত্বে রুখে দিয়েছিল। খালেদা জিয়ার নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে পুলিশ কাউকে কার্যালয়ের সামনে যেতে দেয়নি। এমনকি ডাকসাইটে মন্ত্রী শাজাহান খানকেও ছাড় দেয়া হয়নি। খালেদা জিয়ার প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এহেন ঔদার্য ও সহানুভূতির ব্যাপারটা তোমরা বুঝতে পারবে না।
কিন্তু এখন কি হলো? এখন ঐ কার্যালয়ে আগের মতো পোশাকি পুলিশ আর নিরাপত্তা দিচ্ছে না। কয়েকজন সাদা পোশাকের পুলিশ সেখানে মোতায়েন করা হয়েছে। আমি জানালাম।
খালেদা জিয়া নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে এখন জেলে যেতে বা জেলে থাকতে চাইছেন। সেটা হচ্ছে তার জন্য সবচেয়ে নিরাপদ স্থান। এতে অবশ্য বিএনপি ও সরকার- সবারই সুবিধা হয়।
বিএনপির কি সুবিধা?
গুলশানের ঐ কার্যালয়ে না-খেয়ে না-দেয়ে যেসব নেতা-কর্মকর্তা ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মী আছেন, তোমাদের দেশনেত্রী জেলে গেলে তারা তাদের থাকা-খাওয়ার কষ্ট থেকে রেহাই পাবেন। সরকারে থাকলে সবার কথাই ভাবতে হয়। বুঝলে?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও অন্যদের কথাবার্তা শুনে আমার বিভ্রান্তি দিনে দিনে বাড়ছে। এসব বক্তব্য দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করে তুলছে বলে আমার ধারণা। সম্প্রতি কূটনীতিকরা সরকারের প্রতি যে চিঠি দেন, তাতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি অসৌজন্যমূলক বক্তব্য না দেয়ার আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু এসব বিষয়ে কে শোনে কার কথা!
বিদেশী কূটনীতিকদের দৌড়ঝাঁপের ব্যাপারে আমাদের তিনজনের তিন মত। চাচা মনে করেন, সরকার বিদেশী কূটনীতিকদের মোটেই পাত্তা দিচ্ছে না। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে তাদের নাক গলানো সরকারের মোটেই পছন্দ নয়। অন্যদিকে আমি মনে করি, সরকার মুখে না বললেও তলে তলে কূটনীতিকদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করছে। আর চাচি মনে করেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে এক-এগারোর সময় থেকে সকল আপৎকালে কূটনীতিকদের চাপ সর্বদাই ছিল। এবারও কূটনীতিকরা যখন আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ঢুকে পড়েছে, ভালো হোক বা মন্দ হোক, সমস্যার একটা সমাধান হবেই।
আমরা তিনজনই কিছুক্ষণ চুপচাপ। সহসা চাচি মৌনতা ভঙ্গ করে প্রশ্ন করলেন, বাংলাদেশের বর্তমান দুঃসহ পরিস্থিতি নিয়ে সবচেয়ে উদ্বিগ্ন মানুষটি কে, বলতে পারো?
অবশ্যই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চাচা বললেন।
মোটেই না। তিনি তো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে করণীয় সম্পর্কে নির্দেশ দিয়েই রেখেছেন। তাঁর নির্দেশানুযায়ী কাজ হচ্ছে। সুতরাং, তার উদ্বেগের কী আছে?
তাহলে নিশ্চয়ই খালেদা জিয়া। আমি বললাম, দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক বিষয়ে তিনি খুবই উদ্বিগ্ন।
একেবারেই না। তিনি তার অবর্তমানে আন্দোলনের দিক-নির্দেশনা দিয়ে সব উদ্বিগ্নতা থেকে মুক্ত। এখন আর তার কোনো টেনশন নেই।
তাহলে কে হতে পারেন? আমি ও চাচা প্রায় একই সঙ্গে জানতে চাইলাম। চাচির এহেন রহস্যজনক প্রশ্নের উত্তর কী?
