নেত্রীকে দেয়া কথাও রাখেনি by নুর মোহাম্মদ ও ফররুখ মাহমুদ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম কথা দিয়েছিলেন নেত্রীকে। আমরা আর ভুল করবো না। গত ৩১শে আগস্ট ছাত্র সমাবেশের সেই বক্তৃতা আলোচনায় এসেছিল। কিন্তু নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহেই প্রতিজ্ঞা ভেস্তে গেল। ফের দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্রলীগ অন্তর্দ্বন্দ্ব ও গ্রুপিংয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হলো। একের পর এক উদ্যোগ। যথারীতি সবই ব্যর্থ। আবারও সংবাদ শিরোনাম। গুলির লড়াই। কেউই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না ছাত্রলীগকে। এক সময়কার ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠনটি এখন আত্মঘাতী। কর্মীরা জড়িয়ে পড়েছেন খুন, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, হল দখল, শিক্ষক-ছাত্রী লাঞ্ছনার মতো ঘটনায়। গত ছয় বছরে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, অন্য সংগঠনের ওপর হামলাসহ বিভিন্ন সংঘর্ষে নিহত হয়েছে অন্তত ২৭ জন। দখলদারিত্ব এবং আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ ঘটেছে অন্তত পাঁচ শতাধিক। তাদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন শতাধিক শিক্ষক। একই সংখ্যাক ছাত্রী শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন। নেতা-কর্মী ছাড়াও সাংবাদিক, পুলিশসহ তাদের হামলায় আহত হয়েছেন প্রায় ৪ হাজারের বেশি। ভেঙে গেছে চেইন অব কমান্ড। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে খোদ প্রধানমন্ত্রীকেই বিরক্তি প্রকাশ করতে দেখা গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি প্রশ্রয়ের কারণেই ছাত্রলীগ এমন বেপরোয়া। যদিও ছাত্রলীগের সভাপতি এইচএম বদিউজ্জামান সোহাগ বলেন, এসব ঘটনার জন্য কেন্দ্রীয় কমিটি কোনভাবে দায়ী নয়। গতকালের ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, যে ছেলেটি নিহত হয়েছে সে ছাত্রলীগের কোন কর্মী না। একটি কুচত্রুী মহল এসব ঘটনা ঘটিয়ে সরকার ও ছাত্রলীগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অপচেষ্টায় লিপ্ত। তাদের প্রতিরোধ করা হবে।
ছাত্রলীগের সহিংসতায় নিহত ২৭: গত ছয় বছরে বিভিন্ন স্থানে ছাত্রলীগের সহিংসতায় ২৭ জন নিহত হয়েছেন। গত ১৯শে জানুয়ারি আধিপত্য বিস্তার, টেন্ডারবাজি ও নিয়োগ-বাণিজ্য নিয়ে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের গোলাগুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয় পাশের গ্রামের ১০ বছরের শিশু রাব্বি। গত বছরের ৯ই ডিসেম্বর বিরোধী দলের ডাকা অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে রাজধানীর পুরান ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা প্রকাশ্যে নির্মমভাবে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করেন বিশ্বজিৎ দাসকে। গত বছরের ১৫ই জুলাই পদ্মা সেতুর টাকা উত্তোলনের পর ভাগাভাগি নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক গ্রুপের সংঘর্ষে গুরুতর আহত হন ছাত্রলীগ কর্মী আবদুল্লাহ আল হাসান সোহেল। পরদিন ১৬ই জুলাই মারা যায় ছাত্রলীগের এই কর্মী। গত বছরের ৯ই জানুয়ারি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হামলায় নিহত হন ইংরেজি বিভাগের ছাত্র জুবায়ের আহমেদ। গত বছর ৮ই ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগ-শিবির সংঘর্ষে ২ শিবির নেতা মুজাহিদুল ইসলাম ও মাসুদ বিন হাবিব নিহত হয়। ২৯শে নভেম্বর লক্ষ্মীপুরে মুক্তিপণের টাকা না পেয়ে যুবলীগ কর্মী ওয়াজেদ চৌধুরীকে পিটিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগ ক্যাডারা। ২১শে জানুয়ারি পাবনা টেক্মটাইল কলেজের ছাত্রলীগ কর্মী মোস্তফা কামাল শান্ত নিহত হয়। ২০১১ সালের ১৯শে অক্টোবর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের একক আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে নিহত হয় ছাত্রদল কর্মী আবিদুর রহমান ওরফে আবিদ। ১৪ই সেপ্টেম্বর তেজগাঁওয়ের পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে লতিফ ছাত্রবাসের ডাইনিং-এ বসাকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে রাইসুল