গণমানুষের দৃষ্টিতেই নিহিত সমস্যার সমাধান by আলী যাকের
জানুয়ারির
৭ তারিখ, ঘুম ভাঙল মন কেমন করা সকালে। কাল ঘুমাতে যাওয়ার আগে বিভিন্ন
চ্যানেলে নানা রকম খবর দেখে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছিল। প্রচণ্ড ক্রোধ
হচ্ছিল আমার। মনে হচ্ছিল টেলিভিশন দেখা, পত্রিকা পড়া, এসব বন্ধ করে দেব।
পরে ভাবলাম, আমি বন্ধ করে দিলে কী হবে, যা ঘটার তা তো ঘটতেই থাকবে।
বাংলাদেশে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে অবিরামভাবে চলেছে ধ্বংসের ভয়াবহ প্রদর্শনী।
ট্রেন পোড়ানো, বাস পোড়ানো, ট্রাক পোড়ানো, অটোরিকশায় পেট্রোল বোমা এবং এসব
যানবাহনে ভ্রমণকারী মানুষ অথবা পশুকে অবলীলায় হত্যা করা আমাদের নিত্যদিনের
অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সর্বশেষ এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভোটের আগে এবং পরে
সংখ্যালঘু হননের নির্মম ও ভয়াবহ কর্মকাণ্ড। আমরা ছবি দেখেছি চলমান এবং
স্থিরচিত্রে। দেখেছি কেমনভাবে উচ্ছেদ করা হয়েছে তাদের বাংলাদেশের বিভিন্ন
জায়গায় তাদের নিজের ভিটামাটি থেকে। হঠাৎই যেন মনে এসেছে ১৯৭১-এর কথা। সেই
পাকিস্তানি শাসকরা এবং তাদের পুঙ্গবেরা কীভাবে বাঙালিদের, বিশেষ করে
অমুসলমান বাঙালিদের ওপরে নৃশংস অত্যাচার করেছিল। অথচ আমরা তো জানি, বাঙালি
মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান_ সব ধর্মাবলম্বীই অনেক সহনশীল। আমার
বাবা অত্যন্ত ধার্মিক মুসলমান ছিলেন। ভোররাতে উঠে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়তেন।
পাঁচ ওয়াক্তের সব নামাজই তিনি পড়তেন নিয়মিতভাবে। কিন্তু ভিন্ন
ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। বস্তুতপক্ষে তার
সবচেয়ে প্রিয় দুই বন্ধু, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার সহপাঠী ছিলেন, তারা
দু'জনই ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। কখনও আমি বাবার মুখে অন্য
সম্প্রদায় সম্বন্ধে একটি অপ্রীতিকর উচ্চারণও শুনিনি।
ভারতের শ্রীনগরের কাছে হজরতবল মসজিদে আমাদের নবীজির একটি কেশ সংরক্ষিত বলে কথিত আছে। কেউ একজন রটিয়ে দিয়েছিল, এই কেশটি সেখান থেকে চুরি হয়ে গেছে এবং চোর হিন্দু সম্প্রদায়ের কোনো ব্যক্তি। গোটা বিষয়টি, পরে জানা যায়, রটেছিল পাকিস্তানি কাশ্মীর থেকে। কিন্তু এ নিয়ে সে সময় হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচণ্ড ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। ভারতের বিভিন্ন জায়গায় এবং বাংলাদেশের বেশ কিছু শহরে এ নিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেধেছিল। পরে অবশ্য জানা গিয়েছিল, ঘটনাটি ছিল আদতেই গুজব। বস্তুতপক্ষে ১৯৮৪ সালে আমি যখন সপরিবরে কাশ্মীর গিয়েছিলাম তখন শ্রীনগরের এক ট্যাক্সি ড্রাইভার আমাদের হজরতবল মসজিদ এবং সংলগ্ন মাজারে নিয়ে যায়। আমি সেই ড্রাইভার মোজাফফর আলীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এই কি সেই মসজিদ যেখান থেকে নবীজির চুল চুরি গিয়েছিল? আমাদের গাড়িচালক বলেছিল, 'সাব বাকওয়াস থা।' তাহলেই বুুঝুন? এরকম বাকওয়াসে বিশ্বাস করে আন্তঃসম্প্রদায়ে কত যে দাঙ্গা-ফ্যাসাদ হয়ে