সোনা পাচার- কমিশনের ভাগ যায় রাজনীতিকদের কাছেও by নুরুজ্জামান লাবু
স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিভিন্ন পর্যায়ের অন্তত অর্ধশত কর্মী। ক্লিনার থেকে ঝাড়ুদার, ফ্লাইট স্টুয়ার্ড, কেবিন ক্রু, বিমানবালা, পাইলট, কো-পাইলট, ক্যাপ্টেন, ফ্লাইট সার্ভিসের বেশির ভাগ কর্মকর্তা, এমনকি শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারাও স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। স্বর্ণ চোরাচালানের কমিশনের টাকার একটি বড় অংশ যায় ক্ষমতাসীন সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের একজন নেতাসহ অন্তত সাত রাজনীতিকের কাছে। আর স্বর্ণ চোরাচালানের মূল হোতারা দুবাই বসেই সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে। এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে এক শ্রেণীর অসাধু মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ীও।
গত ১২ই নভেম্বর বাংলাদেশ বিমানের বিজি ০৪৬ ফ্লাইটের স্টুয়ার্ড মাজহারুল ইসলাম রাসেল দুই কেজি স্বর্ণসহ কাস্টমস কর্তৃপক্ষের কাছে হাতেনাতে ধরা পড়ে। এ ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় একটি মামলা দায়ের হয়। পরের দিন মামলাটি স্থানান্তর করা হয় ডিবিতে। ডিবি পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে রাসেল সবকিছু স্বীকার করে। এমনকি বিমান বাংলাদেশের কারা কারা স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত তা ফাঁস করে দেয়। গত সোমবার রাসেল আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। ওই জবানবন্দির তথ্য অনুযায়ী মঙ্গলবার রাতে প্রথমে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট সার্ভিসের উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) এমদাদ হোসেনকে উত্তরার বাসা থেকে আটক করা হয়। পরে তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী বিমান বাংলাদেশের চিফ অব প্ল্যানিং অ্যান্ড সিডিউলিংয়ের ক্যাপ্টেন আবু মো. আসলাম শহীদ, ম্যানেজার (সিডিউলিং) তোজাম্মেল হোসেন, ঠিকাদার মাহমুদুল হক পলাশ এবং উত্তরার ‘ফারহান মানি এক্সচেঞ্জ’-এর মালিক হারুন অর রশীদকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতদের তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে গোয়েন্দা পুলিশ।
মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (ডিসি-উত্তর) শেখ নাজমুল আলম বলেন, বিমান বাংলাদেশের ক্লিনার-ঝাড়ুদার থেকে উচ্চপর্যায়ের অনেকেই স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। নিম্ন পর্যায়ের কর্মচারীরা নিজেরাই অবৈধ স্বর্ণ বিমানবন্দর পার করে দেয়। আর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা স্বর্ণের চোরাচালান যেন সহজেই বের করা যায় সেজন্য প্রয়োজনীয় সব কিছু ঠিক করে রাখে। তিনি বলেন, ঢাকাসহ সারাদেশে মোট দশটি স্বর্ণ চোরাচালান সিন্ডিকেটের তথ্য তারা পেয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকার বিমানবন্দরে সক্রিয় ৬টি, চট্টগ্রামের বিমানবন্দরে তিনটি ও সিলেটে একটি সিন্ডিকেট সক্রিয়। তবে এসব চক্রের মূল হোতারা সবাই পরিবার পরিজন নিয়ে দুবাই থাকে। তাদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। দেশে ফিরলেই তাদের গ্রেপ্তার করা হবে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ মূলত স্বর্ণ চোরাচালানের ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। দুবাই থেকে সরাসরি বা সিঙ্গাপুর কিংবা মালয়েশিয়া হয়ে দেশে স্বর্ণের চালান ঢোকে। সেটি সীমান্তপথে পাশের দেশ ভারতে চলে যায়। বিশেষ করে সাতক্ষীরার ভোমরা সীমান্ত স্বর্ণ পাচারের অন্যতম রুট