অ্যাপেক সম্মেলনে কৌশলগত বিষয়ের প্রাধান্য by কেভিন রাড
বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত এশিয়া-প্যাসিফিক কো-অপারেশন (অ্যাপেক) শীর্ষ সম্মেলনে এর আলোচ্যসূচি যতটা না গুরুত্ব পেয়েছে, তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব প্রকাশ পেয়েছে সম্মেলন চলাকালে সাইডলাইনের আলোচনা। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিংপিং ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার মধ্যে বৈঠক এবং জাপানি প্রধানমন্ত্রী শিনজো অ্যাবের সঙ্গে শি জিংপিংয়ের বৈঠক বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে। এ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কগুলো অনেকাংশে নির্ভর করছে পূর্ব এশিয়ার কৌশলগত অন্তঃস্রোতের ওপর- যখন এ অঞ্চলের দীর্ঘদিনের ভূকৌশলগত স্থিতিশীলতা প্রশ্নের সম্মুখীন।
মূল বাস্তবতাটি হল, একবিংশ শতাব্দীর দ্রুত বিশ্বায়নে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের যেসব অর্থনৈতিক শক্তি ভূমিকা রাখছে, তাদের মোকাবেলা করতে হচ্ছে বেশকিছু দেশের উনবিংশ শতাব্দীর জাতীয় উত্তেজনা। এই পরস্পর বিরোধিতার প্রভাব পড়ছে গোটা বিশ্বের ওপরই, কারণ বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় ৬০ শতাংশ ধারণ করে এ অঞ্চলটি। অর্থনীতির ভাষায় বলতে হয়, ভবিষ্যতে এশিয়া যেদিকে যাবে, পৃথিবী সেদিকে তাকে অনুসরণ করবে।
তবে এশিয়া হল অসংখ্য অমীমাংসিত ভূখণ্ডগত বিরোধের স্থান। এটি চীনের উত্থান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর এর প্রভাব থেকে সৃষ্ট উত্তেজনার মূলকেন্দ্র- যে দেশটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এ অঞ্চলের প্রতিষ্ঠিত শক্তি। বস্তুত এ অঞ্চলের অনেক ভূখণ্ডগত বিরোধ যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের চীনের প্রতিদ্বন্দ্বী করে তুলেছে। আরও বড় করে বললে, এ অঞ্চলের সমস্যাগুলো রোগতুল্য। যেমন- বিভক্ত কোরিয়া উপত্যকা; রাশিয়া ও জাপান, চীন ও কোরিয়া এবং চীন ও জাপানের মধ্যে ভূখণ্ডগত বিরোধ; তাইওয়ানের কিম্ভূত পরিস্থিতি এবং দক্ষিণ চীন সাগরের দাবি নিয়ে চীন, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, ব্র“নেই, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম ও তাইওয়ানের মধ্যে বিরোধপূর্ণ অবস্থা। এছাড়া চীনের সঙ্গে ভারতের এবং চীনের মিত্র পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের রয়েছে দীর্ঘদিনের সীমান্ত বিরোধ।
শুধু এগুলোই উদ্বেগের কারণ নয়। এশিয়া পরিণত হতে যাচ্ছে আগামী দিনের বিশ্ব অস্ত্রবাজারে। এ অঞ্চলের সামরিক ব্যয় বর্তমানে ইউরোপের চেয়ে বেশি। অধিকন্তু, এশিয়ার ছয়টি দেশ পারমাণবিক অস্ত্রধারী।
চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের সুর ও আধেয় উভয়ই উদ্বেগের একটি কারণ। চীনের যুক্তি হল, এটি যুক্তরাষ্ট্রের স্বাতন্ত্র্যবাদী (আইসলেশন) ও বাধাদানের নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এর মাধ্যমে ইঙ্গিত করা হয়েছে আমেরিকার ‘ভারসাম্যহীন’ কৌশল, সেই সব দেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক এবং/অথবা কূটনৈতিক সমর্থনকে, যাদের সঙ্গে চীনের দ্বিপক্ষীয় ভূখণ্ডগত বিরোধ রয়েছে; এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানের সংশোধনের জন্য দেশটির প্রতি মার্কিন সমর্থনকে।
যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাবিত ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপে বাধা প্রদানের বাণিজ্যিক দিকটিও চীনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে জাপানকে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও চীনকে বাইরে রাখা হয়েছে। অধিকন্তু চীনা নেতারা তাদের দেশের অভ্যন্তরে (হংকংসহ) রাজনৈতিক বিক্ষোভে ইন্ধন দেয়ার উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার কূটনীতিকে অনধিকার চর্চা বলে গণ্য করে। এসব কারণে দু’দেশের মধ্যে কৌশলগত আস্থার অভাব বাড়ছে।
