বিদ্যুৎ খাতকে বাঁচাতে যা করণীয় by ড. এম শামসুল আলম
শুরুতেই মূল্যহার ও ঘাটতি প্রসঙ্গ। ২০০৯
সালে পাইকারি বিদ্যুতের মূল্যহার ছিল ২.৩৭ টাকা। তখন বিদ্যুৎ উৎপাদনে
সরকারি খাত লাভজনক থাকা সত্ত্বেও ব্যক্তি খাত থেকে আইপিপি ও এসআইপিপির কেনা
বিদ্যুতের দাম অধিক হওয়ায় বিদ্যুৎ খাত আর্থিক ঘাটতির শিকার হয়।
ফলে
ওই সময় এ মূল্যহার বৃদ্ধি করে ২.৬২ টাকা করা হয়। এখন ৪.৭০ টাকা। এ
মূল্যহারে বিদ্যুৎ বিক্রিতে চলতি বছর সরকারি খাতে লাভ হবে এক হাজার ৯৬৮
কোটি টাকা, আইপিপি ও ক্ষুদ্র আইপিপির বিদ্যুতে লস হবে ৩৬৮ কোটি টাকা।
আরপিপি ও কিউআরপিপির বিদ্যুতে লস হবে পাঁচ হাজার ৯৯৭ কোটি টাকা। পিডিবি
অদ্যাবধি কোনো ভর্তুকি পায়নি। ঘাটতি বা লস মোকাবিলার জন্য ভর্তুকির
পরিবর্তে ৩ শতাংশ সুদে পিডিবি লোন পায়। এ সুদ ঘাটতি আরো বাড়ায়। ফলে এ ঘাটতি
মোকাবিলার জন্য একদিকে বিদ্যুতের মূল্যহার বৃদ্ধির চেষ্টা চলে, অন্যদিকে
তেলবিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় কমানো হয়।
উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি
জ্বালানি তেলের উচ্চ মূল্য এবং হরহামেশাই সে মূল্য বৃদ্ধি বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় ও ব্যয়হার বৃদ্ধির একমাত্র কারণ নয়। সরকারি বিনিয়োগ না করে ব্যক্তিমালিকানায় ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগে গ্যাস বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। বিগত চার বছরে উল্লেখযোগ্য গ্যাস সরবরাহ প্রবৃদ্ধি হলেও বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস সরবরাহ তেমন বাড়েনি।
উৎপাদনে বিনিয়োগ
বিদ্যুৎ খাত সংস্কারের মূল লক্ষ্য ব্যক্তি খাত বিনিয়োগে ব্যক্তিমালিকানায় বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করা। সে বিনিয়োগ আকর্ষণে নানা অজুহাতে বিদ্যুতের মূল্যহার বৃদ্ধি করে বিনিয়োগকারীর জন্য পর্যাপ্ত মুনাফা নিশ্চিত করা। ফলে উৎপাদনে সরকারি বিনিয়োগ পর্যায়ক্রমে কমিয়ে আনা হচ্ছে। অথচ গ্যাস ও তেলভিত্তিক পিকিং বিদ্যুৎপ্লান্ট সরকারি বিনিয়োগে সরকারি মালিকানায় নির্মাণ অব্যাহত রয়েছে। প্লান্ট ক্রয় প্রক্রিয়ায় বিদ্যুৎ বিভাগের বিরুদ্ধে অস্বচ্ছতার অভিযোগ রয়েছে। তা ছাড়া আইপিপির বিদ্যুতের স্থির ব্যয়হার তারতম্যে এমন অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া যায়। বিনিয়োগ ব্যয়হার পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্লান্ট ফ্যাক্টরের উল্লেখযোগ্য তারতম্য না থাকা সত্ত্বেও পিডিবির ফার্নেস অয়েলভিত্তিক পিকিংপ্লান্ট বিদ্যুতের এ ব্যয়হার তারতম্য ৩.৪১ টাকা থেকে ১০.৮৯ টাকা অবধি। কুইক রেন্টালের ক্ষেত্রে ৬.১৩ টাকা থেকে ১৯.৫৯ টাকা। এসআইপিপির ক্ষেত্রে এ তারতম্য ২.৯২ টাকা থেকে ৫.০৪ টাকা পর্যন্ত। গ্যাসভিত্তিক আইপিপি ও এসআইপিপির প্লান্টের ক্ষেত্রে এ তারতম্য ০.৬৪ টাকা থেকে ২.২৬ টাকা। এ ধরনের ব্যাপক তারতম্যের কোনো যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
