ময়লা by মাহবুব কামাল
আমেরিকায় যারা থাকেন অথবা ভ্রমণ করেন, তারা সেখানে একটি শব্দ নিয়মিতভাবেই শুনে থাকবেন। শব্দটি মধৎনধমব, বাংলা অর্থ ময়লা বা জঞ্জাল। প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক, এত পরিচ্ছন্ন একটি দেশ, সেখানে ময়লা এলো কোত্থেকে? না, এই ময়লা বস্তুগত নয়; মনোজাগতিক, বলা যেতে পারে বায়বীয়। অনিয়ম, অসঙ্গতি, চিন্তার দৈন্য, আচরণের অশিষ্টতা ইত্যাদির ক্ষেত্রে এই শব্দের শ্লেষাত্মক ব্যবহার হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের বস্তুজগতের ময়লা তো কহতব্য নয়। রুমাল ছাড়া পথ হাঁটাই মুশকিল। একটা চমৎকার দেয়ালের দিকে তাকাব, দেখব সেখানেও কেউ একজন চুন মেখে রেখেছে। ইউরোপ-আমেরিকায় যাওয়ার দরকার নেই, এশিয়ার সিঙ্গাপুরের রাস্তায়ই এক টুকরো পরিষ্কার কাগজও পাওয়া যাবে না, ঢাকার রাস্তায় ময়লাযুক্ত কাগজগুলো টোকালে সেগুলো দিয়ে এক হাজার হাতির শরীর মোড়ানো সম্ভব। থাকগে, বস্তুজগতের ময়লা নিয়ে পরিবেশবাদীরা ভাবুন, আমরা কথা বলব মনোজগতের আবর্জনা নিয়ে।
প্রকৃতপক্ষে, আমরা সবাই নানা রঙের মনোজাগতিক ময়লার মধ্যেই বাস করছি- কালো, ধূসর, এমনকি রঙিনও। গত শতাব্দীর আশির দশকে কালারড টেলিভিশনের সূচনা হয়েছিল যখন, এক বিদগ্ধ লেখক বলেছিলেন- এবার বিটিভির আবর্জনাগুলো রঙিন হল! কুড়ি বছর আগে, আমি একটি সাপ্তাহিকীতে নিয়মিত কলাম লিখে যাচ্ছিলাম, একদিন কানাডাফেরত এক পাঠক, তসলিম যার নাম, আমাকে একটি চাইনিজ রেস্তোরাঁয় খাওয়াতে খাওয়াতে বলেছিলেন- দেশের ময়লা সাফ করার দায়িত্ব নিয়েছেন? কই দেখি ঝাড়ুটা? ওটা ছুঁড়ে ফেলে দিন, পারবেন না। তাই তো! কীভাবে তা সম্ভব?
চিন্তার ময়লাটা একটু দেখুন। নারীসঙ্গবিলাসী কিংবা নির্বিচার যৌনতায় লিপ্ত যে, সে হচ্ছে দুশ্চরিত্র, দুর্নীতিপরায়ণ নয়! আর আর্থিক কেলেংকারি ঘটিয়ে চলেছে যে, সে দুর্নীতিবাজ; কিন্তু দুশ্চরিত্র নয়। কী বুঝলেন? অর্থাৎ সচ্চরিত্র থেকেও দুর্নীতিবাজ হওয়া যায় এবং দুর্নীতিবাজ হয়েও সচ্চরিত্র থাকা যায়! আরেক ধরনের ময়লার কথা বলি। যারা বেশি বেশি টেলিভিশন দেখেন, তারা বলতে পারবেন আমি ঠিক বলছি, কী বেঠিক। টেলিভিশনের পর্দায় যত ধরনের ময়লা ভেসে বেড়ায়, তার একটি হল শোবিজ তারকাদের নিয়ে টকশো। তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী সবাই তারকা; তবে আলোটা বেরোয় ড্যাজলিং পোশাক থেকে, চিন্তা থেকে নয়। অবশ্য চিন্তা অনেক পরে, কথাটাই কি শুদ্ধ করে বলতে পারে তারা? 