গেছে আমাদের এই উপমহাদেশে, তার হিসাব কারও জানা নেই। ১৯৬৪-এর জানুয়ারিতে ঢাকাতে ওই কেশ চুরি নিয়ে দাঙ্গা বাধানোর চেষ্টা করা হয়। বস্তুতপক্ষে হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেক মানুষ তখন অত্যাচারিত হয়ে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হন। তাদের মধ্যে আমার কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধবও ছিল। সে সময় আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। গেণ্ডারিয়া পাড়ায় আমার বাস। মনে আছে আমরা কয়েকজন বন্ধুবান্ধব মিলে একটা দল তৈরি করেছিলাম। হাতে লাঠি নিয়ে দশ-পনেরজন মিলে সারারাত পাড়ার রাস্তায় রাস্তায় পাহারা দিয়ে বেড়াতাম। ওই কয়জন তরুণ কয়েকটা লাঠি নিয়ে সশস্ত্র আক্রমণের বিরুদ্ধে কীই-বা করতে পারি? কিন্তু কোথা থেকে কী এক অদৃশ্য সাহস আসত বুকে। মনে হতো ওই নগণ্য লাঠি দিয়ে জগৎ জয় করা যায়। রাতের অন্ধকারে গলিঘুঁজির মধ্য দিয়ে নির্ভয়ে দৃপ্ত পায়ে, বুকে অমিত বলধারী একদল তরুণ সারারাত বাঁশি বাজিয়ে পাহারা দিয়ে বেড়াত। একদিন ভোরবেলা পাহারা দিয়ে বাড়ি ফিরছি, আমার বাবার বয়সী দু'জন গেণ্ডারিয়ার জামে মসজিদে নামাজ পড়তে যাচ্ছেন। আমাকে দেখে ইশারায় কাছে ডাকলেন। আমি এগিয়ে গেলে একজন বললেন, কাদের জন্য পণ্ডশ্রম করছ? হিন্দুরা আসলে সাপের মতো। সুযোগ বুঝে ঠিকই ছোবল দেবে। আমি সেদিন তাকে বলেছিলাম, আপনার মতো সাম্প্রদায়িক মানুষের সঙ্গে কথা বলার কোনো প্রবৃত্তি আমার নেই। এর অনেক আগে থেকেই অসাম্প্রদায়িকতা আমার যুক্তিলব্ধ বিশ্বাসে স্থান করে নিয়েছে। এই বিশ্বাস আরও বলীয়ান হয়েছে পরবর্তীকালে যখন বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলন জোরদার হয় এবং খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাসস্থানের বিষয়ে যখন বাংলাদেশবাসী সোচ্চার হয়ে ওঠে, তখন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধেও বলিষ্ঠ কণ্ঠে আওয়াজ উঠেছিল। ধর্মনিরপেক্ষতা বাংলাদেশের মানুষের কাছে কেবল স্লোগান নয়, অত্যন্ত স্বাভাবিক এক আচরণই বটে। বাল্যকাল থেকেই আমরা দেখে আসছি, পাকিস্তানমনা কিছু মানুষের দুরভিসন্ধি থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশবাসী কখনও ধর্মের প্রশ্নে পক্ষপাতিত্ব দেখায়নি।
১৯৭৫-এ জাতির পিতার হত্যা এবং ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে চার জাতীয় নেতার হত্যার পরপরই অতি সুচিন্তিত এক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে যেই মূল্যবোধনির্ভর মুক্তিযুদ্ধ আমরা করেছিলাম, সেটিকে ভুলিয়ে দেওয়ার এক খেলা শুরু হয়ে যায় এবং একে একে নস্যাৎ করা হয় সেই চেতনালব্ধ সব সুকৃতিকে। আমরা দেখতে পাই, যারা সরবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় এর বিরোধিতা করেছিল এবং পাকিস্তানের পক্ষে দেশে-বিদেশে সর্বত্র অপপ্রচারে লিপ্ত ছিল, তাদেরই একে একে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসানো হয়। এভাবেই চাকা সামনের দিকে না ঘুরে পেছন দিকে ঘুরতে শুরু করে। আজ ফেসবুকে যখন দেখি জনৈক ব্যক্তি এমন মন্তব্য করেছে যে, বর্তমান সরকারের উচিত ভারত, হিন্দু এবং নাস্তিকদের দেশ থেকে