সংবিধান ও রাজনীতি- সংবিধানের প্রস্তাবনা কী বলে? by ইকতেদার আহমেদ

 প্রস্তাবনা শব্দটির ইংরেজি Preamble বাংলায় এ শব্দটির অর্থ সাধারণ কোনো পুস্তকের ক্ষেত্রে ‘ভূমিকা বা উপক্রমণিকা’ হলেও সংসদ প্রণীত আইন বা সংবিধানের ক্ষেত্রে ‘কারণ ও উদ্দেশ্য সংবলিত বক্তব্য’। ১৯৭২ সালে প্রণীত আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনা পাঁচটি অনুচ্ছেদ সমন্বয়ে গঠিত। মূল প্রস্তাবনাটিতে আছেÑ আমরা বাংলাদেশের জনগণ ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করে জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করেছি;
আমরা অঙ্গীকার করছি যে, যেসব মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদের প্রাণ উৎসর্গ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিলÑ জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেসব আদর্শ এ সংবিধানের মূলনীতি হবে;
আমরা আরো অঙ্গীকার করছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠাÑ যেখানে সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হবে;
আমরা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করছি যে, আমরা যাতে স্বাধীন সত্তায় সমৃদ্ধি লাভ করতে পারি এবং মানবজাতির প্রগতিশীল আশা-আকাক্সার সাথে সঙ্গতি রক্ষা করে আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে পূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারি, সে জন্য বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তিরূপে এ সংবিধানের প্রাধান্য অক্ষুণœ রাখা এবং এর রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান আমাদের পবিত্র কর্তব্য;
এতদ্বারা আমাদের এ গণপরিষদে, অদ্য ১৩৭৯ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসের ১৮ তারিখ মোতাবেক ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসের ৪ তারিখে আমরা এ সংবিধান রচনা ও বিধিবদ্ধ করে সমবেতভাবে গ্রহণ করলাম।
উল্লেখ্য, গণপরিষদে সংবিধান ১৯৭২ সালে ৪ নভেম্বর গৃহীত হলেও এ সংবিধান কার্যকর হয় ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর।
এরপর ৪২ বছরের বেশি সময়ের ইতিহাসে এ প্রস্তাবনাটি দু’বার সংশোধিত হয়। প্রথম সংশোধন হয় দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র (পঞ্চম সংশোধন) আদেশ, ১৯৭৮-এর মাধ্যমে। সে সময় দেশে সামরিক শাসন ছিল। এ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রস্তাবনার উপরিভাগে-বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম (দয়াময় পরম দয়ালু আল্লাহর নামে) শব্দগুলো সন্নিবেশিত হয় এবং প্রথম অনুচ্ছেদে জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের শব্দগুলো জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধের শব্দগুলো দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়।
দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার শব্দগুলো সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র অর্থাৎ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচারের শব্দগুলো দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়।
পরে পঞ্চদশ সংশোধনী দিয়ে আগের ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে গেলেও প্রস্তাবনার উপরিভাগের বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম (দয়াময় পরম দয়ালু আল্লাহের নামে) শব্দগুলো অক্ষুণœ রেখে এর নিচে পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার নামে শব্দগুলো সন্নিবেশিত হয়।