'so'-এর পর 'that' বসালে অর্থটা আর সুতরাং থাকে না, যেন অথবা যাতে হয়ে যায়। অথচ নির্বিবাদে তারা বলে যাচ্ছে-so that, আমি এই পেশা বেছে নিয়েছি। skillকে বলছেskillness; কনফিডেন্স না বলে বলছে- এ ব্যাপারে আমার কনফিডেন্ট আছে। একদিন তো থ মেরে গেলাম। বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতায় অন্তত প্রিলিমিনারি সিলেকশনে টিকে যাবে, এমন এক সুন্দরী বলছে- আমাদের village womansiv এখন অনেক ফ্রিডম। একটা মাত্র বাক্য, কত ভুল! woman-এর বহুবচন women। 's' যোগ করে না হয় প্লুরাল করল; সেক্ষেত্রে iv কেন? একসঙ্গে দুটো প্লুরাল! village-এর জায়গায় যে rural হবে- এই ভুল মাফ করে দেয়া ছাড়া উপায় কী! শেষ হল না। আরে মেয়ে, freedom মানে স্বাধীনতা, স্বাধীন নয়। পরিষ্কার কাপড় পরে এভাবে ময়লাযুক্ত কথা বললে কী আর সুন্দর থাকা যায়! ওই মেয়েটিকে বলতে পারলাম না, স্মার্ট হতে হলে ইংরেজি বলার কিংবা ফ্যাশনদুরস্ত হওয়ার দরকার নেই, মাতৃভাষায় শুদ্ধভাবে কোনো বিষয়ে মতামত দিতে পারলেই স্মার্ট হওয়া যায়। তরুণ-তরুণীরা কথা বলে আর অনবরত হাসে, ভাবে সমগ্র জাতিই বুঝি তাদের কথায় হাসছে। যা নিয়ে হাসে তারা, সেখানে হিউমার তো নেই-ই, বুদ্ধিমত্তাও নেই। তবু হাসে। মাথার ময়লা চাপ দেয়, তারা কী করবে?
রাজনীতির টকশোগুলোর উপযোগিতা কী, বুঝি না। এসব তো চায়ের স্টলেই আলোচিত হয়। ব্যতিক্রম ব্যতিক্রমই, ইংরেজিতে বললে exception justifies the rule- ব্যতিক্রম নিয়মটিকে আরও যুক্তিগ্রাহ্য করে তোলে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অ্যাংকর কি খেয়াল করেন, একসময় তার সামনে আবর্জনার স্তূপ জমা হয়ে যায়? অশুদ্ধের ছড়াছড়ি- অশুদ্ধ শব্দ, অশুদ্ধ বাক্য, অশুদ্ধ যুক্তি, অশুদ্ধ চিন্তা। জার্মানিতে একসময় বিভিন্ন মতবাদের মধ্যে পলেমিক্স হতো। এই পলেমিক্স দর্শনশাস্ত্রকে সমৃদ্ধ করেছে, সভ্যতাকে দিয়েছে প্রচুর। এ দেশের রাজনীতি-বিশ্লেষকরা তাদের মতো পলেমিক্স দূরের কথা, রিমিক্স করতেও জানে না। তারপরও টকশোগুলো জনপ্রিয়! ময়লা তো শুধু টকারদের মাথায়ই নেই, লিসেনারদের মাথায়ও আছে।
আমার মেয়েটি খুব cultured অথবা আমার বাবা খুব ব্যক্তিত্ববান- এ দুটি বাক্য শোনার পর খোঁজ নিলে দেখা যাবে, মেয়েটি শুধু হারমোনিয়াম বাজাতে জানে আর সেই বাবা কম কথা বলেন, গম্ভীর। হারমোনিয়াম ও গাম্ভীর্য যে যথাক্রমে সংস্কৃতি ও ব্যক্তিত্বের খুব নগণ্য কম্পোনেন্ট, এটা কথকদ্বয়কে বোঝাবে কে? কথা ও আচরণের শিল্প এবং জীবনসংগ্রামের গড় প্রকাশই হচ্ছে একজনের সংস্কৃতি। আর ব্যক্তিত্ববান? এমন কথা বলেন না, মানুষে কয় ঝুট; এমন জায়গায় বসেন না, কেউ কয় উঠ্। এবং আরও, তিনি ভালো ও মন্দের প্রভেদ করে ভালোর পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে থাকেন।