চীন-জাপান সম্পর্কের চিত্রটি দৃশ্যত কিছুটা ভালো। মাত্র কয়েক মাস আগেই দিয়াইউ/সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জের মালিকানা নিয়ে বিরোধের কারণে দু’দেশের সম্পর্ক যুদ্ধোত্তর সময়ে সর্বনিু পর্যায়ে পৌঁছেছিল। কিন্তু এখন উভয় সরকার বিতর্কিত ভূখণ্ডের চারপাশে সাগরে ও আকাশে অনভিপ্রেত যুদ্ধের ক্রমবর্ধমান ঝুঁকির বিষয়টি স্বীকার করে নিয়ে উত্তেজনা প্রশমনের পদক্ষেপ নিয়েছে। উভয় পক্ষই উপলব্ধি করতে পারছে যে, সীমিত আকারে যুদ্ধ শুরু হলেও পরে তা ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
অধিকন্তু ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মুখোমুখি জাপান ও চীন এটিও স্বীকার করছে যে, বিশ্বের দ্বিতীয় ও তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে তাদের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াতে হলে এক্ষেত্রে বিদ্যমান বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতাগুলো অপসারণ করা প্রয়োজন। এ কারণে শেষ মুহূর্তের কূটনৈতিক অশিষ্টতাগুলো বাদ দিলে অ্যাপেক সম্মেলন চীন-জাপান সম্পর্ক ঘনিষ্ঠততর করার আনুষ্ঠানিক সূচনা করেছে বলা যায়।
এক অস্ট্রেলীয় কূটনৈতিক উদ্যোগে ২৫ বছর আগে অ্যাপেকের যাত্রা শুরু হয়েছিল। মূলত একে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক ফোরাম হিসেবে গড়ে তোলাই ছিল লক্ষ্য। সৌভাগ্যবশত, এটি দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত স্থিতিশীলতা সংক্রান্ত নানা জটিল বিষয়ে আলোচনার জন্য মার্কিন, চীনা, জাপানি ও অন্যান্য নেতার একটি বার্ষিক ফোরামেও পরিণত হয়েছে। এ অঞ্চলের অর্থনীতি ও বিশ্ব অর্থনীতির ভবিষ্যৎ- এবং যার ওপর স্থিতিশীলতা নির্ভরশীল- এসব আলোচনা, তর্ক-বিতর্কের ফলাফল দ্বারা নির্ধারিত হবে।
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট ২০১৪
কেভিন রাড : অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির বেলফার সেন্টারের সিনিয়র ফেলো
মূল বাস্তবতাটি হল, একবিংশ শতাব্দীর দ্রুত বিশ্বায়নে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের যেসব অর্থনৈতিক শক্তি ভূমিকা রাখছে, তাদের মোকাবেলা করতে হচ্ছে বেশকিছু দেশের উনবিংশ শতাব্দীর জাতীয় উত্তেজনা। এই পরস্পর বিরোধিতার প্রভাব পড়ছে গোটা বিশ্বের ওপরই, কারণ বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় ৬০ শতাংশ ধারণ করে এ অঞ্চলটি। অর্থনীতির ভাষায় বলতে হয়, ভবিষ্যতে এশিয়া যেদিকে যাবে, পৃথিবী সেদিকে তাকে অনুসরণ করবে।
তবে এশিয়া হল অসংখ্য অমীমাংসিত ভূখণ্ডগত বিরোধের স্থান। এটি চীনের উত্থান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর এর প্রভাব থেকে সৃষ্ট উত্তেজনার মূলকেন্দ্র- যে দেশটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এ অঞ্চলের প্রতিষ্ঠিত শক্তি। বস্তুত এ অঞ্চলের অনেক ভূখণ্ডগত বিরোধ যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের চীনের প্রতিদ্বন্দ্বী করে তুলেছে। আরও বড় করে বললে, এ অঞ্চলের সমস্যাগুলো রোগতুল্য। যেমন- বিভক্ত কোরিয়া উপত্যকা; রাশিয়া ও জাপান, চীন ও কোরিয়া এবং চীন ও জাপানের মধ্যে ভূখণ্ডগত বিরোধ; তাইওয়ানের কিম্ভূত পরিস্থিতি এবং দক্ষিণ চীন সাগরের দাবি নিয়ে চীন, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, ব্র“নেই, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম ও তাইওয়ানের মধ্যে বিরোধপূর্ণ অবস্থা। এছাড়া চীনের সঙ্গে ভারতের এবং চীনের মিত্র পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের রয়েছে দীর্ঘদিনের সীমান্ত বিরোধ।
