গ্রেফতারের টার্গেটে আরও ২৫ আত্মগোপনে ৪৪ বিমানকর্মী
বিমানের ডিজিএমসহ তিন বিমানকর্মী গ্রেফতারের পর আতংক ছড়িয়ে পড়েছে বিমানের সোনা চোরাচালান সিন্ডিকেটের মধ্যে। কেউ কেউ দেশ ছেড়ে পালানোরও চেষ্টা করছেন। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ জানিয়েছে, বিমানের আরও ২৫ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া গেছে। যেকোনো সময় তাদের গ্রেফতার করা হবে। তাদের গোয়েন্দা নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে বলেও জানা গেছে। এই ২৫ জনের মধ্যে বিমানের প্রকৌশল বিভাগের ৪, কেবিন ক্রু ও গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং বিভাগের ১২, ক্লিনিং বিভাগের ৫ ও বিমানের অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োজিত ৪ কর্মচারী রয়েছেন। এদের মধ্যে নারীকর্মী রয়েছেন ৮ জন। সূত্র জানিয়েছে, ২৫ জনের মধ্যে উচ্চপদস্থ কয়েকজন কর্মকর্তাও রয়েছেন। এর বাইরেও শুল্ক গোয়েন্দার প্রতিবেদনে বিমানের প্রকৌশল শাখার ১০ জন কর্মীর নাম রয়েছে।
অন্যদিকে সোনা চোরাচালান চক্রের প্রধান হোতা ভুয়া পাইলট পলাশ ও বিমানের চিফ অব শিডিউলিং ক্যাপ্টেন শহীদ গ্রেফতার হওয়ার পর তাদের সাঙ্গপাঙ্গদের মধ্যে আতংক নেমে এসেছে। বিমানের ফ্লাইট সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, এ ঘটনার পর কেবিন ক্রুসহ ৪টি বিভাগের ৪৪ বিমানকর্মী আত্মগোপনে রয়েছেন। কেউ কেউ বিদেশে ফ্লাইট নিয়ে গিয়ে সেখানেই থেকে যাচ্ছেন। ফিরতি শিডিউল ফ্লাইটে তাদের আসার কথা থাকলেও অসুস্থতাসহ নানা অজুহাতে তারা আপাতত দেশে ফিরতে চাইছেন না। বিদেশে থেকেই খোঁজ নিচ্ছেন দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে। এতে ফ্লাইট পরিচালনার ক্ষেত্রে অসুবিধা দেখা দিতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, তিন বিমানকর্মীসহ ইতিমধ্যে গ্রেফতার পাঁচ চোরাচালানিকে ৪ দিনের রিমান্ডে এনে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। বৃহস্পতিবার জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে তিন বিমানকর্মী ও বিমানের ঠিকাদার পলাশকে। জিজ্ঞাসাবাদে তাদের অঢেল সম্পদের তথ্য জানতে পেরেছেন গোয়েন্দারা। জানা গেছে, দেশে-বিদেশে তিন বিমান কর্মকর্তার রয়েছে একাধিক ব্যাংক হিসাব। অবৈধ পথে উপার্জিত বিপুল অর্থ তারা বিদেশেও পাচার করেছেন।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলেছেন, প্রায় অর্ধযুগ ধরে হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে সোনা চোরাচালানের মূল হোতা ছিলেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ডিজিএম (ফ্লাইট সার্ভিস) এমদাদ হোসেন। পদস্থ কর্মকর্তা হওয়ায় তিনি সবসময়ই থেকেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। তিনি বিমানের ম্যানেজার তোজাম্মেল, পাইলট আবু আসলাম শহীদসহ ১০ জনের একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন। আর বিমানের শীর্ষ এক কর্মকর্তার ধর্মপুত্র হিসেবে পরিচিত ছিলেন বিমানের ঠিকাদার মাহমুদুল হক পলাশ। মঙ্গলবারের অভিযানে দেশের স্বর্ণ চোরাচালানের টপ সিন্ডিকেটের তিনজন গ্রেফতার হওয়ার পর ওই চক্রের সক্রিয় সদস্য ক্যাপ্টেন শামীম নজরুল (ডেপুটি চিফ অব ট্রেনিং) বুধবার কানাডা পাড়ি জমিয়েছেন।
যেভাবে গ্রেফতার তিন বিমানকর্মী : গোয়েন্দা পুলিশ জানিয়েছে, দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর জানা যায়, সোনা চোরাচালানের সঙ্গে বিমানের বেশ কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছিল না। গত ১২ নভেম্বর গ্রেফতার বিমানের কেবিন ক্রু মাজহারুল আফসার রাসেল সোমবার ১৬৪ ধারায় দেয়া জবানবন্দিতে বেশ কয়েকজন বিমান কর্মকর্তার নাম বলার পর গোয়েন্দারা অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করেন। ঢাকা মহানগর পুলিশের শীর্ষ পর্যায় থেকে গ্রিন সিগন্যাল পাওয়ার পর অভিযানে নামে গোয়েন্দা পুলিশ। প্রথমেই