শিক্ষকের গুণ ও শিক্ষণের সংকট by কামাল আহমেদ
৫ অক্টোবর ছিল বিশ্ব শিক্ষক দিবস। বাংলাদেশে এবার দিনটি প্রায় নীরবেই পার হয়ে গেছে। ঈদের ছুটির কারণে সেটাই স্বাভাবিক। তবে, এ বছরের শিক্ষক দিবসের যে মূল ভাবনা, সেটি উপেক্ষিত হোক, তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। বৈশ্বিক পরিসরে শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রসারে যে প্রতিষ্ঠানটি নানা ধরনের নির্দেশনা ও নেতৃত্ব দিয়ে থাকে, সেটি হচ্ছে জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানবিষয়ক সংস্থা—ইউনেসকো। এ বছরে শিক্ষক দিবসে তারা বলেছে যে শিক্ষকতায় বিনিয়োগই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, তাদের বিবেচনায় যে দেশের শিক্ষক যতটা গুণী, সে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ততটাই ভালো। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জাতীয়ভিত্তিক পরীক্ষাগুলোতে উঁচু হারে সাফল্যের যথার্থতা নিয়ে যে বিতর্ক চলছে, তার পটভূমিতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ইউনেসকোর এই বক্তব্যটির প্রতিফলন কেমন?
পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস, পাসের উচ্চ হারের পেছনে রাজনৈতিক প্রভাবের অভিযোগ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে কেন্দ্র করে রাজনীতিকদের প্রভাববলয় বিস্তারের প্রতিযোগিতা, শিক্ষক নিয়োগ এবং ছাত্র ভর্তিতে দুর্নীতি, শিক্ষকরাজনীতি ও তাঁদের কারও কারও দলীয় লেজুড়বৃত্তির বিষয়গুলো নিয়ে বিতর্কের অন্ত নেই। এগুলোর সবকিছুই শিক্ষার প্রতিটি স্তরকে স্পর্শ করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। ফলে শিক্ষকদের গুণগত মানের বিষয়টিতে তেমন কোনো অর্থবহ আলোচনা শোনা যায় না। এবার বিশ্ব শিক্ষক দিবস উপলক্ষে ইউনেসকোর ইনস্টিটিউট অব স্ট্যাস্টিসটিকস এক বৈশ্বিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে (ওয়ানটেড: ট্রেইন্ড টিচার্স টু এনশিওর এভরি চাইল্ডস রাইট টু প্রাইমারি এডুকেশন)। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে বিশ্বের ৯৩টি দেশে শিক্ষক-ঘাটতি চরমে এবং ২০১৫ সালের মধ্যে বিশ্বে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে শ্রেণিকক্ষে আরও ৪০ লাখ শিক্ষক প্রয়োজন। তবে, সংস্থাটি বলছে যে এই বিপুলসংখ্যক শিক্ষক-ঘাটতির পাশাপাশি আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে শিক্ষার গুণগত মান। প্রায়ই শিক্ষকেরা কোনো উপকরণ এবং প্রশিক্ষণ ছাড়াই কাজ করছেন। অথচ, বিশ্বে বর্তমানে প্রায় ২৫ কোটি শিশু পড়া বা লেখার মৌলিক দক্ষতা অর্জনে ব্যর্থ বলে জানাচ্ছে ইউনেসকো। সংস্থাটি তাই বলছে যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যখন ২০১৫-উত্তর উন্নয়ন লক্ষ্য নির্ধারণের কাজ করছে, তখন শিক্ষকদের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।
