মালালা–কৈলাসের স্বপ্ন বনাম কাশ্মীর সীমান্ত by মহিউদ্দিন আহমদ
এ বছর ‘শান্তি’তে নোবেল পাওয়ার খবরটি সবার জানা। ভারতের প্রবীণ সমাজকর্মী কৈলাস সত্যার্থী এবং পাকিস্তানের কিশোরী মালালা ইউসুফজাই এই সম্মাননা পেয়েছেন। তাঁদের অভিনন্দন জানাই। প্রতিবছর নোবেল পুরস্কার ঘোষণার আগে থেকেই নানা জল্পনাকল্পনা চলে। এবার এটা একটু কমই হয়েছে। মালালাকে নোবেল দেওয়ার প্রস্তাব উঠেছিল আগেই। কৈলাস তেমন আলোচনায় ছিলেন না। ১০ ডিসেম্বর নরওয়ের অসলো শহরের সিটি হলে তাঁরা উপস্থিত হয়ে এই পুরস্কার গ্রহণ করবেন বলে আশা করা যায়। ১৮৯৫ সালে আলফ্রেড নোবেলের অন্তিম ইচ্ছা অনুযায়ী রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, চিকিৎসাশাস্ত্র, সাহিত্য ও শান্তি—এই পাঁচটি ক্ষেত্রে সৃজনশীল কাজ ও অবদান রাখার জন্য নোবেল পুরস্কার চালু হয়। ১৯০১ সাল থেকে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার ছিল না। তবে ব্যাংক অব সুইডেনের শতবার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে এই ব্যাংকের অনুদানে ১৯৬৯ সাল থেকে দেওয়া হচ্ছে ব্যাংক অব সুইডেন প্রাইজ ফর ইকোনমিক সায়েন্স ইন মেমোরি অব আলফ্রেড নোবেল পুরস্কার। পুরস্কারের অর্থমূল্য এবং বাছাই–প্রক্রিয়া একই হওয়ার কারণে এটাকেও নোবেল পুরস্কার হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। সব কটি পুরস্কার সুইডেনের রাজধানী স্টকহোম থেকে দেওয়া হয়। রাজা নিজেই এটা দেন। শুধু শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয় নরওয়ের অসলো শহরে। নরওয়ের রাজার উপস্থিতিতে এটা দেন নোবেল পুরস্কার কমিটির সভাপতি। এবার শান্তিতে নোবেল পুরস্কার নিয়ে পাকিস্তান ও ভারতে অনেক আলোচনা–সমালোচনা হচ্ছে। এই অঞ্চলের সব মানুষ সব সিদ্ধান্তে একমত হবেন, খুশি হবেন—এটা আশা করা যায় না।
মালালার ‘সকাল’টাই বলে দিচ্ছিল, তার দিনটা কেমন যাবে। মাত্র ১২ বছর বয়সে ২০০৯ সালে পাকিস্তানের সোয়াত উপত্যকায় তালেবানি উপদ্রব বন্ধ এবং শিক্ষার জন্য সর্বজনীন সুযোগ তৈরির আহ্বান জানিয়ে সে বিবিসির কাছে ছদ্মনামে একটা লেখা পাঠিয়েছিল। এ ছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকার কিংবদন্তি শান্তি-সংগঠক ডেসমন্ড টুটু আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কারের জন্য মালালার নাম প্রস্তাব করেছিলেন। ২০১২ সালের ৯ অক্টোবর বাসে চড়ে স্কুলে যাওয়ার পথে অজ্ঞাতনামা এক আততায়ী তার নাম জিজ্ঞেস করে, নিশ্চিত হয়ে, ঠান্ডা মাথায় তাকে তিনটি গুলি করেছিল। মালালার সৌভাগ্য, সে মারা যায়নি। প্রথমে পেশোয়ারের সামরিক হাসপাতালে এবং পরে বার্মিংহামের কুইন এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পর সে সেরে ওঠে এবং ব্রিটেনেই মা-বাবাকে নিয়ে নির্বাসিত জীবন যাপন করতে থাকে। দুনিয়াজুড়ে মেয়েশিশুদের শিক্ষার সুযোগ দেওয়ার দাবিতে যে আন্দোলন চলমান, মালালা তার সামনের কাতারের একজন লড়াকু যোদ্ধা।