ব্যয় নিয়ন্ত্রণ
সে জন্য আরপিপি ও কিউআরপিপির চুক্তির মেয়াদ নবায়ন বা বৃদ্ধি না করা নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে সব ডিজেলপ্লান্ট বাধ্যতামূলকভাবে অবসরে দিতে হবে। খুলনা বিদ্যুৎ প্লান্টের মতো কারিগরি বিবেচনায় অকেজো বা অচল প্লান্টকেও অবসরে পাঠাতে হবে। সরকারি মালিকানাধীন প্লান্টগুলোর সংস্কার, নবায়ন ও উন্নয়নে অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং তাতে সরকারি বিনিয়োগ হতে হবে। এভাবে অব্যবহারযোগ্য উৎপাদন ক্ষমতা কমিয়ে এনে ব্যবহারযোগ্য ক্ষমতা পরি্পূর্ণভাবে কাজে লাগানো হলে একদিকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় কমে আসবে, অন্যদিকে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। এমন সহজ ও সঠিক পথে কি বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধান হবে? হবে না।
সরবরাহ ব্যয় বৃদ্ধি
উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি হলে বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যয় বৃদ্ধি পায়। আবার এ ব্যয় বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যয় এবং উভয় ক্ষেত্রে সিস্টেম লস বৃদ্ধিতেও বৃদ্ধি পায়। সংবিধান মতে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থার মালিক জনগণ হলেও তা বণিজ্যিকভাবে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে তার শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে ব্যক্তিমালিকানায় হস্তান্তর চলছে। ফলে বিতরণ ব্যয় কমিয়ে আনার সুযোগ থাকলেও মুনাফার জন্য নানাভাবে তা বৃদ্ধির কৌশল গ্রহণ করায় সরবরাহ ব্যয় বাড়ছে। সঞ্চালন কম্পানি হিসেবে পিজিসিবি লাভজনক। তার শেয়ার ২৫ শতাংশ বিক্রি হয়েছে। বিতরণ কম্পানি হিসেবে ডেসকো ও ডিপিডিসি লাভজনক। ডেসকোর শেয়ার ২৫ শতাংশ বিক্রি হয়েছে। ডিপিডিসির শেয়ার বিক্রি প্রক্রিয়াধীন। অন্যান্য বিতরণ সংস্থা লোকসানে রয়েছে। গ্রাহক পর্যায়ে মূল্যবৃদ্ধিতে তারতম্য না থাকায় লাভজনক প্রতিষ্ঠান আরো লাভবান হয়, লোকসানে থাকা প্রতিষ্ঠান কখনোই লাভবান হতে পারে না। ফলে লোকসানের দায়ভার সরকার তথা জনগণ বহন করে। কম্পানির মুনাফায় জনগণের কোনো অধিকার নেই। জনবল ব্যয় বৃদ্ধির কারণে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির মতোই বিতরণ ব্যয় বাড়ায়। ফলে বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যয় বৃদ্ধি পায়। সম্প্রতি পশ্চিমাঞ্চল বিদ্যুৎ বিতরণ কম্পানিতে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী একসঙ্গে ১৫২ জন নিয়োগ হয়েছে। এসব ব্যয় বৃদ্ধি ও নিয়োগ বিদ্যুৎ খাত উন্নয়নের জন্য হয়নি, মহলবিশেষের স্বার্থে হয়েছে। তাই এ ব্যয় কমানোসহ নানা কৌশলে সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যয় কমিয়ে বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যয় কমানোর সুযোগ থাকলেও তা না করে কেবল ভোক্তাদের বিদ্যুতের বিল বেশি বেশি বাড়ানোর চেষ্টা চলেছে।