আমাদের উভয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে চাচি মৃদু হাসলেন। বললেন, তার নাম জালাল উদ্দিন মজুমদার।
কী করেছেন তিনি? আমার জিজ্ঞাসা।
চাচি জানালেন, জালাল উদ্দিন হরতাল অবরোধ বন্ধ করা, পেট্রলবোমা দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারা ও ক্রসফায়ার বন্ধের দাবিতে প্রেসক্লাবের ফুটপাথের কড়ই গাছের মগডালে উঠে ২৪ ঘণ্টা অবস্থান ধর্মঘট পালন করেন। অত্যন্ত সাধারণ মানুষ তিনি। তার ঐ ধরনের অবস্থানের কারণ একটা ব্যানারে লিখে গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। অবস্থান ধর্মঘট শেষে গাছ থেকে নামার পর পুলিশ তাকে আটক করে শাহবাগ থানায় নিয়ে গেলে জালাল উদ্দিন মজুমদার বলেন, ‘সরকার ও বিরোধী দল সবাই থাকে উপরে। কেউ নিচে নামে না। আমাদের কথা শোনে না। তাই আমিও গাছের ওপরে উঠে অবস্থান ও প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছি।’
ও তো একজন মানসিক রোগী। শাহবাগ থানার ওসি বলেছেন, তাকে আটক বা গ্রেপ্তার, কোনটাই করা হয়নি। এভাবে গাছে বসে থাকায় মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে। নিরাপত্তার স্বার্থে তাকে পুলিশি হেফাজতে আনা হয়েছিল। চাচা আরও জানালেন, খবরটি আমিও পড়েছি।
চাচি বললেন, থানার ওসির বক্তব্য সম্পর্কে আমার দ্বিমত আছে। জালাল উদ্দিনের মৃত্যুঝুঁকি সম্পর্কে পুলিশের যদি মাথাব্যথা থাকতো, তাহলে তাকে পুলিশ ২৪ ঘণ্টার আগেই গাছের ওপর থেকে নামিয়ে আনতো। আর তিনি যে একজন মানসিক রোগী তা কে বলেছে?
শাহবাগ থানার ওসিই বলেছেন।
তিনি কী করে এ কথা বললেন? তিনি কি ডাক্তার? চাচির কণ্ঠে দৃঢ়তার আভাস, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় নূর হোসেন যখন বুকে-পিঠে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ লিখে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন, সেটাও অনেকের মতে স্বাভাবিক ছিল না। অথচ সেদিন নূর হোসেনের আত্মদানের মধ্য দিয়েই স্বৈরাচারের পতন ত্বরান্বিত হয়েছিল। সাধারণ মানুষের প্রতিবাদের ভাষা এমনই হয়।
তুমি আসলে কি বলতে চাও? চাচা প্রশ্ন করলেন।
চাচি কয়েক মুহূর্ত অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন আমাদের মুখের দিকে। তারপর চোখ নামিয়ে ধীরে ধীরে বললেন, দেশের এই সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় যারা নিরুদ্বেগ সময় কাটান, যারা এসব ঘটনার দায়দায়িত্ব নিতে চান না, তারা সবাই মানসিক রোগী, না এসবের প্রতিবাদকারী একজন জালাল উদ্দিন মানসিক রোগী, তা নির্ধারণ করা খুবই মুশকিল।
কই? তেমন কিছুর কোনো আলামত তো দেখতে পেলাম না।
আপনি আলামত না দেখলে কী হবে? ব্যাপারটা চিন্তা করে এখনও আমার বুক ধড়াস ধড়াস করছে।
কি হয়েছে খুলে বলবে তো?
সেদিন বিভিন্ন দেশের ১৬ জন রাষ্ট্রদূত একসঙ্গে খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন, তারা সরকারের অনুমতিক্রমেই সেখানে যান। তাদের সেখানে যেতে দেওয়া সরকারের মোটেই উচিত হয়নি।
তাতে হলোটা কী?
খালেদা জিয়ার ঐ আস্তানা মোটেই নিরাপদ জায়গা নয়। তারা যে ভালোয় ভালোয় ফিরে এসেছেন, সে জন্য আল্লাহর কাছে শোকরানা আদায় করছি।
তুমি সেখানে নিরাপত্তার ঘাটতি কোথায় দেখলে?
আমি দেখিনি। দেখেছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। তিনি খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে চিরুনি অভিযান চালাতে বলেছেন। নগর আওয়ামী লীগের এক সভায় তিনি বলেছেন, ‘সব সন্ত্রাসী ও উগ্রপন্থি সেখানে (বিএনপি নেত্রীর কার্যালয়ে) আছে’। কি সাংঘাতিক ব্যাপার! এসব জেনেও সরকার কূটনীতিকদের সেখানে যেতে দিল কী করে?
