গার্মেন্টের পর এবার কি ট্যানারি?
তৈরী পোশাক বা গার্মেন্ট শিল্পের পরিণতি ভোগ করতে পারে দেশের ১০০ কোটি ডলারের ট্যানারি শিল্প! গার্মেন্ট শিল্পের মতোই এ শিল্পের উন্নতির জন্য চাপ সৃষ্টি করতে পারে বিদেশী সরকার ও আন্তর্জাতিক ক্রেতারা। এমন চাপ সৃষ্টির পরামর্শও দেয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন হুমকি দিয়েছে। তারা বলেছে, এ শিল্পের উন্নতি না হলে বাংলাদেশ থেকে চামড়া আমদানি বন্ধ করে দেবে তারা। গার্মেন্টে শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ, তাদের জীবনমান, নিরাপত্তা ইত্যাদি নিয়ে পশ্চিমা ক্রেতারা যেমন চাপ সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশের ওপর, ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে তাদের কাজ অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছে বা নেয়ার চেষ্টা করছে, ট্যানারি শিল্পেও সেই গার্মেন্টের মতো পরিবেশ বিরাজমান। শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ, জীবনমান, মজুরি সেই গার্মেন্ট শ্রমিকদের মতোই। কখনো তাদের অবস্থা আরও সঙিন। বিশেষ করে গার্মেন্ট শিল্পের ভয়াবহতায় দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে দেয়া বিশেষ জিএসপি সুবিধা স্থগিত করে রেখেছে। একই রকম পরিণতি আসতে পারে ট্যানারি শিল্পে। বিজনেস উইক-এ প্রকাশিত এক রিপোর্টে এমন সব আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে এখনই যদি এ শিল্পের শ্রমিকদের জীবনমানের উন্নয়নে পরিকল্পনা না করা হয় তাহলে নেমে আসতে পারে দুরবস্থা। ১৩ই নভেম্বর বিজনেস উইকে বাংলাদেশের ট্যানারি শিল্পের এমন এক অন্ধকার অধ্যায় তুলে ধরা হয়। তাতে বাংলাদেশের হাজারীবাগে অবস্থিত ট্যানারি শিল্প পরিবেশের জন্য কতটা ক্ষতিকর, সেখানে কর্মজীবী শ্রমিকদের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি, তাদের স্বল্প মজুরি ইত্যাদি নিয়ে আলোকপাত করা হয়। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পের পর এ খাতে দেশকে বিরাট মূল্য দিতে হচ্ছে। সরকারি হিসাবে, প্রতিদিন হাজারীবাগের ট্যানারি থেকে পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর এমন ২২০০০ ঘন মিটার তরল বর্জ্য ছেড়ে দেয়া হচ্ছে বুড়িগঙ্গা নদীতে। এতে মিশ্রিত অবস্থায় থাকে হেক্সাভ্যালেন্ট ক্রোমিয়াম। ২০১৩ সালের নভেম্বরে নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ব্ল্যাকস্মিথ ইনস্টিটিউট বাংলাদেশকে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দূষিত ১০টি স্থানের একটি হিসেবে অভিহিত করেছে বাংলাদেশের হাজারীবাগকে। ঢাকাভিত্তিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ট হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট-এর পরিচালক ফিলিপ গায়েনের মতে, একবার যদি আপনি হাজারীবাগের ভিতরে প্রবেশ করেন তাহলে মনে করবেন আপনি একটি দূষিত চেম্বারের মধ্যে অবস্থান করছেন। সবচেয়ে করুণ পরিণতি ট্যানারিতে নিয়োজিত ৮ থেকে ১২ হাজার শ্রমিকের। তারা সপ্তাহের সাতদিনই কাজ করেন। প্রতিদিন তাদেরকে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। এতে দিনে তারা ২ ডলারেরও কম পারিশ্রমিক পান। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, এ অবস্থার পরিবর্তন হবে একমাত্র তখনই যদি বিদেশী সরকার ও আন্তর্জাতিক ক্রেতারা বাংলাদেশের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে। এরই মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন হুমকি দিয়েছে যদি ট্যানারি শিল্পের উন্নতি না হয় তাহলে তারা বাংলাদেশ থেকে চামড়া আমদানি বন্ধ করে দিতে পারে। কিন্তু এ হুমকির পরেও কোন পরিবর্তন এসেছে কিনা তা কেউ বলতে পারেন না। বিজনেস উইকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে রঙিন ৬টি ছবিসহ ট্যানারি শিল্প, বিশেষ করে হাজারীবাগের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের অনুসন্ধান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের হুমকি এ পরিস্থিতির দিকে ইঙ্গিত করে। এ অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য পশ্চিমা ক্রেতাদের চাপ দেয়ার বিষয়টি সুপারিশ করা হয়েছে। দূষণ কমানো ও এ শিল্পকে সাভারে স্থানান্তরে সরকারের নিষ্ক্রিয়তার বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছে ওই রিপোর্টে। বিজনেস উইকে প্রকাশিত প্রতিবেদনের লেখক জেসন মোটলাগ এবং জোশ এইডেলসন। তারা লিখেছেন, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার ভিতরে একটি এলাকা হাজারীবাগ। হাজারীবাগ অর্থ হাজার গাছের বাগান। কিন্তু এই হাজারীবাগানে কোন গাছ নেই। ফুল নেই। তার পরিবর্তে আছে ২ শতাধিক চামড়া প্রক্রিয়াকরণ ট্যানারি শিল্প। তাতে ব্যবহার করা হয় বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ। তা প্রতিনিয়ত বাতাস, পানি ও মাটিকে দূষিত করে চলেছে। এসব শিল্পে পশুর চামড়া থেকে ছাড়ানো ময়লা এক জায়গায় জমা করে রাখা হয়, চুল্লি থেকে নির্গত ধোঁয়া এতটাই বাজে যে, স্থানীয়রা মুখোশ পরতে বাধ্য হন। এর কাছাকাছি বসবাস করেন দু’সন্তানের জননী গুল দুলালি (২৭)। তিনি বলেন, এ জীবন লজ্জার। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ ব্যুরোর হিসাবমতে, বছরে বাংলাদেশ ১০০ কোটি ডলারের চামড়া রপ্তানি করে। তুলনামূলক কম দাম ও গুণগত মানের ভাল হওয়ায় এশিয়া ও ইউরোপের ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে চামড়া কিনতে বেশি আগ্রহী হচ্ছে। দেশের প্রক্রিয়াকরণ করা মোট চামড়ার শতকরা ৮০ ভাগই রপ্তানি করা হয়। এখানকার একটি কারখানা, যারা হংকং, কোরিয়া ও ইতালিতে কালো চামড়া পাইকারি বিক্রি করে থাকে সেখানে কাঠে তৈরি বিশাল সব ড্রামে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থে ভিজিয়ে রাখা হয়েছে চামড়া। এসব রাসায়নিকের মধ্যে রয়েছে ক্রোমিয়াম সালফেট, আর্সেনিক। চামড়াকে নরম করতে এগুলো ব্যবহার করা হয়। বেশির ভাগ শ্রমিকই হাতে কোন গ্লাভস না পরে পায়ে কোন নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা ছাড়াই নেমে যান সেই ড্রামে। মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এসিড। তার ওপর দিয়ে খালি পায়ে হাঁটেন তারা। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিচার্ড পিয়ারসহাউজ ২০১২ সালে এ কারখানা পরিদর্শন করেছেন। তিনি বলেছেন, এমন পরিবেশে কাজ করছেন শ্রমিকরা। তাদের কোন নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেই। তাদের বা মালিকপক্ষ থেকে নেই স্বাস্থ্য সচেতনতা। এসব রাসায়নিক পদার্থ দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে সৃষ্টি হতে পারে ক্যান্সার। ৩৫ বছর বয়সী একজন শ্রমিক নূর মোহাম্মদ। তার হাতে ও পায়ে রাসায়নিক পদার্থের কারণে অনেক ক্ষতের চিহ্ন বর্তমান। তিনি বলেন, এসব ঘায়ে সব সময় ব্যথা করে। তিনি বলেন, যদি অসুস্থতায় কেউ ছুটি চায় তাহলে তাকে কাজ থেকে ছাঁটাই করে দেয়া হয়। একটি কারখানার ম্যানেজার বলেছেন, তার ট্যানারি থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়। মাসে চিকিৎসা খাতে ২০ ডলার পর্যন্ত দেয়া হয়। তবে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের অনুসন্ধানে দেখেছে, দূষণ বন্ধে কর্তৃপক্ষ কোন উদ্যোগ নেয় নি। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় মালিকরা পরিবেশ বিধি লঙ্ঘন করছেন। তারা পরিণতির কথা ভাবছেন না। ওদিকে একটি কারখানার মালিক, বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টারস এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবু তাহের বলেছেন, সীমিত জায়গা ও ক্রমবর্ধমান অর্থনীতিই হাজারীবাগের এই অবস্থার জন্য দায়ী। এ সমস্যা সমাধানে সরকার সমর্থিত একটি প্রস্তাব আছে। তাতে ট্যানারি শিল্পকে সাভারে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। ২০০৩ সালে তাতে সম্মতি দিয়েছেন ১৫০ জন মালিকের একটি গ্রুপ। কিন্তু তারপর অনেকগুলো ডেডলাইন পার হয়ে গেছে।
No comments