প্রস্তাবনাটি অবলোকনে প্রতীয়মান হয় এতে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে, বাংলাদেশের জনগণ ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছে। স্বাধীনতা ঘোষণা বিষয়ে সংবিধানের প্রস্তাবনায় জনগণের স্বাধীনতা ঘোষণার বক্তব্য থাকায় ধরে নিতে হবে এ দেশের সব শ্রেণী-পেশা তথা আপামর জনগণ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। সুতরাং প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে কে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে, এ বিতর্কে না গিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণার কৃতিত্ব জনগণকে দেয়া উচিত। আর যদি একান্ত বিতর্কে যেতেই হয় তবে নানা প্রশ্ন উদয় হতে বাধ্য। যদিও সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন মর্মে সিদ্ধান্ত দিয়ে বিতর্কের অবসান ঘটানোর প্রয়াস নিয়েছেন; কিন্তু বিষয়টি ইতিহাসের বিষয় হওয়ায় ইতিহাসের নিজ ধারাবাহিকতায় প্রশ্নটির সুরাহা হওয়া বাঞ্ছনীয়। অনেকের জিজ্ঞাস্য, আদালত সিদ্ধান্ত দিয়ে প্রশ্নটির কি সুরাহা করেছেন? সুরাহা হয়নি বলেই দেখা গেল তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা শারমিন আহমদ স্বাধীনতা ঘোষণা বিষয়ে তার বই ‘তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা’-তে উল্লেখ করেছেনÑ ‘পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৫ মার্চের ভয়াল কালরাতে আব্বু গেলেন মুজিব কাকুকে নিতে, মুজিব কাকু আব্বুর সঙ্গে আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করবেন সে ব্যাপারে আব্বু মুজিব কাকুর সাথে আলোচনা করেছিলেন, মুজিব কাকু সে ব্যাপারে সম্মতিও দিয়েছিলেন। সে অনুযায়ী আত্মগোপনের জন্য পুরান ঢাকার একটি বাসাও ঠিক করে রাখা হয়েছিল। বড় কোনো সিদ্ধান্ত সম্পর্কে আব্বুর উপদেশ গ্রহণে মুজিব কাকু এর আগে দ্বিধা করেননি। আব্বুর সে কারণে বিশ্বাস ছিল যে, ইতিহাসের এই যুগসন্ধিক্ষণে মুজিব কাকু কথা রাখবেন। মুজিব কাকু আব্বুর সাথেই যাবেন। অথচ মুহূর্তে মুজিব কাকু অনড় রয়ে গেলেন। তিনি আব্বুকে বললেন, ‘বাড়ি গিয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে থাকো, পরশু দিন (২৭ মার্চ) হরতাল ডেকেছি’। মুজিব কাকুর তাৎক্ষণিক এ উক্তিতে আব্বু বিস্ময় ও বেদনায় বিমূঢ় হয়ে পড়লেন। এ দিকে বেগম মুজিব ওই শোয়ার ঘরেই স্যুটকেসে মুজিব কাকুর জামাকাপড় ভাঁজ করে রাখতে শুরু করলেন। ঢোলা পায়জামায় ফিতা ভরলেন। পাকিস্তানি সেনার হাতে মুজিব কাকুর স্বেচ্ছাবন্দী হওয়ার এসব প্রস্তুতি দেখার পরও আব্বু হাল না ছেড়ে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে বিভিন্ন ঐতিহাসিক উদাহরণ টেনে মুজিব কাকুকে বুঝাবার চেষ্টা করলেন। তিনি কিংবদন্তি সমতুল্য বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের উদাহরণ তুলে ধরলেন, যাঁরা আত্মগোপন করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। কিন্তু মুজিব কাকু তাঁর এ সিদ্ধান্তে অনড় হয়ে রইলেন। আব্বু বললেন যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মূল লক্ষ্য হলো পূর্ব-বাংলাকে সম্পূর্ণরূপেই নেতৃত্বশূন্য করে দেয়া। এ অবস্থায় মুজিব কাকুর ধরা দেয়ার অর্থ হলো আত্মহত্যার শামিল। তিনি বললেন, ‘মুজিব ভাই বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা হলেন আপনি। আপনার নেতৃত্বের ওপরই তাঁরা সম্পূর্ণ ভরসা করে রয়েছে।’ মুজিব কাকু বললেন, ‘তোমরা যা করবার কর। আমি কোথাও যাব না।’ আব্বু বললেন, ‘আপনার অবর্তমানে দ্বিতীয় কে নেতৃত্ব দেবে এমন ঘোষণা তো দিয়ে যাননি। নেতার অনুপস্থিতিতে দ্বিতীয় ব্যক্তি কে হবে, দলকে তো তা জানানো হয়নি। ফলে দ্বিতীয় কারো নেতৃত্ব প্রদান দুরূহ হবে এবং মুক্তিযুদ্ধকে এক অনিশ্চিত ও জটিল পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়া হবে।’ আব্বুর সে দিনের উক্তিটি ছিল এক নির্মম সত্য ভবিষদ্বাণী।