চিন্তার ময়লা কোথায় নেই? একদিন আড্ডায় এক অনুজপ্রতিম জিজ্ঞেস করেছিল- আপনি ঈর্ষা করেন কাকে? বললাম- নেইল আর্মস্ট্রং ও কার্লো পন্টিকে (তখন সোফিয়া লরেনে আসক্ত আমি)। সে এরপর বলল- করুণা? বলেছিলাম- করি, মাদ্রাসার ছাত্রকে। খুব মায়া হয় এদের জন্য। আমাদেরই সন্তান, অথচ ফ্যাশন বলতে পাঞ্জাবির বোতামটা ভালো হওয়া চাই, সেই পাঞ্জাবিতে পারফিউমের বদলে আতর। কেন এই দুর্দশার মধ্যে ফেলা হয়েছে তাদের? আমরা যারা মাদ্রাসা শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা করি, তারা কি নিজেদের সন্তানকে মাদ্রাসায় পাঠাই? গোলাম আযমের কোন্ ছেলে অথবা মেয়েটি মাদ্রাসায় পড়েছে? এই চালাকি কি আমরা বুঝি না? এটা এক ধরনের ম্যানিপুলেশন, যা শেয়ারবাজার ম্যানিপুলেশনের চেয়েও মারাত্মক। পরিকল্পিতভাবে মানবগোষ্ঠীর একটি নির্দোষ অংশকে পরজীবী, কুয়োর ব্যাঙ, অনুৎপাদনশীল শ্রেণীতে পরিণত করা হচ্ছে না শুধু, সভ্যতাবিরোধী মারণাস্ত্র (মাদ্রাসা ছাত্রদের অনেকেই জঙ্গি হয়ে উঠছে) হিসেবেও তৈরি করা হচ্ছে তাদের। যার পক্ষে অমর্ত্য সেন কিংবা স্টিফেন হকিং হতে পারাটা বিচিত্র কিছু ছিল না, সে কি-না মিলাদ পড়িয়ে নিচ্ছে ১০০ টাকা! জ্ঞানের বিস্তার যে কতটা বিস্তারিত হতে পারে, এরা ভাবতেও পারে না; লাদেনের (বর্তমানে আইএস) ভিডিও বার্তাই তাদের কাছে আলটিমেট নলেজ! অন্যকিছু ভাববে কীভাবে? মাথা ময়লার কারণে আঁটো হয়ে আছে না? কেন এমনটা করছি আমরা? বুদ্ধিমান সন্তানটিকে পাঠাচ্ছি ইংলিশ মিডিয়ামে আর বুদ্ধি প্রতিবন্ধীকে মাদ্রাসায়। প্রতিবন্ধী সন্তানের মাথাটা যাতে খোলে, সেজন্য দরকার ছিল আধুনিক শিক্ষার, অথচ তা না করে সেই মাথা করে তুলছি আরও অকার্যকর। কোনোই মায়া নেই তার জন্য? গ্রামের বালিকাটি বিয়ের পর পরের ঘরে চলে যাবে বলে সে-ও যেতে পারবে না স্কুলে? যাবে মাদ্রাসায়? বড় জমাটবাঁধা মাথার এই ময়লা।
এবার রাজনীতিক। রাজনীতি বোধকরি এমন এক কর্ম যে, যতই তুমি নির্মল করো প্রার্থনা করি না কেন, মলিন মর্ম থেকে পরিত্রাণ নেই। রাজীব গান্ধী মি. ক্লিন উপাধি পেয়েছিলেন। পরে দেখা গেল, তার শার্টের নিচে ছিল বোফর্সের কলংকমাখা মলিন গেঞ্জি। রাজনীতি কেম্ব্রিজ-শিক্ষিত রাজীবকে দূষিত করেছে; ওদিকে দেখুন অক্সফোর্ড-শিক্ষিত ইমরান খান কীভাবে গায়ে ময়লা মেখেছেন। একদা আধুনিক এই গ্ল্যামার বয় এখন আগাপাশতলা অনাধুনিক। তার পরনে কাবুলি পোশাক, হাতে চোঙা, মুখে ধর্মীয় রাজনীতি। আজানুলম্বিত তার ওই কাবুলি পাঞ্জাবি যতই শুভ্র, ফিনফিনে দেখাক, ওটা আসলে ময়লাযুক্ত ত্যানা।
পাঠক হয়তো এতক্ষণে ভাবা শুরু করেছেন, বাংলাদেশের রাজনীতিক থাকতে পাক-ভারত নিয়ে টানাটানি কেন? আসলে এদের নিয়ে কিছু লেখার নেই। কয়লা ধুলে ময়লা যায় না- এই প্রবাদটির অর্থ বুঝি না আমি। পরিষ্কার কোনো কিছুর সঙ্গে লেগে থাকলেই না সেটা ময়লা! কয়লার আবার ময়লা কী!