কথাটা কি ঠিক?
এ খবর পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। আমি বললাম, দুর্যোগ বা মহাদুর্যোগের আপৎকালীন খবর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রীরই আগে জানার কথা। এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকারের একজন মন্ত্রী হয়ে তিনি তো আর মিথ্যা বলতে পারেন না।
আমার কথা শুনে চাচাকে তেমন বিচলিত মনে হলো না। তিনি আমার কথার কোন উত্তর দিলেন না।
এই সময়ে চাচি ঘরে এলেন। চা ও নাশতা প্লেটে সাজিয়ে নিয়ে এসেছেন। সোফায় বসতে বসতে বললেন, তোমাদের আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু কী?
আমরা খালেদা জিয়ার সঙ্গে কূটনীতিকদের বৈঠকের বিষয়ে আলোচনা করছি। আমি জানালাম।
চাচা বললেন, কূটনীতিকরা খালেদা জিয়ার সঙ্গে যা-ই আলোচনা করুন না কেন, সরকারের তাতে কিছুই যায় আসে না।
কিছু তো নিশ্চয়ই যায় আসে। চাচি মৃদু হেসে বললেন, আদালতের ভাষ্যে খালেদা জিয়া একজন ‘পলাতক’ আসামি। তার নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে। তার গুলশান কার্যালয়, যেখানে তিনি অবস্থান করছেন, সেখানে তল্লাশির হুকুমও দিয়েছেন আদালত। অসংখ্য হত্যা মামলার হুকুমের আসামি তিনি। তার সঙ্গে বিভিন্ন দেশের ১৬ জন রাষ্ট্রদূত দুই ঘণ্টা ধরে বৈঠক করলেন, সরকার তাতে বাধা দিল না কেন? নৈতিকতার দিক বিবেচনায় এটা সরকারের মেনে নেয়া উচিত হয়নি। কিন্তু বিদেশী দূতদের এই মেগা বৈঠকের ব্যাপারে সরকারের কিছুই করার ছিল না।
আমি বললাম, আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশে খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করার কথা। কিন্তু অনেক দিন হয়ে গেলেও নির্দেশটি আদালত থেকে থানায় গিয়ে পৌঁছায়নি।
সময় হলেই তাকে গ্রেপ্তার করা হবে। চাচা জানালেন, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলে দিয়েছেন, আইন সবার জন্য সমান।
উত্তরে চাচি বললেন, এটা পুঁথিগত বিদ্যার কথা, বাস্তবের কথা নয়। প্রবাদে বলা হয়ে থাকে- আইন কারও কারও জন্য বেশি সমান।
তোমার বাস্তবের কথাটা কি?
বাস্তব অবস্থা হচ্ছে, আইন সবার জন্য সমান নয়।
এর কোনো প্রমাণ আছে কি?
প্রমাণ অবশ্যই আছে। বিগত ৩রা মার্চ, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীরই অধীনস্থ কর্মকর্তা রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের সহকারী কমিশনার রফিকুল আলম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রগতিশীল ছাত্র জোটের প্রতিবাদ র্যালি ভণ্ডুল করে দেন। সংগঠনটি অভিজিৎ হত্যার প্রতিবাদ জানাচ্ছিল। সহকারী কমিশনার ছাত্রদের জানান, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যে কোনো সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ রয়েছে। কেবল ছাত্রলীগ এখানে মিছিল করতে পারে, তাদের ক্ষেত্রে এই সমাবেশ নিষিদ্ধের নির্দেশ প্রযোজ্য নয়।’ চাচি মৃদু হেসে আবার বললেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ‘আইনের চোখে সবাই সমান’ কথাটি পুলিশের সহকারী কমিশনার যে অমান্য করেছেন, সে জন্য তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানা যায়নি।
চাচির কথার পর এ বিষয়ে আমার আর কোনো মন্তব্যের অবকাশ নেই। চাচাও এ বিষয়ে আর কথা না বাড়িয়ে প্রসঙ্গান্তরে যেতে চাইলেন। আমি আগেও লক্ষ্য করেছি, কোনো বিষয়ে চাচা যদি হেরে যান বা বিব্রতবোধ করেন, তখন তিনি অন্য প্রসঙ্গ টেনে আনেন। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে চাচা বললেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঔদার্য দেখে আমি বিস্মিত। আসলে এক-এগারোর সময় খালেদা জিয়া ও তিনি পাশাপাশি বন্দী জীবনযাপন করেছেন কিনা! বেগম খালেদা জিয়ার মনের পাঠ তিনিই সবচাইতে ভালো বুঝতে পারেন।