ইসলাম রশিদ নামে এক ছাত্র নিহত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১০ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে নির্মমভাবে খুন হন ইসলামের ইতিহাস বিভাগের মেধাবী ছাত্র আবু বকর সিদ্দিক। মৃত্যুর পর তার রেজাল্ট প্রকাশ হলে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন। একই বছর ৭ জানুয়ারি ছাত্রলীগের হামলায় রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ছাত্রমৈত্রীর সহ-সভাপতি রেজওয়ানুল ইসলাম চৌধুরী মারা যান। ৯ই ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগ-শিবির সংঘর্ষে বলির শিকার হন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের ছাত্র ফারুক হোসেন। এর দুদিন পরেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র মহিউদ্দিনকে কুপিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগ। ১৪ই মার্চ ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে সংঘর্ষের ঘটনায় যশোর সদর উপজেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক রিপন হোসেন দাদা নিহত হন। ২৯শে মার্চ চৌধুরী হাট রেল স্টেশনের পাশ থেকে উদ্ধার করা হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং স্টাডিজ বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র হারুন-অর-রশিদ কায়সারের ক্ষত-বিক্ষত লাশ। ১৩ই এপ্রিল রাজধানীর আদাবরে খুন হন স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা রুহিজ। ১৫ই এপ্রিল রাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রেল ক্রসিং এলাকায় আহত হন হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ও ছাত্রলীগ কর্মী আসাদুজ্জামান গুরুতর আহত হন। পরদিন ১৬ই এপ্রিল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি মারা যান। ১৫ই আগস্ট রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শোক দিবসের ইফতারির টোকেন সংগ্রহকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ইতিহাস বিভাগের ছাত্র ও ছাত্রলীগ কর্মী নাসরুল্লাহ নাসিম নিহত হয়। ১২ই জুলাই সিলেট এমসি কলেজে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে গণিত বিভাগের ৩য় বর্ষের ছাত্র উদয়েন্দু সিংহ পলাশ নিহত হয়। ২০০৯ সালের মার্চে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে নিহত হন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ রাজীব। একই বছর ১৩ই মার্চ ছাত্রলীগ-শিবির সংঘর্ষে নিহত হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবিরের সাধারণ সম্পাদক শরীফুজ্জামান নোমানী। এছাড়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সঞ্জয় দেবনাথ অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নিহত হন।
এছাড়া বিভিন্ন ঘটনায় ছাত্রলীগ কর্তৃক ১২১ জন শিক্ষক লাঞ্ছিত হয়েছেন। এর একটি ঘটনার বিচার হয়নি। তাদের হাতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভাবে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন শতাধিক ছাত্রী। লাগামহীন ছাত্রলীগ সারাদেশে তাণ্ডবলীলা চালিয়েছে অন্তত পাঁচ শতাধিক। এর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য গত বছরের ৯ই জুলাই সিলেটের ১২০ বছরের পুরানো ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজ ছাত্রাবাস আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া। ১৩ই মার্চ রাজধানীর নীলক্ষেতে হোটেলে ফাও খাওয়াকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় ৮-১০ রাউন্ড গুলি ও ১০-১৫টি হাত বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগ। ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের আহ্বায়কের পিস্তলের ছোড়া গুলিতে গুলিবিদ্ধ হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্র। ২০১১ সালের ১৪ই আগস্ট কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবিরের সংঘর্ষে উভয় পক্ষের অন্তত ৩৫ জন আহত হন। একই বছর ২৬শে এপ্রিল আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হলে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত ১শ’ ছাত্রলীগ নেতাকর্মী আহত হয়। ওই বছরের ১৮ই জানুয়ারি ছাত্রদলের নতুন কমিটি গঠন করার পর কমিটির নেতৃবৃন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে তাদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। ওই হামলায় তৎকালীন ছাত্রদল সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু গুরুতর আহত হন ২৫ জন।