গুলিবিদ্ধ হওয়ার তিন দিন পর, ১২ অক্টোবর, মালালার পক্ষে পাকিস্তানের ৫০ জন ইসলামি চিন্তাবিদ-ওলামা একটি বিবৃতি দিয়েছিলেন। কিন্তু তালেবানি সংগঠনগুলো তাকে হত্যা করার ফতোয়া জারি রেখেছে। পাকিস্তানের মূলধারার বড় রাজনৈতিক দলগুলো এ নিয়ে তেমন কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। সবার লক্ষ্য ‘মুসলমানের ভোট’। মালালা দেশে বিতাড়িত হয়েছে, কিন্তু দুনিয়াজুড়ে সে পেয়েছে আস্থা ও আশ্বাসের ঠাঁই। ২০১৩ সালের ১২ জুলাই জাতিসংঘের সদর দপ্তরে সে মেয়েশিশুদের শিক্ষার অবাধ সুযোগ দাবি করে এক আবেগস্পর্শী বক্তৃতা দিয়েছিল। হ্যালিফেক্সে ইউনিভার্সিটি অব কিংস কলেজ তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দেয়। এ ছাড়া সে অনেক দেশ ও সংগঠনের পরম আরাধ্য পুরস্কার পেয়েছে এবং পাচ্ছে। সর্বশেষ পেল নোবেল। মালালাকে নিয়ে স্ক্যান্ডাল কম হয়নি। একশ্রেণির গণমাধ্যমে ফলাও করে খবর ছড়ানো হয়েছিল, মালালা খ্রিষ্টান, সাম্রাজ্যবাদীদের সাজানো এক নাটকের কুশীলব। তাকে দিয়ে পাকিস্তানের ‘ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের’ শায়েস্তা করার জন্য গভীর একটি সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র হচ্ছে। আমার ধারণা এবং আশা, মালালা অনেক দূর এগিয়ে যাবে এবং মোল্লাতন্ত্রের কবল থেকে পাকিস্তানের নতুন প্রজন্মকে মুক্তি দিতে প্রেরণা জোগাবে।
কৈলাসের সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৮৬ সালের আগস্টে। এশিয়ান কালচারাল ফোরাম অন ডেভেলপমেন্টের (অ্যাকফোড) কাউন্সিল সভায় অংশ নিতে তিনি আর আমি ব্যাংককে গিয়েছিলাম। তখন থেকেই বন্ধুত্ব। এরপর দেখা হয়েছে অনেকবার। ১৯৯৬ সালের মার্চে কাঠমান্ডুতে অনুষ্ঠিত হলো ‘পিপলস প্ল্যান ফর টোয়েন্টি ওয়ান সেঞ্চুরি’সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সম্মেলন। কৈলাস ও আমি ছিলাম অন্যতম যুগ্ম আহ্বায়ক। এই সম্মেলনের অংশ হিসেবে আমরা ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক লেখক সম্মেলনের আয়োজন করেছিলাম। অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কবি শামসুর রাহমান সম্মেলনটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছিলেন। আর কৈলাস আয়োজন করেছিলেন কলকাতা থেকে কাঠমান্ডু পর্যন্ত অবিস্মরণীয় এক ‘চাইল্ড ওয়ার্কার্স মার্চ’। সদালাপী, হাসিখুশি, নিরহংকার কৈলাস পাজামা-কুর্তা পরেন সব সময়। নিরামিষ খাবার খান। রঁাধেনও ভালো। জন্ম ভারতের মধ্যপ্রদেশে। পরিবার নিয়ে বাস করেন নয়াদিল্লিতে। তড়িৎ প্রকৌশলে স্নাতক। অল্প কয়েক দিন একটি কলেজে শিক্ষকতাও করেছেন। ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন উন্নয়ন সংস্থা ‘বাচপান বাঁচাও আন্দোলন’। শিশু শ্রমিকদের নিয়ে এই সংগঠনের কাজ। সংগঠনটির মূল দাবি হলো, আইন করে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করতে হবে। এ নিয়ে ভারতে (এবং আমাদের দেশেও) এনজিওগুলোর মধ্যে বিভক্তি আছে। আছে নানান ডিসকোর্স এবং মতামতের স্কুল।