হিসেবে ব্যবহার করা হয়। অনুসন্ধানে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন দেশে আসা প্রত্যেকটি স্বর্ণের চালানের সঙ্গে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের লোকজন জড়িত থাকে। তারাই মূলত স্বর্ণের বার বিমানবন্দর পার করে দেয়। এর বিনিময়ে দশ তোলা ওজনের প্রতিটি বারের জন্য এক থেকে দুই হাজার টাকা কমিশন নেয়া হয়। সেই কমিশন বিমানের সিন্ডিকেট সদস্যরা ভাগ করে নেয়। কমিশনের বড় একটি অংশ যায় ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ এক রাজনীতিকের পকেটে। এছাড়া আরও অন্তত ৭ জন রাজনীতিককেও কমিশনের ভাগ দিতে হয়। তবে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এসব রাজনীতিকের নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার (এসি) মিনহাজুল আবেদীন জানান, গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। জিজ্ঞাসাবাদ ও তদন্তে যাদের নাম আসবে তাদেরকেই আইনের আওতায় আনা হবে।
দশ সিন্ডিকেট, হোতারা দুবাইয়ে: গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, স্বর্ণ চোরাচালানে অন্তত দশটি সিন্ডিকেটের সন্ধান পেয়েছেন তারা। এই সিন্ডিকেটের মূল হোতারা সবাই বর্তমানে দুবাইয়ে অবস্থান করছেন। তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে দুবাইয়ে থাকেন। সেখানেই ব্যবসা-বাণিজ্যের আড়ালে তারা স্বর্ণ চোরাচালানের কাজ করে থাকেন। সিন্ডিকেটের দেশীয় এজেন্টরা তাদের পাঠানো স্বর্ণ জায়গা মতো পৌঁছে দেয়। সেই স্বর্ণ ভারতে পাচারের পর ভারতীয় সিন্ডিকেট সদস্যরা দুবাইয়ে তাদের মূল্য পরিশোধ করে দেয়। এই সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য হলো শফিউল আজম তালুকদার ওরফে মিন্টু। তার বাড়ি চট্টগ্রামে। বর্তমানে সে দুবাইয়ে অবস্থান করছে। স্বর্ণ চোরাচালানের আরেক সিন্ডিকেটের মূল হোতা হলো মাসুম আল আজাদ ওরফে সুমন। রাজধানীর উত্তরা এলাকায় আলামিন মানি এক্সচেঞ্জসহ অন্তত সাতটি মানি এক্সচেঞ্জ রয়েছে তার। তবে সেও বেশিরভাগ সময় দুবাইয়ে থাকে। দুবাইয়ের এমরান মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ী এমরান একটি সিন্ডিকেটের মূল হোতা। সে দুবাইয়ে ব্যবসার পাশাপাশি স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত। এছাড়া অন্য সিন্ডিকেটগুলোর মধ্যে আব্বাস, হাছান, পিন্টু ও শাহীনের নাম উল্লেখযোগ্য।
বিমানের অর্ধশত কর্মী জড়িত: গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, স্বর্ণ চোরাচালানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের অন্তত অর্ধশত কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত বলে তারা জানতে পেরেছেন। জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রাপ্ত তথ্য যাচাই বাছাই করা হচ্ছে। যাদের বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যাবে তাদেরকেই গ্রেপ্তার করা হবে বলে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। ১২ই নভেম্বর গ্রেপ্তার হওয়া মাজহারুল ইসলাম রাসেলের স্বীকারোক্তির বরাত দিয়ে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, স্বর্ণ পাচারের সঙ্গে বিমানের বাইরেও সিভিল এভিয়েশন, কাস্টমস, বিভিন্ন প্রাইভেট এয়ারলাইন্স ও বিমানবন্দরে নিয়োজিত একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও জড়িত রয়েছে। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে রাসেল জানিয়েছে, বিমানবন্দর সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যারা ক্যাজুয়াল (দৈনিক হাজিরা) ভিত্তিতে কাজ করে তারাই অতিরিক্ত অর্থের লোভে স্বর্ণ চোরাচালানের কাজ করে থাকে। স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িতদের মধ্যে রয়েছে এয়ারপোর্ট সিভিল এভিয়েশন সিকিউরিটির আমির, জহির, মোস্তাফিজ, জলিল ও জিয়া। স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে গ্রেপ্তারকৃত বিমান বাংলাদেশের তিন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছাড়াও অন্যদের মধ্যে রয়েছে শিডিউলার মতিন, সরোয়ার, এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার সিদ্দিক। বিমান কর্মীদের মধ্যে রয়েছে ককপিট ক্রু ক্যাপ্টেন আলী, ইমরান, ইশতিয়াক, রফিক ও হাসান ইমাম; ফাস্ট অফিসার আহমেদ ইমরান, রাশেদুল, গফুর, আমিন; কেবিন ক্রু মাসুদ, আখলাক, আযম, সাদি, শওকত, শারমিন, জাহিদ, ওয়াসিক, রাফসান, আবির, মুকিত, হাসিব, মুগনি, রাজ, আরাফাত, আমিন, ইকরাম, আরিয়ান, জুয়েল, শওগাত, আলম, আদনান, শফিক, আশিক; বিমানবালা রিনি, নিশি, নিপা, হাসনা, জয়া, জেনি, মুক্তা, হোসনে আরা, বীথি, আদিবা, আসফিয়া, দিয়া, কসমিক, শ্যামা ও শোভা। এছাড়া চোরাচালানের সঙ্গে আরও যারা জড়িত তাদের নাম- বিমানের জুনিয়র সিকিউরিটি অফিসার কামরুল, ইঞ্জিনিয়ারিং অফিসার সালেহ, সুইপিং সুপারভাইজর জাফর, ইন্সপেকশন অফিসার শাহজাহান সিরাজ, এয়ারক্রাফট মেকানিক মাসুদ, আনিস ও গণি।
স্বর্ণ আসছে চট্টগ্রাম দিয়েও: গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তারা বিভিন্ন সময়ে স্বর্ণ পাচারকারী সিন্ডিকেট সদস্যদের গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পেরেছেন, ঢাকা বিমানবন্দরে কড়াকড়ি আরোপ করা হলেই তারা নতুন পথ বেছে নেয়। এক্ষেত্রে তাদের প্রথম পছন্দ চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দরের মাধ্যমে প্রচুর স্বর্ণের চালান ঢুকছে। চট্টগ্রাম থেকে নদী, সড়ক ও ট্রেনপথে স্বর্ণের চালান ঢাকায় আসে। আবার কখনও কখনও চট্টগ্রাম থেকে নদীপথে চালানগুলো সাতক্ষীরার ভোমরা সীমান্তে পৌঁছানো হয়। সেখান থেকে চালান চলে যায় ভারতে। গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, স্বর্ণের চালান ঢাকায় এলে অনেক সময় এক সিন্ডিকেটের কাছ থেকে আরেক সিন্ডিকেট সদস্যরা কিনে নেয়। পরে তা ভারতে পাচার করা হয়। এক্ষেত্রে বিভিন্ন মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ীরা জড়িত বেশি। তারা নিজেদের লোকজনের মাধ্যমে দুবাই সিন্ডিকেট সদস্যদের টাকা পৌঁছে দেয়।
গত ১২ই নভেম্বর বাংলাদেশ বিমানের বিজি ০৪৬ ফ্লাইটের স্টুয়ার্ড মাজহারুল ইসলাম রাসেল দুই কেজি স্বর্ণসহ কাস্টমস কর্তৃপক্ষের কাছে হাতেনাতে ধরা পড়ে। এ ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় একটি মামলা দায়ের হয়। পরের দিন মামলাটি স্থানান্তর করা হয় ডিবিতে। ডিবি পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে রাসেল সবকিছু স্বীকার করে। এমনকি বিমান বাংলাদেশের কারা কারা স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত তা ফাঁস করে দেয়। গত সোমবার রাসেল আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। ওই জবানবন্দির তথ্য অনুযায়ী মঙ্গলবার রাতে প্রথমে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট সার্ভিসের উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) এমদাদ হোসেনকে উত্তরার বাসা থেকে আটক করা হয়। পরে তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী বিমান বাংলাদেশের চিফ অব প্ল্যানিং অ্যান্ড সিডিউলিংয়ের ক্যাপ্টেন আবু মো. আসলাম শহীদ, ম্যানেজার (সিডিউলিং) তোজাম্মেল হোসেন, ঠিকাদার মাহমুদুল হক পলাশ এবং উত্তরার ‘ফারহান মানি এক্সচেঞ্জ’-এর মালিক হারুন অর রশীদকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতদের তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে গোয়েন্দা পুলিশ।
মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (ডিসি-উত্তর) শেখ নাজমুল আলম বলেন, বিমান বাংলাদেশের ক্লিনার-ঝাড়ুদার থেকে উচ্চপর্যায়ের অনেকেই স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। নিম্ন পর্যায়ের কর্মচারীরা নিজেরাই অবৈধ স্বর্ণ বিমানবন্দর পার করে দেয়। আর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা স্বর্ণের চোরাচালান যেন সহজেই বের করা যায় সেজন্য প্রয়োজনীয় সব কিছু ঠিক করে রাখে। তিনি বলেন, ঢাকাসহ সারাদেশে মোট দশটি স্বর্ণ চোরাচালান সিন্ডিকেটের তথ্য তারা পেয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকার বিমানবন্দরে সক্রিয় ৬টি, চট্টগ্রামের বিমানবন্দরে তিনটি ও সিলেটে একটি সিন্ডিকেট সক্রিয়। তবে এসব চক্রের মূল হোতারা সবাই পরিবার পরিজন নিয়ে দুবাই থাকে। তাদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। দেশে ফিরলেই তাদের গ্রেপ্তার করা হবে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ মূলত স্বর্ণ চোরাচালানের ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। দুবাই থেকে সরাসরি বা সিঙ্গাপুর কিংবা মালয়েশিয়া হয়ে দেশে স্বর্ণের চালান ঢোকে। সেটি সীমান্তপথে পাশের দেশ ভারতে চলে যায়। বিশেষ করে সাতক্ষীরার ভোমরা সীমান্ত স্বর্ণ পাচারের অন্যতম রুট হিসেবে ব্যবহার করা হয়। অনুসন্ধানে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন দেশে আসা প্রত্যেকটি স্বর্ণের চালানের সঙ্গে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের লোকজন জড়িত থাকে। তারাই মূলত স্বর্ণের বার বিমানবন্দর পার করে দেয়। এর বিনিময়ে দশ তোলা ওজনের প্রতিটি বারের জন্য এক থেকে দুই হাজার টাকা কমিশন নেয়া হয়। সেই কমিশন বিমানের সিন্ডিকেট সদস্যরা ভাগ করে নেয়। কমিশনের বড় একটি অংশ যায় ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ এক রাজনীতিকের পকেটে। এছাড়া আরও অন্তত ৭ জন রাজনীতিককেও কমিশনের ভাগ দিতে হয়। তবে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এসব রাজনীতিকের নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার (এসি) মিনহাজুল আবেদীন জানান, গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। জিজ্ঞাসাবাদ ও তদন্তে যাদের নাম আসবে তাদেরকেই আইনের আওতায় আনা হবে।
দশ সিন্ডিকেট, হোতারা দুবাইয়ে: গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, স্বর্ণ চোরাচালানে অন্তত দশটি সিন্ডিকেটের সন্ধান পেয়েছেন তারা। এই সিন্ডিকেটের মূল হোতারা সবাই বর্তমানে দুবাইয়ে অবস্থান করছেন। তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে দুবাইয়ে থাকেন। সেখানেই ব্যবসা-বাণিজ্যের আড়ালে তারা স্বর্ণ চোরাচালানের কাজ করে থাকেন। সিন্ডিকেটের দেশীয় এজেন্টরা তাদের পাঠানো স্বর্ণ জায়গা মতো পৌঁছে দেয়। সেই স্বর্ণ ভারতে পাচারের পর ভারতীয় সিন্ডিকেট সদস্যরা দুবাইয়ে তাদের মূল্য পরিশোধ করে দেয়। এই সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য হলো শফিউল আজম তালুকদার ওরফে মিন্টু। তার বাড়ি চট্টগ্রামে। বর্তমানে সে দুবাইয়ে অবস্থান করছে। স্বর্ণ চোরাচালানের আরেক সিন্ডিকেটের মূল হোতা হলো মাসুম আল আজাদ ওরফে সুমন। রাজধানীর উত্তরা এলাকায় আলামিন মানি এক্সচেঞ্জসহ অন্তত সাতটি মানি এক্সচেঞ্জ রয়েছে তার। তবে সেও বেশিরভাগ সময় দুবাইয়ে থাকে। দুবাইয়ের এমরান মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ী এমরান একটি সিন্ডিকেটের মূল হোতা। সে দুবাইয়ে ব্যবসার পাশাপাশি স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত। এছাড়া অন্য সিন্ডিকেটগুলোর মধ্যে আব্বাস, হাছান, পিন্টু ও শাহীনের নাম উল্লেখযোগ্য।
বিমানের অর্ধশত কর্মী জড়িত: গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, স্বর্ণ চোরাচালানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের অন্তত অর্ধশত কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত বলে তারা জানতে পেরেছেন। জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রাপ্ত তথ্য যাচাই বাছাই করা হচ্ছে। যাদের বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যাবে তাদেরকেই গ্রেপ্তার করা হবে বলে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। ১২ই নভেম্বর গ্রেপ্তার হওয়া মাজহারুল ইসলাম রাসেলের স্বীকারোক্তির বরাত দিয়ে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, স্বর্ণ পাচারের সঙ্গে বিমানের বাইরেও সিভিল এভিয়েশন, কাস্টমস, বিভিন্ন প্রাইভেট এয়ারলাইন্স ও বিমানবন্দরে নিয়োজিত একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও জড়িত রয়েছে। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে রাসেল জানিয়েছে, বিমানবন্দর সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যারা ক্যাজুয়াল (দৈনিক হাজিরা) ভিত্তিতে কাজ করে তারাই অতিরিক্ত অর্থের লোভে স্বর্ণ চোরাচালানের কাজ করে থাকে। স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িতদের মধ্যে রয়েছে এয়ারপোর্ট সিভিল এভিয়েশন সিকিউরিটির আমির, জহির, মোস্তাফিজ, জলিল ও জিয়া। স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে গ্রেপ্তারকৃত বিমান বাংলাদেশের তিন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছাড়াও অন্যদের মধ্যে রয়েছে শিডিউলার মতিন, সরোয়ার, এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার সিদ্দিক। বিমান কর্মীদের মধ্যে রয়েছে ককপিট ক্রু ক্যাপ্টেন আলী, ইমরান, ইশতিয়াক, রফিক ও হাসান ইমাম; ফাস্ট অফিসার আহমেদ ইমরান, রাশেদুল, গফুর, আমিন; কেবিন ক্রু মাসুদ, আখলাক, আযম, সাদি, শওকত, শারমিন, জাহিদ, ওয়াসিক, রাফসান, আবির, মুকিত, হাসিব, মুগনি, রাজ, আরাফাত, আমিন, ইকরাম, আরিয়ান, জুয়েল, শওগাত, আলম, আদনান, শফিক, আশিক; বিমানবালা রিনি, নিশি, নিপা, হাসনা, জয়া, জেনি, মুক্তা, হোসনে আরা, বীথি, আদিবা, আসফিয়া, দিয়া, কসমিক, শ্যামা ও শোভা। এছাড়া চোরাচালানের সঙ্গে আরও যারা জড়িত তাদের নাম- বিমানের জুনিয়র সিকিউরিটি অফিসার কামরুল, ইঞ্জিনিয়ারিং অফিসার সালেহ, সুইপিং সুপারভাইজর জাফর, ইন্সপেকশন অফিসার শাহজাহান সিরাজ, এয়ারক্রাফট মেকানিক মাসুদ, আনিস ও গণি।
স্বর্ণ আসছে চট্টগ্রাম দিয়েও: গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তারা বিভিন্ন সময়ে স্বর্ণ পাচারকারী সিন্ডিকেট সদস্যদের গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পেরেছেন, ঢাকা বিমানবন্দরে কড়াকড়ি আরোপ করা হলেই তারা নতুন পথ বেছে নেয়। এক্ষেত্রে তাদের প্রথম পছন্দ চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দরের মাধ্যমে প্রচুর স্বর্ণের চালান ঢুকছে। চট্টগ্রাম থেকে নদী, সড়ক ও ট্রেনপথে স্বর্ণের চালান ঢাকায় আসে। আবার কখনও কখনও চট্টগ্রাম থেকে নদীপথে চালানগুলো সাতক্ষীরার ভোমরা সীমান্তে পৌঁছানো হয়। সেখান থেকে চালান চলে যায় ভারতে। গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, স্বর্ণের চালান ঢাকায় এলে অনেক সময় এক সিন্ডিকেটের কাছ থেকে আরেক সিন্ডিকেট সদস্যরা কিনে নেয়। পরে তা ভারতে পাচার করা হয়। এক্ষেত্রে বিভিন্ন মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ীরা জড়িত বেশি। তারা নিজেদের লোকজনের মাধ্যমে দুবাই সিন্ডিকেট সদস্যদের টাকা পৌঁছে দেয়।
No comments