কেমন গণতন্ত্র, কোথায় গণতন্ত্র? by ড. মাহবুব উল্লাহ্
প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ৮ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে একটি জনসভা করতে চেয়েছিল। এই জনসভায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ভাষণ দেয়ার কথা ছিল। জনসভা করার জন্য অনুমতি চেয়ে দলটি ৭-৮ দিন আগেই যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছিল। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, কখনও অনুমতি পাওয়া গেছে আবার কখনও অনুমতি পাওয়া যায়নি। অনুমতি পাওয়া গেলেও তা জানানো হয় ২৪ ঘণ্টা আগে বা তার চেয়েও কম সময়ে। জনসভা করা যাবে কী যাবে না এ রকম একটি দোলাচলে থাকতে হয় দলটিকে। ফলে জনসভার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেয়া সম্ভব হয় না। এসব কৌশল প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেয়া হয় জনসভাটি যেন ব্যাপক জনসমাগমে সফল না হয়ে ওঠে। আমাদের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, যদি কোনো দলের জনসভাগুলোয় একের পর এক বিপুল জনসমাগম ঘটতে থাকে তাহলে জনমনস্তত্ত্বেও এর একটি প্রভাব পড়ে। মানুষ তখন ভাবতে শুরু করে, যে কর্মসূচি বা যে লক্ষ্য নিয়ে দলটি সমাবেশ করছে এর প্রতি দেশের জনগোষ্ঠীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশের সমর্থন রয়েছে। এটি ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর জন্য স্বস্তিদায়ক নয়। তারা ভাবতে থাকে তাদের প্রতি জনগণের আস্থা নষ্ট হয়ে গেছে এবং জনগণ তাদের আনুগত্য পরিবর্তন করছে, আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে ক্ষমতাসীনরা ভাবতে চায় না জনগণ তাদের প্রতি আস্থা হারাচ্ছে। আস্থা হারানোর দৃশ্যটি যখন প্রকট হয়ে ওঠে তখন শাসক দল মনে করে পরবর্তী নির্বাচনে তাদের ভরাডুবি হবে কিংবা একটি গণঅভ্যুত্থানের পরিবেশ সৃষ্টি হবে। যার ফলে তাদের ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হতে পারে। কিন্তু এই মানসিকতা কোনোক্রমেই গণতান্ত্রিক বলে বিবেচিত হতে পারে না। এই মানসিকতার অন্তরালে থাকে অনন্তকাল ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার দুরভিসন্ধি।
রাজধানী ঢাকায় জনসভা করার মাঠ নেই বললেই চলে। একসময় পল্টন ময়দানে জনসভা হতো। কিন্তু সেই ময়দানও আজ জনসভার জন্য অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। বিশাল উন্মুক্ত পল্টন ময়দানে মার্কেট ও স্টেডিয়াম নির্মিত হয়েছে। ফলে পল্টন ময়দান সংকুচিত হয়ে পড়েছে এবং জনসভা অনুষ্ঠানের জন্য হয়ে গেছে অনুপযোগী। কিছুদিন মানিক মিয়া এভিনিউতে জনসভা হতো। মানিক মিয়া এভিনিউ বিশাল চওড়া রাজপথ। এমন একটি জায়গায় কোনো দলের পক্ষেই এক-চতুর্থাংশ লোক সমাগম করে ভরাট করা সম্ভব ছিল না। ১৯৯৬, ২০০১-এ যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল তখন মানিক মিয়া এভিনিউয়ের মাঝখানে চওড়া আইল্যান্ড নির্মাণ করে খেজুর গাছ লাগিয়ে দেয়া হয়েছিল, যাতে এই জায়গাটিও জনসভার জন্য অনাকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। আইল্যান্ড নির্মাণের পর সেখানে আর কোনো জনসভা করতে দেয়া হয়নি। বাকি রইল সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। গত কিছুদিন