সরবরাহ উন্নয়নে বিনিয়োগ
৩৩ কেভি ভোল্টেজ লেভেল থেকে নিচের ভোল্টেজ লেভেলের বিদ্যুৎ লাইনগুলো বিতরণ কম্পানির আওতাধীন এবং ১৩২ কেভি ও তার ওপরের বিদ্যুৎ লাইন সঞ্চালন কম্পানি পিজিসিবির আওতাধীন। অথচ এরূপ ৪টি ১৩২ কেভি লাইন ডিপিডিসির আওতাধীন রয়েছে। বিইআরসির গণশুনানিতে প্রতীয়মান হয়, ডিপিডিসির প্রদর্শিত সিস্টেম লস প্রকৃত সিস্টেম লস অপেক্ষা কম। তাদের অধীনে থাকা ১৩২ কেভি লাইনের সিস্টেম লসের সঙ্গে তাদের লস সমন্বয় করে কম দেখানো হয়। গণশুনানিতে এ লাইনগুলো পিজিসিবির কাছে হস্তান্তরের প্রস্তাবে ডিপিডিসি সম্মত হলেও তা হস্তান্তর হয়নি। এ ধরনের সুযোগ ডেসকো নেওয়ার লক্ষ্যে তাদের আওতায় ৬টি ১৩২ কেভি সঞ্চালন লাইন নির্মাণের প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। এ রূপ উন্নয়নে বিনিয়োগ বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যয়হার কমাতে যদি সহায়ক না হয়, তাহলে এ বিনিয়োগ যৌক্তিক ও সামঞ্জস্যপূর্ণ বলা চলে না।
মূল্যহার বৈষম্যে ভোক্তা
পাইকারি বিদ্যুতের মূল্যহার আরইবির জন্য সর্বাপেক্ষা কম। ৪.০৩ টাকা। এ মূল্যহার ডিপিডিসি ও ডেসকোর জন্য ৫.৪০ টাকা। ডিপিডিসি ও ডেসকোর মতোই আরইবির আওতাধীন ৭১টি পিবিএসের মধ্যে আটটি লাভজনক। বাদবাকি পিবিএস সব সময় লোকসানে থাকে। ন্যায্য ও সমতার প্রশ্নে লাভজনক পিবিএসগুলোর দামহার ডিপিডিসি ও ডেসকোর অনুরূপ হওয়াই ছিল যৌক্তিক। তাতে সরবরাহ ব্যয়হার কমে আসত। অথচ বিদ্যুতের দামহার ঢাকায় যে শ্রেণীর আবাসিক গ্রাহকের জন্য ৩.৩৩ টাকা, গ্রামে সে শ্রেণীর গ্রাহকের জন্য ৩.৬৬ টাকা। আবার পিবিএস ভেদে এর তারতম্য ও বৈষম্য রয়েছে। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে বিদ্যুতের দামহার ৬.৯৫ টাকা। এরা ফিডার লাইন থেকে বিদ্যুৎ নেয় এবং সবচেয়ে বেশি লোডশেডিং ভোগ করে। ১৩২ কেভি ভোল্টেজ লেভেলে শিল্প গ্রাহকের জন্য দামহার ৬.১৬ টাকা। তারা লোডশেডিংমুক্ত বিদ্যুৎ পায়। ৩৩ কেভি ভোল্টেজ লেভেলে মাঝারি শিল্প গ্রাহক বিদ্যুৎ পায় ৬.৪৮ টাকা দামহারে। ১১ কেভি ভোল্টেজ লেভেলে সে দামহার ৬.৮১ টাকা। এ তারতম্য ও বৈষম্যে দেখা যায়, মূল্যহার বিভাজনে বৃহৎ তথা ধনী শিল্প গ্রাহক সুবিধা পাচ্ছে এবং ক্ষুদ্র তথা গরিব শিল্প গ্রাহক বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। এখানে লক্ষণীয়, বৃহৎ ও মাঝারি শিল্প গ্রাহক ভর্তুকি সুবিধা পাচ্ছে। বাণিজ্যক গ্রাহক হিসেবে পান-বিড়ির দোকানদারের জন্য বিদ্যুতের দামহার ৯ টাকা। অথচ বসুন্ধরার মতো অল এয়ার কন্ডিশন্ড বড় মার্কেট বিদ্যুৎ পায় ৬.