খালেদা জিয়া : নির্যাতনই যেন নিয়তি by সৈয়দ আবদাল আহমদ
এক
দুঃখিনী নাম খালেদা জিয়া। অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করাই যেন তার নিয়তি।
এরশাদ জান্তার নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তিনি। নির্যাতন চালিয়েছে শেখ
হাসিনার প্রথম মেয়াদের সরকার। মইন-ফখরুদ্দীনের জরুরি সরকারের আমলে মূল
টার্গেটই ছিলেন খালেদা জিয়া। তাকে ছয় মাস গৃহবন্দী ও এক বছর নির্জন
কারাগারে বন্দী থাকতে হয়। কারাগারে তিনি রোগযন্ত্রণায় ছটফট করেছেন। দুই
ছেলের নির্যাতনের খবরে বিচলিত হয়েছেন। মায়ের মৃত্যুর সময় তার পাশেও থাকতে
পারেননি। সেনাসমর্থিত এই সরকার তাকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করতে বিদেশে
নির্বাসনে পাঠানোরও অপচেষ্টা চালায়। আর বর্তমান শেখ হাসিনার সরকার চাইছে
খালেদা জিয়া শেষই হয়ে যাক। তাকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ এবং শারীরিক ও মানসিক
নিপীড়ন করেই তারা ক্ষান্ত হয়নি, তিনি ও তার দল বিএনপিকে রাজনীতি থেকে
একেবারে নিশ্চিহ্ন করার ভয়ঙ্কর এক খেলায় মেতে উঠেছে। দেশের জনপ্রিয়
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাহাদতের পর এক নিভৃত গৃহবধূ থেকে জনগণের
অনুরোধে রাজনীতিতে আসেন খালেদা জিয়া। ১৯৮২ সালে বিএনপির প্রাথমিক সদস্য
হওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় তার রাজনৈতিক যাত্রা। এরপর তিনি এ দলের সিনিয়র
ভাইস চেয়ারপারসন ও চেয়ারপারসন হন। রাজনীতিতে আজ তার ৩৩ বছর। এ সময়ে তিনি
তীব্র গণ-আন্দোলন গড়ে তুলে এরশাদের ৯ বছরের স্বৈরশাসনের পতন ঘটান। নিজের দল
বিএনপিকে নির্বাচনে বিজয়ী করে দু’বার রাষ্ট্র ক্ষমতায় নিয়ে আসেন। দেশে
প্রতিষ্ঠা করেন সংসদীয় গণতন্ত্র। দেশের উন্নয়নে অবিস্মরণীয় ভূমিকা তার।
যমুনা সেতুর মতো বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে তার হাতে। বাংলাদেশের
স্বাধীনতা, বহুদলীয় গণতন্ত্র, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও সমাজ বিকাশ বিশেষত
শিক্ষা তথা নারী শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায়
তার সাফল্য অনন্য। একইভাবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতাসহ মানুষের মৌলিক অধিকার
প্রতিষ্ঠায় তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী খালেদা
জিয়া ছিলেন অগ্রগণ্য। সার্কসহ আন্তর্জাতিক ফোরামেও বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল
করেছেন তিনি।
কিন্তু সেই তাকেই আজ অত্যাচার-নির্যাতনে নিষ্পেষিত করা হচ্ছে। গণতন্ত্রের মহান নেত্রী খালেদা জিয়া আজ অসহায়। প্রায় ৭০ বছর বয়সে তাকে যখন দুশ্চিন্তাহীন এক নতুন জীবন কাটানোর কথা, তখন তিনি নির্যাতনে দিশেহারা। আট বছরেরও বেশি সময় ধরে পরিবার-পরিজন থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন থাকতে বাধ্য হতে হচ্ছে। এতটুকু শান্তিও জোটেনি তার কপালে। ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো সম্প্রতি অমানবিকভাবে অকালে মৃত্যুবরণ করেছেন। বড় ছেলে, ছেলের বউ, নাতনীরাও কাছে নেই। তার বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত চালানো হচ্ছে কুৎসা ও অপপ্রচার। এটাই কি তার প্রাপ্য?