এ বিষয়ে নাগরিক ঐক্য-এর আহ্বায়ক ও ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, যা কিছু অর্জন, তার সবই বিসর্জন দিয়েছে ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের অব্যাহত তাণ্ডবের কারণ হিসেবে তিনি বলেন, জাতীয় রাজনীতির প্রভাবে এ ধরনের ঘটনা বাড়ছে। জাতীয় নেতারা তাদের নিজের কাজে ব্যবহার করছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য তিনি ছাত্র সংগঠনগুলোর লেজুড়বৃত্তি পরিহার করা এবং ডাকসু নির্বাচনের ব্যবস্থা করার কথা বলেন।
কথা রাখেনি ছাত্রলীগ: ‘নেত্রী, কথা দিচ্ছি। আর ভুল করবো না।’ গত ৩১শে আগস্ট ছাত্র সমাবেশে ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলমের এমন প্রতিজ্ঞার পরও ভুল পথেই হাঁটছে ছাত্রলীগ। কথা রাখেনি তারা। জড়িয়ে পড়েছে নানা অপরাধে। সর্বশেষ গতকাল সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। এতে সুমন নামে একজন নিহত হয়। ১৮ই নভেম্বর দিনাজপুর মেড়িকেল কলেজে পাল্টাপাল্টি কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে ১০ জন আহত হয়। চারজনকে আটক করা হয়। কলেজ কর্তৃপক্ষ ঘটনা তদন্তে ৭ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করে। এছাড়া ১৯শে নভেম্বর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে হলে সিট বরাদ্দকে কেন্দ্র করে রাতভর ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়। এতে আহত হয় প্রায় ৫০ জন। সভাপতি নাজমুল, সাধারণ সম্পাদক দেবাশীষ ও সহ সভাপতি আতিক গ্রুপের মধ্যে এই সংঘর্ষ হয়। সূত্র জানায়, শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হলে সিট বরাদ্দকে কেন্দ্র করে এই সংঘর্ষ ঘটে। ক্যাম্পাসে এখনও উত্তেজনা বিরাজ করছে। ১৯শে নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে ছাত্রলীগ নেতা উৎপল সাহার ছোট ভাই উদয় সাহা বহিরাগত এক গাড়িচালককে ধরে এনে হলের ২২৯ নম্বর কক্ষে আটকে রাখে। তাকে মারধর করে মুক্তিপণ দাবি করে। পরে খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ এম আমজাদ ও শাহবাগ থানা পুলিশ তাকে উদ্ধার করে। অপহরণের শিকার সুকুমার শাহবাগ থানায় একটি অপহরণ মামলা দায়ের করেন। মামলা নং-৩১। ছাত্রলীগ নেতা উৎপলের ভাই উদয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী না হলেও দীর্ঘদিন ধরে হলে অবস্থান করছেন। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হলে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) এক কর্মচারীকে অপহরণ করে ছাত্রলীগের হল শাখার সাবেক সভাপতি মাঈন উদ্দিন বাবু। পরে বিশ্ববিদ্যালয় এবং পুলিশ প্রশাসনের তৎপরতায় ওই কর্মচারীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ থেকে উদ্ধার করা হয়। বাবুর কক্ষ তল্লাশি করে সিলগালা করে কর্তৃপক্ষ। জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে কিছুদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মোজাম্মেল হক লেনিনকে আটক করে র্যাব।
ছাত্রলীগের সহিংসতায় নিহত ২৭: গত ছয় বছরে বিভিন্ন স্থানে ছাত্রলীগের সহিংসতায় ২৭ জন নিহত হয়েছেন। গত ১৯শে জানুয়ারি আধিপত্য বিস্তার, টেন্ডারবাজি ও নিয়োগ-বাণিজ্য নিয়ে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের গোলাগুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয় পাশের গ্রামের ১০ বছরের শিশু রাব্বি। গত বছরের ৯ই ডিসেম্বর বিরোধী দলের ডাকা অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে রাজধানীর পুরান ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা প্রকাশ্যে নির্মমভাবে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করেন বিশ্বজিৎ দাসকে। গত বছরের ১৫ই জুলাই পদ্মা সেতুর টাকা উত্তোলনের পর ভাগাভাগি নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক গ্রুপের সংঘর্ষে গুরুতর আহত হন ছাত্রলীগ কর্মী আবদুল্লাহ আল হাসান সোহেল। পরদিন ১৬ই জুলাই মারা যায় ছাত্রলীগের এই কর্মী। গত বছরের ৯ই