ধরে এখানে বড় দলগুলো জনসভা করছে। এই মাঠটির নাম পাকিস্তান আমলে ছিল রেসকোর্স মাঠ। এই মাঠে গলফ খেলা হতো, হতো ঘোড়দৌড়। তখন এটি উদ্যান ছিল না। ফলে বিশাল জনসভা করার জন্য এই মাঠটি ছিল আদর্শস্থানীয়। এই মাঠেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি লাভের পর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৬৯ সালে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিল। এই সংবর্ধনা-সভায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে আমিও বক্তব্য রেখেছিলাম। এই মাঠেই ১৯৪৮ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে তার বিতর্কিত বক্তব্যের জন্য প্রথম প্রতিবাদের সম্মুখীন হন। এই মাঠে মওলানা ভাসানীও বেশ কিছু জনসভা করেছেন। জনসমাগম প্রচুর হবে মনে করলেই রাজনৈতিক দলগুলো জনসভার জন্য এই মাঠটি বেছে নিত। এখন আর এটি মাঠ নয়। এটি একটি উদ্যান। উদ্যান হলেও কিছু কিছু স্থাপনা নির্মাণের ফলে এর পরিসর সংকুচিত হয়ে গেছে। এছাড়া বৃক্ষরাজির আড়ালে কত জনসমাগম হল সেটাও পাশের রাস্তাগুলো থেকে খুব একটা দৃশ্যমান হয় না। অর্থাৎ গণতন্ত্রে যেখানে জনতার উপস্থিতিই মুখ্য, সেখানে জনতাকে আড়াল করারই অভিনব কৌশল এটা। এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এখানেই জনসভা করেন। বোঝা যায় না লোক বেশি হল না কম।
বিএনপির প্রার্থিত জনসভাটির দিন চারেক আগেই জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ জনসভা করেছে। এই সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপির তীব্র সমালোচনা করেছেন। ৮ নভেম্বর বিএনপি যদি জনসভাটি করতে পারত, তাহলে বিএনপি চেয়ারপারসন প্রধানমন্ত্রীর অনেক সমালোচনারই জবাব দিতে পারতেন। এর ফলে গণতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য ইভেন প্লেইং ফিল্ডের নীতিটি প্রতিষ্ঠিত হতে পারত। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের নামে যে চর্চা চলছে তা মোটেও ইভেন বা সমতল নয়। যারা ক্ষমতায় থাকেন তারা সব অধিকার ভোগ করবেন আর বিরোধীপক্ষীয়রা সে অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। এর ফলে দেশে জবাবদিহিতা থাকে না, থাকে না সুশাসন। গণতন্ত্র হয়ে পড়ে স্বৈরতন্ত্র। আওয়ামী লীগ নেতারা অহোরাত্র বলে চলেছেন, বিএনপি নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে, বিএনপির আন্দোলন করার হিম্মত নেই, জনগণ বিএনপি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। বিএনপি যদি এতই অথর্ব ও অসমর্থ একটি দল হয়, তাহলে দলটিকে নিয়ে এত দুর্ভাবনা কেন? কেন তাদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশও করতে দেয়া হয় না? লক্ষ্য করা গেছে বিএনপি আয়োজিত মানববন্ধন পুলিশি হস্তক্ষেপে পণ্ড হয়ে গেছে। এভাবে পুলিশের ওপর নির্ভর করে চণ্ডনীতি চালানো সরকারের সবলতা নয়, দুর্বলতারই বহিঃপ্রকাশ। বর্তমান সময়ে এই দুর্বলতার প্রধান উৎস হল ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচন বা প্রায় ভোটারশূন্য নির্বাচন। এ রকম নির্বাচনে নিয়ম রক্ষা হয় বটে; কিন্তু নীতি-নৈতিকতার বিচারে বৈধতা হয় না। সেজন্যই ইদানীংকালে আমরা সরকারি দলের নেতাদের মুখ থেকে শুনতে পাচ্ছি, গণতন্ত্র নয়, উন্নয়নই প্রধান বিবেচ্য বিষয়। গণতন্ত্রকে