পুনশ্চঃ এ লেখায় চরিত্রহীন শব্দটি ব্যবহার না করে লিখেছি দুশ্চরিত্র। চরিত্রহীন সহজপ্রবেশ্য শব্দ, তারপরও দুশ্চরিত্র কেন লিখলাম, তার কারণ আছে নিশ্চয়ই।
স্কুল জীবনের শেষ দিকে ধুন্ধুমার শরৎ পড়ছি। চরিত্রহীন উপন্যাসটি হাতে পাওয়ার পর খটকা লাগল। চরিত্র মানে ধর্ম, স্বভাব অথবা বৈশিষ্ট্য। তাই যদি হয়, তাহলে জড় অথবা জীব- চরিত্রহীন বলে আছে নাকি কিছু কোথাও? অভিধান খুললাম, সেখানে চরিত্রহীন-এর অর্থ দেয়া আছে লম্পট। ছুঁড়ে মারলাম অভিধান। প্রথমত, এমন একটি শব্দ থাকবে কেন অভিধানে? থাকলেও তার অর্থ হতে হবে- যার চরিত্র নেই। কে জানে, অবস্তুগত কোনো ধারণা (concept) চরিত্রহীন হয় যদি। কিন্তু সতত ক্রিয়াশীল একটি লিভিং বডি- মানুষ, তার কোনো ধর্ম নেই, স্বভাব নেই, চরিত্র নেই! ভাবলাম, শরৎ বাবু নিশ্চয়ই চরিত্রহীন বলতে দুশ্চরিত্র বুঝিয়েছেন। উপন্যাস শেষ করে দেখলাম, আমার ধারণাই ঠিক।
মাহবুব কামাল : সাংবাদিক
বাংলাদেশের বস্তুজগতের ময়লা তো কহতব্য নয়। রুমাল ছাড়া পথ হাঁটাই মুশকিল। একটা চমৎকার দেয়ালের দিকে তাকাব, দেখব সেখানেও কেউ একজন চুন মেখে রেখেছে। ইউরোপ-আমেরিকায় যাওয়ার দরকার নেই, এশিয়ার সিঙ্গাপুরের রাস্তায়ই এক টুকরো পরিষ্কার কাগজও পাওয়া যাবে না, ঢাকার রাস্তায় ময়লাযুক্ত কাগজগুলো টোকালে সেগুলো দিয়ে এক হাজার হাতির শরীর মোড়ানো সম্ভব। থাকগে, বস্তুজগতের ময়লা নিয়ে পরিবেশবাদীরা ভাবুন, আমরা কথা বলব মনোজগতের আবর্জনা নিয়ে।
প্রকৃতপক্ষে, আমরা সবাই নানা রঙের মনোজাগতিক ময়লার মধ্যেই বাস করছি- কালো, ধূসর, এমনকি রঙিনও। গত শতাব্দীর আশির দশকে কালারড টেলিভিশনের সূচনা হয়েছিল যখন, এক বিদগ্ধ লেখক বলেছিলেন- এবার বিটিভির আবর্জনাগুলো রঙিন হল! কুড়ি বছর আগে, আমি একটি সাপ্তাহিকীতে নিয়মিত কলাম লিখে যাচ্ছিলাম, একদিন কানাডাফেরত এক পাঠক, তসলিম যার নাম, আমাকে একটি চাইনিজ রেস্তোরাঁয় খাওয়াতে খাওয়াতে বলেছিলেন- দেশের ময়লা সাফ করার দায়িত্ব নিয়েছেন? কই দেখি ঝাড়ুটা? ওটা ছুঁড়ে ফেলে দিন, পারবেন না। তাই তো! কীভাবে তা সম্ভব?
