সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য by ড. একেএম শাহনাওয়াজ

১৫২
উনিশ শতকে অর্থনৈতিকভাবে মুসলমান সমাজ দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। হিন্দু-মুসলমান এই দুই সম্প্রদায়ের এমন মানসিক গড়ন দেখে আতংকিত হয়ে পড়েছিলেন দুই সম্প্রদায়ের কয়েকজন শিক্ষিত আধুনিক মানুষ। তারা বুঝেছিলেন, স্ব-স্ব সম্প্রদায়ের মানুষদের রক্ষণশীলতার ঘেরাটোপ থেকে বের করে আনতে হবে। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। কিন্তু এ পথে হাঁটা অত সহজ হবে না। সমাজ সংস্কারের মধ্য দিয়ে মানুষকে মুক্ত করতে হবে চিন্তার বন্দিত্ব থেকে।
এই প্রেক্ষাপটে দুই সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে বেশ কয়েকজন সংস্কারক বেরিয়ে এলেন। হিন্দু সমাজ সংস্কারে যারা বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন রাজা রামমোহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। আর মুসলিম সংস্কারকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সৈয়দ আমীর আলী, নওয়াব আবদুল লতিফ, হাজী মোহাম্মদ মহসীন, হাজী শরিয়তুল্লাহ প্রমুখ।
হিন্দু সমাজ সংস্কার : উনিশ শতকে ভারতে সমাজ সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে ধর্মসংস্কার ও শিক্ষা উন্নয়নের একটি সম্পর্ক ছিল। বাংলার হিন্দু সমাজ সংস্কারে অভিন্ন বাস্তবতা প্রত্যক্ষ করা যায়।
রাজা রামমোহন রায় (১৭৭৪-১৮৩৩) : বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী রামমোহন রায় উনিশ শতকের একজন ধর্ম ও সমাজ সংস্কারক হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিত। হুগলি জেলার রাধানগর গ্রামে এক হিন্দু পরিবারে তার জন্ম হয়েছিল। রামমোহন রায়ের পারিবারিক ধর্মীয় ঐতিহ্য সে যুগের বিচারে ব্যতিক্রমী ছিল। রামমোহন রায়ের পরিবার রাঢ়ী ব্রাহ্মণ। পারিবারিক উপাধি বন্দ্যোপাধ্যায়। তার ঠাকুরদা কৃষ্ণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ‘রায়’ উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। রামমোহনের পিতা রামকান্ত রায় বৈষ্ণব মতবাদ গ্রহণ করেন। অন্যদিকে তার মা তারিণী দেবী শৈব পরিবারের মেয়ে ছিলেন। এসব কারণেই সম্ভবত একটি উদার ও মিশ্র ধর্মীয় অবয়বের ভেতর অনেকটা মুক্ত মানসিকতায় বেড়ে উঠেছিলেন রামমোহন রায়। তাই তার রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা তার ধর্মীয় ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা প্রভাবিত ছিল।
রাজা রামমোহন রায় একজন ধর্ম সংস্কারক ও শিক্ষা সংস্কারক হিসেবে পরিচিত হলেও সমাজ সংস্কারক হিসেবেই তার ভূমিকা ছিল সবচেয়ে উজ্জ্বল। তার ধর্মীয় ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি রাজনৈতিক চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করেছিল।
রামমোহন রায়ের শিক্ষা জীবনের উজ্জ্বল সময়টি কাটে আঠারো শতকের শেষদিকে। বাংলা ও হিন্দি ভাষা চর্চার মধ্য দিয়ে শিক্ষা জীবন শুরু করলেও ধীরে ধীরে সংস্কৃত, ইংরেজি, আরবি ও ফারসি ভাষায় বিশেষ বুৎপত্তি অর্জন করেন। তিনি গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে যেমন হিন্দু ধর্মীয় গ্রন্থগুলো অধ্যয়ন করেন, তেমনি ইসলামী ধর্মতত্ত্ব ও আইনশাস্ত্রের একজন নিষ্ঠাবান পাঠক ছিলেন।
উনিশ শতকে হিন্দু সমাজ সংস্কারে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছিলেন রামমোহন রায়। উনিশ শতকের ইউরোপীয়দের চোখে রামমোহন রায় ছিলেন ভারতের একজন আধুনিক মানুষ। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে বুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন রামমোহন রায়। রামমোহন বেন্থাম, মন্টেস্কু প্রমুখ পাশ্চাত্য চিন্তাবিদের জ্ঞানচর্চায় প্রভাবিত হয়েছিলেন।
১৮৩৭ সাল পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনস্থ বাংলার সরকারি ভাষা ছিল ফারসি। তাই রাজস্ব আদায় ও বিচারকাজ পরিচালনার জন্য ইংরেজি, আরবি ও ফারসি ভাষা জানা ভারতীয়দের জন্য সরকারি চাকরির সুযোগ ছিল। সাধারণত এই পদাধিকারীরা মুন্সি নামে পরিচিত ছিলেন। এই সূত্রে রামমোহন রায় মুর্শিদাবাদের আপিল আদালতের রেজিস্ট্রার টমাস উডফোর্ডের অধীনে মুন্সি পদে চাকরি গ্রহণ করেন। ১৮০৩ থেকে ১৮১৫ পর্যন্ত তিনি এ পদে বহাল ছিলেন।

No comments

Powered by Blogger.