৩০ টাকা দাম হারে। নির্মাণ ও বিনোদন অনুষ্ঠানাদিতে ব্যবহৃত বিদ্যুতের দামহারও ৯ টাকা। এমন বৈষম্য সভ্য সমাজে কোথাও কি চলে! এ ধরনের অসংগতি আরো অনেক ক্ষেত্রেই রয়েছে। ১১ কেভি থেকে ১৩২ কেভি ভোল্টেজ লেভেলে শিল্প গ্রাহক মোট সরবরাহকৃত বিদ্যুতের ৪০ শতাংশ পায়। বণিজ্যিক গ্রাহক পায় ১১ শতাংশ। এসি আবাসিক গ্রাহক ও বিনোদন অনুষ্ঠানাদিতে ব্যয় হতে পারে ৫ শতাংশ। মোট ৫৬ শতাংশ। পাইকারি বিদ্যুতের ৫৬ শতাংশ যদি প্রদত্ত ভর্তুকির আওতাবহির্ভূত রাখা হতো, তাহলে আর্থিক ঘাটতি অনায়াসে ২.৫ হাজার কোটি টাকা কমে আসত।
বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন
শুরুর কথা ছিল, মানব উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য টেকসই জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। তা নিশ্চিত হলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ১০ শতাংশের অধিক হারে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখার তাগিদে টেকসই জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত হবে এবং সহনীয় দামহারে জনগণের বিদ্যুৎ প্রাপ্তি নিশ্চিত হবে। বর্তমান এবং নিকট-ভবিষ্যতে বিদ্যুতের সিংহভাগই উৎপাদন হবে গ্যাস থেকে। সে গ্যাসের উৎপাদান উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়লেও গ্যাসের চাহিদাও বেড়েছে। ফলে চাহিদামাফিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের সরবরাহ বৃদ্ধির সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। জ্বালানি তেল ছাড়া বিকল্প জ্বালানির এখনো কোনো ব্যবস্থা হয়নি। উৎপাদন ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও একদিকে গ্যাস স্বল্পতার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হচ্ছে, অন্যদিকে উৎপাদন ব্যয় নিয়ন্ত্রণের জন্য তেলবিদ্যুৎ কম উৎপাদন করা হচ্ছে। এতে বোঝা যায়, জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা কত অনিশ্চিত!
শেষের কথা
আশা করি পাঠক এতক্ষণে নিশ্চয় অনুধাবন করেছেন, বিদ্যুৎ বিভাগ ব্যবসায়ীদের চাপে কিভাবে ভাড়া ও দ্রুত ভাড়া বিদ্যুতের মেয়াদ দীর্ঘায়িত করতে চলেছে, বিদ্যুৎ বণ্টন ও বিতরণে সেই ব্যবসায়ীরাই আবার কিভাবে সুযোগ ও সুবিধা পাচ্ছে। সেসব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করায় পত্রিকায় খবর হয় ধনীর বিদ্যুৎ বিল কমে, গরিবের বিদ্যুৎ বিল বাড়ে। বিদ্যুৎ উদ্যোক্তা ও ধনী ব্যবসায়ীদের মুনাফা ও ভোগ-বিলাসিতায় তছনছ হচ্ছে বিদ্যুৎ খাত। এ মুহূর্তে আর বিদ্যুৎ খাত উন্নয়নের কথা ভাবা বা বলা চলে না। কেবল কিভাবে মুহূর্ষু এ খাতকে বাঁচাতে হবে, তাই এখন একমাত্র ভাবার বিষয় হওয়া জরুরি। সে জন্য দরকার বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি রোধে জনগণ যেভাবে সোচ্চার হয়েছিল, রাস্তায় নেমেছিল, সেই একই