চিন্তার ময়লাটা একটু দেখুন। নারীসঙ্গবিলাসী কিংবা নির্বিচার যৌনতায় লিপ্ত যে, সে হচ্ছে দুশ্চরিত্র, দুর্নীতিপরায়ণ নয়! আর আর্থিক কেলেংকারি ঘটিয়ে চলেছে যে, সে দুর্নীতিবাজ; কিন্তু দুশ্চরিত্র নয়। কী বুঝলেন? অর্থাৎ সচ্চরিত্র থেকেও দুর্নীতিবাজ হওয়া যায় এবং দুর্নীতিবাজ হয়েও সচ্চরিত্র থাকা যায়! আরেক ধরনের ময়লার কথা বলি। যারা বেশি বেশি টেলিভিশন দেখেন, তারা বলতে পারবেন আমি ঠিক বলছি, কী বেঠিক। টেলিভিশনের পর্দায় যত ধরনের ময়লা ভেসে বেড়ায়, তার একটি হল শোবিজ তারকাদের নিয়ে টকশো। তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী সবাই তারকা; তবে আলোটা বেরোয় ড্যাজলিং পোশাক থেকে, চিন্তা থেকে নয়। অবশ্য চিন্তা অনেক পরে, কথাটাই কি শুদ্ধ করে বলতে পারে তারা? 'so'-এর পর 'that' বসালে অর্থটা আর সুতরাং থাকে না, যেন অথবা যাতে হয়ে যায়। অথচ নির্বিবাদে তারা বলে যাচ্ছে-so that, আমি এই পেশা বেছে নিয়েছি। skillকে বলছেskillness; কনফিডেন্স না বলে বলছে- এ ব্যাপারে আমার কনফিডেন্ট আছে। একদিন তো থ মেরে গেলাম। বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতায় অন্তত প্রিলিমিনারি সিলেকশনে টিকে যাবে, এমন এক সুন্দরী বলছে- আমাদের village womansiv এখন অনেক ফ্রিডম। একটা মাত্র বাক্য, কত ভুল! woman-এর বহুবচন women। 's' যোগ করে না হয় প্লুরাল করল; সেক্ষেত্রে iv কেন? একসঙ্গে দুটো প্লুরাল! village-এর জায়গায় যে rural হবে- এই ভুল মাফ করে দেয়া ছাড়া উপায় কী! শেষ হল না। আরে মেয়ে, freedom মানে স্বাধীনতা, স্বাধীন নয়। পরিষ্কার কাপড় পরে এভাবে ময়লাযুক্ত কথা বললে কী আর সুন্দর থাকা যায়! ওই মেয়েটিকে বলতে পারলাম না, স্মার্ট হতে হলে ইংরেজি বলার কিংবা ফ্যাশনদুরস্ত হওয়ার দরকার নেই, মাতৃভাষায় শুদ্ধভাবে কোনো বিষয়ে মতামত দিতে পারলেই স্মার্ট হওয়া যায়। তরুণ-তরুণীরা কথা বলে আর অনবরত হাসে, ভাবে সমগ্র জাতিই বুঝি তাদের কথায় হাসছে। যা নিয়ে হাসে তারা, সেখানে হিউমার তো নেই-ই, বুদ্ধিমত্তাও নেই। তবু হাসে। মাথার ময়লা চাপ দেয়, তারা কী করবে?
রাজনীতির টকশোগুলোর উপযোগিতা কী, বুঝি না। এসব তো চায়ের স্টলেই আলোচিত হয়। ব্যতিক্রম ব্যতিক্রমই, ইংরেজিতে বললে exception justifies the rule- ব্যতিক্রম নিয়মটিকে আরও যুক্তিগ্রাহ্য করে তোলে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অ্যাংকর কি খেয়াল করেন, একসময় তার সামনে আবর্জনার স্তূপ জমা হয়ে যায়? অশুদ্ধের ছড়াছড়ি- অশুদ্ধ শব্দ, অশুদ্ধ বাক্য, অশুদ্ধ যুক্তি, অশুদ্ধ চিন্তা। জার্মানিতে একসময় বিভিন্ন মতবাদের মধ্যে পলেমিক্স হতো। এই পলেমিক্স দর্শনশাস্ত্রকে সমৃদ্ধ করেছে, সভ্যতাকে দিয়েছে প্রচুর। এ দেশের রাজনীতি-বিশ্লেষকরা তাদের মতো পলেমিক্স দূরের কথা, রিমিক্স করতেও জানে না। তারপরও টকশোগুলো জনপ্রিয়! ময়লা তো শুধু টকারদের মাথায়ই নেই, লিসেনারদের মাথায়ও আছে।
আমার মেয়েটি খুব cultured অথবা আমার বাবা খুব ব্যক্তিত্ববান- এ দুটি বাক্য শোনার পর খোঁজ নিলে দেখা যাবে, মেয়েটি শুধু হারমোনিয়াম বাজাতে জানে আর সেই বাবা কম কথা বলেন, গম্ভীর। হারমোনিয়াম ও গাম্ভীর্য যে যথাক্রমে সংস্কৃতি ও ব্যক্তিত্বের খুব নগণ্য কম্পোনেন্ট, এটা কথকদ্বয়কে বোঝাবে কে? কথা ও আচরণের শিল্প এবং জীবনসংগ্রামের গড় প্রকাশই হচ্ছে একজনের সংস্কৃতি। আর ব্যক্তিত্ববান? এমন কথা বলেন না, মানুষে কয় ঝুট; এমন জায়গায় বসেন না, কেউ কয় উঠ্। এবং আরও, তিনি ভালো ও মন্দের প্রভেদ করে ভালোর পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে থাকেন।
চিন্তার ময়লা কোথায় নেই? একদিন আড্ডায় এক অনুজপ্রতিম জিজ্ঞেস করেছিল- আপনি ঈর্ষা করেন কাকে? বললাম- নেইল আর্মস্ট্রং ও কার্লো পন্টিকে (তখন সোফিয়া লরেনে আসক্ত আমি)। সে এরপর বলল- করুণা? বলেছিলাম- করি, মাদ্রাসার ছাত্রকে। খুব মায়া হয় এদের জন্য। আমাদেরই সন্তান, অথচ ফ্যাশন বলতে পাঞ্জাবির বোতামটা ভালো হওয়া চাই, সেই পাঞ্জাবিতে পারফিউমের বদলে আতর। কেন এই দুর্দশার মধ্যে ফেলা হয়েছে তাদের? আমরা যারা মাদ্রাসা শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা করি, তারা কি নিজেদের সন্তানকে মাদ্রাসায় পাঠাই? গোলাম আযমের কোন্ ছেলে অথবা মেয়েটি মাদ্রাসায় পড়েছে? এই চালাকি কি আমরা বুঝি না? এটা এক ধরনের ম্যানিপুলেশন, যা শেয়ারবাজার ম্যানিপুলেশনের চেয়েও মারাত্মক। পরিকল্পিতভাবে মানবগোষ্ঠীর একটি নির্দোষ অংশকে পরজীবী, কুয়োর ব্যাঙ, অনুৎপাদনশীল শ্রেণীতে পরিণত করা হচ্ছে না শুধু, সভ্যতাবিরোধী মারণাস্ত্র (মাদ্রাসা ছাত্রদের অনেকেই জঙ্গি হয়ে উঠছে) হিসেবেও তৈরি করা হচ্ছে তাদের। যার পক্ষে অমর্ত্য সেন কিংবা স্টিফেন হকিং হতে পারাটা বিচিত্র কিছু ছিল না, সে কি-না