গত বছরের ৫ জানুয়ারির প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার সরকার গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠায়। হরণ করা হয় জনগণের ভোটাধিকার। জনগণের সেই গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার পুনরুদ্ধারের দাবিতে আন্দোলন করছেন খালেদা জিয়া। কিন্তু জবরদস্তির মাধ্যমে ন্যায্য গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে নস্যাৎ করে দেয়ার জন্য মরিয়া সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগ চিরদিনের জন্য দেশের একচ্ছত্র ক্ষমতার মালিক হওয়ার লক্ষ্যে এক নীলনকশা বাস্তবায়নে এগিয়ে যাচ্ছে। এই নীলনকশার অংশ হিসেবে তারা তিনবারের নির্বাচিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং ২০ দলীয় ঐক্যজোট তথা জাতীয়তাবাদী শক্তিকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাইছে। প্রথমেই তারা টার্গেট করেছে খালেদা জিয়াকে। পেট্রলবোমা বিস্ফোরণ, যানবাহন ভাঙচুর ও আগুনের ঘটনায় তাকে হুকুমের আসামি করে দেশব্যাপী মামলা দেয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে জারি করা হয়েছে গ্রেফতারি পরোয়ানা। তার বাসভবনের পুলিশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। সর্বশেষ পুলিশ তাকে গ্রেফতার এবং বড় কোনো ষড়যন্ত্রে জড়াতে তার গুলশান অফিসে তল্লাশি চালানোর পাঁয়তারা করছে।
ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে সংগ্রাম করতে গিয়ে ইতোমধ্যে নিষ্ঠুর অত্যাচারের শিকার হয়েছেন খালেদা জিয়া। গত ৩ জানুয়ারি থেকে গুলশান কার্যালয়ে তিনি অবরুদ্ধ। ডজনখানেক ইট ও বালুর ট্রাক বসিয়ে এবং গেট তালাবদ্ধ করে প্রথমে তাকে অবরুদ্ধ করা হয়। তাকে লক্ষ্য করে ছোড়া হয় পেপার ¯েপ্র বা মরিচের গুঁড়ো। তাকে দলের নেতাকর্মী ও দেশবাসীর কাছ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। বিচ্ছিন্ন করা হয় তার অফিসের বিদ্যুৎ লাইন, ডিশলাইন, ইন্টারনেট ও মোবাইল নেটওয়ার্ক। তার ওপর প্রচণ্ড মানসিক চাপ সৃষ্টির জন্য কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধনের নামে কখনো ভাড়া করা লোক, কখনো দলীয় ক্যাডার ও স্কুলের শিশুদের জোরপূর্বক এনে উৎপীড়ন করা হয়। নৌমন্ত্রীর নেতৃত্বে তথাকথিত শ্রমিক পেশাজীবীদের দিয়ে কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচি, গুলশান অফিস লক্ষ্য করে ইট, ককটেল নিক্ষেপ ও গুলিবর্ষণ করে তাকে হুমকি, ভয়ভীতি প্রদর্শনের অপচেষ্টা করা হয়। সরকার কতটা অমানবিক তার নিষ্ঠুর উদাহরণ হচ্ছে খালেদা জিয়া ও তার সাথের লোকদের অভুক্ত রাখার জন্য গুলশান অফিসে খাবার সরবরাহ পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের মহান নেত্রী খালেদা জিয়াকে ‘খুনি, জঙ্গি, সন্ত্রাসী, দানব, আততায়ী, আলকায়েদা, আইএস’Ñ মুখে যখন যা আসছে তা-ই বলে যাচ্ছেন। তার মতো একজন বিশাল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে এ ধরনের গালমন্দ ও বাক্য উচ্চারণে বিবেকে এতটুকু বাধছে না।
এরশাদ জান্তা ও শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের নির্যাতন-নিষ্পেষণ
জেনারেল এরশাদের ৯ বছরের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে এক আপসহীন গণ-আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন খালেদা জিয়া। সেই সংগ্রামে তাকে সইতে হয়েছে নির্মম অত্যাচার। সাতবার তাকে গৃহবন্দী করা হয়। রাজপথে তিনি স্বৈরাচারী সরকারের পুলিশ বাহিনীর লাঠিচার্জের শিকার হন। কাঁদানে গ্যাসের শেল তার শরীরে আঘাত করে। গ্যাসের ঝাঁজালো ধোঁয়া ছুড়ে মারা হয় তার চোখে মুখে। এ সময় তার প্রাণনাশেরও হুমকি দেয়া হয়।
স্বৈরাচারী এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের সব চেয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে খালেদা জিয়া সরকার গঠন করেন। কিন্তু শেখ হাসিনা ঘোষণা দেনÑ ‘এক মুহূর্তের জন্যও তাকে শান্তিতে থাকতে দেবো না।’ কথা অনুযায়ী কাজও করেন তিনি। তার ডাকা ১৭৩ দিনের হরতাল অবরোধ, অসহযোগ এবং জ্বালাও-পোড়াওয়ে খালেদা জিয়া শেষের দিকে ঠিকই শান্তিতে আর দেশ চালাতে পারেননি। তার সরকারকে পদে পদে বিপর্যস্ত করা হয়েছে। দেশকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নেয়া হয়েছে। তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল নাসিমের সাথে গোপন আঁতাত করে দেশ ও সরকারকে অস্থিতিশীলও করা হয়। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা বিরোধী দল বিএনপির ওপর প্রচণ্ড দমন-পীড়ন চালান। হাজার হাজার রাজনৈতিক মামলা দেয়ার পাশাপাশি বিএনপির ৬০ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। গুলি ও টিয়ার শেল মেরে পল্টনে খালেদা জিয়াকে গুরুতর আহত ও তার জনসভা ভেঙে দেয়া হয়। রাজনৈতিক আক্রোশে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দু’টি মামলাও দেয়া হয়।
খালেদা জিয়াকে ১/১১’র জরুরি সরকারের নির্যাতন
আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে জেনারেল মইন-মাসুদ গংয়ের সাথে গোপন আঁতাতের অশুভ প্রক্রিয়ায় ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত জরুরি সরকার ক্ষমতায় আসে। শেখ হাসিনা প্রকাশ্যে বলেন, এ সরকার তার আন্দোলনের ফসল। এই জরুরি সরকারের নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন খালেদা জিয়া। কুচক্রীরা প্রথমে তাকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করার জন্য বিদেশে সপরিবারে নির্বাসনে পাঠানোর অপচেষ্টা চালায়। এটা ব্যর্থ হলে তাকে বিনা অপরাধে ছয় মাস ক্যান্টনমেন্টের বাসভবনে গৃহবন্দী করে রাখা হয়। পরে গ্রেফতার করে এক বছর নির্জন কারাগারে বন্দী রাখা হয়। তার বিরুদ্ধে চারটি মামলা দেয়া হয় এবং চালানো হয় সীমাহীন কুৎসা ও অপপ্রচার। শুধু খালেদা জিয়াই নন, তার দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানকেও গ্রেফতার করা হয়। তারেক রহমানের ওপর চলে অমানুষিক নির্যাতন। তার মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে দেয়া হয়। বন্দী থাকার কারণে মা বেগম তৈয়বা মজুমদারের মৃত্যুর সময়ও পাশে থাকতে পারেননি তিনি। তাকে গুরুতর অসুস্থ দুই সন্তানকে দেখতেও দেয়া হয়নি। এক বছর পর প্যারোলে মুক্তি পেলেও পরিবার থেকে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। এখন পর্যন্ত তিনি ছেলে, ছেলের বউ ও নাতনীদের নিয়ে একত্রে থাকতে পারছেন না। নিঃসঙ্গ এবং বিচ্ছিন্ন জীবনযাপনই করতে হচ্ছে খালেদা জিয়াকে।
জরুরি সরকারের সাথে আঁতাত করে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনার সরকার খালেদা জিয়া ও তার দল বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে। ২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে বলপূর্বক খালেদা জিয়াকে সেনানিবাসের বাসভবন থেকে এক কাপড়ে উচ্ছেদ করা হয়। এই বাড়িটি ছিল স্বামী শহীদ জিয়াউর রহমানের সাথে তার ৩৮ বছরের স্মৃতিবিজড়িত ঠিকানা। বাড়ি থেকে উচ্ছেদের সময় সারা দিন তিনি অভুক্ত ছিলেন। অথচ খালেদা জিয়ার নামে তৎকালীন সংসদ বাড়িটি বরাদ্দ দিয়েছিল। এ দেশের জনপ্রিয় রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সামরিক বাহিনীর সদস্যদের জন্য ডিওএইচএস বা সামরিক আবাসিক এলাকা গড়ে তুলেছিলেন। সেখানে অনেক কর্মকর্তাকে প্লট বরাদ্দের ব্যবস্থা করেছিলেন। নিজে সেনাবাহিনীর প্রধান হয়েও ডিওএইচএসে কোনো প্লট বরাদ্দ নেননি। অন্য কোথাও তার নিজের নামে একদণ্ড জমিও ছিল না। তাই শাহাদতের পর রাষ্ট্র তার পরিবারের জন্য বাড়ি বরাদ্দ করেছিল এবং সেটা সংসদে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে। সেই সিদ্ধান্তের সাথে তৎকালীন বিরোধীদল আওয়ামী লীগও ছিল। কিন্তু প্রতিহিংসার কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই বাড়ির বরাদ্দও বাতিলের ব্যবস্থা করেন। মালয়েশিয়ায় চিকিৎসাধীন থাকাকালে খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর অকাল মৃত্যু হয়। এ সময় মা খালেদা জিয়া গুলশান কার্যালয়ে অবরুদ্ধ। তার লাশ দেশে আসে। লাশ জড়িয়ে ধরে অঝোর কান্না ছাড়া কিছুই করার ছিল না মায়ের। তবে কোকোর নামাজে জানাজায় লাখ লাখ মানুষ শরিক হয়ে এ কথাই জানিয়ে দেয় জিয়া পরিবারের পাশে বরাবরের মতোই তারা আছেন। কোকোর লাশ বনানীর সামরিক কবরস্থানে দাফনের জন্য আবেদন করা হলে সেখানে সাড়ে তিন হাত জায়গাও তার ভাগ্যে জোটেনি। অথচ কোকোর বাবা ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক, সাবেক সেনাপ্রধান এবং নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি। দেশের দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই তিনি শাহাদতবরণ করেন। সেনা পরিবারের সদস্য হিসেবে কোকোর বনানী সামরিক কবরস্থানে দাফনের অধিকার ছিল। প্রতিহিংসাপরায়ণ সরকার তাকে প্রাপ্য সুবিধা থেকেও বঞ্চিত করে।
শেখ হাসিনার দ্বিতীয় সরকারের নির্যাতন
২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার জন্য এক নীলনকশা বাস্তবায়ন শুরু করেন। এর অংশ হিসেবেই সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়। এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন খালেদা জিয়া। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে তিনি নির্বাচন চান। কিন্তু নানা চলছাতুরীর আশ্রয় নিয়ে শেখ হাসিনার সরকার গত বছরের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠানে এগিয়ে যান। নির্বাচনের আগে ২৯ ডিসেম্বর খালেদা জিয়া জনগণকে জাতীয় পতাকা হাতে ঢাকায় মার্চ করার কর্মসূচি আহ্বান করেন। সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে এ কর্মসূচি ভণ্ডুল করে দেয়। খালেদা জিয়ার বাসভবনের সামনে বালুর ট্রাক বসিয়ে তাকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। ওই দিন বাসভবন থেকে তিনি বেরিয়ে আসার অনেক চেষ্টা করেন। তাকে আসতে দেয়া হয়নি। ফলে গেটে দাঁড়িয়েই তিনি বক্তৃতা দেন। তাকে বাসভবনে অবরুদ্ধ রেখেই ৫ জানুয়ারি অস্ত্র ও গুলির মুখে একতরফাভাবে প্রহসনের নির্বাচনী তামাশা করা হয়।
খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সৌজন্যবোধ
২৪ জানুয়ারি আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর সংবাদ জানার পর ওই দিন সন্ধ্যায় খালেদা জিয়াকে সমবেদনা জানাতে গুলশান কার্যালয়ে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু গেট বন্ধ থাকায় তিনি সেখানে ঢুকতে পারেননি। গুলশান অফিসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন ছোট ছেলের মৃত্যুতে খালেদা জিয়া এতটাই ভেঙে পড়েছেন যে, ডাক্তার তাকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছেন। এ কথা প্রধানমন্ত্রীর অফিসকে আগেই জানানো হয়েছিল। তবুও প্রধানমন্ত্রী যখন এসে পড়েছেন খালেদা জিয়া অচেতন থাকলেও তার কর্মকর্তা কিংবা দলের নেতারা প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়ে কৃতজ্ঞতা জানানো প্রয়োজন ছিল। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ অবশ্য পর দিন এ জন্য ভুল স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং বিবৃতির মাধ্যমে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।