ইতিমধ্যে মালালাকে নিয়ে পাকিস্তানে টানাহেঁচড়া শুরু হয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে সম্রাট আকবরের সভাসদ ফার্সি কবি উর্ফির উদ্ধৃতি উল্লেখ করা যেতে পারে: উর্ফি, তু মা আন্দেশ যা ঘোখায়ে রাকীবান, আওয়াজ এ শুগান কুম না কুনাদ রিয্ক এ গুদ্দারা (উর্ফি, ভয় পেয়ো না, তোমার ঈর্ষাকাতর প্রতিদ্বন্দ্বীদের চিৎকার শুনে, কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ ফকিরের খাবার কমাতে পারে না)। অনেকেই মনে করেন, শিশুশ্রম তুলে দিলে ওরা খাবে কী। এ নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। অনেকেই কৈলাসকে পশ্চিমাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নকারী একজন ‘দালাল’ হিসেবে মনে করেন। এ ছাড়া একদল মানুষ আছেন, যাঁরা মনে করেন ‘এনজিও’ মানেই সাম্রাজ্যবাদের দালাল। আর জোরেশোরে ‘সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক’ স্লোগান যাঁরা দেন, তাঁরা সবাই ফেরেশতা। এ রকম একটি এনজিওর কর্ণধার নোবেল পেয়ে যাওয়ায় অন্যরা যে কী রকম গোস্বা হবেন, তা বলাই বাহুল্য।
১০-১২ বছর আগে ‘বাচপান বাঁচাও আন্দোলন’ নিয়ে বিবিসি একটা ডকুমেন্টারি তৈরি করেছিল। কৈলাসদের মোদ্দা কথা হলো, শিশুশ্রম আছে সমাজে, এটা একটা বাস্তবতা। কিন্তু এটা অনৈতিক এবং তা নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। শিশুদের জন্য বিকল্প উদ্ভাবনের দায় হলো রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র তার দায়িত্ব পালন করছে না। অন্যান্য বিষয়ে নোবেল পুরস্কার যাঁরা পান, তারা ওই সব বিষয়ের টেকনিক্যাল দিকটির ক্ষেত্রে সবাই বিশেষজ্ঞ। সাহিত্যে নোবেল দেওয়া নিয়ে রাজনীতির অভিযোগ বরাবরই ছিল, বিশেষ করে যখন যুযুধান দুই শিবিরের মধ্যে চলেছিল শীতল লড়াই। শান্তিতে নোবেল পুরস্কার নিয়ে রাজনীতির অভিযোগ বেশ পুরোনো। এ বিতর্ক আগেও ছিল, এখনো আছে। ১৯৭৩ সালে প্যারিসে ভিয়েতনামের সঙ্গে শান্তি আলোচনা শেষে যুদ্ধবিরতি চুক্তি সই হওয়ার পর ভিয়েতনাম ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যথাক্রমে লে ডাক থো ও হেনরি কিসিঞ্জারকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। তখন বিতর্ক বেশ জমে উঠেছিল। লে ডাক থো পুরস্কার গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিেয়ছিলেন। নোবেল কমিটির দুজন সদস্য পদত্যাগ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটেও চুক্তিটি অনুমোদন করা হয়নি। অন্য যাঁদের নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে আছেন মিখাইল গর্বাচভ, আইজ্যাক রবিন, মেনাহিম বেগিন, ইয়াসির আরাফাত, জিমি কার্টার, আল গোর, বারাক ওবামা এবং সবশেষে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