মিলাদ পড়িয়ে নিচ্ছে ১০০ টাকা! জ্ঞানের বিস্তার যে কতটা বিস্তারিত হতে পারে, এরা ভাবতেও পারে না; লাদেনের (বর্তমানে আইএস) ভিডিও বার্তাই তাদের কাছে আলটিমেট নলেজ! অন্যকিছু ভাববে কীভাবে? মাথা ময়লার কারণে আঁটো হয়ে আছে না? কেন এমনটা করছি আমরা? বুদ্ধিমান সন্তানটিকে পাঠাচ্ছি ইংলিশ মিডিয়ামে আর বুদ্ধি প্রতিবন্ধীকে মাদ্রাসায়। প্রতিবন্ধী সন্তানের মাথাটা যাতে খোলে, সেজন্য দরকার ছিল আধুনিক শিক্ষার, অথচ তা না করে সেই মাথা করে তুলছি আরও অকার্যকর। কোনোই মায়া নেই তার জন্য? গ্রামের বালিকাটি বিয়ের পর পরের ঘরে চলে যাবে বলে সে-ও যেতে পারবে না স্কুলে? যাবে মাদ্রাসায়? বড় জমাটবাঁধা মাথার এই ময়লা।
এবার রাজনীতিক। রাজনীতি বোধকরি এমন এক কর্ম যে, যতই তুমি নির্মল করো প্রার্থনা করি না কেন, মলিন মর্ম থেকে পরিত্রাণ নেই। রাজীব গান্ধী মি. ক্লিন উপাধি পেয়েছিলেন। পরে দেখা গেল, তার শার্টের নিচে ছিল বোফর্সের কলংকমাখা মলিন গেঞ্জি। রাজনীতি কেম্ব্রিজ-শিক্ষিত রাজীবকে দূষিত করেছে; ওদিকে দেখুন অক্সফোর্ড-শিক্ষিত ইমরান খান কীভাবে গায়ে ময়লা মেখেছেন। একদা আধুনিক এই গ্ল্যামার বয় এখন আগাপাশতলা অনাধুনিক। তার পরনে কাবুলি পোশাক, হাতে চোঙা, মুখে ধর্মীয় রাজনীতি। আজানুলম্বিত তার ওই কাবুলি পাঞ্জাবি যতই শুভ্র, ফিনফিনে দেখাক, ওটা আসলে ময়লাযুক্ত ত্যানা।
পাঠক হয়তো এতক্ষণে ভাবা শুরু করেছেন, বাংলাদেশের রাজনীতিক থাকতে পাক-ভারত নিয়ে টানাটানি কেন? আসলে এদের নিয়ে কিছু লেখার নেই। কয়লা ধুলে ময়লা যায় না- এই প্রবাদটির অর্থ বুঝি না আমি। পরিষ্কার কোনো কিছুর সঙ্গে লেগে থাকলেই না সেটা ময়লা! কয়লার আবার ময়লা কী!
পুনশ্চঃ এ লেখায় চরিত্রহীন শব্দটি ব্যবহার না করে লিখেছি দুশ্চরিত্র। চরিত্রহীন সহজপ্রবেশ্য শব্দ, তারপরও দুশ্চরিত্র কেন লিখলাম, তার কারণ আছে নিশ্চয়ই।
স্কুল জীবনের শেষ দিকে ধুন্ধুমার শরৎ পড়ছি। চরিত্রহীন উপন্যাসটি হাতে পাওয়ার পর খটকা লাগল। চরিত্র মানে ধর্ম, স্বভাব অথবা বৈশিষ্ট্য। তাই যদি হয়, তাহলে জড় অথবা জীব- চরিত্রহীন বলে আছে নাকি কিছু কোথাও? অভিধান খুললাম, সেখানে চরিত্রহীন-এর অর্থ দেয়া আছে লম্পট। ছুঁড়ে মারলাম অভিধান। প্রথমত, এমন একটি শব্দ থাকবে কেন অভিধানে? থাকলেও তার অর্থ হতে হবে- যার চরিত্র নেই। কে জানে, অবস্তুগত কোনো ধারণা (concept) চরিত্রহীন হয় যদি। কিন্তু সতত ক্রিয়াশীল একটি লিভিং বডি- মানুষ, তার কোনো ধর্ম নেই, স্বভাব নেই, চরিত্র নেই! ভাবলাম, শরৎ বাবু নিশ্চয়ই চরিত্রহীন বলতে দুশ্চরিত্র বুঝিয়েছেন। উপন্যাস শেষ করে দেখলাম, আমার ধারণাই ঠিক।
মাহবুব কামাল : সাংবাদিক
No comments