বিমানের ডিজিএম এমদাদকে গ্রেফতারের ছক আঁকেন গোয়েন্দারা। বিমানবন্দর এলাকায় অবস্থান নেয় গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক টিম। একই সঙ্গে তার ৪৪/এফ/৬ নম্বর বাড়ির আশপাশেও অবস্থান নেয় পুলিশ। অভিযানের সময় ডিজিএম অফিসেই ছিলেন। প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে তার অবস্থান শনাক্ত করেন গোয়েন্দারা। বিকাল ৩টার দিকে তিনি অফিস থেকে বেরিয়ে তার নির্ধারিত গাড়িতে উঠছিলেন। এ সময় গোয়েন্দা পুলিশ তাকে গাড়ি থেকে নেমে আসতে বলেন। কৌশলী গোয়েন্দা কর্মকর্তারা তাকে বলেন, আপনার সঙ্গে জরুরি কথা আছে। আমাদের সঙ্গে মিন্টো রোডে যেতে হবে। কিন্তু তখনও ডিজিএম এমদাদ আঁচ করতে পারেননি তিনি গোয়েন্দা জালে আটকা পড়েছেন। ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে আসার পরও কৌশলগত কারণে তাকে হাতকড়া না পরিয়ে একজন অফিসারের কক্ষে বসিয়ে রাখা হয়। পরদিন মহানগর পুলিশের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে তাকে হাজির করা হলে ভেঙে পড়েন এমদাদ। এ সময় তিনি মুখ ঢেকে রাখার জন্য পুলিশের কাছে বারবার একটা গামছা চান। কিন্তু পুলিশ তাকে গামছা দেয়নি। ডিজিএম এমদাদকে গ্রেফতার করে মিন্টো রোডে নিয়ে যাওয়ার পর বিমানের ম্যানেজার তোজাম্মেলকে গ্রেফতারে অভিযান চালায় গোয়েন্দা পুলিশ। রাত ২টায় তোজাম্মেলের উত্তরা ৫ নম্বর সেক্টরের বাড়িতে হাজির হন গোয়েন্দারা। তোজাম্মেল তখন বাড়িতেই অবস্থান করছিলেন। কিন্তু ভবনের নিরাপত্তারক্ষীরা গেট খুলতে গড়িমসি শুরু করে। একপর্যায়ে নাটকীয়তার আশ্রয় নেন গোয়েন্দারা। নাটকীয়তার একপর্যায়ে নিরাপত্তারক্ষী ভবনের দরজা খুলে দেন। এরপর গোয়েন্দারা তোজাম্মেলকে তার ফ্ল্যাট থেকে গ্রেফতার করে মিন্টো রোডে নিয়ে যান। রাত ৩টায় বিমানের ক্যাপ্টেন আবু মোহাম্মদ আসলাম শহীদকে গ্রেফতারের জন্য তার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার সি ব্লকের ৪৫ নম্বর বাড়িতে হানা দেন গোয়েন্দারা। সেখান থেকে ক্যাপ্টেন শহীদকে গ্রেফতার করে মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়। এরপর রাতেই বিমানের ঠিকাদার পলাশকে উত্তরা এক নম্বর সেক্টর, দুই নম্বর রোডের তিন নম্বর বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়।
ফ্লাইং ক্লাব থেকে বিমান পরিচালনার ট্রেনিং নিয়ে পলাশ নিজকে পাইলট হিসেবে পরিচয় দিতেন। একপর্যায়ে তিনি ফ্লাইং ক্লাবের বোর্ড মেম্বারও হন। এরপর তিনি পাইলট হিসেবে লাইসেন্স নেয়ার জন্য বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) কাছে আবেদন করেন। কিন্তু বেবিচক গোপন সূত্রে জানতে পারে পলাশ এইচএসসি পাস করতে পারেননি। ভুয়া সাটিফিকেট দিয়ে তিনি ফ্লাইং ক্লাবে ভর্তি হয়েছিলেন। সিভিল এভিয়েশন থেকে পলাশের কলেজ ও বোর্ডে গিয়ে সার্টিফিকেট পরীক্ষা করার পর এ জালিয়াতি ধরা পড়ে। এরপরই মূলত বিমানের বিভিন্ন ঠিকাদারি ব্যবসা শুরু করেন তিনি। জানা গেছে, ১০ বছর আগে তিনি বিমানে ছোটখাটো ঠিকাদারি ব্যবসা শুরু করেন। ওই সময় তিনি বিমানের একজন শীর্ষ কর্মকর্তার আশীর্বাদে রাতারাতি প্রভাবশালী বনে যান। ওই সময়ে আবারও জাল কাগজপত্র দিয়ে বিমানের পাইলট হিসেবে নিয়োগ পেতে আবেদন করেন। কিন্তু বিষয়টি ফাঁস হয়ে গেলে তার সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরপর তিনি বিমানের তৎকালীন ফার্স্ট অফিসার ক্যাপ্টেন শামীম নজরুল ও বিমানের এক প্রভাবশালী ব্যক্তির ছেলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলেন। এরপর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। স্ত্রী কেবিন ক্রু হওয়ার সুবাদে পুরো ফ্লাইটের নিয়ন্ত্রণ চলে আসে তার হাতে। স্ত্রীর মাধ্যমে কেবিন ক্রুদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। আর তাদের দিয়েই চালাতে শুরু করেন স্বর্ণ ও ওষুধ চোরাচারালানি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানিয়েছেন, বিমানের