শিশুদের জন্য নোবেল
শান্তির জন্য এবারের নোবেল পুরস্কার বাস্তবিকই শিশুদের জন্য। শিশুশ্রমবিরোধী আন্দোলনের কর্মী ভারতের কৈলাশ সত্যার্থী এবং নারীশিক্ষা আন্দোলনের পরিচিত মুখ পাকিস্তানের মালালা ইউসুফজাইয়ের হাত ধরে এবারের নোবেল শান্তি পুরস্কার এসেছে ভারত এবং পাকিস্তানে। দুদেশের সীমান্তে যখন গোলাগুলি চলছে, তখন তারই মাঝে দুই দেশের দুই প্রতিনিধির যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপ্তি শুধু আনন্দের নয়, যথেষ্ট শিক্ষণীয় এবং বার্তাবহও বটে। নোবেল কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘শিশু ও তরুণদের শোষণের বিরুদ্ধে এবং সকল শিশুর শিক্ষার অধিকারের দাবিতে তাদের সংগ্রামের জন্য এই পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে।’ পাকিস্তানে নারীশিক্ষা নিয়ে সোচ্চার হয়ে সন্ত্রাসবাদী তালেবানদের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছিলেন মালালা ইউসুফজাই। তালেবানদের হুমকির মুখে পড়েও তিনি শিক্ষার দাবি থেকে সরে আসেননি। ফলে আক্রমণের শিকারও হয়েছিলেন। ২০১২ সালের অক্টোবরে পাকিস্তানের সোয়াত উপত্যকায় এক তালেবানি সন্ত্রাসবাদী সরাসরি তার মাথা লক্ষ্য করে গুলি করে। দীর্ঘ লড়াই করে প্রায় মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসেন মালালা। তবু দমে যাননি, শিক্ষার জন্য আবার লড়াইতে ফিরে গেছেন। বর্তমানে তিনি বিশ্বের বহু দেশেই অল্পবয়সী মেয়েদের শিক্ষার অধিকারের জন্য সংগ্রামের প্রতীক। বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ নোবেল প্রাপক তিনিই। তাকে নোবেল পুরস্কার প্রদানের ফলে নারীশিক্ষার সংগ্রাম সর্বত্রই শক্তিশালী হবে বলে আশা করা যায়। একইসঙ্গে ভারতে শিশুশ্রমবিরোধী আন্দোলনের অগ্রণী কর্মী কৈলাশ সত্যার্থীর নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তিও প্রবল উৎসাহব্যঞ্জক। মধ্যপ্রদেশে জন্ম নেয়া এই ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার দিল্লিতে গরিব শিশুদের পাঠ্যবই দিয়ে সাহায্য করার মধ্যে দিয়ে শিশুশ্রমবিরোধী আন্দোলনে নেমেছিলেন, তারপর তার ‘বচপন বাঁচাও আন্দোলন’ বহু শিশুশ্রমিককে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে সাহায্য করেছে। এর আগে ১৯৭৯-তে শান্তিতে মাদার তেরেসা নোবেল পেয়েছিলেন। এবার কৈলাস সত্যার্থী পেলেন, নোবেল প্রাপ্তির নিরিখে তিনি সপ্তম ভারতীয়। নিঃসন্দেহে বিষয়টি ভারতীয়দের কাছে গৌরবের। কিন্তু এই গৌরবের আলো দিয়ে অন্ধকার দিকটি ঢাকা যাবে না। সেটা হলো ভারতে শিশুশ্রমিকদের ভয়ানক সংখ্যাতত্ত্ব। ২০০১ সালের জনগণনার হিসাব অনুসারে ভারতে প্রায় দেড় কোটি শিশু শ্রমিক রয়েছেন যাদের বয়স ৫ থেকে ১৪বছরের মধ্যে। সংখ্যাটা পরবর্তী জনগণনার হিসাবে সামান্যই কমেছে। ইউনিসেফের মতে, বিশ্বের সর্বাধিক শিশুশ্রমিক রয়েছে ভারতেই। আরো লজ্জার বিষয় হলো এই যে, শিশু শ্রমিকদের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বিপজ্জনক পেশায় নিযুক্ত রয়েছে। এবং একাংশ বন্ডেড লেবার বা দাসশ্রমিকের মতো জীবন কাটাচ্ছে। সাধারণভাবে মিডিয়ার প্রচার আলো সবসময় এইসব দিকে পড়ে না। তবে কখনো কখনো কোনো বাজি কারখানায় কিংবা অলঙ্কার শিল্পক্ষেত্রে অগ্নিকাণ্ডে বহু শিশুর একসঙ্গে পুড়ে মৃত্যুর সংবাদ প্রকাশিত হয়। শিশুশ্রমিক বিরোধী একটি কঠোর আইন ভারত সরকার তৈরি করেছে, তাও দশ বছরের বেশি সময় হয়ে গেছে। কিন্তু তাতে লাভ কী হয়েছে? বাস্তবে শিশুশ্রম সমস্যার মূলে রয়েছে সমাজের অর্থনৈতিক সমস্যা। রাষ্ট্র আইন করে শিশুশ্রমিক নিষিদ্ধ করলেও ভারতে শিশুদের মা বাবাই তাদের কাজের জন্য রেস্তোরাঁতে অথবা গৃহস্থ বাড়িতে পাঠান, চায়ের দোকানে বসান অথবা চাষের কাজে সঙ্গে করে মাঠে নিয়ে যান। উল্টো দিকে শিশুশ্রমের সহজলভ্যতায় অনেকের লাভও হয়, কম পয়সায় অথবা কখনো বিনা মজুরিতেই শিশুশ্রমিক পাওয়ার সুযোগ তারা কাজে লাগান। এক কথায়, দারিদ্র্যের সমস্যাই শিশুশ্রমিকদের জন্ম দিচ্ছে। আমাদের দেশে এখনো বহু পরিবারে শিশুদের স্কুলে পাঠানো ও শৈশব যাপন করতে দেয়া এক ব্যয়সাধ্য বিলাসিতা। রাষ্ট্র যদি এই শিশুদের শৈশব ফিরিয়ে দেয়ার জন্য দায়িত্ববোধ অনুভব না করে তবে দু একটি এনজিও –র ভালো কাজে পরিস্থিতির প্রকৃত পরিবর্তন ঘটবে না। শান্তির জন্য এবারের নোবেল প্রাপ্তি রাষ্ট্রকে সেই বার্তাই দিক।
No comments