এই বিষয়টি একটি ব্যতিক্রম হলেও রাজনীতির ৩৩ বছরে খালেদা জিয়ারই আছে বিনয় আর উদারতার এক উজ্জ্বল উদাহরণ। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় চট্টগ্রামে শেখ হাসিনার জনসভায় গুলি হয়েছিল। এর প্রতিবাদে ৭ দল ও ১৫ দলের কর্মসূচি ছিল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে দুই নেত্রীর নেতৃত্বে শোকমিছিল। কিন্তু শোকমিছিলে সে দিন শেখ হাসিনা আসেননি, বেগম জিয়া ঠিকই এসেছিলেন। তেমনি ১৯৮৬ সালের ২০ মার্চ বায়তুল মোকাররম থেকে ৭ দল ও ১৫ দলের এরশাদবিরোধী কর্মসূচি ছিল দুই নেত্রীর নেতৃত্বে বায়তুল মোকাররম থেকে যৌথ গণমিছিল। শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে সেই মিছিলেও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বেগম জিয়া। ১৯৮৬ সালে এরশাদের পাতানো নির্বাচনের পর ৭ দল ও ১৫ দলের ঐক্য ভেঙে যায়। ১৯৮৮ সালে আবার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন শুরু করার উদ্যোগ খালেদা জিয়াই নিয়েছিলেন। এ লক্ষ্যে তিনি শেখ হাসিনাকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাতে পয়লা বৈশাখ ছুটে গিয়েছিলেন ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাড়িতে। শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের বিয়েতে যোগ দিতে এমপি হোস্টেলের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। শেখ হাসিনা তাকে রিসিভ করেননি কিন্তু সেনাকুঞ্জে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানের বিয়েতে শেখ হাসিনা এলে গাড়ি থেকে নামার পর বেগম জিয়া দুইবারই সেখানে নিজে উপস্থিত থেকে তাকে স্বাগত জানান এবং এক সাথে পাশাপাশি বসে খাবার খান ও ছেলের বউকে দেখাতে নিয়ে যান। খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকা কালে হজ করে এসে শেখ হাসিনাকে জায়নামাজ, তসবিহ, আতর ও খেজুর পাঠিয়েছেন। আওয়ামী লীগের অফিসের সামনে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর সমবেদনা জানাতে সুধা সদনে যেতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাদের প্রবল আপত্তির মুখে যেতে পারেননি। এক-এগারোর জরুরি সরকার শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করে কোর্টে তোলার সময় কোর্ট প্রাঙ্গণে তার যে দুর্ভোগ হয়, পুলিশ তাকে যেভাবে হেস্তনেস্ত করে, বিবৃতি দিয়ে এর প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন বেগম জিয়া। তেমনি শেরেবাংলা নগরের সাবজেলে থাকা অবস্থায় শেখ হাসিনার চোখের অসুখ বেড়ে গেলে কোর্টে হাজিরা দিতে গিয়ে বেগম জিয়া তার বক্তৃতায় তাকে সুচিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর দাবির প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে সরকারকে ত্বরিত ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। জরুরি শাসনের অবসানের পর অনুষ্ঠিত ২০০৮ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করেন। এ সময় শেখ হাসিনার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়ার মৃত্যু সংবাদে খালেদা জিয়া গভীর শোক প্রকাশ করেন এবং শোক জানাতে ছুটে যান ধানমন্ডির সুধা সদনে। সেখানে তিনি শেখ হাসিনাকে বুকে জড়িয়ে ধরে সমবেদনা জানান। রাজনীতিতে এ ধরনের সৌজন্যবোধ এবং সংস্কৃতিতেই বিশ্বাসী বেগম খালেদা জিয়া।
নির্যাতনই সব কিছুর শেষ নয়
রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা আছে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে। এক দল আরেক দলের প্রতিদ্বন্দ্বী। এক নেতা আরেক নেতার প্রতিদ্বন্দ্বী। দলে দলে, নেতায় নেতায় প্রতিযোগিতা হয়, প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। কেউ কারো শত্রু হয় না। কিন্তু আজকের রাজনীতি যেন শত্রুতায় রূপ নিয়েছে। আওয়ামী লীগ বিরোধী দল বিএনপিকে প্রতিপক্ষ বা প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবছে না। ভাবছে শত্রু। তেমনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তারই রাজনৈতিক সহযোদ্ধা খালেদা জিয়াকে ভাবছেন শত্রু। ৭ মার্চের জনসভায়ও খালেদা জিয়াকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে সে ভাষায়ই বক্তব্য দিয়েছেন। বলেছেন, ‘খালেদা জিয়াকে শাস্তি পেতেই হবে। বাংলার মাটিতে তার স্থান নেই।’
খালেদা জিয়ার ওপর যে নির্মম সীমাহীন নির্যাতন হচ্ছে তার উদাহরণ বিরল। তবুও তাকে আরো নির্যাতন করতে হবে। তাকে আর কত নির্যাতন? আওয়ামী লীগকে, জননেত্রী শেখ হাসিনাকে বুঝতে হবে কেউ কাউকে শেষ করে দিতে পারে না। আওয়ামী লীগ যেমন বিএনপিকে নির্মূল করতে পারবে না, তেমনি বিএনপিও আওয়ামী লীগকে নির্মূল করতে পারবে না। খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রেও এ কথা বলা যায়, তাকে নির্যাতনই সব কিছুর শেষ নয়। কবি নজরুলের ভাষায়-
যুগের ধর্ম এই-
পীড়ন করিলে সে পীড়ন এসে পীড়া দেবে তোমাকেই!
