পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সবকিছুই অন্ধকারাচ্ছন্ন নয় by আবদুল মান্নান
কিছুদিন পর পর বাংলাদেশের পাবলিক বা
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়, তবে কদাচিৎ ভালো কারণে।
আবার বাংলাদেশ একমাত্র ব্যতিক্রমধর্মী দেশ, যেখানে দেশের সব প্রথম শ্রেণীর
সংবাদপত্রের বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদদাতা আছে।
বলা যায়, এঁরা
শিক্ষানবিশ সংবাদদাতা এবং এঁদের নিয়োগ দেওয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের
মধ্য থেকে। এই সংবাদদাতাদের বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি নামে আবার একটা
সংগঠনও থাকে। এই সংবাদদাতাদের অনেকেই পরবর্তীকালে পেশাদার সাংবাদিক হয়ে
ওঠেন এবং কেউ কেউ এই পেশায় সফল হন।
অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ালেখা অথবা ভালো কর্মকাণ্ড কি এখন হয় না? নিশ্চয় হয়, তবে তা পত্রপত্রিকায় আসে কম। কারণ, সংবাদদাতারা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতিবাচক সংবাদ পরিবেশনটাকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। একবার আমি এক সম্পাদকের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা বা সেমিনার-কনফারেন্স হয়, তাকে না যত গুরুত্ব দিয়ে পত্রপত্রিকাগুলো পরিবেশন করতে উৎসাহিত হয়, তার চেয়ে বেশি উৎসাহিত হয় দুই দল ছাত্রের মধ্যে মারামারি। বন্ধু সম্পাদকের সোজাসাপ্টা উত্তর, ভালো কাজ করা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ, তা পাঠকের কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়, যতটা হবে ছাত্রলীগ বনাম ছাত্রদলের মারামারি। তাঁর যুক্তিটা অদ্ভুত ঠেকল। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিবাচক সংবাদগুলো সংবাদপত্রে বা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে তাতে এসব সংবাদের যাঁরা জন্মদাতা, তাঁরা অনুপ্রাণিত হন। ছাত্রদের ভালো কাজগুলো পত্রিকায় ছাপা হলে তাঁরাও উৎসাহ বোধ করেন।
কিছুদিন আগে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আমাকে ফোনে জানালেন তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে একটি জাতীয় দৈনিকে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, যা আদৌ সত্য নয় এবং তা প্রকাশিত হওয়ার কারণ ওই পত্রিকার বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদদাতা তাঁর কাছে কিছু অন্যায় আবদার করেছিলেন, যা তাঁর পক্ষে পূরণ করা সম্ভব ছিল না। এতেই তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে এই সিরিজ প্রতিবেদনগুলো প্রকাশ করেছেন। আবার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে পত্রপত্রিকায় অনেক প্রতিবেদন ছাপা হয়, যা বস্তুনিষ্ঠ নয় এবং এরূপ হওয়ার কারণ, যাঁরা এই প্রতিবেদনগুলো করেন, তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিবদ্ধ পর্ষদগুলো কীভাবে কাজ করে, সে সম্পর্কে তাঁদের সম্যক ধারণা না থাকা। একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিধিবদ্ধ পর্ষদ হচ্ছে তার সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটে শিক্ষক এবং সরকারি প্রতিনিধি উভয়ই আছে। পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আছে প্রাক্তন ছাত্রদের প্রতিনিধি (রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট)। সিনেট থেকে বিশিষ্ট নাগরিকদেরও একজন প্রতিনিধি থাকেন। শিক্ষক নিয়োগের জন্যও যে নির্বাচনী বোর্ড থাকে, তা-ও বিধিবদ্ধ পর্ষদ। সেখানে বিভাগীয় সভাপতি থাকেন, বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞ থাকেন, কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে সংশ্লিষ্ট অনুষদের ডিনও থাকেন। অধ্যাপক আর সহযোগী অধ্যাপক নিয়োগের জন্য গঠিত নির্বাচনী বোর্ডে চ্যান্সেলর তথা রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি থাকেন।
