সুন্দরবন- জাতিসংঘের সুপারিশ আমলে নিন
গত
বছরের ৯ ডিসেম্বর সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে তেলবাহী ট্যাঙ্কারডুবিতে
বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে দেখা দেওয়া পরিবেশগত বিপর্যয় নিয়ে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক
দল বৃহস্পতিবার পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে যে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা
দিয়েছে, তাতে 'অপ্রত্যাশিত' কোনো তথ্য নেই। বস্তুত সুন্দরবনের দুর্গত এলাকা
পাঁচ দিন পরিদর্শন শেষে গত ৩১ ডিসেম্বর মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া খসড়া
প্রতিবেদন এবং সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্যেরই সম্প্রসারিত রূপমাত্র। সোমবার
সমকালে প্রকাশিত প্রতিবেদন সূত্রে জানা যাচ্ছে, পর্যবেক্ষক দল বলেছে,
ম্যানগ্রোভ ও জলজ পরিবেশের ওপর ছড়িয়ে পড়া তেলের প্রভাব সীমিত। তবে শ্যালা
নদীসহ এর ছোট খালগুলোতে তেলের আস্তরণ পড়ে, যা দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতির কারণ হয়ে
দাঁড়াতে পারে। তেল দূষণের কারণে পানির মধ্যে থাকা ডিম, রেণুপোনা, জলজ
প্রাণী কিছু কিছু এলাকায় ধ্বংস হয়েছে, মাছের উৎপাদনও কিছু কমেছে। আমাদের
মনে আছে, দেশীয় পরিবেশকর্মী ও বিশেষজ্ঞরাও একই ধরনের আশঙ্কা ব্যক্ত
করেছিলেন। জাতিসংঘ প্রতিবেদনে যেসব সুপারিশ করা হয়েছে, তার সঙ্গেও মিল
রয়েছে দেশীয় বিশেষজ্ঞদের করা তাৎক্ষণিক সুপারিশের। পর্যবেক্ষকরা আগামী দেড়
বছর তিন ধাপে সুন্দরবনের ওপর তিন ধরনের গবেষণা ও মনিটরিং অব্যাহত রাখার যে
সুপারিশ করেছেন, সুন্দরবনে তেল বিপর্যয়ের পর সমকালের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে
বাংলাদেশের আইইউসিএনের আবাসিক প্রতিনিধিও তা-ই বলেছিলেন। আমাদের মনে আছে,
পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ড. আতিক রহমান সহযোগী একটি দৈনিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে
সুন্দরবনসহ অন্য এলাকায় তেল দুর্ঘটনারোধ ও দুর্ঘটনার পর তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা
নিতে আলাদা কর্তৃপক্ষ গঠনের যে কথা বলেছিলেন, জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক দলের
সুপারিশে তারও প্রতিধ্বনি রয়েছে। আমরা নিজেরাও এই সম্পাদকীয় কলামে
একাধিকবার বলেছি যে, অভিজ্ঞতা ও অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কারণে তেল
দুর্যোগের মতো অঘটনে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া ও ক্ষতি সীমিত রাখা প্রায় অসম্ভব
হয়ে পড়ে। জাতিসংঘ প্রতিবেদনে তেল উদ্ধারে তাৎক্ষণিকভাবে দেশীয় পদ্ধতি নিয়ে
নেমে পড়া স্থানীয় জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যঝুঁকির যে কথা বলেছে, তা অবশ্য
প্রণিধানযোগ্য। আমরা মনে করি, সুন্দরবনের পাশাপাশি তাদের স্বাস্থ্যও দীর্ঘ
মেয়াদে পর্যবেক্ষণে রাখা উচিত। আমরা আশা করব, সরকার জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক
দলের সুপারিশ আমলে নেবে। এর মধ্য দিয়ে এ দেশীয় পরিবেশকর্মী ও বিশেষজ্ঞদের
অবস্থানও যে সঠিক প্রমাণিত হলো, তা মনে রাখবে। তাদের উদ্বেগ, আশঙ্কা ও
পরামর্শ ভবিষ্যতে আরও কার্যকরভাবে নীতিনির্ধারকরা গ্রহণ করবেন বলে
প্রত্যাশা। আমরা মনে করি, জাতিসংঘের এই প্রতিবেদনে সবচেয়ে জরুরি যে সুপারিশ
তা হচ্ছে, বিশ্বঐতিহ্যস্থল ও প্রতিবেশগত দিক থেকে নাজুক সুন্দরবনের ভেতর
দিয়ে যান্ত্রিক নৌ চলাচল বন্ধ রাখা; জরুরি প্রয়োজনে নিরাপত্তা ও সুরক্ষা
ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। শ্যালা নদীতে বিপর্যয়কর তেল-দুর্ঘটনার মাসখানেক পর
কিছু শর্তসাপেক্ষে পুনরায় নৌ চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল অনেকটা নিরুপায়
হয়ে। কারণ, মংলা বন্দরের সঙ্গে সংযোগকারী ঘষিয়াখালী চ্যানেল উদ্ধার
প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়ায় দুই প্রান্তেই মালবাহী অনেক নৌযান আটকা পড়ে
ছিল। এর মধ্যে জরুরি প্রয়োজনীয় মালামালও ছিল। নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের
পক্ষেও এই সংকট নিরসনের দাবি, অন্যথায় দেশব্যাপী ধর্মঘটের হুমকি দেওয়া
হচ্ছিল। এই পরিপ্রেক্ষিতে শ্যালা নদী 'সাময়িকভাবে' নৌ চলাচলের জন্য খুলে
দেওয়ার খুব বেশি বিকল্প কর্তৃপক্ষের হাতে ছিল বলে মনে হয় না। কিন্তু এ
পরিস্থিতি যাতে নদীটিতে নির্বিচার ও স্থায়ী নৌ চলাচলের অজুহাত হিসেবে
ব্যবহৃত না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক দলের পূর্ণাঙ্গ
প্রতিবেদনের পর সেই তাগিদ আরও বাড়ল।
No comments