শিক্ষকেরা কেন দেশের জন্য একটি বিনিয়োগ? ইউনেসকোর যুক্তি হচ্ছে আজকের শিশু প্রাপ্তবয়সে কোন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে তা যেহেতু কারও পক্ষে আগাম বলে দেওয়া সম্ভব নয়, সেহেতু আজ এবং আগামীকালের শিক্ষকদের এমন জ্ঞান এবং দক্ষতা প্রয়োজন, যা তাঁদের ভবিষ্যতের প্রতিটি ছেলেমেয়ের শিক্ষার বহুমুখী চাহিদা মেটানোর যোগ্য করে তুলবে। কিন্তু, তাঁদের হিসাবে বিশ্বে ২৫ কোটির বেশি শিশু লিখতে অথবা পড়তে পারা কিংবা অঙ্ক করার মতো মৌলিক দক্ষতা অর্জন করেনি। এই ২৫ কোটির মধ্যে ১৩ কোটি শিশু চার বছর স্কুলে কাটানোর পরও যথেষ্ট পরিমাণে মৌলিক দক্ষতা অর্জন করেনি। আবার এসব শিশুর তিন-চতুর্থাংশই দক্ষিণ এশিয়ার। এই বিপুলসংখ্যক শিশুর পড়া, লেখা বা গণনা করার মতো জ্ঞানের অভাবকে তাঁরা বলছেন শিক্ষণের সংকট (লার্নিং ক্রাইসিস)। সবার জন্য শিক্ষার বৈশ্বিক পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন প্রস্তুতকারীদের অন্যতম একজন গবেষক, নিহান কসেলেচি বলেন যে আমরা সমস্যা দেখছি শিক্ষার গুণগত মানে, শিক্ষকদের গুণগত মানে। তিনি বলছেন যে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষক যথেষ্ট পরিমাণে থাকলেও প্রশিক্ষিত শিক্ষক যথেষ্ট পরিমাণে নেই। কসেলেচি আরও বলেছেন, আপনি ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাত যদি বিবেচনা করেন, তাহলে দেখবেন ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাত ভালো হলেও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের সঙ্গে ছাত্রের অনুপাত ভালো নয়। সেখানে যথেষ্ট পরিমাণে প্রশিক্ষিত শিক্ষক নেই। (সূত্র: জাতিসংঘ রেডিও, ১৪ অক্টোবর, ২০১৪)। ইউনেসকোর ২০১৪ সালের প্রকাশিত এই সর্বসাম্প্রতিক গবেষণায় যেসব দেশে প্রশিক্ষিত শিক্ষকের পরিমাণ ৭৫ শতাংশের কম, সে রকম ৩০টি দেশকে চিহ্নিত করা হয়েছে, যার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্দশ। রিপোর্টটিতে ২০১২ সালের যে পরিসংখ্যান সংকলন করা হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের হার ৬০ শতাংশের চেয়ে কিছু কম। অর্থাৎ, ৪০ শতাংশের বেশি শিক্ষকই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নন বা মানসম্মত মৌলিক শিক্ষা দেওয়ার গুণে গুণান্বিত নন। ফলে শিক্ষণের সংকট যে রয়েছে, তাকে অস্বীকার করার মাধ্যমে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎকে আরও অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছি কি না সে প্রশ্নের জবাব প্রয়োজন।
অবশ্য এই প্রশ্নের জবাব খোঁজার আগ্রহে যে ঘাটতি আছে তার প্রমাণ মেলে এ বিষয়ে রাজনীতিতাড়িত বক্তব্য-বিবৃতিতে। তা না হলে শিক্ষামন্ত্রীর পক্ষে ‘অতীতে শিক্ষার মান ভালো ছিল না’ মর্মে ঢালাও মন্তব্য করা হয়তো সম্ভব হতো না। তিনি যদি অন্তত রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি আমলের কথা বলতেন, তাহলে হয়তো তার ব্যাখ্যা পাওয়া যেত। কিন্তু অতীত বলতে তিনি তাঁর ছাত্রজীবনের শিক্ষার মানকে বুঝিয়েছেন কি না, সে প্রশ্ন তোলাটা বোধ হয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না। আমি অবশ্য আমার শিক্ষাজীবনের শিক্ষার মান সম্পর্কে এ ধরনের মূল্যায়ন মানতে রাজি নই। আমাদের শিক্ষকেরা আমাদের যেমন লিখতে ও পড়তে শিখিয়েছেন, তেমনটি যে ওনার আমলে হচ্ছে না, অন্তত ৪০ শতাংশের ক্ষেত্রে তার প্রমাণ ইউনেসকোর প্রতিবেদন। আমাদের ছাত্রজীবনে আমরা স্কুল কমিটির নেতৃত্ব নিয়ে রাজনৈতিক দলাদলি, এমপি সাহেবদের চিঠি চালাচালি, শিক্ষক নিয়ে দলীয় আনুগত্য প্রমাণ করা কিংবা টাকা দিয়ে চাকরি