ভাবে বিদ্যুৎ খাতকে বাঁচাতে জনগণকে সোচ্চার হতে হবে, রাস্তায় নামতে হবে। ব্যবসায়ীরা যেভাবে বাধ্য করছেন, জনগণকেও সেভাবেই বাধ্য করতে হবে। তাতে জনগণ সফল হলে তার সুফল ফুল, ফল ও ফসল হয়ে আগামী নির্বাচনে বর্তমান সরকারেরই ঘরে উঠবে। ইতিহাস থেকে এমন শিক্ষাই পাওয়া। জ্বালানি উপদেষ্টা কি সরকারকে এ শিক্ষা নিতে উপদেশ দেবেন? আগামী লেখায় হবে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের সুশাসন নিয়ে।
লেখক : জ্বালানি বিশেষজ্ঞ
উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি
জ্বালানি তেলের উচ্চ মূল্য এবং হরহামেশাই সে মূল্য বৃদ্ধি বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় ও ব্যয়হার বৃদ্ধির একমাত্র কারণ নয়। সরকারি বিনিয়োগ না করে ব্যক্তিমালিকানায় ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগে গ্যাস বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। বিগত চার বছরে উল্লেখযোগ্য গ্যাস সরবরাহ প্রবৃদ্ধি হলেও বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস সরবরাহ তেমন বাড়েনি।
উৎপাদনে বিনিয়োগ
বিদ্যুৎ খাত সংস্কারের মূল লক্ষ্য ব্যক্তি খাত বিনিয়োগে ব্যক্তিমালিকানায় বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করা। সে বিনিয়োগ আকর্ষণে নানা অজুহাতে বিদ্যুতের মূল্যহার বৃদ্ধি করে বিনিয়োগকারীর জন্য পর্যাপ্ত মুনাফা নিশ্চিত করা। ফলে উৎপাদনে সরকারি বিনিয়োগ পর্যায়ক্রমে কমিয়ে আনা হচ্ছে। অথচ গ্যাস ও তেলভিত্তিক পিকিং বিদ্যুৎপ্লান্ট সরকারি বিনিয়োগে সরকারি মালিকানায় নির্মাণ অব্যাহত রয়েছে। প্লান্ট ক্রয় প্রক্রিয়ায় বিদ্যুৎ বিভাগের বিরুদ্ধে অস্বচ্ছতার অভিযোগ রয়েছে। তা ছাড়া আইপিপির বিদ্যুতের স্থির ব্যয়হার তারতম্যে এমন অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া যায়। বিনিয়োগ ব্যয়হার পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্লান্ট ফ্যাক্টরের উল্লেখযোগ্য তারতম্য না থাকা সত্ত্বেও পিডিবির ফার্নেস অয়েলভিত্তিক পিকিংপ্লান্ট বিদ্যুতের এ ব্যয়হার তারতম্য ৩.৪১ টাকা থেকে ১০.৮৯ টাকা অবধি। কুইক রেন্টালের ক্ষেত্রে ৬.১৩ টাকা থেকে ১৯.৫৯ টাকা। এসআইপিপির ক্ষেত্রে এ তারতম্য ২.৯২ টাকা থেকে ৫.০৪ টাকা পর্যন্ত। গ্যাসভিত্তিক আইপিপি ও এসআইপিপির প্লান্টের ক্ষেত্রে এ তারতম্য ০.৬৪ টাকা থেকে ২.২৬ টাকা। এ ধরনের ব্যাপক তারতম্যের কোনো যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
ব্যয় নিয়ন্ত্রণ
সে জন্য আরপিপি ও কিউআরপিপির চুক্তির মেয়াদ নবায়ন বা বৃদ্ধি না করা নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে সব ডিজেলপ্লান্ট বাধ্যতামূলকভাবে অবসরে দিতে হবে। খুলনা বিদ্যুৎ প্লান্টের মতো কারিগরি বিবেচনায় অকেজো বা অচল প্লান্টকেও অবসরে পাঠাতে হবে। সরকারি মালিকানাধীন প্লান্টগুলোর সংস্কার, নবায়ন ও উন্নয়নে অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং তাতে সরকারি বিনিয়োগ হতে হবে। এভাবে অব্যবহারযোগ্য উৎপাদন ক্ষমতা কমিয়ে এনে ব্যবহারযোগ্য ক্ষমতা পরি্পূর্ণভাবে কাজে লাগানো হলে একদিকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় কমে আসবে, অন্যদিকে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। এমন সহজ ও সঠিক পথে কি বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধান হবে? হবে না।
সরবরাহ ব্যয় বৃদ্ধি
উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি হলে বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যয় বৃদ্ধি পায়। আবার এ ব্যয় বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যয় এবং উভয় ক্ষেত্রে সিস্টেম লস বৃদ্ধিতেও বৃদ্ধি পায়। সংবিধান মতে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থার মালিক জনগণ হলেও তা বণিজ্যিকভাবে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে তার শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে ব্যক্তিমালিকানায় হস্তান্তর চলছে। ফলে বিতরণ ব্যয় কমিয়ে আনার সুযোগ থাকলেও মুনাফার জন্য নানাভাবে তা বৃদ্ধির কৌশল গ্রহণ করায় সরবরাহ ব্যয় বাড়ছে। সঞ্চালন কম্পানি হিসেবে পিজিসিবি লাভজনক। তার শেয়ার ২৫ শতাংশ বিক্রি হয়েছে। বিতরণ কম্পানি হিসেবে ডেসকো ও ডিপিডিসি লাভজনক। ডেসকোর শেয়ার ২৫ শতাংশ বিক্রি হয়েছে। ডিপিডিসির শেয়ার বিক্রি প্রক্রিয়াধীন। অন্যান্য বিতরণ সংস্থা লোকসানে রয়েছে। গ্রাহক পর্যায়ে মূল্যবৃদ্ধিতে তারতম্য না থাকায় লাভজনক প্রতিষ্ঠান আরো লাভবান হয়, লোকসানে থাকা প্রতিষ্ঠান কখনোই লাভবান হতে পারে না। ফলে লোকসানের দায়ভার সরকার তথা জনগণ বহন করে। কম্পানির মুনাফায় জনগণের কোনো অধিকার নেই। জনবল ব্যয় বৃদ্ধির কারণে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির মতোই বিতরণ ব্যয় বাড়ায়। ফলে বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যয় বৃদ্ধি পায়। সম্প্রতি পশ্চিমাঞ্চল বিদ্যুৎ বিতরণ কম্পানিতে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী একসঙ্গে ১৫২ জন নিয়োগ হয়েছে। এসব ব্যয় বৃদ্ধি ও নিয়োগ বিদ্যুৎ খাত উন্নয়নের জন্য হয়নি, মহলবিশেষের স্বার্থে হয়েছে। তাই এ ব্যয় কমানোসহ নানা কৌশলে সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যয় কমিয়ে বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যয় কমানোর সুযোগ থাকলেও তা না করে কেবল ভোক্তাদের বিদ্যুতের বিল বেশি বেশি বাড়ানোর চেষ্টা চলেছে।
সরবরাহ উন্নয়নে বিনিয়োগ
৩৩ কেভি ভোল্টেজ লেভেল থেকে নিচের ভোল্টেজ লেভেলের বিদ্যুৎ লাইনগুলো বিতরণ কম্পানির আওতাধীন এবং ১৩২ কেভি ও তার ওপরের বিদ্যুৎ লাইন সঞ্চালন কম্পানি পিজিসিবির আওতাধীন। অথচ এরূপ ৪টি ১৩২ কেভি লাইন ডিপিডিসির আওতাধীন রয়েছে। বিইআরসির গণশুনানিতে প্রতীয়মান হয়, ডিপিডিসির প্রদর্শিত সিস্টেম লস প্রকৃত সিস্টেম লস অপেক্ষা কম। তাদের অধীনে থাকা ১৩২ কেভি লাইনের সিস্টেম লসের সঙ্গে তাদের লস সমন্বয় করে কম দেখানো হয়। গণশুনানিতে এ লাইনগুলো পিজিসিবির কাছে হস্তান্তরের প্রস্তাবে ডিপিডিসি সম্মত হলেও তা হস্তান্তর হয়নি। এ ধরনের সুযোগ ডেসকো নেওয়ার লক্ষ্যে তাদের আওতায় ৬টি ১৩২ কেভি সঞ্চালন লাইন নির্মাণের প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। এ রূপ উন্নয়নে বিনিয়োগ বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যয়হার কমাতে যদি সহায়ক না হয়, তাহলে এ বিনিয়োগ যৌক্তিক ও সামঞ্জস্যপূর্ণ বলা চলে না।
মূল্যহার বৈষম্যে ভোক্তা
পাইকারি বিদ্যুতের মূল্যহার আরইবির জন্য সর্বাপেক্ষা কম। ৪.০৩ টাকা। এ মূল্যহার ডিপিডিসি ও ডেসকোর জন্য ৫.৪০ টাকা। ডিপিডিসি ও ডেসকোর মতোই আরইবির আওতাধীন ৭১টি পিবিএসের মধ্যে আটটি লাভজনক। বাদবাকি পিবিএস সব সময় লোকসানে থাকে। ন্যায্য ও সমতার প্রশ্নে লাভজনক পিবিএসগুলোর দামহার ডিপিডিসি ও ডেসকোর অনুরূপ হওয়াই ছিল যৌক্তিক। তাতে সরবরাহ ব্যয়হার কমে আসত। অথচ বিদ্যুতের দামহার ঢাকায় যে শ্রেণীর আবাসিক গ্রাহকের জন্য ৩.৩৩ টাকা, গ্রামে সে শ্রেণীর গ্রাহকের জন্য ৩.৬৬ টাকা। আবার পিবিএস ভেদে এর তারতম্য ও বৈষম্য রয়েছে। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে বিদ্যুতের দামহার ৬.৯৫ টাকা। এরা ফিডার লাইন থেকে বিদ্যুৎ নেয় এবং সবচেয়ে বেশি লোডশেডিং ভোগ করে। ১৩২ কেভি ভোল্টেজ লেভেলে শিল্প গ্রাহকের জন্য দামহার ৬.১৬ টাকা। তারা লোডশেডিংমুক্ত বিদ্যুৎ পায়। ৩৩ কেভি ভোল্টেজ লেভেলে মাঝারি শিল্প গ্রাহক বিদ্যুৎ পায় ৬.৪৮ টাকা দামহারে। ১১ কেভি ভোল্টেজ লেভেলে সে দামহার ৬.৮১ টাকা। এ তারতম্য ও বৈষম্যে দেখা যায়, মূল্যহার বিভাজনে বৃহৎ তথা ধনী শিল্প গ্রাহক সুবিধা পাচ্ছে এবং ক্ষুদ্র তথা গরিব শিল্প গ্রাহক বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। এখানে লক্ষণীয়, বৃহৎ ও মাঝারি শিল্প গ্রাহক ভর্তুকি সুবিধা পাচ্ছে। বাণিজ্যক গ্রাহক হিসেবে পান-বিড়ির দোকানদারের জন্য বিদ্যুতের দামহার ৯ টাকা। অথচ বসুন্ধরার মতো অল এয়ার কন্ডিশন্ড বড় মার্কেট বিদ্যুৎ পায় ৬.৩০ টাকা দাম হারে। নির্মাণ ও বিনোদন অনুষ্ঠানাদিতে ব্যবহৃত বিদ্যুতের দামহারও ৯ টাকা। এমন বৈষম্য সভ্য সমাজে কোথাও কি চলে! এ ধরনের অসংগতি আরো অনেক ক্ষেত্রেই রয়েছে। ১১ কেভি থেকে ১৩২ কেভি ভোল্টেজ লেভেলে শিল্প গ্রাহক মোট সরবরাহকৃত বিদ্যুতের ৪০ শতাংশ পায়। বণিজ্যিক গ্রাহক পায় ১১ শতাংশ। এসি আবাসিক গ্রাহক ও বিনোদন অনুষ্ঠানাদিতে ব্যয় হতে পারে ৫ শতাংশ। মোট ৫৬ শতাংশ। পাইকারি বিদ্যুতের ৫৬ শতাংশ যদি প্রদত্ত ভর্তুকির আওতাবহির্ভূত রাখা হতো, তাহলে আর্থিক ঘাটতি অনায়াসে ২.৫ হাজার কোটি টাকা কমে আসত।
বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন
শুরুর কথা ছিল, মানব উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য টেকসই জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। তা নিশ্চিত হলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ১০ শতাংশের অধিক হারে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখার তাগিদে টেকসই জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত হবে এবং সহনীয় দামহারে জনগণের বিদ্যুৎ প্রাপ্তি নিশ্চিত হবে। বর্তমান এবং নিকট-ভবিষ্যতে বিদ্যুতের সিংহভাগই উৎপাদন হবে গ্যাস থেকে। সে গ্যাসের উৎপাদান উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়লেও গ্যাসের চাহিদাও বেড়েছে। ফলে চাহিদামাফিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের সরবরাহ বৃদ্ধির সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। জ্বালানি তেল ছাড়া বিকল্প জ্বালানির এখনো কোনো ব্যবস্থা হয়নি। উৎপাদন ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও একদিকে গ্যাস স্বল্পতার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হচ্ছে, অন্যদিকে উৎপাদন ব্যয় নিয়ন্ত্রণের জন্য তেলবিদ্যুৎ কম উৎপাদন করা হচ্ছে। এতে বোঝা যায়, জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা কত অনিশ্চিত!
শেষের কথা
আশা করি পাঠক এতক্ষণে নিশ্চয় অনুধাবন করেছেন, বিদ্যুৎ বিভাগ ব্যবসায়ীদের চাপে কিভাবে ভাড়া ও দ্রুত ভাড়া বিদ্যুতের মেয়াদ দীর্ঘায়িত করতে চলেছে, বিদ্যুৎ বণ্টন ও বিতরণে সেই ব্যবসায়ীরাই আবার কিভাবে সুযোগ ও সুবিধা পাচ্ছে। সেসব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করায় পত্রিকায় খবর হয় ধনীর বিদ্যুৎ বিল কমে, গরিবের বিদ্যুৎ বিল বাড়ে। বিদ্যুৎ উদ্যোক্তা ও ধনী ব্যবসায়ীদের মুনাফা ও ভোগ-বিলাসিতায় তছনছ হচ্ছে বিদ্যুৎ খাত। এ মুহূর্তে আর বিদ্যুৎ খাত উন্নয়নের কথা ভাবা বা বলা চলে না। কেবল কিভাবে মুহূর্ষু এ খাতকে বাঁচাতে হবে, তাই এখন একমাত্র ভাবার বিষয় হওয়া জরুরি। সে জন্য দরকার বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি রোধে জনগণ যেভাবে সোচ্চার হয়েছিল, রাস্তায় নেমেছিল, সেই একই ভাবে বিদ্যুৎ খাতকে বাঁচাতে জনগণকে সোচ্চার হতে হবে, রাস্তায় নামতে হবে। ব্যবসায়ীরা যেভাবে বাধ্য করছেন, জনগণকেও সেভাবেই বাধ্য করতে হবে। তাতে জনগণ সফল হলে তার সুফল ফুল, ফল ও ফসল হয়ে আগামী নির্বাচনে বর্তমান সরকারেরই ঘরে উঠবে। ইতিহাস থেকে এমন শিক্ষাই পাওয়া। জ্বালানি উপদেষ্টা কি সরকারকে এ শিক্ষা নিতে উপদেশ দেবেন? আগামী লেখায় হবে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের সুশাসন নিয়ে।
লেখক : জ্বালানি বিশেষজ্ঞ
No comments