জানুয়ারি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হামলায় নিহত হন ইংরেজি বিভাগের ছাত্র জুবায়ের আহমেদ। গত বছর ৮ই ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগ-শিবির সংঘর্ষে ২ শিবির নেতা মুজাহিদুল ইসলাম ও মাসুদ বিন হাবিব নিহত হয়। ২৯শে নভেম্বর লক্ষ্মীপুরে মুক্তিপণের টাকা না পেয়ে যুবলীগ কর্মী ওয়াজেদ চৌধুরীকে পিটিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগ ক্যাডারা। ২১শে জানুয়ারি পাবনা টেক্মটাইল কলেজের ছাত্রলীগ কর্মী মোস্তফা কামাল শান্ত নিহত হয়। ২০১১ সালের ১৯শে অক্টোবর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের একক আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে নিহত হয় ছাত্রদল কর্মী আবিদুর রহমান ওরফে আবিদ। ১৪ই সেপ্টেম্বর তেজগাঁওয়ের পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে লতিফ ছাত্রবাসের ডাইনিং-এ বসাকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে রাইসুল ইসলাম রশিদ নামে এক ছাত্র নিহত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১০ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে নির্মমভাবে খুন হন ইসলামের ইতিহাস বিভাগের মেধাবী ছাত্র আবু বকর সিদ্দিক। মৃত্যুর পর তার রেজাল্ট প্রকাশ হলে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন। একই বছর ৭ জানুয়ারি ছাত্রলীগের হামলায় রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ছাত্রমৈত্রীর সহ-সভাপতি রেজওয়ানুল ইসলাম চৌধুরী মারা যান। ৯ই ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগ-শিবির সংঘর্ষে বলির শিকার হন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের ছাত্র ফারুক হোসেন। এর দুদিন পরেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র মহিউদ্দিনকে কুপিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগ। ১৪ই মার্চ ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে সংঘর্ষের ঘটনায় যশোর সদর উপজেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক রিপন হোসেন দাদা নিহত হন। ২৯শে মার্চ চৌধুরী হাট রেল স্টেশনের পাশ থেকে উদ্ধার করা হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং স্টাডিজ বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র হারুন-অর-রশিদ কায়সারের ক্ষত-বিক্ষত লাশ। ১৩ই এপ্রিল রাজধানীর আদাবরে খুন হন স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা রুহিজ। ১৫ই এপ্রিল রাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রেল ক্রসিং এলাকায় আহত হন হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ও ছাত্রলীগ কর্মী আসাদুজ্জামান গুরুতর আহত হন। পরদিন ১৬ই এপ্রিল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি মারা যান। ১৫ই আগস্ট রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শোক দিবসের ইফতারির টোকেন সংগ্রহকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ইতিহাস বিভাগের ছাত্র ও ছাত্রলীগ কর্মী নাসরুল্লাহ নাসিম নিহত হয়। ১২ই জুলাই সিলেট এমসি কলেজে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে গণিত বিভাগের ৩য় বর্ষের ছাত্র উদয়েন্দু সিংহ পলাশ নিহত হয়। ২০০৯ সালের মার্চে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে নিহত হন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ রাজীব। একই বছর ১৩ই মার্চ ছাত্রলীগ-শিবির সংঘর্ষে নিহত হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবিরের সাধারণ সম্পাদক শরীফুজ্জামান নোমানী। এছাড়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সঞ্জয় দেবনাথ অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নিহত হন।