সিনেট হচ্ছে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্লামেন্ট। আরও আছে ফিন্যান্স কমিটি, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন কমিটি। প্রতিটি বিভাগে আছে পরিকল্পনা কমিটি আর বিদ্যায়তনিক কমিটি। বিশ্ববিদ্যালয়েরও একটা বিদ্যায়তনিক কমিটি আছে (একাডেমিক কাউন্সিল)। প্রতিটি অনুষদেও তার নিজস্ব কমিটি আছে। এই সবই বিধিবদ্ধ পর্ষদ। বিভাগীয় আর অনুষদের কমিটিগুলো ছাড়া অন্য সব কমিটিতে পদাধিকারবলে উপাচার্য সভাপতিত্ব করেন। সভাগুলোতে চেষ্টা করা হয় কোনো সিদ্ধান্ত যেন সর্বসম্মিতক্রমে গৃহীত হয়। কারও দ্বিমত থাকলে তা লিপিবদ্ধ করার সুযোগ আছে। উপাচার্য কর্তৃক একক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া তেমন সহজ নয়। তবে জরুরি অবস্থায় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য একজন উপাচার্যকে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের আইনে যথেষ্ট ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। উপাচার্যকে তাঁর কর্মকাণ্ডের জন্য আইনগতভাবে চ্যান্সেলরের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। উপাচার্যের দায়িত্বটা সার্বক্ষণিক কিন্তু একজন উপাচার্যের আলাদা বেতনকাঠামো নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাড়িতে থাকলে তাঁর জন্য বাড়িভাড়া কর্তন করা হয়।
সাম্প্রতিককালে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের নামে অসদুপায়ে অর্থ উপার্জনের অভিযোগ উঠেছে। সে সম্পর্কে মন্তব্য করার মতো তথ্য আমার কাছে নেই। তবে অভিযোগগুলোর বিন্দুমাত্রও যদি সত্য হয়, তাহলে তা হবে মারাত্মক অপরাধজনিত একটি কাজ। উপাচার্য অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি। তিনি যদি অন্যায় কাজ করে থাকেন, তাহলে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আর সেটা যদি হয় শিক্ষক নিয়োগসংক্রান্ত, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে। একজন অযোগ্য ব্যক্তি যদি কোনো বাঁকা পথে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন, একদিন সেই ব্যক্তি বিভাগীয় সভাপতি অথবা অনুষদের ডিন হবেন এবং একসময় তাঁর উপাচার্য হওয়ার খায়েশও জাগতে পারে। এমন শিক্ষক যে বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই, তা নয়। তবে তাঁদের সংখ্যা হাতে গোনা।
আরেকটি বিষয় গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে হবে। একসময় ভালো ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অথবা সরকারি আমলা হতে চাইত। এখন কিন্তু তাদের সেই আকর্ষণটা কমে গেছে। কারণ, এই দুই ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা অথবা বেতন-ভাতা বেসরকারি খাত থেকে অনেক কম। এসব বিষয় সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে তেমন প্রতিফলিত হয় না।
কয়েক দিন আগে প্রথম আলোতেই সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হলো। দেশের ৩৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে চারটি, যথা ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইনে পরিচালিত হয়। এই আইনে বলা আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট তিনজনের একটি প্যানেল নির্বাচিত করবে এবং সেই প্যানেল থেকে চ্যান্সেলর একজনকে চার বছর মেয়াদের জন্য উপাচার্য নিয়োগ দেবেন। রেওয়াজ অনুযায়ী একবার একজন উপাচার্য নিয়োগপ্রাপ্ত হলে তখন সেই প্যানেল আপনাআপনি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ধারাটি একসময় বলবৎ করার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেল খালেদা জিয়ার ১৯৯১ সালে সরকার গঠন করার পর। তিনি রাতারাতি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ১১ জন উপাচার্য, সহ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষকে তাঁদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে নিজের দলীয় লোক বসিয়ে দিলেন। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নব নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্যের সকাল পর্যন্ত তর সইল না। তিনি রাতেই উপাচার্যের কক্ষের তালা ভেঙে তাঁর নতুন পদে যোগদান করলেন। আবার কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়তো একজন নতুন উপাচার্য ১৯৭৩ সালের আইন অনুযায়ী নিয়োগপ্রাপ্ত হলেন। অন্য আরেক দল শিক্ষক বললেন, এই নিয়োগ মানি না। কেন মানি না, তার যুক্তিসংগত উত্তর নেই।