বের করে দেওয়া, তখন আর আশ্চর্য হই না। এই ছিল '৭১-এর আগে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা, সেখানেই আবার আমরা ফিরে এসেছি। অতএব, আমাদের এখানে সংখ্যালঘুরা যে নিরাপদে নেই, এটি আর অনুমান করতে হয় না। এটি এখন একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। এরকম একটি পরিস্থিতিতে যারা এখনও সেক্যুলার চিন্তাভাবনা ধারণ করেন, তাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসতে হবে। কেবল রাজনীতিবিদদের ওপরে নির্ভর করলেই সব সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে হয় না।
সবাই জানি, রাজনৈতিকভাবে বড় দুর্বিষহ একটি সময় পার করছি আমরা। এই চরম অস্থিরতা কেন ঘটছে? বলা হয়ে থাকে, এসব সংঘটিত হচ্ছে এ কারণে যে, আমরা নাকি আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছি। সেই অধিকার আমাদের ফেরত চাই। যে দেশের বা সমাজের প্রায় সব রাজনৈতিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বিভিন্ন গণমাধ্যমে বাধাহীনভাবে দিনের পর দিন আলোচিত হচ্ছে, এমনকি শাসকগোষ্ঠীকে প্রতিনিয়ত তুলাধোনা করা হচ্ছে, সে দেশে গণতান্ত্রিক অধিকার ব্যাহত হওয়ার কারণে মানুষ মারতে হবে কেন, তার বৈধ কারণ এখনও বুঝে ওঠা দুঃসাধ্য। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, কারণ একটিই। আমি যদি ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ না করতে পারি, তাহলে কিসের গণতন্ত্র? অর্থাৎ গণতন্ত্রের অপর নাম 'কিছু মানুষের রাষ্ট্রক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ'। আমি জানি না কেন একজন কিংবা একটি গোষ্ঠীর রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের জন্য এ দেশের আপামর জনসাধারণকে জিম্মি থাকতে হবে। আমাদের দেশে বিভিন্ন সময়ে দেশি-বিদেশি অনেক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সমীক্ষা চালিয়ে থাকে। তাদের অনুরোধ করব একটি দেশজোড়া গবেষণা করতে এবং দেশের গণমানুষকে জিজ্ঞেস করতে যে, বর্তমানের বাংলাদেশে তারা গণতান্ত্রিক অধিকার বঞ্চিত কি-না। আমি নিশ্চিত বলতে পারি, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ এ নিয়ে কোনো জবাবই দিতে পারবেন না। কেননা তথাকথিত গণতান্ত্রিক অধিকার সম্বন্ধে তাদের কোনো ধারণাই নেই। অতএব, আমরা যদি রাজনৈতিক ভাষার মারপ্যাঁচ নিয়ে বাকবিতণ্ডা না করে আমাদের দেশের গণমানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে আজকের এই অচল অবস্থাকে দেখার চেষ্টা করি, তাহলে অতি সহজেই দিকনির্দেশ পেয়ে যাব।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
ভারতের শ্রীনগরের কাছে হজরতবল মসজিদে আমাদের নবীজির একটি কেশ সংরক্ষিত বলে কথিত আছে। কেউ একজন রটিয়ে দিয়েছিল, এই কেশটি সেখান থেকে চুরি হয়ে গেছে এবং চোর হিন্দু সম্প্রদায়ের কোনো ব্যক্তি। গোটা বিষয়টি, পরে জানা যায়, রটেছিল পাকিস্তানি কাশ্মীর থেকে। কিন্তু এ নিয়ে সে সময় হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচণ্ড ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। ভারতের বিভিন্ন জায়গায় এবং বাংলাদেশের বেশ কিছু শহরে এ নিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেধেছিল। পরে