এছাড়া বিভিন্ন ঘটনায় ছাত্রলীগ কর্তৃক ১২১ জন শিক্ষক লাঞ্ছিত হয়েছেন। এর একটি ঘটনার বিচার হয়নি। তাদের হাতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভাবে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন শতাধিক ছাত্রী। লাগামহীন ছাত্রলীগ সারাদেশে তাণ্ডবলীলা চালিয়েছে অন্তত পাঁচ শতাধিক। এর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য গত বছরের ৯ই জুলাই সিলেটের ১২০ বছরের পুরানো ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজ ছাত্রাবাস আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া। ১৩ই মার্চ রাজধানীর নীলক্ষেতে হোটেলে ফাও খাওয়াকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় ৮-১০ রাউন্ড গুলি ও ১০-১৫টি হাত বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগ। ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের আহ্বায়কের পিস্তলের ছোড়া গুলিতে গুলিবিদ্ধ হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্র। ২০১১ সালের ১৪ই আগস্ট কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবিরের সংঘর্ষে উভয় পক্ষের অন্তত ৩৫ জন আহত হন। একই বছর ২৬শে এপ্রিল আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হলে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত ১শ’ ছাত্রলীগ নেতাকর্মী আহত হয়। ওই বছরের ১৮ই জানুয়ারি ছাত্রদলের নতুন কমিটি গঠন করার পর কমিটির নেতৃবৃন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে তাদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। ওই হামলায় তৎকালীন ছাত্রদল সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু গুরুতর আহত হন ২৫ জন।
এ বিষয়ে নাগরিক ঐক্য-এর আহ্বায়ক ও ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, যা কিছু অর্জন, তার সবই বিসর্জন দিয়েছে ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের অব্যাহত তাণ্ডবের কারণ হিসেবে তিনি বলেন, জাতীয় রাজনীতির প্রভাবে এ ধরনের ঘটনা বাড়ছে। জাতীয় নেতারা তাদের নিজের কাজে ব্যবহার করছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য তিনি ছাত্র সংগঠনগুলোর লেজুড়বৃত্তি পরিহার করা এবং ডাকসু নির্বাচনের ব্যবস্থা করার কথা বলেন।
কথা রাখেনি ছাত্রলীগ: ‘নেত্রী, কথা দিচ্ছি। আর ভুল করবো না।’ গত ৩১শে আগস্ট ছাত্র সমাবেশে ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলমের এমন প্রতিজ্ঞার পরও ভুল পথেই হাঁটছে ছাত্রলীগ। কথা রাখেনি তারা। জড়িয়ে পড়েছে নানা অপরাধে। সর্বশেষ গতকাল সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। এতে সুমন নামে একজন নিহত হয়। ১৮ই নভেম্বর দিনাজপুর মেড়িকেল কলেজে পাল্টাপাল্টি কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে ১০ জন আহত হয়। চারজনকে আটক করা হয়। কলেজ কর্তৃপক্ষ ঘটনা তদন্তে ৭ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করে। এছাড়া ১৯শে নভেম্বর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে হলে সিট বরাদ্দকে কেন্দ্র করে রাতভর ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়। এতে আহত হয় প্রায় ৫০ জন। সভাপতি নাজমুল, সাধারণ সম্পাদক দেবাশীষ ও সহ সভাপতি আতিক গ্রুপের মধ্যে এই সংঘর্ষ হয়। সূত্র জানায়, শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হলে সিট বরাদ্দকে কেন্দ্র করে এই সংঘর্ষ ঘটে। ক্যাম্পাসে এখনও উত্তেজনা বিরাজ করছে। ১৯শে নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে ছাত্রলীগ নেতা উৎপল সাহার ছোট ভাই উদয় সাহা বহিরাগত এক গাড়িচালককে ধরে এনে হলের ২২৯ নম্বর কক্ষে আটকে রাখে। তাকে মারধর করে মুক্তিপণ দাবি করে। পরে খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ এম আমজাদ ও শাহবাগ থানা পুলিশ তাকে উদ্ধার করে। অপহরণের শিকার সুকুমার শাহবাগ থানায় একটি অপহরণ মামলা দায়ের করেন। মামলা নং-৩১। ছাত্রলীগ নেতা উৎপলের ভাই উদয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী না হলেও দীর্ঘদিন ধরে হলে অবস্থান করছেন। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হলে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) এক কর্মচারীকে অপহরণ করে ছাত্রলীগের হল শাখার সাবেক সভাপতি মাঈন উদ্দিন বাবু। পরে বিশ্ববিদ্যালয় এবং পুলিশ প্রশাসনের তৎপরতায় ওই কর্মচারীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ থেকে উদ্ধার করা হয়। বাবুর কক্ষ তল্লাশি করে সিলগালা করে কর্তৃপক্ষ। জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে কিছুদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মোজাম্মেল হক লেনিনকে আটক করে র্যাব।
No comments