শোনো মর্ত্যরে জীব
অন্যেরে যত করিবে পীড়ন, নিজে হবে তত কীব!
লেখক : জাতীয় প্রেস কাবের সাধারণ সম্পাদক
কিন্তু সেই তাকেই আজ অত্যাচার-নির্যাতনে নিষ্পেষিত করা হচ্ছে। গণতন্ত্রের মহান নেত্রী খালেদা জিয়া আজ অসহায়। প্রায় ৭০ বছর বয়সে তাকে যখন দুশ্চিন্তাহীন এক নতুন জীবন কাটানোর কথা, তখন তিনি নির্যাতনে দিশেহারা। আট বছরেরও বেশি সময় ধরে পরিবার-পরিজন থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন থাকতে বাধ্য হতে হচ্ছে। এতটুকু শান্তিও জোটেনি তার কপালে। ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো সম্প্রতি অমানবিকভাবে অকালে মৃত্যুবরণ করেছেন। বড় ছেলে, ছেলের বউ, নাতনীরাও কাছে নেই। তার বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত চালানো হচ্ছে কুৎসা ও অপপ্রচার। এটাই কি তার প্রাপ্য?
গত বছরের ৫ জানুয়ারির প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার সরকার গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠায়। হরণ করা হয় জনগণের ভোটাধিকার। জনগণের সেই গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার পুনরুদ্ধারের দাবিতে আন্দোলন করছেন খালেদা জিয়া। কিন্তু জবরদস্তির মাধ্যমে ন্যায্য গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে নস্যাৎ করে দেয়ার জন্য মরিয়া সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগ চিরদিনের জন্য দেশের একচ্ছত্র ক্ষমতার মালিক হওয়ার লক্ষ্যে এক নীলনকশা বাস্তবায়নে এগিয়ে যাচ্ছে। এই নীলনকশার অংশ হিসেবে তারা তিনবারের নির্বাচিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং ২০ দলীয় ঐক্যজোট তথা জাতীয়তাবাদী শক্তিকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাইছে। প্রথমেই তারা টার্গেট করেছে খালেদা জিয়াকে। পেট্রলবোমা বিস্ফোরণ, যানবাহন ভাঙচুর ও আগুনের ঘটনায় তাকে হুকুমের আসামি করে দেশব্যাপী মামলা দেয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে জারি করা হয়েছে গ্রেফতারি পরোয়ানা। তার বাসভবনের পুলিশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। সর্বশেষ পুলিশ তাকে গ্রেফতার এবং বড় কোনো ষড়যন্ত্রে জড়াতে তার গুলশান অফিসে তল্লাশি চালানোর পাঁয়তারা করছে।
ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে সংগ্রাম করতে গিয়ে ইতোমধ্যে নিষ্ঠুর অত্যাচারের শিকার হয়েছেন খালেদা জিয়া। গত ৩ জানুয়ারি থেকে গুলশান কার্যালয়ে তিনি অবরুদ্ধ। ডজনখানেক ইট ও বালুর ট্রাক বসিয়ে এবং গেট তালাবদ্ধ করে প্রথমে তাকে অবরুদ্ধ করা হয়। তাকে লক্ষ্য করে ছোড়া হয় পেপার ¯েপ্র বা মরিচের গুঁড়ো। তাকে দলের নেতাকর্মী ও দেশবাসীর কাছ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। বিচ্ছিন্ন করা হয় তার অফিসের বিদ্যুৎ লাইন, ডিশলাইন, ইন্টারনেট ও মোবাইল নেটওয়ার্ক। তার ওপর প্রচণ্ড মানসিক চাপ সৃষ্টির জন্য কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধনের নামে কখনো ভাড়া করা লোক, কখনো দলীয় ক্যাডার ও স্কুলের শিশুদের জোরপূর্বক এনে উৎপীড়ন করা হয়। নৌমন্ত্রীর নেতৃত্বে তথাকথিত শ্রমিক পেশাজীবীদের দিয়ে কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচি, গুলশান অফিস লক্ষ্য করে ইট, ককটেল নিক্ষেপ ও গুলিবর্ষণ করে তাকে হুমকি, ভয়ভীতি প্রদর্শনের অপচেষ্টা করা হয়। সরকার কতটা অমানবিক তার নিষ্ঠুর উদাহরণ হচ্ছে খালেদা জিয়া ও তার সাথের লোকদের অভুক্ত রাখার জন্য গুলশান অফিসে খাবার সরবরাহ পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের মহান নেত্রী খালেদা জিয়াকে ‘খুনি, জঙ্গি, সন্ত্রাসী, দানব, আততায়ী, আলকায়েদা, আইএস’Ñ মুখে যখন যা আসছে তা-ই বলে যাচ্ছেন। তার মতো একজন বিশাল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে এ ধরনের গালমন্দ ও বাক্য উচ্চারণে বিবেকে এতটুকু বাধছে না।
এরশাদ জান্তা ও শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের নির্যাতন-নিষ্পেষণ