তাই নাকি! চাচি ও আমি সবিস্ময়ে তাকালাম তার মুখের দিকে।
তোমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলে আমার বক্তব্যের মর্মার্থ বুঝতে পারবে।
প্রধানমন্ত্রী কি বলেছেন? চাচির জিজ্ঞাসা।
প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে বলেছেন, খালেদা জিয়া জনরোষ থেকে বাঁচতেই এখন জেলে যেতে চান। নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে কারাগারে থাকাই তার কাছে শ্রেয় মনে হয়। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মনের ভাষা জেনেই কথাটা বলেছেন।
তুমি কি মনে করো খালেদা জিয়া নিরাপত্তার ঝুঁকিতে আছেন? চাচি জানতে চাইলেন।
অবশ্যই। তিনি যখন প্রথম গুলশান কার্যালয়ে আশ্রয় নেন, তখন অনেকগুলো বালির ট্রাক ফেলে তার নিরাপত্তা দেয়া হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে মন্ত্রী শাজাহান খানের মিছিল যখন তার কার্যালয় অভিমুখে যায়, তখন পুলিশ তাদের নিরাপদ দূরত্বে রুখে দিয়েছিল। খালেদা জিয়ার নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে পুলিশ কাউকে কার্যালয়ের সামনে যেতে দেয়নি। এমনকি ডাকসাইটে মন্ত্রী শাজাহান খানকেও ছাড় দেয়া হয়নি। খালেদা জিয়ার প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এহেন ঔদার্য ও সহানুভূতির ব্যাপারটা তোমরা বুঝতে পারবে না।
কিন্তু এখন কি হলো? এখন ঐ কার্যালয়ে আগের মতো পোশাকি পুলিশ আর নিরাপত্তা দিচ্ছে না। কয়েকজন সাদা পোশাকের পুলিশ সেখানে মোতায়েন করা হয়েছে। আমি জানালাম।
খালেদা জিয়া নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে এখন জেলে যেতে বা জেলে থাকতে চাইছেন। সেটা হচ্ছে তার জন্য সবচেয়ে নিরাপদ স্থান। এতে অবশ্য বিএনপি ও সরকার- সবারই সুবিধা হয়।
বিএনপির কি সুবিধা?
গুলশানের ঐ কার্যালয়ে না-খেয়ে না-দেয়ে যেসব নেতা-কর্মকর্তা ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মী আছেন, তোমাদের দেশনেত্রী জেলে গেলে তারা তাদের থাকা-খাওয়ার কষ্ট থেকে রেহাই পাবেন। সরকারে থাকলে সবার কথাই ভাবতে হয়। বুঝলে?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও অন্যদের কথাবার্তা শুনে আমার বিভ্রান্তি দিনে দিনে বাড়ছে। এসব বক্তব্য দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করে তুলছে বলে আমার ধারণা। সম্প্রতি কূটনীতিকরা সরকারের প্রতি যে চিঠি দেন, তাতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি অসৌজন্যমূলক বক্তব্য না দেয়ার আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু এসব বিষয়ে কে শোনে কার কথা!
বিদেশী কূটনীতিকদের দৌড়ঝাঁপের ব্যাপারে আমাদের তিনজনের তিন মত। চাচা মনে করেন, সরকার বিদেশী কূটনীতিকদের মোটেই পাত্তা দিচ্ছে না। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে তাদের নাক গলানো সরকারের মোটেই পছন্দ নয়। অন্যদিকে আমি মনে করি, সরকার মুখে না বললেও তলে তলে কূটনীতিকদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করছে। আর চাচি মনে করেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে এক-এগারোর সময় থেকে সকল আপৎকালে কূটনীতিকদের চাপ সর্বদাই ছিল। এবারও কূটনীতিকরা যখন আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ঢুকে পড়েছে, ভালো হোক বা মন্দ হোক, সমস্যার একটা সমাধান হবেই।
আমরা তিনজনই কিছুক্ষণ চুপচাপ। সহসা চাচি মৌনতা ভঙ্গ করে প্রশ্ন করলেন, বাংলাদেশের বর্তমান দুঃসহ পরিস্থিতি নিয়ে সবচেয়ে উদ্বিগ্ন মানুষটি কে, বলতে পারো?