কেনা, এমপিওভুক্তির জন্য শিক্ষামন্ত্রীর সিদ্ধান্ত নাকচ করতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের কথা কখনো শুনিনি। গত আড়াই-তিন দশকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পাল্লাপাল্লির প্রতিযোগিতায় তা রীতিমতো এক নৈরাজ্যের পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এ ধরনের অশুভ প্রতিযোগিতা থেকে মুক্ত নয়। এখন থেকে প্রায় দেড় যুগ আগে বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন লায়লা রহমান কবীর। সে সময় তিনি এক সাক্ষাৎকারে আমাকে বলেছিলেন যে চাকরির আবেদনকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীদের একটি বিরাট অংশই শুদ্ধভাবে ইংরেজি বা বাংলা কোনোটিই লিখতে পারেন না। তিনি আক্ষেপের সুরে বলেছিলেন যে দেশে শিল্পায়ন এবং বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে প্রয়োজনীয় যোগ্য জনশক্তির অভাবে উদ্যোক্তারা হতাশা বোধ করেন। বাংলাদেশের শিল্প-বাণিজ্য খাতে সে কারণে বিদেশিদের নিয়োগ করার প্রবণতা যে ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠছে তা যদি আমাদের রাজনীতিক ও নীতিনির্ধারকদের নজরে না এসে থাকে, তাহলে তা হবে খুবই হতাশার বিষয়। বিদেশে বাংলাদেশিদের কাজের বাজার সম্প্রসারণে শিক্ষার গুণগত মান বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার কথা নাহয় আলোচনায় না-ই আনলাম।
শিক্ষণের সংকট নিয়ে বিশ্বজুড়েই চলছে আলোচনা। ব্রিটেনেও প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে রাজনীতিকেরা প্রতিবছরই বিতর্ক করেন। আমেরিকা ও ইউরোপের অন্য দেশগুলোর পাশাপাশি তাঁরা চীন ও ভারতের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষার মান নিয়ে তুলনা টানেন। তাঁদের কাছে বিস্ময় চীনা ও ভারতীয় ছাত্রছাত্রীরা অঙ্কে এত ভালো কেন? ইংরেজিতেও তাঁদের দক্ষতা ঈর্ষণীয়। কিন্তু, আমাদের তুলনা কারা? ভাবসাব দেখে মনে হয় আমাদের কোনো তুলনা নেই। সুতরাং অন্যদের দিকে তাকানোর প্রয়োজন নেই। কিন্তু এ ধরনের আত্মম্ভরিতা যে ভবিষ্যতে কাল হতে পারে, সেটা ভুলে যাওয়া বোধ হয় ঠিক হচ্ছে না।
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক।
পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস, পাসের উচ্চ হারের পেছনে রাজনৈতিক প্রভাবের অভিযোগ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে কেন্দ্র করে রাজনীতিকদের প্রভাববলয় বিস্তারের প্রতিযোগিতা, শিক্ষক নিয়োগ এবং ছাত্র ভর্তিতে দুর্নীতি, শিক্ষকরাজনীতি ও তাঁদের কারও কারও দলীয় লেজুড়বৃত্তির বিষয়গুলো নিয়ে বিতর্কের অন্ত নেই। এগুলোর সবকিছুই শিক্ষার প্রতিটি স্তরকে স্পর্শ করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। ফলে শিক্ষকদের গুণগত মানের বিষয়টিতে তেমন কোনো অর্থবহ আলোচনা শোনা যায় না। এবার বিশ্ব শিক্ষক দিবস উপলক্ষে ইউনেসকোর ইনস্টিটিউট অব স্ট্যাস্টিসটিকস এক বৈশ্বিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে (ওয়ানটেড: ট্রেইন্ড টিচার্স টু এনশিওর এভরি চাইল্ডস রাইট টু প্রাইমারি এডুকেশন)। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে বিশ্বের ৯৩টি দেশে শিক্ষক-ঘাটতি চরমে এবং ২০১৫ সালের মধ্যে বিশ্বে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে শ্রেণিকক্ষে আরও ৪০ লাখ শিক্ষক প্রয়োজন। তবে, সংস্থাটি বলছে যে এই বিপুলসংখ্যক শিক্ষক-ঘাটতির পাশাপাশি আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে শিক্ষার গুণগত মান। প্রায়ই শিক্ষকেরা কোনো উপকরণ এবং প্রশিক্ষণ ছাড়াই কাজ করছেন। অথচ, বিশ্বে বর্তমানে প্রায় ২৫ কোটি শিশু পড়া বা লেখার মৌলিক দক্ষতা অর্জনে ব্যর্থ বলে জানাচ্ছে ইউনেসকো। সংস্থাটি তাই বলছে যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যখন ২০১৫-উত্তর উন্নয়ন লক্ষ্য নির্ধারণের কাজ করছে, তখন শিক্ষকদের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।
শিক্ষকেরা কেন দেশের জন্য একটি বিনিয়োগ? ইউনেসকোর যুক্তি হচ্ছে আজকের শিশু প্রাপ্তবয়সে কোন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে তা যেহেতু কারও পক্ষে আগাম বলে দেওয়া সম্ভব নয়, সেহেতু আজ এবং আগামীকালের শিক্ষকদের এমন জ্ঞান এবং দক্ষতা প্রয়োজন, যা তাঁদের ভবিষ্যতের প্রতিটি ছেলেমেয়ের শিক্ষার বহুমুখী চাহিদা মেটানোর যোগ্য করে তুলবে। কিন্তু, তাঁদের হিসাবে বিশ্বে ২৫ কোটির বেশি শিশু লিখতে অথবা পড়তে পারা কিংবা অঙ্ক করার মতো মৌলিক দক্ষতা অর্জন করেনি। এই ২৫ কোটির মধ্যে ১৩ কোটি শিশু চার বছর স্কুলে কাটানোর পরও যথেষ্ট পরিমাণে মৌলিক দক্ষতা অর্জন করেনি। আবার এসব শিশুর তিন-চতুর্থাংশই দক্ষিণ এশিয়ার। এই বিপুলসংখ্যক শিশুর পড়া, লেখা বা গণনা করার মতো জ্ঞানের অভাবকে তাঁরা বলছেন শিক্ষণের সংকট (লার্নিং ক্রাইসিস)। সবার জন্য শিক্ষার বৈশ্বিক পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন প্রস্তুতকারীদের অন্যতম একজন গবেষক, নিহান কসেলেচি বলেন যে আমরা সমস্যা দেখছি শিক্ষার গুণগত মানে, শিক্ষকদের গুণগত মানে। তিনি বলছেন যে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষক যথেষ্ট পরিমাণে থাকলেও প্রশিক্ষিত শিক্ষক যথেষ্ট পরিমাণে নেই। কসেলেচি আরও বলেছেন, আপনি ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাত যদি বিবেচনা করেন, তাহলে দেখবেন ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাত ভালো হলেও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের সঙ্গে ছাত্রের অনুপাত ভালো নয়। সেখানে যথেষ্ট পরিমাণে প্রশিক্ষিত শিক্ষক নেই। (সূত্র: জাতিসংঘ রেডিও, ১৪ অক্টোবর, ২০১৪)। ইউনেসকোর ২০১৪ সালের প্রকাশিত এই সর্বসাম্প্রতিক গবেষণায় যেসব দেশে প্রশিক্ষিত শিক্ষকের পরিমাণ ৭৫ শতাংশের কম, সে রকম ৩০টি দেশকে চিহ্নিত করা হয়েছে, যার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্দশ। রিপোর্টটিতে ২০১২ সালের যে পরিসংখ্যান সংকলন করা হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের হার ৬০ শতাংশের চেয়ে কিছু কম। অর্থাৎ, ৪০ শতাংশের বেশি শিক্ষকই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নন বা মানসম্মত মৌলিক শিক্ষা দেওয়ার গুণে গুণান্বিত নন। ফলে শিক্ষণের সংকট যে রয়েছে, তাকে অস্বীকার করার মাধ্যমে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎকে আরও অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছি কি না সে প্রশ্নের জবাব প্রয়োজন।