জেনারেল এরশাদের ৯ বছরের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে এক আপসহীন গণ-আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন খালেদা জিয়া। সেই সংগ্রামে তাকে সইতে হয়েছে নির্মম অত্যাচার। সাতবার তাকে গৃহবন্দী করা হয়। রাজপথে তিনি স্বৈরাচারী সরকারের পুলিশ বাহিনীর লাঠিচার্জের শিকার হন। কাঁদানে গ্যাসের শেল তার শরীরে আঘাত করে। গ্যাসের ঝাঁজালো ধোঁয়া ছুড়ে মারা হয় তার চোখে মুখে। এ সময় তার প্রাণনাশেরও হুমকি দেয়া হয়।
স্বৈরাচারী এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের সব চেয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে খালেদা জিয়া সরকার গঠন করেন। কিন্তু শেখ হাসিনা ঘোষণা দেনÑ ‘এক মুহূর্তের জন্যও তাকে শান্তিতে থাকতে দেবো না।’ কথা অনুযায়ী কাজও করেন তিনি। তার ডাকা ১৭৩ দিনের হরতাল অবরোধ, অসহযোগ এবং জ্বালাও-পোড়াওয়ে খালেদা জিয়া শেষের দিকে ঠিকই শান্তিতে আর দেশ চালাতে পারেননি। তার সরকারকে পদে পদে বিপর্যস্ত করা হয়েছে। দেশকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নেয়া হয়েছে। তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল নাসিমের সাথে গোপন আঁতাত করে দেশ ও সরকারকে অস্থিতিশীলও করা হয়। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা বিরোধী দল বিএনপির ওপর প্রচণ্ড দমন-পীড়ন চালান। হাজার হাজার রাজনৈতিক মামলা দেয়ার পাশাপাশি বিএনপির ৬০ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। গুলি ও টিয়ার শেল মেরে পল্টনে খালেদা জিয়াকে গুরুতর আহত ও তার জনসভা ভেঙে দেয়া হয়। রাজনৈতিক আক্রোশে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দু’টি মামলাও দেয়া হয়।
খালেদা জিয়াকে ১/১১’র জরুরি সরকারের নির্যাতন
আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে জেনারেল মইন-মাসুদ গংয়ের সাথে গোপন আঁতাতের অশুভ প্রক্রিয়ায় ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত জরুরি সরকার ক্ষমতায় আসে। শেখ হাসিনা প্রকাশ্যে বলেন, এ সরকার তার আন্দোলনের ফসল। এই জরুরি সরকারের নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন খালেদা জিয়া। কুচক্রীরা প্রথমে তাকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করার জন্য বিদেশে সপরিবারে নির্বাসনে পাঠানোর অপচেষ্টা চালায়। এটা ব্যর্থ হলে তাকে বিনা অপরাধে ছয় মাস ক্যান্টনমেন্টের বাসভবনে গৃহবন্দী করে রাখা হয়। পরে গ্রেফতার করে এক বছর নির্জন কারাগারে বন্দী রাখা হয়। তার বিরুদ্ধে চারটি মামলা দেয়া হয় এবং চালানো হয় সীমাহীন কুৎসা ও অপপ্রচার। শুধু খালেদা জিয়াই নন, তার দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানকেও গ্রেফতার করা হয়। তারেক রহমানের ওপর চলে অমানুষিক নির্যাতন। তার মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে দেয়া হয়। বন্দী থাকার কারণে মা বেগম তৈয়বা মজুমদারের মৃত্যুর সময়ও পাশে থাকতে পারেননি তিনি। তাকে গুরুতর অসুস্থ দুই সন্তানকে দেখতেও দেয়া হয়নি। এক বছর পর প্যারোলে মুক্তি পেলেও পরিবার থেকে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। এখন পর্যন্ত তিনি ছেলে, ছেলের বউ ও নাতনীদের নিয়ে একত্রে থাকতে পারছেন না। নিঃসঙ্গ এবং বিচ্ছিন্ন জীবনযাপনই করতে হচ্ছে খালেদা জিয়াকে।
জরুরি সরকারের সাথে আঁতাত করে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনার সরকার খালেদা জিয়া ও তার দল বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে। ২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে বলপূর্বক খালেদা জিয়াকে সেনানিবাসের বাসভবন থেকে এক কাপড়ে উচ্ছেদ করা হয়। এই বাড়িটি ছিল স্বামী শহীদ জিয়াউর রহমানের সাথে তার ৩৮ বছরের স্মৃতিবিজড়িত ঠিকানা। বাড়ি থেকে উচ্ছেদের সময় সারা দিন তিনি অভুক্ত ছিলেন। অথচ খালেদা জিয়ার নামে তৎকালীন সংসদ বাড়িটি বরাদ্দ দিয়েছিল। এ দেশের জনপ্রিয় রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সামরিক বাহিনীর সদস্যদের জন্য ডিওএইচএস বা সামরিক আবাসিক এলাকা গড়ে তুলেছিলেন। সেখানে অনেক কর্মকর্তাকে প্লট বরাদ্দের ব্যবস্থা করেছিলেন। নিজে সেনাবাহিনীর প্রধান হয়েও ডিওএইচএসে কোনো প্লট বরাদ্দ নেননি। অন্য কোথাও তার নিজের নামে একদণ্ড জমিও ছিল না। তাই শাহাদতের পর রাষ্ট্র তার পরিবারের জন্য বাড়ি বরাদ্দ করেছিল এবং সেটা সংসদে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে। সেই সিদ্ধান্তের সাথে তৎকালীন