সরল গরল- ‘সংবিধান রক্ষায়’ সংবিধানবিচ্যুত শপথ by মিজানুর রহমান খান
ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুই দেশ শাসন করেছিলেন ১৬৪৩ থেকে ৭২ বছরের বেশি। ‘আমিই রাষ্ট্র’ কথাটি তাঁর জবানিতেই পরিচিত। অপ্রয়োজনে সংবিধান থেকে সরে আজই শপথ এবং ১২ জানুয়ারির মধ্যে নতুন সরকার গঠনের প্রশ্নবিদ্ধ উদ্যোগ দেখে লুইয়ের কয়েকটি উদ্ধৃতি স্মরণে আসছে।
লুই বলেছিলেন, ‘যে ব্যক্তি নিজেকে জয় করতে পারে, তার সামনে আর সামান্যই কিছু টিকতে পারে।’ অবশ্য তিনি তাঁর অন্তিম শয়ানে বলেছিলেন, ‘আমি চলে যাচ্ছি কিন্তু রাষ্ট্র সর্বদাই টিকে থাকবে।’
রকিব উদ্দীন কমিশন গতকাল গেজেট করে যা করল, তাতে মনে হয় তাঁরা লুইয়ের সপ্তদশ শতাব্দীর রাজকর্মচারী। তাঁরা লুইয়ের মনোবাঞ্ছা পূরণ করছেন। লুই বলতেন, ‘এটা আইনসম্মত, কারণ এটাই আমার অভিপ্রায়।’ এখন সরকার সংসদ ভাঙছে না অথচ ইসিকে দিয়ে সংবিধান ভাঙাচ্ছে। সরকারি মন্ত্রণাদাতারা ও তাদের তথাকথিত শুভানুধ্যায়ীরা উদ্ভট ও অসাংবিধানিক মন্ত্রণা দিচ্ছেন। তাঁরা নাকি বলছেন, নবম সংসদ ভাঙতে হবে না। শপথ নিলে এবং দশম সংসদ ডাকলেই নবম সংসদ বিলুপ্ত হবে। অথচ সংবিধান বলেছে, শুধু দুভাবে সংসদ লুপ্ত হবে। প্রথমত প্রধানমন্ত্রীর লিখিত পরামর্শে রাষ্ট্রপতির আদেশে। দ্বিতীয়ত প্রথম বৈঠক থেকে পাঁচ বছরের মেয়াদ পুরা হলে। এটা পুরা হবে ২৪ জানুয়ারি। এই তারিখ এলেই তবে সংসদ আপনাআপনি ভাঙবে। কাউকে ভাঙতে হবে না। এখন নাকি সিদ্ধান্ত হয়েছে, সংসদ ভাঙতে রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দেওয়া হবে না। ২৪ জানুয়ারির জন্য অপেক্ষাও করা হবে না। তালি বাজিয়ে নবম সংসদ উধাও করে দেওয়া হবে।
রাষ্ট্রপতি, স্পিকার ও প্রত্যেক নির্বাচন কমিশনার শপথ নিয়েছিলেন, আমি সংবিধানের রক্ষণ ও সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করব। আইন অনুযায়ী ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে আমার পদের কর্তব্য পালন করব এবং আমার সরকারি কার্য ও সরকারি সিদ্ধান্তকে ব্যক্তিগত স্বার্থের দ্বারা প্রভাবিত হতে দেব না।
গতকাল নতুন নির্বাচনের ফলাফল সরকারি বিজ্ঞপ্তি দ্বারা প্রকাশ করে ইসি সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদের তিন দফার শর্ত নির্দিষ্টভাবে লঙ্ঘন করল। স্পিকার শপথ পড়ানোর দায়িত্ব নিয়ে তাঁর শপথও লঙ্ঘন করলেন। এরপর বাকি থাকবেন রাষ্ট্রপতি।
১২৩ অনুচ্ছেদের বিধান নিম্নরূপ: ‘(৩) সংসদ-সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে (ক) মেয়াদ-অবসানের কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙ্গিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে: এবং (খ) মেয়াদ-অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙ্গিয়া যাইবার পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে: তবে শর্ত থাকে যে, এই দফার (ক) উপ-দফা অনুযায়ী অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত ব্যক্তিগণ, উক্ত উপ-দফায় উল্লিখিত মেয়াদ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত সংসদ-সদস্যরূপে কার্যভার গ্রহণ করিবেন না।’ দশম সংসদ নির্বাচন ওই (ক) উপদফা মতে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সুতরাং সংবিধান বলেছে, ‘নির্বাচিত ব্যক্তিগণ’ আগামী ২৪ জানুয়ারি অর্থাৎ ‘মেয়াদ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত সংসদ-সদস্যরূপে কার্যভার গ্রহণ করবেন না।’ কিন্তু শপথ নিয়ে আজই তাঁরা কার্যভার গ্রহণ করছেন।
সংবিধানের ১৪৮ অনুচ্ছেদের ২(ক) দফায় শপথের বিধান আছে। তাই ১২৩ ও ১৪৮ অনুচ্ছেদ মিলিয়ে পড়তে হবে। ১৪৮(২ক) বলেছে, ‘১২৩ অনুচ্ছেদের (৩) দফার অধীন অনুষ্ঠিত সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপিত হওয়ার তারিখ হতে পরবর্তী তিন দিনের মধ্যে’ শপথ পড়াতে হবে। এই অনুচ্ছেদেরই ৩ উপদফা বলেছে, শপথ মাত্রই কার্যভার গ্রহণ।