উন্নয়নের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানোর প্রয়াস অনেক দেশের স্বৈরাচারী শাসকদের পক্ষ থেকে লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু বাস্তবতা হল, উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের মধ্যে কোনো বৈরিতা নেই। গণতন্ত্র যদি যথার্থভাবে প্রতিপালিত হয় তাহলে উন্নয়নও বেগবান হয়। তাই তাত্ত্বিকরা বলেন, রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে সত্যিকার প্রতিযোগিতার কোনো বিকল্প নেই। রাজনীতিতে যদি প্রতিযোগিতা নিশ্চিত হয়, তাহলে অর্থনীতিতেও প্রতিযোগিতা নিশ্চিত হবে। প্রতিযোগিতা নিঃসন্দেহে একচেটিয়াত্ববাদের চেয়েও অধিকতর দক্ষ ও উৎপাদনশীল। তাই তাত্ত্বিকরা দুই ধরনের বাজারের কথা বলেছেন, এর একটি হল রাজনীতির বাজার এবং অন্যটি হল অর্থনীতির বাজার। রাজনীতির বাজারে অর্থ ও পেশিশক্তি কেন্দ্রীভূত না থাকলে এবং নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে দলীয় বাহিনীতে রূপান্তরিত না করা হলে রাজনীতির বাজারে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত হয়। রাজনীতির বাজারে একচেটিয়া প্রভাব বিস্তারের উদ্দেশে রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করে, নীতি-কৌশলকে দুমড়ে-মুচড়ে ক্ষমতা ও অর্থবিত্ত কিছু লোকের মধ্যে কুক্ষিগত করা হয়। এর ফলে জন্ম নেয় একটি অলিগার্কি বা মুষ্টিমেয়তন্ত্র। এসব সম্ভব হয় যদি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সঠিকভাবে কাজ করতে না পারে। এই পরিস্থিতিতে পার্লামেন্ট, নির্বাচন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ক্ষমতাসীন সরকারের তল্পিবাহকে পরিণত হয়। রাজনীতিতে তখন গণতন্ত্র চর্চাও অসম্ভব হয়ে ওঠে। নানা রকম বিধি-নিষেধের বেড়াজালে গণতন্ত্র শৃংখলিত হয়। মত প্রকাশের স্বাধীনতা, কথা বলার স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, তথ্য প্রবাহের স্বাধীনতা সবকিছুই বিঘ্নিত হয়। জনগণ তখন অধিকার বঞ্চিত হয়ে এক ধরনের ক্রীতদাসে পরিণত হয়। এ রকম পরিস্থিতিতে একটি দেশে নেমে আসতে পারে শতবর্ষের নিস্তব্ধতা। তখন মনে হয় সবকিছুই ঠিকঠাক চলছে, দেশ স্থিতিশীল রয়েছে এবং সর্বোচ্চ ক্ষমতাধারী ব্যক্তি হয়ে
ওঠেন প্রায় ঈশ্বর বা ঈশ্বরের প্রতিমূর্তি। এ রকম
একটি পরিস্থিতিকেই কবি-সাহিত্যিকরা কবরের শান্তির সঙ্গে তুলনা করেছেন।
গত প্রায় ছয় বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, শাসক দল রাজধানী ঢাকার ব্যাপারে প্রচণ্ড সংবেদনশীল। রাজধানী ঢাকায় বিরোধী দল সংগঠিত হোক, সভা-সমাবেশের মাধ্যমে জনমনে প্রভাব ফেলুক এটা কোনো ক্রমেই এদের কাম্য নয়। তাই দেখা গেছে সরকার পক্ষ ঢাকায় বিরোধী দলের বিশেষ করে বিএনপির কর্মতৎপরতাকে যথাসাধ্য বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করে। এই প্রয়াসে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী সরকারের প্রধান সহায়। বিশেষ একটি জেলার পুলিশদের ঢাকায় এনে জড়ো করা হয়েছে বলে নগরিকদের মনে সন্দেহ রয়েছে। সম্প্রতি মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান পুলিশের একটি বাড়াবাড়ির প্রতি নিন্দা জানাতে গিয়ে এ রকমই একটি ইঙ্গিত দিয়েছেন। এর জন্য ডিএমপির পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জ্ঞাপন করা হয়েছে।
মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যানের উক্তির প্রতিবাদ ডিএমপির পক্ষ থেকে না এসে সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিংবা তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে আসা সঙ্গত ছিল কিনা সে ব্যাপারেও প্রশ্ন উঠেছে। আমরা যতদূর জানি মানবাধিকার কমিশন একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়াই সঙ্গত। কিন্তু এ ব্যাপারেও অনীহা লক্ষ করা যাচ্ছে। ড. মিজান সব সময় সরকারের সমালোচনা করেন এমন নয়। তিনি বহু ব্যাপারে সরকারের উচ্ছ্বসিত প্রশংসাও করেন। এছাড়াও তিনি বংশগতভাবে আওয়ামী নীতি-আদর্শেরও একজন দৃঢ় সমর্থক। সেটা তার ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার। অনেক সময় দেখা যায় বিবেকবান মানুষরা কোনো নীতি-আদর্শের কড়া সমর্থক হয়েও কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিবেকের দংশন অনুভব করেন। সম্ভবত বিবেকের দংশন থেকেই তিনি এ রকম একটি মন্তব্য করেছেন। তার সেই বিবেকের স্বাধীনতা থাকা বাঞ্ছনীয়। এই স্বাধীনতার চর্চা করতে দিলে সরকারেরই মঙ্গল হয়। কারণ বিবেকপ্রসূত এবং বিদ্বেষহীন কোনো উক্তি সরকারের জন্য বিশেষ করে গণতন্ত্রের দাবিদার একটি সরকারের জন্য ক্ষতিকারক বিবেচিত হতে পারে না। বরং ফলে সরকার তার ত্র“টি-বিচ্যুতি এবং ভুল-ভ্রান্তি শুধরে নিয়ে নৈতিক শক্তিতে বলীয়ান হতে পারে।
৮ নভেম্বরের জনসভার অনুমতি না দেয়ায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, গণতন্ত্র এখন পুলিশের বুটের তলায়। রাষ্ট্র যেন পুলিশি রাষ্ট্র হয়ে উঠেছে। জনসভার অনুমতি না দেয়ায় প্রতিবাদ জ্ঞাপনার্থে বিএনপি বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দিয়েছে। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এ কর্মসূচিকে অভিনন্দিত করেছেন এই বলে যে, বিএনপি হরতালের ডাক দেয়নি। গণতন্ত্র পুলিশের বুটের তলায় না অন্য কারোর অঞ্চলাবদ্ধ, সেটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। এদিকে আওয়ামী লীগের আরেক নেতা মাহবুবউল আলম হানিফ মির্জা ফখরুলকে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা পাঠ করার
পরামর্শ দিয়েছেন। এ দুজনের মধ্যে কে অধিকতর জ্ঞানী তা আমাদের জানা নেই। তবে এটুকু বুঝতে পারি গণতন্ত্রের সংজ্ঞা এদের দুজনেরই জানা থাকার কথা। সমস্যাটা
দাঁড়ায় এর অনুশীলনে। এখন যখন লিখছি তখন ভাবছি বিএনপির বিক্ষোভ কর্মসূচি নিরুপদ্রব পালিত হয় কিনা। সে ব্যাপারেও মনে মনে শংকাবোধ করছি। তারপরও চাইব, ওবায়দুল কাদেরের অভিনন্দনের ওপর যাতে কোনো কালো ছায়া না পড়ে।
ড. মাহবুব উল্লাহ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক
রাজধানী ঢাকায় জনসভা করার মাঠ নেই বললেই চলে। একসময় পল্টন ময়দানে জনসভা হতো। কিন্তু সেই ময়দানও আজ জনসভার জন্য অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। বিশাল উন্মুক্ত পল্টন ময়দানে মার্কেট ও স্টেডিয়াম নির্মিত হয়েছে। ফলে পল্টন ময়দান সংকুচিত হয়ে পড়েছে এবং জনসভা অনুষ্ঠানের জন্য হয়ে গেছে অনুপযোগী। কিছুদিন মানিক মিয়া এভিনিউতে জনসভা হতো। মানিক মিয়া এভিনিউ বিশাল চওড়া রাজপথ। এমন একটি জায়গায় কোনো দলের পক্ষেই এক-চতুর্থাংশ লোক সমাগম করে ভরাট করা সম্ভব ছিল না। ১৯৯৬, ২০০১-এ যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল তখন মানিক মিয়া এভিনিউয়ের মাঝখানে চওড়া আইল্যান্ড নির্মাণ করে খেজুর গাছ লাগিয়ে দেয়া হয়েছিল, যাতে এই জায়গাটিও জনসভার জন্য অনাকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। আইল্যান্ড নির্মাণের পর সেখানে আর কোনো জনসভা করতে দেয়া হয়নি। বাকি রইল সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। গত কিছুদিন ধরে এখানে বড় দলগুলো জনসভা করছে। এই মাঠটির নাম পাকিস্তান আমলে ছিল রেসকোর্স মাঠ। এই মাঠে গলফ খেলা হতো, হতো ঘোড়দৌড়। তখন এটি উদ্যান ছিল না। ফলে বিশাল জনসভা করার জন্য এই মাঠটি ছিল আদর্শস্থানীয়। এই মাঠেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি লাভের পর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৬৯ সালে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিল। এই সংবর্ধনা-সভায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে আমিও বক্তব্য রেখেছিলাম। এই মাঠেই ১৯৪৮ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে তার বিতর্কিত বক্তব্যের জন্য প্রথম প্রতিবাদের সম্মুখীন হন। এই মাঠে মওলানা ভাসানীও বেশ কিছু জনসভা করেছেন। জনসমাগম প্রচুর হবে মনে করলেই রাজনৈতিক দলগুলো জনসভার জন্য এই মাঠটি বেছে নিত। এখন আর এটি মাঠ নয়। এটি একটি উদ্যান। উদ্যান হলেও কিছু কিছু স্থাপনা নির্মাণের ফলে এর পরিসর সংকুচিত হয়ে গেছে। এছাড়া বৃক্ষরাজির আড়ালে কত জনসমাগম হল সেটাও পাশের রাস্তাগুলো থেকে খুব একটা দৃশ্যমান হয় না। অর্থাৎ গণতন্ত্রে যেখানে জনতার উপস্থিতিই মুখ্য, সেখানে জনতাকে আড়াল করারই অভিনব কৌশল এটা। এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এখানেই জনসভা করেন। বোঝা যায় না লোক বেশি হল না কম।
বিএনপির প্রার্থিত জনসভাটির দিন চারেক আগেই জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ জনসভা করেছে। এই সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপির তীব্র সমালোচনা করেছেন। ৮ নভেম্বর বিএনপি যদি জনসভাটি করতে পারত, তাহলে বিএনপি চেয়ারপারসন প্রধানমন্ত্রীর অনেক সমালোচনারই জবাব দিতে পারতেন। এর ফলে গণতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য ইভেন প্লেইং ফিল্ডের নীতিটি প্রতিষ্ঠিত হতে পারত। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের নামে যে চর্চা চলছে তা মোটেও ইভেন বা সমতল নয়। যারা ক্ষমতায় থাকেন তারা সব অধিকার ভোগ করবেন আর বিরোধীপক্ষীয়রা সে অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। এর ফলে দেশে জবাবদিহিতা থাকে না, থাকে না সুশাসন। গণতন্ত্র হয়ে পড়ে স্বৈরতন্ত্র। আওয়ামী লীগ নেতারা অহোরাত্র বলে চলেছেন, বিএনপি নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে, বিএনপির আন্দোলন করার হিম্মত নেই, জনগণ বিএনপি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। বিএনপি যদি এতই অথর্ব ও অসমর্থ একটি দল হয়, তাহলে দলটিকে নিয়ে এত দুর্ভাবনা কেন? কেন তাদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশও করতে দেয়া হয় না? লক্ষ্য করা গেছে বিএনপি আয়োজিত মানববন্ধন পুলিশি হস্তক্ষেপে পণ্ড