‘পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আব্বু স্বাধীনতার ঘোষণা লিখে নিয়ে এসেছিলেন এবং টেপ রেকর্ডারও নিয়ে এসেছিলেন। টেপে বিবৃতি দিতে বা স্বাধীনতার ঘোষণায় স্বাক্ষর দিতে মুজিব কাকু অস্বীকৃতি জানান। কথা ছিল যে, মুজিব কাকুর স্বাক্ষরকৃত স্বাধীনতার ঘোষণা হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে (বর্তমান শেরাটন) অবস্থিত বিদেশী সাংবাদিকদের কাছে পৌঁছে দেয়া হবে এবং তাঁরা আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিচালনা করবেন। আব্বু বলেছিলেন, ‘মুজিব ভাই, এটা আপনাকে বলে যেতেই হবে, কারণ কালকে কী হবে, আমাদের সবাইকে যদি গ্রেফতার করে নিয়ে যায়, তাহলে কেউ জানবে না, কী তাদের করতে হবে। এ ঘোষণা কোনো-না-কোনো জায়গা থেকে কপি করে আমরা জানাব। যদি বেতার মারফত কিছু করা যায়, তা হলে সেটাই করা হবে। মুজিব কাকু তখন উত্তর দিয়েছিলেন, ‘এটা আমার বিরুদ্ধে দলিল হয়ে থাকবে। এর জন্য পাকিস্তানিরা আমাকে দেশদ্রোহের জন্য বিচার করতে পারবে’।
২৫ মার্চ রাতে তাজউদ্দীন আহমদ ছাড়াও আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কিছু গুরুত্বপূর্ণ নেতা বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে গিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য পীড়াপীড়ি করেছিলেন এবং অগত্যা তাদের সাথে আত্মগোপনে যেতে বলেছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ কন্যা শারমিন আহমদ স্বাধীনতা ঘোষণা না করার ব্যাপারে এবং আত্মগোপনে না যাওয়ার ব্যাপারে তার রচিত বইয়ে বঙ্গবন্ধুর যে অনড় অবস্থানের কথা উল্লেখ করেছেন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দের বক্তব্য ও সাক্ষাৎকারে এর থেকে ভিন্নতর কিছু পাওয়া যায়নি।
শারমিন আহমদের বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর উল্লেখযোগ্য সময় অতিবাহিত হলেও বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ রাতে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা না করার ব্যাপারে তার বইয়ে উল্লেখিত বক্তব্য খণ্ডন করে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এখনো কোনো ধরনের বিবৃতি দেয়া হয়নি। আওয়ামী লীগ এ বিষয়ে বিবৃতি দেয়ার ক্ষেত্রে যে কালক্ষেপণ করছে তাতে প্রতীয়মান হয় এ বিষয়ে শারমিন আহমদের বর্ণনা বস্তুনিষ্ঠ।
স্বাধীনতা ঘোষণা বিষয়ে বাংলাদেশের অন্য বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির অবস্থান আওয়ামী লীগের অবস্থান থেকে ভিন্নতর। বিএনপি জোটে যেসব শরিক দল রয়েছে, এ বিষয়ে তাদের অবস্থানও বিএনপির অনুরূপ। যদিও দাবি করা হয় ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতা ঘোষণা বিষয়ে একটি বার্তা পাঠিয়েছিলেন; কিন্তু বাস্তব সত্য হলো বাংলাদেশের কোনো নাগরিক এ বার্তাটি শোনেনি, বরং এ দেশের ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক জনতার একটি বড় অংশ স্বাধীনতার যে ঘোষণাটি দিয়ে উজ্জীবিত হয়েছেন সেটি উচ্চারিত হয়েছিল চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে সম্প্রচারিত তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমানের কণ্ঠে। এটি ঐতিহাসিক সত্য, তিনিই প্রথমে নিজেকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট দাবি করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পরদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এখানে উল্লেখ্য, জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার আগে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন বলে শোনা যায়।
বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় সংবিধান প্রণীত হলেও তখন সংবিধানে কে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করছেন, এ ধরনের কোনো কিছু উল্লেখ ছিল না। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে অনুচ্ছেদ নং ১৫০-এ দফা (২) সংযোজনের মাধ্যমে অপরাপর বিষয়ের পাশাপাশি বলা হয়Ñ ‘ষষ্ঠ তফসিলে বর্ণিত ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তারিখে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার টেলিগ্রাম উক্ত সময়কালের জন্য ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলি বলে গণ্য হবে।’
পঞ্চদশ সংশোধনী-পূর্ব সংবিধানে চারটি তফসিল ছিল, যার মধ্যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনসংক্রান্ত দ্বিতীয় তফসিল আগেই বিলুপ্ত হয়েছিল। স্পষ্টত সংবিধানের প্রস্তাবনায় বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতা ঘোষণাপূর্বক স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছে মর্মে উল্লেখ থাকায় পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে অনুচ্ছেদ নং ১৫০(২)-এ এবং ষষ্ঠ তফসিলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার উল্লেখ সাংঘর্ষিক।
সংবিধান প্রণয়নকালে প্রস্তাবনায় জনগণ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন মর্মে উল্লেখ থাকায় এবং আনুষ্ঠানিকভাবে কে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে, এ বিষয়ে জাতি দ্বিধাবিভক্ত হওয়ায় এ ধরনের বিষয়ের সংবেদনশীলতা বিবেচনায় এর সংবিধানে সন্নিবেশন অহেতুক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। তাই এটির পরিহার উত্তম ছিল। তা ছাড়া এ বিষয়টিও বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন সংবিধান প্রণয়নকালে সংবিধানের অন্যান্য অনুচ্ছেদের মতো প্রস্তাবনা সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশের ভোটে সংশোধনযোগ্য ছিল। পরে দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র (পঞ্চম সংশোধন) আদেশ, ১৯৭৮-এর মাধ্যমে প্রস্তাবনাসহ অনুচ্ছেদ ৮, ৪৮ ও ৫৬ সংশোধন বিষয়ে দুই-তৃতীয়াংশ ভোটের অতিরিক্ত গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের মাধ্যমে অনুমোদনের বিধান জুড়ে দেয়া হয়। অতঃপর পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে গণভোটের বিধান রহিত করত সংবিধানের প্রস্তাবনাসহ প্রথম ভাগের সব অনুচ্ছেদ, দ্বিতীয় ভাগের সব অনুচ্ছেদ, নবম ক-ভাগে বর্ণিত অনুচ্ছেদগুলোর বিধানাবলি সাপেক্ষে তৃতীয় ভাগের সব অনুচ্ছেদ এবং একাদশ ভাগের ১৫০ অনুচ্ছেদসহ সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক কাঠামোসংক্রান্ত অনুচ্ছেদগুলোর বিধানাবলি সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন, রহিতকরণ কিংবা অন্য কোনো পন্থায় সংশোধন অযোগ্য করা হয়।
সংবিধান একটি আইন। মানুষের প্রয়োজনে আইন, আইনের প্রয়োজনে মানুষ নয়। স্বাধীনতার ঘোষণা বিষয়ে প্রস্তাবনার সাথে অনুচ্ছেদ নং ১৫০(২) এবং ষষ্ঠ তফসিলের যে সাংঘর্ষিকতা সৃষ্টি হয়েছে তা প্রস্তাবনাকে সংশোধন অযোগ্য ও ক্রান্তিকালীন বিধানাবলির সময়সীমা সীমাবদ্ধকরণের মধ্যে বিতর্কের অবসান ঘটাবে, এমনটি যদি কেউ আশা করে তবে তা হবে জন-আকাক্সার প্রতি অসম্মান ও অশ্রদ্ধা। তাই যেকোনো ঐতিহাসিক বিষয়কে আইনের জটিল ঘোরপ্যাঁচে আবদ্ধ না রেখে ইতিহাসের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নির্ধারিত হতে দেয়ার মধ্যে নিহিত আছে যেকোনো ধরনের বিতর্কের অবসানসহ জন-আকাক্সার প্রতিফলনে দেশের স্থিতিশীলতা এবং সুখ ও সমৃদ্ধি।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
iktederahmed@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.