আমাকে ১৯৯৬ সালের ৬ নভেম্বর চ্যান্সেলর (তখন প্রধানমন্ত্রী) আমার অধ্যাপকের দায়িত্বের পাশাপাশি উপাচার্যের একটি বাড়তি দায়িত্ব দিলেন। সিনেট কর্তৃক উপাচার্য প্যানেল তৈরি করা সম্ভব নয়। কারণ, দুজন শিক্ষক এই নির্বাচনের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে মামলা করেছেন এবং আদালত একটা স্থগিতাদেশ দিয়েছেন। চেষ্টা করছিলাম সেই স্থগিতাদেশ খারিজ করে সিনেট ডেকে প্যানেল নির্বাচন দিতে। আমার একাধিক সহকর্মী, যাঁরা আবার নিজেদের বঙ্গবন্ধুর সৈনিক বলে দাবি করেন, তাঁরা পত্রপত্রিকায় লেখালেখি শুরু করলেন আমার দুরভিসন্ধি চরিতার্থ করার জন্য আমি মামলার ব্যাপারে পদক্ষেপ নিচ্ছি না। উচ্চ আদালতের কজ লিস্টে মামলাটি ১৮ বার উঠল ঠিক কিন্তু শুনানি হলো না। ১৯তম বারে শুনানি হলো এবং আদালত বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে রায় দিলেন। রায় পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কালবিলম্ব না করে আমি সিনেট ডেকে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু করলে এবার একজন উল্টো মামলা ঠুকে দিলেন আমার বিরুদ্ধে। বাদীর পেছনে সেই স্বঘোষিত বঙ্গবন্ধুর সৈনিকেরা। তাঁদের বক্তব্য, সিনেট মেয়াদোত্তীর্ণ সুতরাং এই প্যানেল করা আইনসম্মত নয়। গত এক যুগেও বিষয়টির আর সুরাহা হয়নি। সুতরাং যাঁরা এসব বিষয়ে সংবাদ পরিবেশন করেন, তাঁদের কাছে অনেক তথ্য থাকে না।
এমন একটি বিষয়ের সর্বশেষ উদাহরণ। খবর প্রকাশিত হয়েছে বর্তমান উপাচার্য তাঁর পুত্রকে চাকরি দেওয়ার জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজকে রাতারাতি শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে রূপান্তর করেছেন। বাস্তবতা হচ্ছে, ২০০৪ সাল থেকে এই কলেজকে ইনস্টিটিউটে রূপান্তর করার জন্য প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। কারণ, সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে কলেজকে বাজেটে অর্থ বরাদ্দ করতে অস্বীকার করে আসছে অনেক বছর ধরে। একসময় তা বন্ধও করে দেওয়া হয়। ঘটনাচক্রে বর্তমান প্রশাসনের আমলে ইনস্টিটিউটকে সরকার অনুমোদন দেয়। তাতে বর্তমান প্রশাসন বা উপাচার্যের তেমন কৃতিত্ব আছে বলা যাবে না। তার পরও তাঁকে সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়। আর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের পরিচালনা পর্ষদের প্রধান হয়ে থাকেন সহ-উপাচার্য। উপাচার্যের ছেলে বা আত্মীয়স্বজনের যদি যোগ্যতা থাকে, তাহলে তাঁর চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা হওয়া উচিত নয়। আর যদি তাঁর যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে, তবে তা নিঃসন্দেহে একটি চরম অপরাধমূলক কাজ।
বর্তমানে যেসব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে অনিয়ম বা দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, তার প্রতিটির তদন্ত হওয়া উচিত এবং কেউ যদি দোষী সাব্যস্ত হন, তাঁর আইনানুগ শাস্তি হওয়া উচিত। শিক্ষাঙ্গনগুলো যদি অনিয়ম বা দুর্নীতির লালনক্ষেত্রে পরিণত হয়, তাহলে তা সমগ্র জাতির জন্য তা অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয়। আর সরকার বা চ্যান্সেলর যখন একজন ব্যক্তিকে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ পদে নিয়োগ দেন, ওই ব্যক্তির নিয়োগের দলীয় আনুগত্যই একমাত্র মাপকাঠি হওয়া উচিত নয়। সততা, পাণ্ডিত্য, প্রজ্ঞা, প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা আর নেতৃত্ব দেওয়ার সক্ষমতাই একজন ব্যক্তিকে উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান মাপকাঠি হওয়া উচিত। এ কথাও ঠিক, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সবকিছু অন্ধকারাচ্ছন্ন নয়।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ালেখা অথবা ভালো কর্মকাণ্ড কি এখন হয় না? নিশ্চয় হয়, তবে তা পত্রপত্রিকায় আসে কম। কারণ, সংবাদদাতারা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতিবাচক সংবাদ পরিবেশনটাকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। একবার আমি এক সম্পাদকের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা বা সেমিনার-কনফারেন্স হয়, তাকে না যত গুরুত্ব দিয়ে পত্রপত্রিকাগুলো পরিবেশন করতে উৎসাহিত হয়, তার চেয়ে বেশি উৎসাহিত হয় দুই দল ছাত্রের মধ্যে মারামারি। বন্ধু সম্পাদকের সোজাসাপ্টা উত্তর, ভালো কাজ করা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ, তা পাঠকের কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়, যতটা হবে ছাত্রলীগ বনাম ছাত্রদলের মারামারি। তাঁর যুক্তিটা অদ্ভুত ঠেকল। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিবাচক সংবাদগুলো সংবাদপত্রে বা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে তাতে এসব সংবাদের যাঁরা জন্মদাতা, তাঁরা অনুপ্রাণিত হন। ছাত্রদের ভালো কাজগুলো পত্রিকায় ছাপা হলে তাঁরাও উৎসাহ বোধ করেন।
কিছুদিন আগে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আমাকে ফোনে জানালেন তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে একটি জাতীয় দৈনিকে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, যা আদৌ সত্য নয় এবং তা প্রকাশিত হওয়ার কারণ ওই পত্রিকার বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদদাতা তাঁর কাছে কিছু অন্যায় আবদার করেছিলেন, যা তাঁর পক্ষে পূরণ করা সম্ভব ছিল না। এতেই তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে এই সিরিজ প্রতিবেদনগুলো প্রকাশ করেছেন। আবার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে পত্রপত্রিকায় অনেক প্রতিবেদন ছাপা হয়, যা বস্তুনিষ্ঠ নয় এবং এরূপ হওয়ার কারণ, যাঁরা এই প্রতিবেদনগুলো করেন, তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিবদ্ধ পর্ষদগুলো কীভাবে কাজ করে, সে সম্পর্কে তাঁদের সম্যক ধারণা না থাকা। একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিধিবদ্ধ পর্ষদ হচ্ছে তার সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটে শিক্ষক এবং সরকারি প্রতিনিধি উভয়ই আছে। পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আছে প্রাক্তন ছাত্রদের প্রতিনিধি (রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট)। সিনেট থেকে বিশিষ্ট নাগরিকদেরও একজন প্রতিনিধি থাকেন। শিক্ষক নিয়োগের জন্যও যে নির্বাচনী বোর্ড থাকে, তা-ও বিধিবদ্ধ পর্ষদ। সেখানে বিভাগীয় সভাপতি থাকেন, বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞ থাকেন, কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে সংশ্লিষ্ট অনুষদের ডিনও থাকেন। অধ্যাপক আর সহযোগী অধ্যাপক নিয়োগের জন্য গঠিত নির্বাচনী বোর্ডে চ্যান্সেলর তথা রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি থাকেন।