ইসি যদি ২৩ জানুয়ারিতেও গেজেট প্রকাশ করত, তাহলে ২৫ জানুয়ারিতেই শপথ পড়ানো সম্ভব ছিল। বহুল উচ্চারিত ‘সংবিধান রক্ষার’ জন্য তারা ১৫ দিন সময় অপেক্ষা করতে পারেনি।
এর আগে ২৪ জানুয়ারির পর নতুন সরকারের শপথ গ্রহণের চিন্তাভাবনা ছিল। এখন ‘সংখ্যালঘুদের ওপর হামলাসহ বিদ্যমান পরিস্থিতির’ কথা বিবেচনা করে দ্রুততম সময়ে শপথ গ্রহণ করা হচ্ছে। পত্রিকায় এসেছে, গত সোমবার রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনা করে শপথের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটা বিশ্বাস করা কঠিন যে, রাষ্ট্রপতি সংবিধান ভঙ্গ করার সভায় পৌরোহিত্য করেছেন।
শাসকগণ প্রমাণ দিচ্ছেন, মাত্র ১৫ দিন বিলম্বের চেয়ে সংবিধান ভাঙা অনেক সহজ। অথচ এঁরাই সংবিধানের কোনো বিচ্যুতি ঘটালেও বিরাট শাস্তির বিধান করেছেন।
শাসকেরা চাইলেই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সংবিধান সংশোধন করে ১২৩ অনুচ্ছেদের ওই শর্তাংশ মুছে ফেলতে পারতেন। কিন্তু তাতে বদনাম হবে। লোকে ধরে ফেলবে। সংবিধানে সংশোধনী আনা বদনামের। কিন্তু তাকে দলিতকরণ দোষণীয় বা দণ্ডনীয় নয়। লোকে ধরতে পারবে না। আমরা তথাকথিত সাংবিধানিক শাসনে কতটা আছি, এটা তার আরেকটি প্রমাণ।
রকিব কমিশন সংবিধান ভাঙল। শপথ পড়ালে স্পিকারও তার ভাগীদার হবেন। এখন দেখতে হবে, রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী হতে শেখ হাসিনাকে কবে কখন আমন্ত্রণ জানান। রাষ্ট্রপতি এটা করলে তাঁর তরফে একটি নির্দিষ্ট সাংবিধানিক বিচ্যুতি ঘটানো হবে। তিনি যদি সরকার করার আমন্ত্রণ জানাতে আরও ১৫ দিন সময় নেন, তাহলে সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদ বেঁচে যাবে। আমরা বুঝতে অপারগ থাকব, নবম সংসদের সত্তা মাঘের কুয়াশায় মিলিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত কী করে তিনি দশম সংসদ ডাকবেন।
২৪ জানুয়ারির আগে রাষ্ট্রপতি দশম সংসদের কোনো সদস্যকে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বৈধভাবে নিয়োগ দিতে পারেন না। কারণ সংবিধানের ৫৬(৩) অনুচ্ছেদ বলেছে, ‘যে সংসদ সদস্য সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন বলে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রতীয়মান হবেন, রাষ্ট্রপতি তাকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করবেন।’ কিন্তু সংবিধানমতে আমি তো ২৪ জানুয়ারির আগে কার্যভার গ্রহণ-উপযোগী কোনো ‘সংসদ সদস্য’ দেখি না। সংবিধানবহির্ভূত শপথ আইনের চোখে বৈধ শপথ হবে না। তাই রাষ্ট্রপতি তাঁদেরকে সরকার গড়তে আহ্বান জানাতে বাধ্য নন। শুনেছি, রাষ্ট্রপতি সঠিক পরামর্শ দিয়ে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে।
এখন রাষ্ট্রপতি যদি ২৪ জানুয়ারির আগে দশম সংসদের কোনো সদস্যকে প্রধানমন্ত্রী হতে আমন্ত্রণ জানান, তাহলে তিনি সংবিধানের ১২৩ ও ৫৬ অনুচ্ছেদ লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত হবেন। রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসনের ক্ষেত্র সৃষ্টি হবে।
যেকোনো ধরনের সম্ভাব্য পরিস্থিতি সংবিধান কল্পনা করেছিল। তাই ৫৭(৩) অনুচ্ছেদ বলেছে, ‘প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে স্বীয় পদে বহাল থাকতে কোনো কিছুই অযোগ্য করবে না।’
আসলে ভয় পেয়েছে আওয়ামী লীগ। নৈতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ দলটি এখন তাদের লব্ধ ‘বিজয়’ হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে শঙ্কিত। তাই সংবিধানের এমন শক্তিশালী রক্ষাকবচ সত্ত্বেও কখন কী হয় এ প্রশ্ন তাদের তাড়া করে ফিরছে।
বস্তুত তাঁরা রাজার ইচ্ছা পূরণ করছেন। সংবিধানবিচ্যুত হয়ে সংবিধান রক্ষণের শপথ আজ। এই রাষ্ট্রে কার কাছে এর প্রতিকার চাইব?
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
No comments