শান্তি পুরস্কার যাঁদের সত্যিকার অর্থেই প্রাপ্য ছিল, তাঁদের কেউ কেউ নির্বাচিত হননি। এ নিয়েও ক্ষোভ আছে মানুষের। উদাহরণস্বরূপ, গান্ধীর পক্ষে মনোনয়ন জমা পড়েছিল ১৯৩৭, ১৯৩৮, ১৯৩৯, ১৯৪৭ ও ১৯৪৮ সালে। কোনোবারই তিনি চূড়ান্ত পর্বে নির্বাচিত হননি। ১৯৪৮ সালে তাঁকে এটা দেওয়া হয়নি এই যুক্তিতে যে, নোবেল পুরস্কার মৃত ব্যক্তিকে দেওয়ার বিধান নেই। ওই বছর নোবেল কমিটি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছিল, উপযুক্ত প্রার্থী না থাকার কারণে এ বছর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হলো না। পরে প্রকাশ্য ঘোষণায় নোবেল কমিটি গান্ধীকে নোবেল পুরস্কার না দিতে পারার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছিল। নোবেল পাওয়া না–পাওয়া নিয়ে ক্ষোভ কিংবা বিতর্ক থাকতেই পারে। কিন্তু সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণে খোলামকুচির মতো এই পুরস্কার বিলানো হয়, এই ধারণাও ঠিক নয়। মনোনয়ন–প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল। শান্তি পুরস্কারের ব্যাপারে যাঁরা প্রাথমিক মনোনয়ন প্রস্তাব দিতে পারেন তাঁরা হলেন: পার্লামেন্টের সদস্য অথবা কোনো দেশের সরকার, ইন্টার-পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন, পার্মানেন্ট কোর্ট অব আরবিট্রেশন এবং আন্তর্জাতিক আদালতের সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় বিভাগের অধ্যাপক এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, আগে যাঁরা নোবেল পেয়েছেন, নরওয়েজীয় নোবেল কমিটির বর্তমান ও ভূতপূর্ব সদস্য এবং নরওয়েজীয় নোবেল কমিটির সাবেক পরামর্শক। তাঁদের দেওয়া প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত করার কাজটি করে নরওয়ের নোবেল কমিটি। এই কমিটি তৈরি হয় নরওয়ের পার্লামেন্টের সদস্যদের দ্বারা। মনোনয়ন প্রস্তাব থাকে অনেক। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৯ সালে মনোনয়ন জমা পড়েছিল ২০৫টি, ২০১০ সালে ২৩৭টি এবং ২০১১ সালে ২৪১টি। সুতরাং বাছাই–প্রক্রিয়াটি বেশ লম্বা ও জটিল। তার পরও বিতর্ক থাকে। কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তান ও ভারতের সীমান্তরক্ষীরা পরস্পরের দিকে রাইফেল-কামান তাক করে আছে। কয়েক দিন ধরে গোলাগুলিও হচ্ছে। এ রকম একটি উত্তপ্ত সময়ে এই দুই দেশের দুজন শান্তি পুরস্কার পেলেন অভিন্ন বিষয়ে কাজ করার জন্য। তাঁদের উভয়ের কর্মক্ষেত্র হচ্ছে শিশুদের কল্যাণ, সুরক্ষা ও সমৃদ্ধি। আমরা আশা করতেই পারি, এই একটি বিষয়ে উভয় দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে ঐকমত্য হবে। যত ঝগড়াবিবাদ থাকুক, আমাদের শিশুদের জন্য আমরা এই পৃথিবী বাসযোগ্য করব—এই হোক অঙ্গীকার।
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
mohi2005@gmail.com
মালালার ‘সকাল’টাই বলে দিচ্ছিল, তার দিনটা কেমন যাবে। মাত্র ১২ বছর বয়সে ২০০৯ সালে পাকিস্তানের সোয়াত উপত্যকায় তালেবানি উপদ্রব বন্ধ এবং শিক্ষার জন্য সর্বজনীন সুযোগ তৈরির আহ্বান জানিয়ে সে বিবিসির কাছে ছদ্মনামে একটা লেখা পাঠিয়েছিল। এ ছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকার কিংবদন্তি শান্তি-সংগঠক ডেসমন্ড টুটু আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কারের জন্য মালালার নাম প্রস্তাব করেছিলেন। ২০১২ সালের ৯ অক্টোবর বাসে চড়ে স্কুলে যাওয়ার পথে অজ্ঞাতনামা এক আততায়ী তার