সংশ্লিষ্ট সবার কাছে পলাশ পরিচিত ছিলেন এক প্রভাবশালীর ধর্মপুত্র হিসেবে। গোয়েন্দা সূত্র বলেছে, শুধু সোনা চোরাচালান নয়, গত ৬ বছর ধরে একচেটিয়া কমিশন বাণিজ্য, পদোন্নতি, বদলিসহ সব ধরনের তদবিরের শিরোমণি ছিলেন পলাশ। বিমানবন্দরে বিশেষ করে ফ্লাইটে ডিউটি রোস্টার নিয়ন্ত্রণ হতো তার ইশারায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সোনা চোরাচালান থেকে শুরু করে বিমানের নিয়োগ বাণিজ্যেও শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন পলাশ। সম্প্রতি হজ ফ্লাইট পরিচালনার জন্য ১০০ কেবিন ক্রু নিয়োগ দেয়া হয় তার দেয়া তালিকা অনুযায়ী। এর জন্য তাদের কাছ থেকে পলাশ মোটা অংকের ঘুষ নেন।
এমদাদ ওরফে লীগ এমদাদ : ডিজিএম এমদাদ হোসেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সবার কাছে পরিচিত ছিলেন। বিমানের সবাই তাকে চিনতেন লীগ এমদাদ হিসেবে। কারণ তার নামের আগে তিনি যোগ করেছিলেন লীগ শব্দটি। গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, এমদাদ গ্রেফতার হওয়ার পর একাধিক বিমানকর্মী গোয়েন্দা কার্যালয়ে গিয়ে এমদাদের অনেক অপকর্মের তথ্য দিয়েছেন। সেসব তথ্যের সূত্র ধরে তদন্ত চলছে।
সূত্র আরও জানিয়েছে, এমদাদের নামে ঢাকায় পাঁচটি ফ্ল্যাট ও তিনটি বহুতল বাণিজ্যিক ভবন রয়েছে। নিউমার্কেট এলাকায় তার স্ত্রীর নামে একটি মার্কেট রয়েছে। গুলশান-১ নম্বর সার্কেলে তার দুটি দোকানের তথ্য জানা গেছে। এ ছাড়া এমদাদ মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম করেছেন। টাকা পাচার করেছেন সিঙ্গাপুর ও অস্ট্রেলিয়ায়। দেশে তার ১২টি ব্যাংক হিসাবের সন্ধান পেয়েছেন গোয়েন্দারা। বিমান সূত্র জানিয়েছে, সম্প্রতি পদোন্নতি পেয়ে বিমানের ডিজিএম হন এমদাদ। অফিসে যাতায়াত করেন মার্সিডিজ বেঞ্জ মডেলের বিলাসবহুল গাড়িতে।
বিলাসী জীবন ক্যাপ্টেন শহীদের : বিমানের প্ল্যানিং ও শিডিউলিং বিভাগের প্রধান ক্যাপ্টেন শহীদ দীর্ঘ দিন ধরেই চোরাচালান চক্রের একজন সক্রিয় সদস্য। চিফ অব শিডিউলিং হিসেবে যোগদানের পর থেকে বিমানকেন্দ্রিক সোনা চোরাচালান বেড়ে যাওয়ার নেপথ্যে তার হাত ছিল। গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার সি ব্লকের ৪৫ নম্বর বাড়িটি দেখতে অনেকটাই রাজপ্রাসাদের মতো। বাড়ির ভেতরে ঢুকে জৌলুস দেখে হতভম্ব হয়ে যায় পুলিশ। গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, ক্যাপ্টেন শহীদ সোনা চোরাচালান ছাড়াও হুন্ডি চক্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। দীর্ঘ দিন ধরেই মানি এক্সচেঞ্জগুলোর সঙ্গে যোগসাজশ করে অর্থ চোরাচালানের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন। তার অর্থ-বিত্তের খোঁজে জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রেখেছেন গোয়েন্দারা।
সূত্র জানায়, ক্যাপ্টেন শহীদের চাকরি নিয়েও রয়েছে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ। বিমানে যোগদানের পর ১৯৮৫ সালে এফ-২৫ এর টেকনিক্যাল কোর্সে উত্তীর্ণ হতে পারেননি শহীদ। তারপরও বিমান তাকে নিয়োগ দেয়।
এদিকে গোয়েন্দারা ক্যাপ্টেন শহীদের ঘনিষ্ঠ ম্যানেজার (শিডিউলিং) শাহ আলম মিরন, পরিচালক (প্রশাসন) রাজপতি সরকারসহ আরও কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য খুঁজছে। গোয়েন্দারা বলেছেন, এদের জিজ্ঞাসাবাদ করা গেলে সোনা চোরাচালান ও দুর্নীতির অনেক তথ্য বেরিয়ে আসবে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার শেখ নাজমুল আলম বলেন, এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য বিমানবন্দরকেন্দ্রিক এই চোরাচালান সিন্ডিকেটটি ভয়াবহ বলে মনে হচ্ছে। তারা দীর্ঘদিন ধরে সোনা চোরাচালানের ট্রানজিট হিসেবে শাহজালাল বিমানবন্দরকে ব্যবহার করছিল। গোয়েন্দা পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার মিনহাজ উদ্দীন বলেন, বিমানের প্রায় ২৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি তারা খতিয়ে দেখছেন। এদের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি চালানো হচ্ছে।