অবশ্য জানা গিয়েছিল, ঘটনাটি ছিল আদতেই গুজব। বস্তুতপক্ষে ১৯৮৪ সালে আমি যখন সপরিবরে কাশ্মীর গিয়েছিলাম তখন শ্রীনগরের এক ট্যাক্সি ড্রাইভার আমাদের হজরতবল মসজিদ এবং সংলগ্ন মাজারে নিয়ে যায়। আমি সেই ড্রাইভার মোজাফফর আলীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এই কি সেই মসজিদ যেখান থেকে নবীজির চুল চুরি গিয়েছিল? আমাদের গাড়িচালক বলেছিল, 'সাব বাকওয়াস থা।' তাহলেই বুুঝুন? এরকম বাকওয়াসে বিশ্বাস করে আন্তঃসম্প্রদায়ে কত যে দাঙ্গা-ফ্যাসাদ হয়ে গেছে আমাদের এই উপমহাদেশে, তার হিসাব কারও জানা নেই। ১৯৬৪-এর জানুয়ারিতে ঢাকাতে ওই কেশ চুরি নিয়ে দাঙ্গা বাধানোর চেষ্টা করা হয়। বস্তুতপক্ষে হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেক মানুষ তখন অত্যাচারিত হয়ে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হন। তাদের মধ্যে আমার কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধবও ছিল। সে সময় আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। গেণ্ডারিয়া পাড়ায় আমার বাস। মনে আছে আমরা কয়েকজন বন্ধুবান্ধব মিলে একটা দল তৈরি করেছিলাম। হাতে লাঠি নিয়ে দশ-পনেরজন মিলে সারারাত পাড়ার রাস্তায় রাস্তায় পাহারা দিয়ে বেড়াতাম। ওই কয়জন তরুণ কয়েকটা লাঠি নিয়ে সশস্ত্র আক্রমণের বিরুদ্ধে কীই-বা করতে পারি? কিন্তু কোথা থেকে কী এক অদৃশ্য সাহস আসত বুকে। মনে হতো ওই নগণ্য লাঠি দিয়ে জগৎ জয় করা যায়। রাতের অন্ধকারে গলিঘুঁজির মধ্য দিয়ে নির্ভয়ে দৃপ্ত পায়ে, বুকে অমিত বলধারী একদল তরুণ সারারাত বাঁশি বাজিয়ে পাহারা দিয়ে বেড়াত। একদিন ভোরবেলা পাহারা দিয়ে বাড়ি ফিরছি, আমার বাবার বয়সী দু'জন গেণ্ডারিয়ার জামে মসজিদে নামাজ পড়তে যাচ্ছেন। আমাকে দেখে ইশারায় কাছে ডাকলেন। আমি এগিয়ে গেলে একজন বললেন, কাদের জন্য পণ্ডশ্রম করছ? হিন্দুরা আসলে সাপের মতো। সুযোগ বুঝে ঠিকই ছোবল দেবে। আমি সেদিন তাকে বলেছিলাম, আপনার মতো সাম্প্রদায়িক মানুষের সঙ্গে কথা বলার কোনো প্রবৃত্তি আমার নেই। এর অনেক আগে থেকেই অসাম্প্রদায়িকতা আমার যুক্তিলব্ধ বিশ্বাসে স্থান করে নিয়েছে। এই বিশ্বাস আরও বলীয়ান হয়েছে পরবর্তীকালে যখন বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলন জোরদার হয় এবং খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাসস্থানের বিষয়ে যখন বাংলাদেশবাসী সোচ্চার হয়ে ওঠে, তখন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধেও বলিষ্ঠ কণ্ঠে আওয়াজ উঠেছিল। ধর্মনিরপেক্ষতা বাংলাদেশের মানুষের কাছে কেবল স্লোগান নয়, অত্যন্ত স্বাভাবিক এক আচরণই বটে। বাল্যকাল থেকেই আমরা দেখে আসছি, পাকিস্তানমনা কিছু মানুষের দুরভিসন্ধি থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশবাসী কখনও ধর্মের প্রশ্নে পক্ষপাতিত্ব দেখায়নি।