বিরোধীদল আওয়ামী লীগও ছিল। কিন্তু প্রতিহিংসার কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই বাড়ির বরাদ্দও বাতিলের ব্যবস্থা করেন। মালয়েশিয়ায় চিকিৎসাধীন থাকাকালে খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর অকাল মৃত্যু হয়। এ সময় মা খালেদা জিয়া গুলশান কার্যালয়ে অবরুদ্ধ। তার লাশ দেশে আসে। লাশ জড়িয়ে ধরে অঝোর কান্না ছাড়া কিছুই করার ছিল না মায়ের। তবে কোকোর নামাজে জানাজায় লাখ লাখ মানুষ শরিক হয়ে এ কথাই জানিয়ে দেয় জিয়া পরিবারের পাশে বরাবরের মতোই তারা আছেন। কোকোর লাশ বনানীর সামরিক কবরস্থানে দাফনের জন্য আবেদন করা হলে সেখানে সাড়ে তিন হাত জায়গাও তার ভাগ্যে জোটেনি। অথচ কোকোর বাবা ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক, সাবেক সেনাপ্রধান এবং নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি। দেশের দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই তিনি শাহাদতবরণ করেন। সেনা পরিবারের সদস্য হিসেবে কোকোর বনানী সামরিক কবরস্থানে দাফনের অধিকার ছিল। প্রতিহিংসাপরায়ণ সরকার তাকে প্রাপ্য সুবিধা থেকেও বঞ্চিত করে।
শেখ হাসিনার দ্বিতীয় সরকারের নির্যাতন
২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার জন্য এক নীলনকশা বাস্তবায়ন শুরু করেন। এর অংশ হিসেবেই সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়। এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন খালেদা জিয়া। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে তিনি নির্বাচন চান। কিন্তু নানা চলছাতুরীর আশ্রয় নিয়ে শেখ হাসিনার সরকার গত বছরের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠানে এগিয়ে যান। নির্বাচনের আগে ২৯ ডিসেম্বর খালেদা জিয়া জনগণকে জাতীয় পতাকা হাতে ঢাকায় মার্চ করার কর্মসূচি আহ্বান করেন। সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে এ কর্মসূচি ভণ্ডুল করে দেয়। খালেদা জিয়ার বাসভবনের সামনে বালুর ট্রাক বসিয়ে তাকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। ওই দিন বাসভবন থেকে তিনি বেরিয়ে আসার অনেক চেষ্টা করেন। তাকে আসতে দেয়া হয়নি। ফলে গেটে দাঁড়িয়েই তিনি বক্তৃতা দেন। তাকে বাসভবনে অবরুদ্ধ রেখেই ৫ জানুয়ারি অস্ত্র ও গুলির মুখে একতরফাভাবে প্রহসনের নির্বাচনী তামাশা করা হয়।
খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সৌজন্যবোধ
২৪ জানুয়ারি আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর সংবাদ জানার পর ওই দিন সন্ধ্যায় খালেদা জিয়াকে সমবেদনা জানাতে গুলশান কার্যালয়ে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু গেট বন্ধ থাকায় তিনি সেখানে ঢুকতে পারেননি। গুলশান অফিসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন ছোট ছেলের মৃত্যুতে খালেদা জিয়া এতটাই ভেঙে পড়েছেন যে, ডাক্তার তাকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছেন। এ কথা প্রধানমন্ত্রীর অফিসকে আগেই জানানো হয়েছিল। তবুও প্রধানমন্ত্রী যখন এসে পড়েছেন খালেদা জিয়া অচেতন থাকলেও তার কর্মকর্তা কিংবা দলের নেতারা প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়ে কৃতজ্ঞতা জানানো প্রয়োজন ছিল। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ অবশ্য পর দিন এ জন্য ভুল স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং বিবৃতির মাধ্যমে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।
এই বিষয়টি একটি ব্যতিক্রম হলেও রাজনীতির ৩৩ বছরে খালেদা জিয়ারই আছে বিনয় আর উদারতার এক উজ্জ্বল উদাহরণ। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় চট্টগ্রামে শেখ হাসিনার জনসভায় গুলি হয়েছিল। এর প্রতিবাদে ৭ দল ও ১৫ দলের কর্মসূচি ছিল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে দুই নেত্রীর নেতৃত্বে শোকমিছিল। কিন্তু শোকমিছিলে সে দিন শেখ হাসিনা আসেননি, বেগম জিয়া ঠিকই এসেছিলেন। তেমনি ১৯৮৬ সালের ২০ মার্চ বায়তুল মোকাররম থেকে ৭ দল ও ১৫ দলের এরশাদবিরোধী কর্মসূচি ছিল দুই নেত্রীর নেতৃত্বে বায়তুল মোকাররম থেকে যৌথ গণমিছিল। শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে সেই মিছিলেও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বেগম জিয়া। ১৯৮৬ সালে এরশাদের পাতানো নির্বাচনের পর ৭ দল ও ১৫ দলের ঐক্য ভেঙে যায়। ১৯৮৮ সালে আবার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন শুরু করার উদ্যোগ খালেদা জিয়াই নিয়েছিলেন। এ লক্ষ্যে তিনি শেখ হাসিনাকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাতে পয়লা বৈশাখ ছুটে গিয়েছিলেন ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাড়িতে। শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের বিয়েতে যোগ দিতে এমপি হোস্টেলের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। শেখ হাসিনা তাকে রিসিভ করেননি কিন্তু সেনাকুঞ্জে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানের বিয়েতে শেখ হাসিনা এলে গাড়ি থেকে নামার পর বেগম জিয়া দুইবারই সেখানে নিজে উপস্থিত থেকে তাকে স্বাগত জানান এবং এক সাথে পাশাপাশি বসে খাবার খান ও ছেলের বউকে দেখাতে নিয়ে যান। খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকা কালে হজ করে এসে শেখ হাসিনাকে জায়নামাজ, তসবিহ, আতর ও খেজুর পাঠিয়েছেন। আওয়ামী লীগের অফিসের সামনে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর সমবেদনা জানাতে সুধা সদনে যেতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাদের প্রবল আপত্তির মুখে যেতে পারেননি। এক-এগারোর জরুরি সরকার শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করে কোর্টে তোলার সময় কোর্ট প্রাঙ্গণে তার যে দুর্ভোগ হয়, পুলিশ তাকে যেভাবে হেস্তনেস্ত করে, বিবৃতি দিয়ে এর প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন বেগম জিয়া। তেমনি শেরেবাংলা নগরের সাবজেলে থাকা অবস্থায় শেখ হাসিনার চোখের অসুখ বেড়ে গেলে কোর্টে হাজিরা দিতে গিয়ে বেগম জিয়া তার বক্তৃতায় তাকে সুচিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর দাবির প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে সরকারকে ত্বরিত ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। জরুরি শাসনের অবসানের পর অনুষ্ঠিত ২০০৮ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করেন। এ সময় শেখ হাসিনার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়ার মৃত্যু সংবাদে খালেদা জিয়া গভীর শোক প্রকাশ করেন এবং শোক জানাতে ছুটে যান ধানমন্ডির সুধা সদনে। সেখানে তিনি শেখ হাসিনাকে বুকে জড়িয়ে ধরে সমবেদনা জানান। রাজনীতিতে এ ধরনের সৌজন্যবোধ এবং সংস্কৃতিতেই বিশ্বাসী বেগম খালেদা জিয়া।
নির্যাতনই সব কিছুর শেষ নয়
রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা আছে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে। এক দল আরেক দলের প্রতিদ্বন্দ্বী। এক নেতা আরেক নেতার প্রতিদ্বন্দ্বী। দলে দলে, নেতায় নেতায় প্রতিযোগিতা হয়, প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। কেউ কারো শত্রু হয় না। কিন্তু আজকের রাজনীতি যেন শত্রুতায় রূপ নিয়েছে। আওয়ামী লীগ বিরোধী দল বিএনপিকে প্রতিপক্ষ বা প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবছে না। ভাবছে শত্রু। তেমনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তারই রাজনৈতিক সহযোদ্ধা খালেদা জিয়াকে ভাবছেন শত্রু। ৭ মার্চের জনসভায়ও খালেদা জিয়াকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে সে ভাষায়ই বক্তব্য দিয়েছেন। বলেছেন, ‘খালেদা জিয়াকে শাস্তি পেতেই হবে। বাংলার মাটিতে তার স্থান নেই।’
খালেদা জিয়ার ওপর যে নির্মম সীমাহীন নির্যাতন হচ্ছে তার উদাহরণ বিরল। তবুও তাকে আরো নির্যাতন করতে হবে। তাকে আর কত নির্যাতন? আওয়ামী লীগকে, জননেত্রী শেখ হাসিনাকে বুঝতে হবে কেউ কাউকে শেষ করে দিতে পারে না। আওয়ামী লীগ যেমন বিএনপিকে নির্মূল করতে পারবে না, তেমনি বিএনপিও আওয়ামী লীগকে নির্মূল করতে পারবে না। খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রেও এ কথা বলা যায়, তাকে নির্যাতনই সব কিছুর শেষ নয়। কবি নজরুলের ভাষায়-
যুগের ধর্ম এই-
পীড়ন করিলে সে পীড়ন এসে পীড়া দেবে তোমাকেই!
শোনো মর্ত্যরে জীব
অন্যেরে যত করিবে পীড়ন, নিজে হবে তত কীব!
লেখক : জাতীয় প্রেস কাবের সাধারণ সম্পাদক
No comments