শুধু এগুলোই উদ্বেগের কারণ নয়। এশিয়া পরিণত হতে যাচ্ছে আগামী দিনের বিশ্ব অস্ত্রবাজারে। এ অঞ্চলের সামরিক ব্যয় বর্তমানে ইউরোপের চেয়ে বেশি। অধিকন্তু, এশিয়ার ছয়টি দেশ পারমাণবিক অস্ত্রধারী।
চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের সুর ও আধেয় উভয়ই উদ্বেগের একটি কারণ। চীনের যুক্তি হল, এটি যুক্তরাষ্ট্রের স্বাতন্ত্র্যবাদী (আইসলেশন) ও বাধাদানের নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এর মাধ্যমে ইঙ্গিত করা হয়েছে আমেরিকার ‘ভারসাম্যহীন’ কৌশল, সেই সব দেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক এবং/অথবা কূটনৈতিক সমর্থনকে, যাদের সঙ্গে চীনের দ্বিপক্ষীয় ভূখণ্ডগত বিরোধ রয়েছে; এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানের সংশোধনের জন্য দেশটির প্রতি মার্কিন সমর্থনকে।
যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাবিত ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপে বাধা প্রদানের বাণিজ্যিক দিকটিও চীনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে জাপানকে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও চীনকে বাইরে রাখা হয়েছে। অধিকন্তু চীনা নেতারা তাদের দেশের অভ্যন্তরে (হংকংসহ) রাজনৈতিক বিক্ষোভে ইন্ধন দেয়ার উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার কূটনীতিকে অনধিকার চর্চা বলে গণ্য করে। এসব কারণে দু’দেশের মধ্যে কৌশলগত আস্থার অভাব বাড়ছে।
চীন-জাপান সম্পর্কের চিত্রটি দৃশ্যত কিছুটা ভালো। মাত্র কয়েক মাস আগেই দিয়াইউ/সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জের মালিকানা নিয়ে বিরোধের কারণে দু’দেশের সম্পর্ক যুদ্ধোত্তর সময়ে সর্বনিু পর্যায়ে পৌঁছেছিল। কিন্তু এখন উভয় সরকার বিতর্কিত ভূখণ্ডের চারপাশে সাগরে ও আকাশে অনভিপ্রেত যুদ্ধের ক্রমবর্ধমান ঝুঁকির বিষয়টি স্বীকার করে নিয়ে উত্তেজনা প্রশমনের পদক্ষেপ নিয়েছে। উভয় পক্ষই উপলব্ধি করতে পারছে যে, সীমিত আকারে যুদ্ধ শুরু হলেও পরে তা ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
অধিকন্তু ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মুখোমুখি জাপান ও চীন এটিও স্বীকার করছে যে, বিশ্বের দ্বিতীয় ও তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে তাদের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াতে হলে এক্ষেত্রে বিদ্যমান বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতাগুলো অপসারণ করা প্রয়োজন। এ কারণে শেষ মুহূর্তের কূটনৈতিক অশিষ্টতাগুলো বাদ দিলে অ্যাপেক সম্মেলন চীন-জাপান সম্পর্ক ঘনিষ্ঠততর করার আনুষ্ঠানিক সূচনা করেছে বলা যায়।
এক অস্ট্রেলীয় কূটনৈতিক উদ্যোগে ২৫ বছর আগে অ্যাপেকের যাত্রা শুরু হয়েছিল। মূলত একে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক ফোরাম হিসেবে গড়ে তোলাই ছিল লক্ষ্য। সৌভাগ্যবশত, এটি দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত স্থিতিশীলতা সংক্রান্ত নানা জটিল বিষয়ে আলোচনার জন্য মার্কিন, চীনা, জাপানি ও অন্যান্য নেতার একটি বার্ষিক ফোরামেও পরিণত হয়েছে। এ অঞ্চলের অর্থনীতি ও বিশ্ব অর্থনীতির ভবিষ্যৎ- এবং যার ওপর স্থিতিশীলতা নির্ভরশীল- এসব আলোচনা, তর্ক-বিতর্কের ফলাফল দ্বারা নির্ধারিত হবে।
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট ২০১৪
কেভিন রাড : অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির বেলফার সেন্টারের সিনিয়র ফেলো
No comments