আত্মগোপনে ৪৪ বিমানকর্মী : বিমানের ফ্লাইট সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ গ্রেফতারের ঘটনার পর কেবিন ক্রুসহ ৪টি বিভাগের ৪৪ জন কর্মকর্তা আত্মগোপন করেছেন। কেবিন ক্রু ও পাইলটদের মধ্যে অনেকে বিদেশে ফ্লাইট নিয়ে গেলেও এই খবর পেয়ে আর দেশে ফেরেননি। এদিকে গ্রেফতার হলেও বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত পাইলট শহীদ, ডিজিএম এমদাদ, জিএম তোজাম্মেল ও কেবিন ক্রু রাসেলের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বরং বিমানের শীর্ষ ম্যানেজমেন্ট থেকে তাদের বাঁচানোর জন্য সব ধরনের চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে জানা গেছে। ইতিমধ্যে তাদের পক্ষে স্ব স্ব বিভাগ থেকে মতামত দিয়ে ফাইল পাঠানো হয়েছে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে। বিমান সূত্রে জানা গেছে, সোনা চোরাচালান চক্রের প্রধান হোতা পলাশের গডফাদার ছিলেন পরিচালক প্রশাসন রাজপতি সরকার ও ডেপুটি চিফ অব ট্রেনিং ক্যাপ্টেন শামীম নজরুল। এছাড়া পরিচালক প্ল্যানিং বেলায়েত হোসেন ও পরিচালক ফাইনান্স মঞ্জুর ইমাম, জেনারেল ম্যানেজার আতিক সোবহান, জিএম শাকিল মেরাজ, ম্যানেজার শাহ আলম মিরন ছিলেন পলাশের আশ্রয়দাতা। পলাশ সম্পর্কে জানতে গোয়েন্দারা এদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেন বলে জানা গেছে। পলাশ বিমানে গিয়ে এদের কক্ষে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিতেন। জানা গেছে, সম্প্রতি পরিচালক প্রশাসন রাজপতি সরকারের চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও পলাশ, শামীম নজরুল ও একজন বোর্ড মেম্বারের সুবাদে তাকে আরও এক বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়। স্থায়ী চাকরিকালীন রাজপতি ৮০ হাজার টাকা বেতন পেলেও এখন পাচ্ছেন মাসে ২ লাখ টাকা। অনিয়ম-দুর্নীতি আর লুটপাটের অভিযোগে এই রাজপতি সরকারকে বিমানের সাবেক বিদেশী এমডি কেভিন স্টিল একাধিকবার শোকজ করলেও পলাশের কারণে তিনি প্রতিবারই বেঁচে যেতেন। পুরস্কার হিসেবে রাজপতি পলাশকে সব ধরনের সহযোগিতা করতেন। পলাশের কু-প্রস্তাব রাজি না হওয়ায় কিছুদিন আগে একজন কেবিন ক্রুকে চাকরিচ্যুত করেন রাজপতি। শেষ পর্যন্ত ওই কেবিন ক্রুর ব্যাগে চারটি সোনার বিস্কুট পাওয়ার অভিযোগ এনে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয় বলে জানা গেছে। যদিও ওই সোনার বারগুলো কেনার বৈধ কাগজপত্র তার কাছে ছিল।
এদিকে বেসরকারি এয়ারলাইন্স কোম্পানি রিজেন্ট, ইউনাইটেড ও ইউএস বাংলা সূত্রে জানা গেছে, পলাশের কাছে মোটা অংকের টাকা দিয়ে তাদের ১৬ জন পাইলট ও ফাস্ট অফিসার সম্প্রতি বিমানে যোগদান করেছেন। সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইন্স সংস্থাগুলোর অভিযোগ, তারা কোটি কোটি টাকা খরচ করে এসব পাইলট ও ফাস্ট অফিসারকে ট্রেনিং করিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা করার মতো করে তৈরি করেছে। তাদের সঙ্গে চুক্তিও আছে যোগদানের ৫ বছরের মধ্যে তারা অন্য কোনো এয়ারলাইন্সে যোগদান করতে পারবে না। আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন আইন অনুযায়ী কোনো পাইলট ও ফাস্ট অফিসার অন্য কোনো সংস্থায় যোগদান করতে হলে তাকে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে (এনওসি) ছাড়পত্র নিতে হবে। কিন্তু ১৬ পাইলট ও ফাস্ট অফিসার কোনো ধরনের ছাড়পত্র না নিয়েই বিমানে যোগদান করেছে। হঠাৎ করে ১৫ পাইলট ফাস্ট অফিসার চাকরি ছেড়ে দেয়ায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে ৩টি এয়ারলাইন্স সংস্থা।