অবশ্যই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চাচা বললেন।
মোটেই না। তিনি তো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে করণীয় সম্পর্কে নির্দেশ দিয়েই রেখেছেন। তাঁর নির্দেশানুযায়ী কাজ হচ্ছে। সুতরাং, তার উদ্বেগের কী আছে?
তাহলে নিশ্চয়ই খালেদা জিয়া। আমি বললাম, দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক বিষয়ে তিনি খুবই উদ্বিগ্ন।
একেবারেই না। তিনি তার অবর্তমানে আন্দোলনের দিক-নির্দেশনা দিয়ে সব উদ্বিগ্নতা থেকে মুক্ত। এখন আর তার কোনো টেনশন নেই।
তাহলে কে হতে পারেন? আমি ও চাচা প্রায় একই সঙ্গে জানতে চাইলাম। চাচির এহেন রহস্যজনক প্রশ্নের উত্তর কী?
আমাদের উভয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে চাচি মৃদু হাসলেন। বললেন, তার নাম জালাল উদ্দিন মজুমদার।
কী করেছেন তিনি? আমার জিজ্ঞাসা।
চাচি জানালেন, জালাল উদ্দিন হরতাল অবরোধ বন্ধ করা, পেট্রলবোমা দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারা ও ক্রসফায়ার বন্ধের দাবিতে প্রেসক্লাবের ফুটপাথের কড়ই গাছের মগডালে উঠে ২৪ ঘণ্টা অবস্থান ধর্মঘট পালন করেন। অত্যন্ত সাধারণ মানুষ তিনি। তার ঐ ধরনের অবস্থানের কারণ একটা ব্যানারে লিখে গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। অবস্থান ধর্মঘট শেষে গাছ থেকে নামার পর পুলিশ তাকে আটক করে শাহবাগ থানায় নিয়ে গেলে জালাল উদ্দিন মজুমদার বলেন, ‘সরকার ও বিরোধী দল সবাই থাকে উপরে। কেউ নিচে নামে না। আমাদের কথা শোনে না। তাই আমিও গাছের ওপরে উঠে অবস্থান ও প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছি।’
ও তো একজন মানসিক রোগী। শাহবাগ থানার ওসি বলেছেন, তাকে আটক বা গ্রেপ্তার, কোনটাই করা হয়নি। এভাবে গাছে বসে থাকায় মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে। নিরাপত্তার স্বার্থে তাকে পুলিশি হেফাজতে আনা হয়েছিল। চাচা আরও জানালেন, খবরটি আমিও পড়েছি।
চাচি বললেন, থানার ওসির বক্তব্য সম্পর্কে আমার দ্বিমত আছে। জালাল উদ্দিনের মৃত্যুঝুঁকি সম্পর্কে পুলিশের যদি মাথাব্যথা থাকতো, তাহলে তাকে পুলিশ ২৪ ঘণ্টার আগেই গাছের ওপর থেকে নামিয়ে আনতো। আর তিনি যে একজন মানসিক রোগী তা কে বলেছে?
শাহবাগ থানার ওসিই বলেছেন।
তিনি কী করে এ কথা বললেন? তিনি কি ডাক্তার? চাচির কণ্ঠে দৃঢ়তার আভাস, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় নূর হোসেন যখন বুকে-পিঠে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ লিখে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন, সেটাও অনেকের মতে স্বাভাবিক ছিল না। অথচ সেদিন নূর হোসেনের আত্মদানের মধ্য দিয়েই স্বৈরাচারের পতন ত্বরান্বিত হয়েছিল। সাধারণ মানুষের প্রতিবাদের ভাষা এমনই হয়।
তুমি আসলে কি বলতে চাও? চাচা প্রশ্ন করলেন।
চাচি কয়েক মুহূর্ত অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন আমাদের মুখের দিকে। তারপর চোখ নামিয়ে ধীরে ধীরে বললেন, দেশের এই সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় যারা নিরুদ্বেগ সময় কাটান, যারা এসব ঘটনার দায়দায়িত্ব নিতে চান না, তারা সবাই মানসিক রোগী, না এসবের প্রতিবাদকারী একজন জালাল উদ্দিন মানসিক রোগী, তা নির্ধারণ করা খুবই মুশকিল।
No comments