নাম জিজ্ঞেস করে, নিশ্চিত হয়ে, ঠান্ডা মাথায় তাকে তিনটি গুলি করেছিল। মালালার সৌভাগ্য, সে মারা যায়নি। প্রথমে পেশোয়ারের সামরিক হাসপাতালে এবং পরে বার্মিংহামের কুইন এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পর সে সেরে ওঠে এবং ব্রিটেনেই মা-বাবাকে নিয়ে নির্বাসিত জীবন যাপন করতে থাকে। দুনিয়াজুড়ে মেয়েশিশুদের শিক্ষার সুযোগ দেওয়ার দাবিতে যে আন্দোলন চলমান, মালালা তার সামনের কাতারের একজন লড়াকু যোদ্ধা।
গুলিবিদ্ধ হওয়ার তিন দিন পর, ১২ অক্টোবর, মালালার পক্ষে পাকিস্তানের ৫০ জন ইসলামি চিন্তাবিদ-ওলামা একটি বিবৃতি দিয়েছিলেন। কিন্তু তালেবানি সংগঠনগুলো তাকে হত্যা করার ফতোয়া জারি রেখেছে। পাকিস্তানের মূলধারার বড় রাজনৈতিক দলগুলো এ নিয়ে তেমন কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। সবার লক্ষ্য ‘মুসলমানের ভোট’। মালালা দেশে বিতাড়িত হয়েছে, কিন্তু দুনিয়াজুড়ে সে পেয়েছে আস্থা ও আশ্বাসের ঠাঁই। ২০১৩ সালের ১২ জুলাই জাতিসংঘের সদর দপ্তরে সে মেয়েশিশুদের শিক্ষার অবাধ সুযোগ দাবি করে এক আবেগস্পর্শী বক্তৃতা দিয়েছিল। হ্যালিফেক্সে ইউনিভার্সিটি অব কিংস কলেজ তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দেয়। এ ছাড়া সে অনেক দেশ ও সংগঠনের পরম আরাধ্য পুরস্কার পেয়েছে এবং পাচ্ছে। সর্বশেষ পেল নোবেল। মালালাকে নিয়ে স্ক্যান্ডাল কম হয়নি। একশ্রেণির গণমাধ্যমে ফলাও করে খবর ছড়ানো হয়েছিল, মালালা খ্রিষ্টান, সাম্রাজ্যবাদীদের সাজানো এক নাটকের কুশীলব। তাকে দিয়ে পাকিস্তানের ‘ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের’ শায়েস্তা করার জন্য গভীর একটি সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র হচ্ছে। আমার ধারণা এবং আশা, মালালা অনেক দূর এগিয়ে যাবে এবং মোল্লাতন্ত্রের কবল থেকে পাকিস্তানের নতুন প্রজন্মকে মুক্তি দিতে প্রেরণা জোগাবে।
কৈলাসের সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৮৬ সালের আগস্টে। এশিয়ান কালচারাল ফোরাম অন ডেভেলপমেন্টের (অ্যাকফোড) কাউন্সিল সভায় অংশ নিতে তিনি আর আমি ব্যাংককে গিয়েছিলাম। তখন থেকেই বন্ধুত্ব। এরপর দেখা হয়েছে অনেকবার। ১৯৯৬ সালের মার্চে কাঠমান্ডুতে অনুষ্ঠিত হলো ‘পিপলস প্ল্যান ফর টোয়েন্টি ওয়ান সেঞ্চুরি’সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সম্মেলন। কৈলাস ও আমি ছিলাম অন্যতম যুগ্ম আহ্বায়ক। এই সম্মেলনের অংশ হিসেবে আমরা ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক লেখক সম্মেলনের আয়োজন করেছিলাম। অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কবি শামসুর রাহমান সম্মেলনটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছিলেন। আর কৈলাস আয়োজন করেছিলেন কলকাতা থেকে কাঠমান্ডু পর্যন্ত অবিস্মরণীয় এক ‘চাইল্ড ওয়ার্কার্স মার্চ’। সদালাপী, হাসিখুশি, নিরহংকার কৈলাস পাজামা-কুর্তা পরেন সব সময়। নিরামিষ খাবার খান। রঁাধেনও ভালো। জন্ম ভারতের মধ্যপ্রদেশে। পরিবার নিয়ে বাস করেন নয়াদিল্লিতে। তড়িৎ প্রকৌশলে স্নাতক। অল্প কয়েক দিন একটি কলেজে শিক্ষকতাও করেছেন। ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন উন্নয়ন সংস্থা ‘বাচপান বাঁচাও আন্দোলন’। শিশু শ্রমিকদের নিয়ে এই সংগঠনের কাজ। সংগঠনটির মূল দাবি হলো, আইন করে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করতে হবে। এ নিয়ে ভারতে (এবং আমাদের দেশেও) এনজিওগুলোর মধ্যে বিভক্তি আছে। আছে নানান ডিসকোর্স এবং মতামতের স্কুল।
ইতিমধ্যে মালালাকে নিয়ে পাকিস্তানে টানাহেঁচড়া শুরু হয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে সম্রাট আকবরের সভাসদ ফার্সি কবি উর্ফির উদ্ধৃতি উল্লেখ করা যেতে পারে: উর্ফি, তু মা আন্দেশ যা ঘোখায়ে রাকীবান, আওয়াজ এ শুগান কুম না কুনাদ রিয্ক এ গুদ্দারা (উর্ফি, ভয় পেয়ো না, তোমার ঈর্ষাকাতর প্রতিদ্বন্দ্বীদের চিৎকার শুনে, কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ ফকিরের খাবার কমাতে পারে না)। অনেকেই মনে করেন, শিশুশ্রম তুলে দিলে ওরা খাবে কী। এ নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। অনেকেই কৈলাসকে পশ্চিমাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নকারী একজন ‘দালাল’ হিসেবে মনে করেন। এ ছাড়া একদল মানুষ আছেন, যাঁরা মনে করেন ‘এনজিও’ মানেই সাম্রাজ্যবাদের দালাল। আর জোরেশোরে ‘সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক’ স্লোগান যাঁরা দেন, তাঁরা সবাই ফেরেশতা। এ রকম একটি এনজিওর কর্ণধার নোবেল পেয়ে যাওয়ায় অন্যরা যে কী রকম গোস্বা হবেন, তা বলাই বাহুল্য।
১০-১২ বছর আগে ‘বাচপান বাঁচাও আন্দোলন’ নিয়ে বিবিসি একটা ডকুমেন্টারি তৈরি করেছিল। কৈলাসদের মোদ্দা কথা হলো, শিশুশ্রম আছে সমাজে, এটা একটা বাস্তবতা। কিন্তু এটা অনৈতিক এবং তা নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। শিশুদের জন্য বিকল্প উদ্ভাবনের দায় হলো রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র তার দায়িত্ব পালন করছে না। অন্যান্য বিষয়ে নোবেল পুরস্কার যাঁরা পান, তারা ওই সব বিষয়ের টেকনিক্যাল দিকটির ক্ষেত্রে সবাই বিশেষজ্ঞ। সাহিত্যে নোবেল দেওয়া নিয়ে রাজনীতির অভিযোগ বরাবরই ছিল, বিশেষ করে যখন যুযুধান দুই শিবিরের মধ্যে চলেছিল শীতল লড়াই। শান্তিতে নোবেল পুরস্কার নিয়ে রাজনীতির অভিযোগ বেশ পুরোনো। এ বিতর্ক আগেও ছিল, এখনো আছে। ১৯৭৩ সালে প্যারিসে ভিয়েতনামের সঙ্গে শান্তি আলোচনা শেষে যুদ্ধবিরতি চুক্তি সই হওয়ার পর ভিয়েতনাম ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যথাক্রমে লে ডাক থো ও হেনরি কিসিঞ্জারকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। তখন বিতর্ক বেশ জমে উঠেছিল। লে ডাক থো পুরস্কার গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিেয়ছিলেন। নোবেল কমিটির দুজন সদস্য পদত্যাগ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটেও চুক্তিটি অনুমোদন করা হয়নি। অন্য যাঁদের নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে আছেন মিখাইল গর্বাচভ, আইজ্যাক রবিন, মেনাহিম বেগিন, ইয়াসির আরাফাত, জিমি কার্টার, আল গোর, বারাক ওবামা এবং সবশেষে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
শান্তি পুরস্কার যাঁদের সত্যিকার অর্থেই প্রাপ্য ছিল, তাঁদের কেউ কেউ নির্বাচিত হননি। এ নিয়েও ক্ষোভ আছে মানুষের। উদাহরণস্বরূপ, গান্ধীর পক্ষে মনোনয়ন জমা পড়েছিল ১৯৩৭, ১৯৩৮, ১৯৩৯, ১৯৪৭ ও ১৯৪৮ সালে। কোনোবারই তিনি চূড়ান্ত পর্বে নির্বাচিত হননি। ১৯৪৮ সালে তাঁকে এটা দেওয়া হয়নি এই যুক্তিতে যে, নোবেল পুরস্কার মৃত ব্যক্তিকে দেওয়ার বিধান নেই। ওই বছর নোবেল কমিটি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছিল, উপযুক্ত প্রার্থী না থাকার কারণে এ বছর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হলো না। পরে প্রকাশ্য ঘোষণায় নোবেল কমিটি গান্ধীকে নোবেল পুরস্কার না দিতে পারার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছিল। নোবেল পাওয়া না–পাওয়া নিয়ে ক্ষোভ কিংবা বিতর্ক থাকতেই পারে। কিন্তু সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণে খোলামকুচির মতো এই পুরস্কার বিলানো হয়, এই ধারণাও ঠিক নয়। মনোনয়ন–প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল। শান্তি পুরস্কারের ব্যাপারে যাঁরা প্রাথমিক মনোনয়ন প্রস্তাব দিতে পারেন তাঁরা হলেন: পার্লামেন্টের সদস্য অথবা কোনো দেশের সরকার, ইন্টার-পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন, পার্মানেন্ট কোর্ট অব আরবিট্রেশন এবং আন্তর্জাতিক আদালতের সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় বিভাগের অধ্যাপক এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, আগে যাঁরা নোবেল পেয়েছেন, নরওয়েজীয় নোবেল কমিটির বর্তমান ও ভূতপূর্ব সদস্য এবং নরওয়েজীয় নোবেল কমিটির সাবেক পরামর্শক। তাঁদের দেওয়া প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত করার কাজটি করে নরওয়ের নোবেল কমিটি। এই কমিটি তৈরি হয় নরওয়ের পার্লামেন্টের সদস্যদের দ্বারা। মনোনয়ন প্রস্তাব থাকে অনেক। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৯ সালে মনোনয়ন জমা পড়েছিল ২০৫টি, ২০১০ সালে ২৩৭টি এবং ২০১১ সালে ২৪১টি। সুতরাং বাছাই–প্রক্রিয়াটি বেশ লম্বা ও জটিল। তার পরও বিতর্ক থাকে। কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তান ও ভারতের সীমান্তরক্ষীরা পরস্পরের দিকে রাইফেল-কামান তাক করে আছে। কয়েক দিন ধরে গোলাগুলিও হচ্ছে। এ রকম একটি উত্তপ্ত সময়ে এই দুই দেশের দুজন শান্তি পুরস্কার পেলেন অভিন্ন বিষয়ে কাজ করার জন্য। তাঁদের উভয়ের কর্মক্ষেত্র হচ্ছে শিশুদের কল্যাণ, সুরক্ষা ও সমৃদ্ধি। আমরা আশা করতেই পারি, এই একটি বিষয়ে উভয় দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে ঐকমত্য হবে। যত ঝগড়াবিবাদ থাকুক, আমাদের শিশুদের জন্য আমরা এই পৃথিবী বাসযোগ্য করব—এই হোক অঙ্গীকার।
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
mohi2005@gmail.com
No comments