হয়ে গেছে। এভাবে পুলিশের ওপর নির্ভর করে চণ্ডনীতি চালানো সরকারের সবলতা নয়, দুর্বলতারই বহিঃপ্রকাশ। বর্তমান সময়ে এই দুর্বলতার প্রধান উৎস হল ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচন বা প্রায় ভোটারশূন্য নির্বাচন। এ রকম নির্বাচনে নিয়ম রক্ষা হয় বটে; কিন্তু নীতি-নৈতিকতার বিচারে বৈধতা হয় না। সেজন্যই ইদানীংকালে আমরা সরকারি দলের নেতাদের মুখ থেকে শুনতে পাচ্ছি, গণতন্ত্র নয়, উন্নয়নই প্রধান বিবেচ্য বিষয়। গণতন্ত্রকে উন্নয়নের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানোর প্রয়াস অনেক দেশের স্বৈরাচারী শাসকদের পক্ষ থেকে লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু বাস্তবতা হল, উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের মধ্যে কোনো বৈরিতা নেই। গণতন্ত্র যদি যথার্থভাবে প্রতিপালিত হয় তাহলে উন্নয়নও বেগবান হয়। তাই তাত্ত্বিকরা বলেন, রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে সত্যিকার প্রতিযোগিতার কোনো বিকল্প নেই। রাজনীতিতে যদি প্রতিযোগিতা নিশ্চিত হয়, তাহলে অর্থনীতিতেও প্রতিযোগিতা নিশ্চিত হবে। প্রতিযোগিতা নিঃসন্দেহে একচেটিয়াত্ববাদের চেয়েও অধিকতর দক্ষ ও উৎপাদনশীল। তাই তাত্ত্বিকরা দুই ধরনের বাজারের কথা বলেছেন, এর একটি হল রাজনীতির বাজার এবং অন্যটি হল অর্থনীতির বাজার। রাজনীতির বাজারে অর্থ ও পেশিশক্তি কেন্দ্রীভূত না থাকলে এবং নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে দলীয় বাহিনীতে রূপান্তরিত না করা হলে রাজনীতির বাজারে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত হয়। রাজনীতির বাজারে একচেটিয়া প্রভাব বিস্তারের উদ্দেশে রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করে, নীতি-কৌশলকে দুমড়ে-মুচড়ে ক্ষমতা ও অর্থবিত্ত কিছু লোকের মধ্যে কুক্ষিগত করা হয়। এর ফলে জন্ম নেয় একটি অলিগার্কি বা মুষ্টিমেয়তন্ত্র। এসব সম্ভব হয় যদি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সঠিকভাবে কাজ করতে না পারে। এই পরিস্থিতিতে পার্লামেন্ট, নির্বাচন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ক্ষমতাসীন সরকারের তল্পিবাহকে পরিণত হয়। রাজনীতিতে তখন গণতন্ত্র চর্চাও অসম্ভব হয়ে ওঠে। নানা রকম বিধি-নিষেধের বেড়াজালে গণতন্ত্র শৃংখলিত হয়। মত প্রকাশের স্বাধীনতা, কথা বলার স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, তথ্য প্রবাহের স্বাধীনতা সবকিছুই বিঘ্নিত হয়। জনগণ তখন অধিকার বঞ্চিত হয়ে এক ধরনের ক্রীতদাসে পরিণত হয়। এ রকম পরিস্থিতিতে একটি দেশে নেমে আসতে পারে শতবর্ষের নিস্তব্ধতা। তখন মনে হয় সবকিছুই ঠিকঠাক চলছে, দেশ স্থিতিশীল রয়েছে এবং সর্বোচ্চ ক্ষমতাধারী ব্যক্তি হয়ে
ওঠেন প্রায় ঈশ্বর বা ঈশ্বরের প্রতিমূর্তি। এ রকম
একটি পরিস্থিতিকেই কবি-সাহিত্যিকরা কবরের শান্তির সঙ্গে তুলনা করেছেন।