অবশ্য এই প্রশ্নের জবাব খোঁজার আগ্রহে যে ঘাটতি আছে তার প্রমাণ মেলে এ বিষয়ে রাজনীতিতাড়িত বক্তব্য-বিবৃতিতে। তা না হলে শিক্ষামন্ত্রীর পক্ষে ‘অতীতে শিক্ষার মান ভালো ছিল না’ মর্মে ঢালাও মন্তব্য করা হয়তো সম্ভব হতো না। তিনি যদি অন্তত রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি আমলের কথা বলতেন, তাহলে হয়তো তার ব্যাখ্যা পাওয়া যেত। কিন্তু অতীত বলতে তিনি তাঁর ছাত্রজীবনের শিক্ষার মানকে বুঝিয়েছেন কি না, সে প্রশ্ন তোলাটা বোধ হয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না। আমি অবশ্য আমার শিক্ষাজীবনের শিক্ষার মান সম্পর্কে এ ধরনের মূল্যায়ন মানতে রাজি নই। আমাদের শিক্ষকেরা আমাদের যেমন লিখতে ও পড়তে শিখিয়েছেন, তেমনটি যে ওনার আমলে হচ্ছে না, অন্তত ৪০ শতাংশের ক্ষেত্রে তার প্রমাণ ইউনেসকোর প্রতিবেদন। আমাদের ছাত্রজীবনে আমরা স্কুল কমিটির নেতৃত্ব নিয়ে রাজনৈতিক দলাদলি, এমপি সাহেবদের চিঠি চালাচালি, শিক্ষক নিয়ে দলীয় আনুগত্য প্রমাণ করা কিংবা টাকা দিয়ে চাকরি কেনা, এমপিওভুক্তির জন্য শিক্ষামন্ত্রীর সিদ্ধান্ত নাকচ করতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের কথা কখনো শুনিনি। গত আড়াই-তিন দশকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পাল্লাপাল্লির প্রতিযোগিতায় তা রীতিমতো এক নৈরাজ্যের পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এ ধরনের অশুভ প্রতিযোগিতা থেকে মুক্ত নয়। এখন থেকে প্রায় দেড় যুগ আগে বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন লায়লা রহমান কবীর। সে সময় তিনি এক সাক্ষাৎকারে আমাকে বলেছিলেন যে চাকরির আবেদনকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীদের একটি বিরাট অংশই শুদ্ধভাবে ইংরেজি বা বাংলা কোনোটিই লিখতে পারেন না। তিনি আক্ষেপের সুরে বলেছিলেন যে দেশে শিল্পায়ন এবং বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে প্রয়োজনীয় যোগ্য জনশক্তির অভাবে উদ্যোক্তারা হতাশা বোধ করেন। বাংলাদেশের শিল্প-বাণিজ্য খাতে সে কারণে বিদেশিদের নিয়োগ করার প্রবণতা যে ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠছে তা যদি আমাদের রাজনীতিক ও নীতিনির্ধারকদের নজরে না এসে থাকে, তাহলে তা হবে খুবই হতাশার বিষয়। বিদেশে বাংলাদেশিদের কাজের বাজার সম্প্রসারণে শিক্ষার গুণগত মান বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার কথা নাহয় আলোচনায় না-ই আনলাম।
শিক্ষণের সংকট নিয়ে বিশ্বজুড়েই চলছে আলোচনা। ব্রিটেনেও প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে রাজনীতিকেরা প্রতিবছরই বিতর্ক করেন। আমেরিকা ও ইউরোপের অন্য দেশগুলোর পাশাপাশি তাঁরা চীন ও ভারতের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষার মান নিয়ে তুলনা টানেন। তাঁদের কাছে বিস্ময় চীনা ও ভারতীয় ছাত্রছাত্রীরা অঙ্কে এত ভালো কেন? ইংরেজিতেও তাঁদের দক্ষতা ঈর্ষণীয়। কিন্তু, আমাদের তুলনা কারা? ভাবসাব দেখে মনে হয় আমাদের কোনো তুলনা নেই। সুতরাং অন্যদের দিকে তাকানোর প্রয়োজন নেই। কিন্তু এ ধরনের আত্মম্ভরিতা যে ভবিষ্যতে কাল হতে পারে, সেটা ভুলে যাওয়া বোধ হয় ঠিক হচ্ছে না।
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক।
No comments