১৯৭৫-এ জাতির পিতার হত্যা এবং ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে চার জাতীয় নেতার হত্যার পরপরই অতি সুচিন্তিত এক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে যেই মূল্যবোধনির্ভর মুক্তিযুদ্ধ আমরা করেছিলাম, সেটিকে ভুলিয়ে দেওয়ার এক খেলা শুরু হয়ে যায় এবং একে একে নস্যাৎ করা হয় সেই চেতনালব্ধ সব সুকৃতিকে। আমরা দেখতে পাই, যারা সরবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় এর বিরোধিতা করেছিল এবং পাকিস্তানের পক্ষে দেশে-বিদেশে সর্বত্র অপপ্রচারে লিপ্ত ছিল, তাদেরই একে একে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসানো হয়। এভাবেই চাকা সামনের দিকে না ঘুরে পেছন দিকে ঘুরতে শুরু করে। আজ ফেসবুকে যখন দেখি জনৈক ব্যক্তি এমন মন্তব্য করেছে যে, বর্তমান সরকারের উচিত ভারত, হিন্দু এবং নাস্তিকদের দেশ থেকে বের করে দেওয়া, তখন আর আশ্চর্য হই না। এই ছিল '৭১-এর আগে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা, সেখানেই আবার আমরা ফিরে এসেছি। অতএব, আমাদের এখানে সংখ্যালঘুরা যে নিরাপদে নেই, এটি আর অনুমান করতে হয় না। এটি এখন একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। এরকম একটি পরিস্থিতিতে যারা এখনও সেক্যুলার চিন্তাভাবনা ধারণ করেন, তাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসতে হবে। কেবল রাজনীতিবিদদের ওপরে নির্ভর করলেই সব সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে হয় না।
সবাই জানি, রাজনৈতিকভাবে বড় দুর্বিষহ একটি সময় পার করছি আমরা। এই চরম অস্থিরতা কেন ঘটছে? বলা হয়ে থাকে, এসব সংঘটিত হচ্ছে এ কারণে যে, আমরা নাকি আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছি। সেই অধিকার আমাদের ফেরত চাই। যে দেশের বা সমাজের প্রায় সব রাজনৈতিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বিভিন্ন গণমাধ্যমে বাধাহীনভাবে দিনের পর দিন আলোচিত হচ্ছে, এমনকি শাসকগোষ্ঠীকে প্রতিনিয়ত তুলাধোনা করা হচ্ছে, সে দেশে গণতান্ত্রিক অধিকার ব্যাহত হওয়ার কারণে মানুষ মারতে হবে কেন, তার বৈধ কারণ এখনও বুঝে ওঠা দুঃসাধ্য। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, কারণ একটিই। আমি যদি ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ না করতে পারি, তাহলে কিসের গণতন্ত্র? অর্থাৎ গণতন্ত্রের অপর নাম 'কিছু মানুষের রাষ্ট্রক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ'। আমি জানি না কেন একজন কিংবা একটি গোষ্ঠীর রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের জন্য এ দেশের আপামর জনসাধারণকে জিম্মি থাকতে হবে। আমাদের দেশে বিভিন্ন সময়ে দেশি-বিদেশি অনেক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সমীক্ষা চালিয়ে থাকে। তাদের অনুরোধ করব একটি দেশজোড়া গবেষণা করতে এবং দেশের গণমানুষকে জিজ্ঞেস করতে যে, বর্তমানের বাংলাদেশে তারা গণতান্ত্রিক অধিকার বঞ্চিত কি-না। আমি নিশ্চিত বলতে পারি, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ এ নিয়ে কোনো জবাবই দিতে পারবেন না। কেননা তথাকথিত গণতান্ত্রিক অধিকার সম্বন্ধে তাদের কোনো ধারণাই নেই। অতএব, আমরা যদি রাজনৈতিক ভাষার মারপ্যাঁচ নিয়ে বাকবিতণ্ডা না করে আমাদের দেশের গণমানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে আজকের এই অচল অবস্থাকে দেখার চেষ্টা করি, তাহলে অতি সহজেই দিকনির্দেশ পেয়ে যাব।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments