বিচারপতি ড. পাল ও জাপান by প্রবীর বিকাশ সরকার
জাতীয় ক্ষেত্রে সংরক্ষণ, প্রদর্শন ও
প্রচার না থাকার কারণে বাঙালি জাতির বহু কীর্তি যেমন বিলুপ্ত হয়ে গেছে,
তেমনি কীর্তিমান মানুষও মিলিয়ে গেছেন, না হয় বিলীয়মান। বিশ্বনন্দিত
বিচারপতি ড. রাধাবিনোদ পালকে (২৬ জানুয়ারি ১৮৮৬-১০ জানুয়ারি ১৯৬৭) ভারত
ভুলে গেছে; বাংলাদেশ তাকে জানেই না। কিন্তু সুপ্রতিষ্ঠিত তিনি জাপানে। ১০
জানুয়ারি তার ৪৭তম মৃত্যুবার্ষিকী।
বিশ্বযুদ্ধপূর্বকালে জাপানের সঙ্গে বাঙালির আধ্যাত্মিক সম্পর্কের সূচনা হয়েছিল উনিশ শতকের শেষ দিকে বা বিংশ শতকের শুরুতে। আর প্রস্টম্ফুটিত হয়েছে জাপানে ড. রাধাবিনোদ পালের উত্থানের মধ্য দিয়ে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের যে, সেই আলোকিত ইতিহাস বাঙালির সামনে তুলে ধরা হয়নি। অথচ বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার অধীন দৌলতপুর উপজেলার তারাগুনিয়া ইউনিয়নের সালিমপুর গ্রামের অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের সন্তান ছিলেন তিনি। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জাপানের পরাজয় হলে পরের বছর টোকিওতে মিত্র শক্তিপ্রধান আমেরিকা কর্তৃক যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক আইন ছাড়াই তথাকথিত টোকিও দূরপ্রাচ্য মিলিটারি ট্রাইব্যুনালের আয়োজন করে সহযোগী ব্রিটেন ও নেদারল্যান্ডসের সহযোগিতায়। ১১টি দেশের বিচারপতিদের মধ্যে রাধাবিনোদ পাল নিযুক্ত হন ব্রিটিশ-ভারতীয় বিচারক হিসেবে। তখন তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে অবসর গ্রহণ করেছেন মাত্র। এর আগে কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ছিলেন।
আড়াই বছরের (১৯৪৬-৪৮) এই বিচারে তিনি ১,২৩৫ পৃষ্ঠার রায়ের মাধ্যমে এই ট্রাইব্যুনালকে নাকচ করে দেন ও আমেরিকার সাজানো প্রহসন বলে আখ্যায়িত করেন। তার এই ভিন্ন মতাবলম্ব্বী রায় সে সময় বিশ্বব্যাপী ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। তিনি এই রায়ের মাধ্যমে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে আণবিক বোমা দিয়ে লাখ লাখ নিরীহ মানুষকে মারার জন্য আমেরিকাকে দায়ী করে তারও বিচারের দাবি জানান। এরকম সাহসী উচ্চারণ আর কোনো বাঙালি কোনোদিন করেছেন বলে ইতিহাসে নেই।
শুধু তাই নয়, ১৯৫২ সালে হিরোশিমাকে কেন্দ্র করে যে আন্তর্জাতিক শান্তি আন্দোলন শুরু হয়েছিল, কতিপয় বিশিষ্ট জাপানি শান্তিবাদী মানুষ দ্বারা সৃষ্ট সেই আন্দোলনেরও তিনি ছিলেন নেতৃস্থানীয় উদ্যোক্তা। সেই বছর হিরোশিমাতে অনুষ্ঠিত এশিয়াভিত্তিক আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলনে বিভিন্ন রাষ্ট্রের শতাধিক শ্বেতাঙ্গ প্রতিনিধির সামনে সভাপতি হিসেবে তিনি অকুতোভয় জ্বালাময়ী বক্তৃতার মাধ্যমে পুনরায় যুদ্ধবাজ আমেরিকার বিচার ও শাস্তি দাবি করেন। সে বছর জাপানব্যাপী তিনি বক্তৃতা দেন। জাপানকে উজ্জীবিত করেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিয়ে। নিহোন বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সাম্মানিক ডিলিট ডিগ্রি প্রদান করে। তিনি বিখ্যাত মোটর গাড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেন।
১৯৬৬ সালে তিনি আরেকবার প্রিয় দেশ জাপান সফর করেছিলেন সম্রাট হিরোহিতোর কাছ থেকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মানজনক পদক 'কোক্কা কুনশোও' তথা 'পার্পল রিবন' গ্রহণ করার জন্য। পরের বছর তিনি কলকাতায় নিজ বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন। জীবিতকালেই বিচারপতি পাল তার প্রতিভা ও গুণগত কর্মকাণ্ডের মূল্যায়নস্বরূপ ১৯৫২ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত জেনেভার জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক আইনসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত রায়টি ইংরেজি ছাড়াও জাপানি, বাংলাসহ আরও একাধিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে। অক্সফোর্ড, হার্ভার্ড, কেম্ব্রিজসহ বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিষয়ের শিক্ষার্থী ও গবেষকরা পাঠ করেন। ১৯৫৭ সালে ড. পাল ভারতের জাতীয় অধ্যাপক এবং ১৯৬০ সালে ভূষিত হন অন্যতম শ্রেষ্ঠ জাতীয় সম্মান 'পদ্মভূষণ' পদকে। সচেতন জাপানিরা বিচারপতি পালকে যে সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধা-ভক্তি করেন তার প্রমাণ ১৯৯৭ সালে টোকিওতে অবস্থিত বিতর্কিত জাতীয় শিন্তোও ধর্মীয় 'ইয়াসুনি জিনজা' মন্দির এবং কিয়োতো শহরের উপকণ্ঠ শোওয়ানোমোরি পাহাড়ি উদ্যানে দুটি পাথরের স্মৃতিফলক স্থাপনের মধ্যে পাওয়া যায়। আর কোনো বিদেশিকে জাপান এত সম্মান দেয়নি।
লেখক ও গবেষক
probirsrkr06@gmail.com
বিশ্বযুদ্ধপূর্বকালে জাপানের সঙ্গে বাঙালির আধ্যাত্মিক সম্পর্কের সূচনা হয়েছিল উনিশ শতকের শেষ দিকে বা বিংশ শতকের শুরুতে। আর প্রস্টম্ফুটিত হয়েছে জাপানে ড. রাধাবিনোদ পালের উত্থানের মধ্য দিয়ে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের যে, সেই আলোকিত ইতিহাস বাঙালির সামনে তুলে ধরা হয়নি। অথচ বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার অধীন দৌলতপুর উপজেলার তারাগুনিয়া ইউনিয়নের সালিমপুর গ্রামের অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের সন্তান ছিলেন তিনি। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জাপানের পরাজয় হলে পরের বছর টোকিওতে মিত্র শক্তিপ্রধান আমেরিকা কর্তৃক যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক আইন ছাড়াই তথাকথিত টোকিও দূরপ্রাচ্য মিলিটারি ট্রাইব্যুনালের আয়োজন করে সহযোগী ব্রিটেন ও নেদারল্যান্ডসের সহযোগিতায়। ১১টি দেশের বিচারপতিদের মধ্যে রাধাবিনোদ পাল নিযুক্ত হন ব্রিটিশ-ভারতীয় বিচারক হিসেবে। তখন তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে অবসর গ্রহণ করেছেন মাত্র। এর আগে কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ছিলেন।
আড়াই বছরের (১৯৪৬-৪৮) এই বিচারে তিনি ১,২৩৫ পৃষ্ঠার রায়ের মাধ্যমে এই ট্রাইব্যুনালকে নাকচ করে দেন ও আমেরিকার সাজানো প্রহসন বলে আখ্যায়িত করেন। তার এই ভিন্ন মতাবলম্ব্বী রায় সে সময় বিশ্বব্যাপী ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। তিনি এই রায়ের মাধ্যমে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে আণবিক বোমা দিয়ে লাখ লাখ নিরীহ মানুষকে মারার জন্য আমেরিকাকে দায়ী করে তারও বিচারের দাবি জানান। এরকম সাহসী উচ্চারণ আর কোনো বাঙালি কোনোদিন করেছেন বলে ইতিহাসে নেই।
শুধু তাই নয়, ১৯৫২ সালে হিরোশিমাকে কেন্দ্র করে যে আন্তর্জাতিক শান্তি আন্দোলন শুরু হয়েছিল, কতিপয় বিশিষ্ট জাপানি শান্তিবাদী মানুষ দ্বারা সৃষ্ট সেই আন্দোলনেরও তিনি ছিলেন নেতৃস্থানীয় উদ্যোক্তা। সেই বছর হিরোশিমাতে অনুষ্ঠিত এশিয়াভিত্তিক আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলনে বিভিন্ন রাষ্ট্রের শতাধিক শ্বেতাঙ্গ প্রতিনিধির সামনে সভাপতি হিসেবে তিনি অকুতোভয় জ্বালাময়ী বক্তৃতার মাধ্যমে পুনরায় যুদ্ধবাজ আমেরিকার বিচার ও শাস্তি দাবি করেন। সে বছর জাপানব্যাপী তিনি বক্তৃতা দেন। জাপানকে উজ্জীবিত করেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিয়ে। নিহোন বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সাম্মানিক ডিলিট ডিগ্রি প্রদান করে। তিনি বিখ্যাত মোটর গাড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেন।
১৯৬৬ সালে তিনি আরেকবার প্রিয় দেশ জাপান সফর করেছিলেন সম্রাট হিরোহিতোর কাছ থেকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মানজনক পদক 'কোক্কা কুনশোও' তথা 'পার্পল রিবন' গ্রহণ করার জন্য। পরের বছর তিনি কলকাতায় নিজ বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন। জীবিতকালেই বিচারপতি পাল তার প্রতিভা ও গুণগত কর্মকাণ্ডের মূল্যায়নস্বরূপ ১৯৫২ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত জেনেভার জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক আইনসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত রায়টি ইংরেজি ছাড়াও জাপানি, বাংলাসহ আরও একাধিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে। অক্সফোর্ড, হার্ভার্ড, কেম্ব্রিজসহ বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিষয়ের শিক্ষার্থী ও গবেষকরা পাঠ করেন। ১৯৫৭ সালে ড. পাল ভারতের জাতীয় অধ্যাপক এবং ১৯৬০ সালে ভূষিত হন অন্যতম শ্রেষ্ঠ জাতীয় সম্মান 'পদ্মভূষণ' পদকে। সচেতন জাপানিরা বিচারপতি পালকে যে সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধা-ভক্তি করেন তার প্রমাণ ১৯৯৭ সালে টোকিওতে অবস্থিত বিতর্কিত জাতীয় শিন্তোও ধর্মীয় 'ইয়াসুনি জিনজা' মন্দির এবং কিয়োতো শহরের উপকণ্ঠ শোওয়ানোমোরি পাহাড়ি উদ্যানে দুটি পাথরের স্মৃতিফলক স্থাপনের মধ্যে পাওয়া যায়। আর কোনো বিদেশিকে জাপান এত সম্মান দেয়নি।
লেখক ও গবেষক
probirsrkr06@gmail.com
No comments