গত প্রায় ছয় বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, শাসক দল রাজধানী ঢাকার ব্যাপারে প্রচণ্ড সংবেদনশীল। রাজধানী ঢাকায় বিরোধী দল সংগঠিত হোক, সভা-সমাবেশের মাধ্যমে জনমনে প্রভাব ফেলুক এটা কোনো ক্রমেই এদের কাম্য নয়। তাই দেখা গেছে সরকার পক্ষ ঢাকায় বিরোধী দলের বিশেষ করে বিএনপির কর্মতৎপরতাকে যথাসাধ্য বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করে। এই প্রয়াসে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী সরকারের প্রধান সহায়। বিশেষ একটি জেলার পুলিশদের ঢাকায় এনে জড়ো করা হয়েছে বলে নগরিকদের মনে সন্দেহ রয়েছে। সম্প্রতি মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান পুলিশের একটি বাড়াবাড়ির প্রতি নিন্দা জানাতে গিয়ে এ রকমই একটি ইঙ্গিত দিয়েছেন। এর জন্য ডিএমপির পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জ্ঞাপন করা হয়েছে।
মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যানের উক্তির প্রতিবাদ ডিএমপির পক্ষ থেকে না এসে সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিংবা তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে আসা সঙ্গত ছিল কিনা সে ব্যাপারেও প্রশ্ন উঠেছে। আমরা যতদূর জানি মানবাধিকার কমিশন একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়াই সঙ্গত। কিন্তু এ ব্যাপারেও অনীহা লক্ষ করা যাচ্ছে। ড. মিজান সব সময় সরকারের সমালোচনা করেন এমন নয়। তিনি বহু ব্যাপারে সরকারের উচ্ছ্বসিত প্রশংসাও করেন। এছাড়াও তিনি বংশগতভাবে আওয়ামী নীতি-আদর্শেরও একজন দৃঢ় সমর্থক। সেটা তার ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার। অনেক সময় দেখা যায় বিবেকবান মানুষরা কোনো নীতি-আদর্শের কড়া সমর্থক হয়েও কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিবেকের দংশন অনুভব করেন। সম্ভবত বিবেকের দংশন থেকেই তিনি এ রকম একটি মন্তব্য করেছেন। তার সেই বিবেকের স্বাধীনতা থাকা বাঞ্ছনীয়। এই স্বাধীনতার চর্চা করতে দিলে সরকারেরই মঙ্গল হয়। কারণ বিবেকপ্রসূত এবং বিদ্বেষহীন কোনো উক্তি সরকারের জন্য বিশেষ করে গণতন্ত্রের দাবিদার একটি সরকারের জন্য ক্ষতিকারক বিবেচিত হতে পারে না। বরং ফলে সরকার তার ত্র“টি-বিচ্যুতি এবং ভুল-ভ্রান্তি শুধরে নিয়ে নৈতিক শক্তিতে বলীয়ান হতে পারে।
৮ নভেম্বরের জনসভার অনুমতি না দেয়ায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, গণতন্ত্র এখন পুলিশের বুটের তলায়। রাষ্ট্র যেন পুলিশি রাষ্ট্র হয়ে উঠেছে। জনসভার অনুমতি না দেয়ায় প্রতিবাদ জ্ঞাপনার্থে বিএনপি বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দিয়েছে। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এ কর্মসূচিকে অভিনন্দিত করেছেন এই বলে যে, বিএনপি হরতালের ডাক দেয়নি। গণতন্ত্র পুলিশের বুটের তলায় না অন্য কারোর অঞ্চলাবদ্ধ, সেটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। এদিকে আওয়ামী লীগের আরেক নেতা মাহবুবউল আলম হানিফ মির্জা ফখরুলকে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা পাঠ করার
পরামর্শ দিয়েছেন। এ দুজনের মধ্যে কে অধিকতর জ্ঞানী তা আমাদের জানা নেই। তবে এটুকু বুঝতে পারি গণতন্ত্রের সংজ্ঞা এদের দুজনেরই জানা থাকার কথা। সমস্যাটা
দাঁড়ায় এর অনুশীলনে। এখন যখন লিখছি তখন ভাবছি বিএনপির বিক্ষোভ কর্মসূচি নিরুপদ্রব পালিত হয় কিনা। সে ব্যাপারেও মনে মনে শংকাবোধ করছি। তারপরও চাইব, ওবায়দুল কাদেরের অভিনন্দনের ওপর যাতে কোনো কালো ছায়া না পড়ে।
ড. মাহবুব উল্লাহ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক
No comments