সিনেট হচ্ছে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্লামেন্ট। আরও আছে ফিন্যান্স কমিটি, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন কমিটি। প্রতিটি বিভাগে আছে পরিকল্পনা কমিটি আর বিদ্যায়তনিক কমিটি। বিশ্ববিদ্যালয়েরও একটা বিদ্যায়তনিক কমিটি আছে (একাডেমিক কাউন্সিল)। প্রতিটি অনুষদেও তার নিজস্ব কমিটি আছে। এই সবই বিধিবদ্ধ পর্ষদ। বিভাগীয় আর অনুষদের কমিটিগুলো ছাড়া অন্য সব কমিটিতে পদাধিকারবলে উপাচার্য সভাপতিত্ব করেন। সভাগুলোতে চেষ্টা করা হয় কোনো সিদ্ধান্ত যেন সর্বসম্মিতক্রমে গৃহীত হয়। কারও দ্বিমত থাকলে তা লিপিবদ্ধ করার সুযোগ আছে। উপাচার্য কর্তৃক একক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া তেমন সহজ নয়। তবে জরুরি অবস্থায় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য একজন উপাচার্যকে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের আইনে যথেষ্ট ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। উপাচার্যকে তাঁর কর্মকাণ্ডের জন্য আইনগতভাবে চ্যান্সেলরের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। উপাচার্যের দায়িত্বটা সার্বক্ষণিক কিন্তু একজন উপাচার্যের আলাদা বেতনকাঠামো নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাড়িতে থাকলে তাঁর জন্য বাড়িভাড়া কর্তন করা হয়।
সাম্প্রতিককালে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের নামে অসদুপায়ে অর্থ উপার্জনের অভিযোগ উঠেছে। সে সম্পর্কে মন্তব্য করার মতো তথ্য আমার কাছে নেই। তবে অভিযোগগুলোর বিন্দুমাত্রও যদি সত্য হয়, তাহলে তা হবে মারাত্মক অপরাধজনিত একটি কাজ। উপাচার্য অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি। তিনি যদি অন্যায় কাজ করে থাকেন, তাহলে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আর সেটা যদি হয় শিক্ষক নিয়োগসংক্রান্ত, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে। একজন অযোগ্য ব্যক্তি যদি কোনো বাঁকা পথে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন, একদিন সেই ব্যক্তি বিভাগীয় সভাপতি অথবা অনুষদের ডিন হবেন এবং একসময় তাঁর উপাচার্য হওয়ার খায়েশও জাগতে পারে। এমন শিক্ষক যে বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই, তা নয়। তবে তাঁদের সংখ্যা হাতে গোনা।
আরেকটি বিষয় গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে হবে। একসময় ভালো ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অথবা সরকারি আমলা হতে চাইত। এখন কিন্তু তাদের সেই আকর্ষণটা কমে গেছে। কারণ, এই দুই ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা অথবা বেতন-ভাতা বেসরকারি খাত থেকে অনেক কম। এসব বিষয় সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে তেমন প্রতিফলিত হয় না।
কয়েক দিন আগে প্রথম আলোতেই সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হলো। দেশের ৩৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে চারটি, যথা ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইনে পরিচালিত হয়। এই আইনে বলা আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট তিনজনের একটি প্যানেল নির্বাচিত করবে এবং সেই প্যানেল থেকে চ্যান্সেলর একজনকে চার বছর মেয়াদের জন্য উপাচার্য নিয়োগ দেবেন। রেওয়াজ অনুযায়ী একবার একজন উপাচার্য নিয়োগপ্রাপ্ত হলে তখন সেই প্যানেল আপনাআপনি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ধারাটি একসময় বলবৎ করার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেল খালেদা জিয়ার ১৯৯১ সালে সরকার গঠন করার পর। তিনি রাতারাতি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ১১ জন উপাচার্য, সহ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষকে তাঁদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে নিজের দলীয় লোক বসিয়ে দিলেন। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নব নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্যের সকাল পর্যন্ত তর সইল না। তিনি রাতেই উপাচার্যের কক্ষের তালা ভেঙে তাঁর নতুন পদে যোগদান করলেন। আবার কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়তো একজন নতুন উপাচার্য ১৯৭৩ সালের আইন অনুযায়ী নিয়োগপ্রাপ্ত হলেন। অন্য আরেক দল শিক্ষক বললেন, এই নিয়োগ মানি না। কেন মানি না, তার যুক্তিসংগত উত্তর নেই।
