অনুপ চেটিয়াকে দ্রুত ফেরত চায় ভারত by দীন ইসলাম
দীর্ঘদিন বাংলাদেশের কারাগারে বন্দি উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার সাধারণ সম্পাদক অনুপ চেটিয়াকে অতি দ্রুত ফেরত চেয়েছে ভারত সরকার। ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম (উলফা)-এর এ শীর্ষ নেতার সঙ্গে তার দুই সহচর লক্ষ্মীপ্রসাদ গোস্বামী ও বাবুল শর্মাকেও ফেরত চান তারা। গত ১৭ই নভেম্বর পররাষ্ট্র সচিবের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে বিষয়টি সর্বোচ্চ মানবিক বিবেচনায় দেখার অনুরোধ করেছে ভারতীয় হাইকমিশন। চিঠিতে তারা তিন বন্দির সঙ্গে ৩০ নভেম্বরের পরও সাক্ষাতের অনুমতি বহাল রাখার অনুরোধ করেছে। ওই চিঠির সঙ্গে অনুপ চেটিয়াসহ তিনজনের নিজ দেশে ফেরার আগ্রহ সংক্রান্ত চিঠি জুড়ে দেয়া হয়েছে। তিন বন্দি ইতিপূর্বে বাংলাদেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য করা আবেদন প্রত্যাহারের অনুরোধ করেছেন। ভারতীয় হাইকমিশনের চিঠিতে বলা হয়েছে, গত ১২ই নভেম্বর তিন বন্দির সঙ্গে ভারতীয় হাইকমিশনের পক্ষ থেকে সাক্ষাৎ করা হয়েছে। ওই সময় তিন ভারতীয় দ্রুত ভারতে প্রত্যাবর্তনের অনুরোধ জানিয়েছেন। ভারতীয় কনস্যুলার অফিসার জানতে পেরেছেন লক্ষ্মীপ্রসাদ গোস্বামীর স্বাস্থ্যগত অবস্থা ভাল নয়। তিনি উচ্চ রক্তচাপ, ডিপ্রেশন ও হার্টের সমস্যায় ভুগছেন। এ কারণে ভারতীয় হাইকমিশন আবারও তিনজনকে দ্রুত ভারতে প্রত্যাবর্তনের অনুরোধ করছে। ৩০শে নভেম্বরের মধ্যে তাদের প্রত্যাবর্তন না হলে এরপরও কনস্যুলার সুবিধা বহাল রাখার অনুরোধ জানানো হয়েছে। চিঠির সঙ্গে তিন বন্দির চিঠি যুক্ত করা হয়েছে। কাশিমপুরের হাইসিকিউরিটি সেল থেকে লেখা চিঠিতে অনুপ চেটিয়া বলেছেন, ২০১৩ সালের ১৩ই মে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে অবস্থানরত অবস্থায় কারা মহাপরিদর্শকের মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কাছে দাখিলকৃত রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন প্রত্যাহার করে নিজ জন্মভূমিতে প্রত্যাবর্তনের জন্য আবেদন করেছিলাম। মহোদয়, সুদীর্ঘদিন সাক্ষাৎকারবিহীন বন্দিত্বের মধ্যে নিদারুণ কষ্টকর জীবন অতিবাহিত করে এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে পরিত্রাণের অসীম প্রত্যাশায়, আত্মীয়-স্বজনের কাছে ফিরে যাবো এ বিশ্বাস নিয়ে মনের মধ্যে উচ্ছ্বাস সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু অদ্যাবধি আমাদের বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত না নেয়ায় আমরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। এমন অবস্থায় আমার দুই সহযোগী বন্দিসহ আমাদেরকে জন্মভূমিতে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মহোদয় সমীপে পুনরায় সবিনয় অনুরোধ জানাচ্ছি।- বিনীত অনুপ চেটিয়া ওরফে গোলাপ বড়ুয়া, কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগার, গাজীপুর। অনুপ চেটিয়ার সহচর লক্ষ্মীপ্রসাদ গোস্বামী তার চিঠিতে লিখেছেন, আমি লক্ষ্মীপ্রসাদ গোস্বামী। সংযুক্ত মুক্তি বাহিনীর সদস্য (উলফা)। ১৯৯৭ সালের ২১শে ডিসেম্বর অনুপ চেটিয়াসহ বাংলাদেশ আমাকে গ্রেপ্তার করে। আমি অনুপ চেটিয়াসহ বাংলাদেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেছি। কিন্তু সদুত্তর পাইনি। বাংলাদেশে স্বাধীনতা আন্দোলনে আমার পরিবার ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। এ প্রেরণাই আমি আমার সংগঠনের করা আসামের স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িত হই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপ্রেরণা নিয়ে। এখন ১৬টা বছর ধরে কারাগারে বন্দি জীবনযাপন করছি। বন্দিত্ব অবস্থায় আমার পরিবারের সঙ্গে কোন ধরনের যোগাযোগ পর্যন্ত করা যাচ্ছে না। এখন আমার সংগঠন ভারত সরকারের সঙ্গে আলোচনা করছে। তাই আমি আবেদন করছি আমার সম্মানজনক প্রত্যাবর্তন। সেটা অবশ্যই যেন রাজনৈতিকভাবে হয়। বাবুল শর্মা ইংরেজিতে লেখা আবেদনে বলেছেন, ১৯৯৮ সালে ৮ই আগস্ট রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেছিলাম। ওই আবেদন প্রত্যাহার করে নিজ দেশে ফিরে যেতে চাই। জাতির বৃহত্তর স্বার্থ ও পরিবারের কথা চিন্তা করে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এর আগে ১৯৯৭ সালের ২১শে ডিসেম্বর ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকার একটি বাসা থেকে অনুপ চেটিয়াকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর তার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান এবং অবৈধভাবে বিদেশী মুদ্রা ও একটি স্যাটেলাইট ফোন রাখার অভিযোগে তিনটি মামলা হয়। পরে তিনটি মামলায় তাকে যথাক্রমে ৩, ৪ ও ৭ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয় বাংলাদেশের আদালত। ২০০৭ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি তার সাজার মেয়াদ শেষ হয়। অতীতে বিভিন্ন সময়ে অনুপ চেটিয়াকে ভারতের কাছে হস্তান্তর করার জন্য ওই দেশের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ ছিল। কিন্তু বাংলাদেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে ২০০৩ সালের ২৩শে আগস্ট হাইকোর্টে আবেদন করেন অনুপ চেটিয়া। এ কারণে তাকে হস্তান্তরে আইনি জটিলতা ও দুই দেশের মধ্যে বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি না থাকার কথাও বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল। বর্তমান সরকার আমলে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি হয়েছে। এদিকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের স্বাধীনতার লক্ষ্যে ১৯৭৯ সালে গঠিত হয় উলফা। এরপর দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে সশস্ত্র তৎপরতা চালায় সংগঠনটি। ভারতীয় গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ২০০৯ সালের শেষ দিকে উলফার চেয়ারম্যান অরবিন্দ রাজখোয়াসহ সংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ের প্রায় সব নেতাকে বাংলাদেশ থেকে ধরে ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপর ২০১০ সাল থেকে দিল্লিতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে উলফার শান্তি আলোচনা চলছে। এছাড়া বাংলাদেশে চলছে তিন উলফা নেতাকে ফিরিয়ে নেয়ার দেনদরবার।
No comments