রিজেন্ট এয়ারের একজন কর্মকর্তা জানান, তাদের ৫ জন পাইলটের মধ্যে ৩ জনই বিমানে যোগদান করেছে। অভিযোগ, এই ফাস্ট অফিসার নিয়োগের পুরোটাতেই নেতৃত্ব দিয়েছে ক্যাপ্টেন শামীম নজরুল, পলাশ ও রাজপতি সরকার। বিনিময়ে তাদের সঙ্গে হয়েছে আন্ডারহ্যান্ড ডিলিং। অভিযোগ রয়েছে পলাশ সিন্ডিকেট এই ১৬ ফাস্ট অফিসারকে নিয়োগ দেয়ার জন্য ৮ জন ক্যাডেট পাইলটকে নিয়োগ দিয়েও ট্রেনিং না করিয়ে ৪ বছর ধরে বসিয়ে রাখা হয়েছে। তাদের অধিকাংশের এখন আর চাকরির বয়স নেই বলেও জানা গেছে। অভিযোগ, ৩ জন মহিলা ক্যাডেট পাইলট আছেন- যারা পলাশের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তাদের ট্রেনিং না করিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে।
অন্যদিকে সোনা চোরাচালান চক্রের প্রধান হোতা ভুয়া পাইলট পলাশ ও বিমানের চিফ অব শিডিউলিং ক্যাপ্টেন শহীদ গ্রেফতার হওয়ার পর তাদের সাঙ্গপাঙ্গদের মধ্যে আতংক নেমে এসেছে। বিমানের ফ্লাইট সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, এ ঘটনার পর কেবিন ক্রুসহ ৪টি বিভাগের ৪৪ বিমানকর্মী আত্মগোপনে রয়েছেন। কেউ কেউ বিদেশে ফ্লাইট নিয়ে গিয়ে সেখানেই থেকে যাচ্ছেন। ফিরতি শিডিউল ফ্লাইটে তাদের আসার কথা থাকলেও অসুস্থতাসহ নানা অজুহাতে তারা আপাতত দেশে ফিরতে চাইছেন না। বিদেশে থেকেই খোঁজ নিচ্ছেন দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে। এতে ফ্লাইট পরিচালনার ক্ষেত্রে অসুবিধা দেখা দিতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, তিন বিমানকর্মীসহ ইতিমধ্যে গ্রেফতার পাঁচ চোরাচালানিকে ৪ দিনের রিমান্ডে এনে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। বৃহস্পতিবার জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে তিন বিমানকর্মী ও বিমানের ঠিকাদার পলাশকে। জিজ্ঞাসাবাদে তাদের অঢেল সম্পদের তথ্য জানতে পেরেছেন গোয়েন্দারা। জানা গেছে, দেশে-বিদেশে তিন বিমান কর্মকর্তার রয়েছে একাধিক ব্যাংক হিসাব। অবৈধ পথে উপার্জিত বিপুল অর্থ তারা বিদেশেও পাচার করেছেন।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলেছেন, প্রায় অর্ধযুগ ধরে হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে সোনা চোরাচালানের মূল হোতা ছিলেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ডিজিএম (ফ্লাইট সার্ভিস) এমদাদ হোসেন। পদস্থ কর্মকর্তা হওয়ায় তিনি সবসময়ই থেকেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। তিনি বিমানের ম্যানেজার তোজাম্মেল, পাইলট আবু আসলাম শহীদসহ ১০ জনের একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন। আর বিমানের শীর্ষ এক কর্মকর্তার ধর্মপুত্র হিসেবে পরিচিত ছিলেন বিমানের ঠিকাদার মাহমুদুল হক পলাশ। মঙ্গলবারের অভিযানে দেশের স্বর্ণ চোরাচালানের টপ সিন্ডিকেটের তিনজন গ্রেফতার হওয়ার পর ওই চক্রের সক্রিয় সদস্য ক্যাপ্টেন শামীম নজরুল (ডেপুটি চিফ অব ট্রেনিং) বুধবার কানাডা পাড়ি জমিয়েছেন।
যেভাবে গ্রেফতার তিন বিমানকর্মী : গোয়েন্দা পুলিশ জানিয়েছে, দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর জানা যায়, সোনা চোরাচালানের সঙ্গে বিমানের বেশ কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছিল না। গত ১২ নভেম্বর গ্রেফতার বিমানের কেবিন ক্রু মাজহারুল আফসার রাসেল সোমবার ১৬৪ ধারায় দেয়া জবানবন্দিতে বেশ কয়েকজন বিমান কর্মকর্তার নাম বলার পর গোয়েন্দারা অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করেন। ঢাকা মহানগর পুলিশের শীর্ষ পর্যায় থেকে গ্রিন সিগন্যাল পাওয়ার পর অভিযানে নামে গোয়েন্দা পুলিশ। প্রথমেই বিমানের ডিজিএম এমদাদকে গ্রেফতারের ছক আঁকেন গোয়েন্দারা। বিমানবন্দর এলাকায় অবস্থান নেয় গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক টিম। একই সঙ্গে তার ৪৪/এফ/৬ নম্বর বাড়ির আশপাশেও অবস্থান নেয় পুলিশ। অভিযানের সময় ডিজিএম অফিসেই ছিলেন। প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে তার অবস্থান শনাক্ত করেন গোয়েন্দারা। বিকাল ৩টার দিকে তিনি অফিস থেকে বেরিয়ে তার নির্ধারিত গাড়িতে উঠছিলেন। এ সময় গোয়েন্দা পুলিশ তাকে গাড়ি থেকে নেমে আসতে বলেন। কৌশলী গোয়েন্দা কর্মকর্তারা তাকে বলেন, আপনার সঙ্গে জরুরি কথা আছে। আমাদের সঙ্গে মিন্টো রোডে যেতে হবে। কিন্তু তখনও ডিজিএম এমদাদ আঁচ করতে পারেননি তিনি গোয়েন্দা জালে আটকা পড়েছেন। ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে আসার পরও কৌশলগত কারণে তাকে হাতকড়া না পরিয়ে একজন অফিসারের কক্ষে বসিয়ে রাখা হয়। পরদিন মহানগর পুলিশের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে তাকে হাজির করা হলে ভেঙে পড়েন এমদাদ। এ সময় তিনি মুখ ঢেকে রাখার জন্য পুলিশের কাছে বারবার একটা গামছা চান। কিন্তু পুলিশ তাকে গামছা দেয়নি। ডিজিএম এমদাদকে গ্রেফতার করে মিন্টো রোডে নিয়ে যাওয়ার পর বিমানের ম্যানেজার তোজাম্মেলকে গ্রেফতারে অভিযান চালায় গোয়েন্দা পুলিশ। রাত ২টায় তোজাম্মেলের উত্তরা ৫ নম্বর সেক্টরের বাড়িতে হাজির হন গোয়েন্দারা। তোজাম্মেল তখন বাড়িতেই অবস্থান করছিলেন। কিন্তু ভবনের নিরাপত্তারক্ষীরা গেট খুলতে গড়িমসি শুরু করে। একপর্যায়ে নাটকীয়তার আশ্রয় নেন গোয়েন্দারা। নাটকীয়তার একপর্যায়ে নিরাপত্তারক্ষী ভবনের দরজা খুলে দেন। এরপর গোয়েন্দারা তোজাম্মেলকে তার ফ্ল্যাট থেকে গ্রেফতার করে মিন্টো রোডে নিয়ে যান। রাত ৩টায় বিমানের ক্যাপ্টেন আবু মোহাম্মদ আসলাম শহীদকে গ্রেফতারের জন্য তার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার সি ব্লকের ৪৫ নম্বর বাড়িতে হানা দেন গোয়েন্দারা। সেখান থেকে ক্যাপ্টেন শহীদকে গ্রেফতার করে মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়। এরপর রাতেই বিমানের ঠিকাদার পলাশকে উত্তরা এক নম্বর সেক্টর, দুই নম্বর রোডের তিন নম্বর বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়।
ফ্লাইং ক্লাব থেকে বিমান পরিচালনার ট্রেনিং নিয়ে পলাশ নিজকে পাইলট হিসেবে পরিচয় দিতেন। একপর্যায়ে তিনি ফ্লাইং ক্লাবের বোর্ড মেম্বারও হন। এরপর তিনি পাইলট হিসেবে লাইসেন্স নেয়ার জন্য বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) কাছে আবেদন করেন। কিন্তু বেবিচক গোপন সূত্রে জানতে পারে পলাশ এইচএসসি পাস করতে পারেননি। ভুয়া সাটিফিকেট দিয়ে তিনি ফ্লাইং ক্লাবে ভর্তি হয়েছিলেন। সিভিল এভিয়েশন থেকে পলাশের কলেজ ও বোর্ডে গিয়ে সার্টিফিকেট পরীক্ষা করার পর এ জালিয়াতি ধরা পড়ে। এরপরই মূলত বিমানের বিভিন্ন ঠিকাদারি ব্যবসা শুরু করেন তিনি। জানা গেছে, ১০ বছর আগে তিনি বিমানে ছোটখাটো ঠিকাদারি ব্যবসা শুরু করেন। ওই সময় তিনি বিমানের একজন শীর্ষ কর্মকর্তার আশীর্বাদে রাতারাতি প্রভাবশালী বনে যান। ওই সময়ে আবারও জাল কাগজপত্র দিয়ে বিমানের পাইলট হিসেবে নিয়োগ পেতে আবেদন করেন। কিন্তু বিষয়টি ফাঁস হয়ে গেলে তার সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরপর তিনি বিমানের তৎকালীন ফার্স্ট অফিসার ক্যাপ্টেন শামীম নজরুল ও বিমানের এক প্রভাবশালী ব্যক্তির ছেলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলেন। এরপর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। স্ত্রী কেবিন ক্রু হওয়ার সুবাদে পুরো ফ্লাইটের নিয়ন্ত্রণ চলে আসে তার হাতে। স্ত্রীর মাধ্যমে কেবিন ক্রুদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। আর তাদের দিয়েই চালাতে শুরু করেন স্বর্ণ ও ওষুধ চোরাচারালানি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানিয়েছেন, বিমানের সংশ্লিষ্ট সবার কাছে পলাশ পরিচিত ছিলেন এক প্রভাবশালীর ধর্মপুত্র হিসেবে। গোয়েন্দা সূত্র বলেছে, শুধু সোনা চোরাচালান নয়, গত ৬ বছর ধরে একচেটিয়া কমিশন বাণিজ্য, পদোন্নতি, বদলিসহ সব ধরনের তদবিরের শিরোমণি ছিলেন পলাশ। বিমানবন্দরে বিশেষ করে ফ্লাইটে ডিউটি রোস্টার নিয়ন্ত্রণ হতো তার ইশারায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সোনা চোরাচালান থেকে শুরু করে বিমানের নিয়োগ বাণিজ্যেও শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন পলাশ। সম্প্রতি হজ ফ্লাইট পরিচালনার জন্য ১০০ কেবিন ক্রু নিয়োগ দেয়া হয় তার দেয়া তালিকা অনুযায়ী। এর জন্য তাদের কাছ থেকে পলাশ মোটা অংকের ঘুষ নেন।
এমদাদ ওরফে লীগ এমদাদ : ডিজিএম এমদাদ হোসেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সবার কাছে পরিচিত ছিলেন। বিমানের সবাই তাকে চিনতেন লীগ এমদাদ হিসেবে। কারণ তার নামের আগে তিনি যোগ করেছিলেন লীগ শব্দটি। গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, এমদাদ গ্রেফতার হওয়ার পর একাধিক বিমানকর্মী গোয়েন্দা কার্যালয়ে গিয়ে এমদাদের অনেক অপকর্মের তথ্য দিয়েছেন। সেসব তথ্যের সূত্র ধরে তদন্ত চলছে।
সূত্র আরও জানিয়েছে, এমদাদের নামে ঢাকায় পাঁচটি ফ্ল্যাট ও তিনটি বহুতল বাণিজ্যিক ভবন রয়েছে। নিউমার্কেট এলাকায় তার স্ত্রীর নামে একটি মার্কেট রয়েছে। গুলশান-১ নম্বর সার্কেলে তার দুটি দোকানের তথ্য জানা গেছে। এ ছাড়া এমদাদ মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম করেছেন। টাকা পাচার করেছেন সিঙ্গাপুর ও অস্ট্রেলিয়ায়। দেশে তার ১২টি ব্যাংক হিসাবের সন্ধান পেয়েছেন গোয়েন্দারা। বিমান সূত্র জানিয়েছে, সম্প্রতি পদোন্নতি পেয়ে বিমানের ডিজিএম হন এমদাদ। অফিসে যাতায়াত করেন মার্সিডিজ বেঞ্জ মডেলের বিলাসবহুল গাড়িতে।
বিলাসী জীবন ক্যাপ্টেন শহীদের : বিমানের প্ল্যানিং ও শিডিউলিং বিভাগের প্রধান ক্যাপ্টেন শহীদ দীর্ঘ দিন ধরেই চোরাচালান চক্রের একজন সক্রিয় সদস্য। চিফ অব শিডিউলিং হিসেবে যোগদানের পর থেকে বিমানকেন্দ্রিক সোনা চোরাচালান বেড়ে যাওয়ার নেপথ্যে তার হাত ছিল। গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার সি ব্লকের ৪৫ নম্বর বাড়িটি দেখতে অনেকটাই রাজপ্রাসাদের মতো। বাড়ির ভেতরে ঢুকে জৌলুস দেখে হতভম্ব হয়ে যায় পুলিশ। গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, ক্যাপ্টেন শহীদ সোনা চোরাচালান ছাড়াও হুন্ডি চক্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। দীর্ঘ দিন ধরেই মানি এক্সচেঞ্জগুলোর সঙ্গে যোগসাজশ করে অর্থ চোরাচালানের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন। তার অর্থ-বিত্তের খোঁজে জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রেখেছেন গোয়েন্দারা।
সূত্র জানায়, ক্যাপ্টেন শহীদের চাকরি নিয়েও রয়েছে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ। বিমানে যোগদানের পর ১৯৮৫ সালে এফ-২৫ এর টেকনিক্যাল কোর্সে উত্তীর্ণ হতে পারেননি শহীদ। তারপরও বিমান তাকে নিয়োগ দেয়।
এদিকে গোয়েন্দারা ক্যাপ্টেন শহীদের ঘনিষ্ঠ ম্যানেজার (শিডিউলিং) শাহ আলম মিরন, পরিচালক (প্রশাসন) রাজপতি সরকারসহ আরও কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য খুঁজছে। গোয়েন্দারা বলেছেন, এদের জিজ্ঞাসাবাদ করা গেলে সোনা চোরাচালান ও দুর্নীতির অনেক তথ্য বেরিয়ে আসবে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার শেখ নাজমুল আলম বলেন, এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য বিমানবন্দরকেন্দ্রিক এই চোরাচালান সিন্ডিকেটটি ভয়াবহ বলে মনে হচ্ছে। তারা দীর্ঘদিন ধরে সোনা চোরাচালানের ট্রানজিট হিসেবে শাহজালাল বিমানবন্দরকে ব্যবহার করছিল। গোয়েন্দা পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার মিনহাজ উদ্দীন বলেন, বিমানের প্রায় ২৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি তারা খতিয়ে দেখছেন। এদের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি চালানো হচ্ছে।
আত্মগোপনে ৪৪ বিমানকর্মী : বিমানের ফ্লাইট সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ গ্রেফতারের ঘটনার পর কেবিন ক্রুসহ ৪টি বিভাগের ৪৪ জন কর্মকর্তা আত্মগোপন করেছেন। কেবিন ক্রু ও পাইলটদের মধ্যে অনেকে বিদেশে ফ্লাইট নিয়ে গেলেও এই খবর পেয়ে আর দেশে ফেরেননি। এদিকে গ্রেফতার হলেও বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত পাইলট শহীদ, ডিজিএম এমদাদ, জিএম তোজাম্মেল ও কেবিন ক্রু রাসেলের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বরং বিমানের শীর্ষ ম্যানেজমেন্ট থেকে তাদের বাঁচানোর জন্য সব ধরনের চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে জানা গেছে। ইতিমধ্যে তাদের পক্ষে স্ব স্ব বিভাগ থেকে মতামত দিয়ে ফাইল পাঠানো হয়েছে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে। বিমান সূত্রে জানা গেছে, সোনা চোরাচালান চক্রের প্রধান হোতা পলাশের গডফাদার ছিলেন পরিচালক প্রশাসন রাজপতি সরকার ও ডেপুটি চিফ অব ট্রেনিং ক্যাপ্টেন শামীম নজরুল। এছাড়া পরিচালক প্ল্যানিং বেলায়েত হোসেন ও পরিচালক ফাইনান্স মঞ্জুর ইমাম, জেনারেল ম্যানেজার আতিক সোবহান, জিএম শাকিল মেরাজ, ম্যানেজার শাহ আলম মিরন ছিলেন পলাশের আশ্রয়দাতা। পলাশ সম্পর্কে জানতে গোয়েন্দারা এদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেন বলে জানা গেছে। পলাশ বিমানে গিয়ে এদের কক্ষে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিতেন। জানা গেছে, সম্প্রতি পরিচালক প্রশাসন রাজপতি সরকারের চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও পলাশ, শামীম নজরুল ও একজন বোর্ড মেম্বারের সুবাদে তাকে আরও এক বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়। স্থায়ী চাকরিকালীন রাজপতি ৮০ হাজার টাকা বেতন পেলেও এখন পাচ্ছেন মাসে ২ লাখ টাকা। অনিয়ম-দুর্নীতি আর লুটপাটের অভিযোগে এই রাজপতি সরকারকে বিমানের সাবেক বিদেশী এমডি কেভিন স্টিল একাধিকবার শোকজ করলেও পলাশের কারণে তিনি প্রতিবারই বেঁচে যেতেন। পুরস্কার হিসেবে রাজপতি পলাশকে সব ধরনের সহযোগিতা করতেন। পলাশের কু-প্রস্তাব রাজি না হওয়ায় কিছুদিন আগে একজন কেবিন ক্রুকে চাকরিচ্যুত করেন রাজপতি। শেষ পর্যন্ত ওই কেবিন ক্রুর ব্যাগে চারটি সোনার বিস্কুট পাওয়ার অভিযোগ এনে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয় বলে জানা গেছে। যদিও ওই সোনার বারগুলো কেনার বৈধ কাগজপত্র তার কাছে ছিল।
এদিকে বেসরকারি এয়ারলাইন্স কোম্পানি রিজেন্ট, ইউনাইটেড ও ইউএস বাংলা সূত্রে জানা গেছে, পলাশের কাছে মোটা অংকের টাকা দিয়ে তাদের ১৬ জন পাইলট ও ফাস্ট অফিসার সম্প্রতি বিমানে যোগদান করেছেন। সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইন্স সংস্থাগুলোর অভিযোগ, তারা কোটি কোটি টাকা খরচ করে এসব পাইলট ও ফাস্ট অফিসারকে ট্রেনিং করিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা করার মতো করে তৈরি করেছে। তাদের সঙ্গে চুক্তিও আছে যোগদানের ৫ বছরের মধ্যে তারা অন্য কোনো এয়ারলাইন্সে যোগদান করতে পারবে না। আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন আইন অনুযায়ী কোনো পাইলট ও ফাস্ট অফিসার অন্য কোনো সংস্থায় যোগদান করতে হলে তাকে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে (এনওসি) ছাড়পত্র নিতে হবে। কিন্তু ১৬ পাইলট ও ফাস্ট অফিসার কোনো ধরনের ছাড়পত্র না নিয়েই বিমানে যোগদান করেছে। হঠাৎ করে ১৫ পাইলট ফাস্ট অফিসার চাকরি ছেড়ে দেয়ায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে ৩টি এয়ারলাইন্স সংস্থা।
রিজেন্ট এয়ারের একজন কর্মকর্তা জানান, তাদের ৫ জন পাইলটের মধ্যে ৩ জনই বিমানে যোগদান করেছে। অভিযোগ, এই ফাস্ট অফিসার নিয়োগের পুরোটাতেই নেতৃত্ব দিয়েছে ক্যাপ্টেন শামীম নজরুল, পলাশ ও রাজপতি সরকার। বিনিময়ে তাদের সঙ্গে হয়েছে আন্ডারহ্যান্ড ডিলিং। অভিযোগ রয়েছে পলাশ সিন্ডিকেট এই ১৬ ফাস্ট অফিসারকে নিয়োগ দেয়ার জন্য ৮ জন ক্যাডেট পাইলটকে নিয়োগ দিয়েও ট্রেনিং না করিয়ে ৪ বছর ধরে বসিয়ে রাখা হয়েছে। তাদের অধিকাংশের এখন আর চাকরির বয়স নেই বলেও জানা গেছে। অভিযোগ, ৩ জন মহিলা ক্যাডেট পাইলট আছেন- যারা পলাশের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তাদের ট্রেনিং না করিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে।
No comments