আমাকে ১৯৯৬ সালের ৬ নভেম্বর চ্যান্সেলর (তখন প্রধানমন্ত্রী) আমার অধ্যাপকের দায়িত্বের পাশাপাশি উপাচার্যের একটি বাড়তি দায়িত্ব দিলেন। সিনেট কর্তৃক উপাচার্য প্যানেল তৈরি করা সম্ভব নয়। কারণ, দুজন শিক্ষক এই নির্বাচনের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে মামলা করেছেন এবং আদালত একটা স্থগিতাদেশ দিয়েছেন। চেষ্টা করছিলাম সেই স্থগিতাদেশ খারিজ করে সিনেট ডেকে প্যানেল নির্বাচন দিতে। আমার একাধিক সহকর্মী, যাঁরা আবার নিজেদের বঙ্গবন্ধুর সৈনিক বলে দাবি করেন, তাঁরা পত্রপত্রিকায় লেখালেখি শুরু করলেন আমার দুরভিসন্ধি চরিতার্থ করার জন্য আমি মামলার ব্যাপারে পদক্ষেপ নিচ্ছি না। উচ্চ আদালতের কজ লিস্টে মামলাটি ১৮ বার উঠল ঠিক কিন্তু শুনানি হলো না। ১৯তম বারে শুনানি হলো এবং আদালত বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে রায় দিলেন। রায় পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কালবিলম্ব না করে আমি সিনেট ডেকে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু করলে এবার একজন উল্টো মামলা ঠুকে দিলেন আমার বিরুদ্ধে। বাদীর পেছনে সেই স্বঘোষিত বঙ্গবন্ধুর সৈনিকেরা। তাঁদের বক্তব্য, সিনেট মেয়াদোত্তীর্ণ সুতরাং এই প্যানেল করা আইনসম্মত নয়। গত এক যুগেও বিষয়টির আর সুরাহা হয়নি। সুতরাং যাঁরা এসব বিষয়ে সংবাদ পরিবেশন করেন, তাঁদের কাছে অনেক তথ্য থাকে না।
এমন একটি বিষয়ের সর্বশেষ উদাহরণ। খবর প্রকাশিত হয়েছে বর্তমান উপাচার্য তাঁর পুত্রকে চাকরি দেওয়ার জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজকে রাতারাতি শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে রূপান্তর করেছেন। বাস্তবতা হচ্ছে, ২০০৪ সাল থেকে এই কলেজকে ইনস্টিটিউটে রূপান্তর করার জন্য প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। কারণ, সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে কলেজকে বাজেটে অর্থ বরাদ্দ করতে অস্বীকার করে আসছে অনেক বছর ধরে। একসময় তা বন্ধও করে দেওয়া হয়। ঘটনাচক্রে বর্তমান প্রশাসনের আমলে ইনস্টিটিউটকে সরকার অনুমোদন দেয়। তাতে বর্তমান প্রশাসন বা উপাচার্যের তেমন কৃতিত্ব আছে বলা যাবে না। তার পরও তাঁকে সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়। আর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের পরিচালনা পর্ষদের প্রধান হয়ে থাকেন সহ-উপাচার্য। উপাচার্যের ছেলে বা আত্মীয়স্বজনের যদি যোগ্যতা থাকে, তাহলে তাঁর চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা হওয়া উচিত নয়। আর যদি তাঁর যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে, তবে তা নিঃসন্দেহে একটি চরম অপরাধমূলক কাজ।
বর্তমানে যেসব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে অনিয়ম বা দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, তার প্রতিটির তদন্ত হওয়া উচিত এবং কেউ যদি দোষী সাব্যস্ত হন, তাঁর আইনানুগ শাস্তি হওয়া উচিত। শিক্ষাঙ্গনগুলো যদি অনিয়ম বা দুর্নীতির লালনক্ষেত্রে পরিণত হয়, তাহলে তা সমগ্র জাতির জন্য তা অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয়। আর সরকার বা চ্যান্সেলর যখন একজন ব্যক্তিকে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ পদে নিয়োগ দেন, ওই ব্যক্তির নিয়োগের দলীয় আনুগত্যই একমাত্র মাপকাঠি হওয়া উচিত নয়। সততা, পাণ্ডিত্য, প্রজ্ঞা, প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা আর নেতৃত্ব দেওয়ার সক্ষমতাই একজন ব্যক্তিকে উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান মাপকাঠি হওয়া উচিত। এ কথাও ঠিক, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সবকিছু অন্ধকারাচ্ছন্ন নয়।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments