অসৎসঙ্গে রাজনীতি by এ কে এম শাহনাওয়াজ

ছেলেবেলা থেকে এই আপ্তবাক্যটি সবার জানা, 'সৎসঙ্গে স্বর্গবাস আর অসৎসঙ্গে সর্বনাশ।' বড় কোনো রাজনৈতিক দলের ভেতর যদি আদর্শিক জায়গাটি মজবুত না থাকে, দূরদর্শী নেতৃত্ব না থাকে ও সংকীর্ণ স্বার্থবাদিতা আচ্ছন্ন করে রাখে; তবে তেমন পরিস্থিতিতে অসৎসঙ্গের প্রভাব তাকে বিপন্ন করে তুলতে পারে।
অন্তত গত এক বছরের রাজনৈতিক ঘটনার বিশ্লেষণে বিএনপির অমন সর্বনাশের পথে এগিয়ে যাওয়াটাই প্রত্যক্ষ করছে মুক্তচিন্তার মানুষ। রাজনীতির ময়দানে এখন সবচেয়ে বড় বিষয় জাতীয় নির্বাচন। গণতন্ত্রের ব্যানারসর্বস্ব আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে এখন আর মানুষ কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্রচর্চা আশা করে না। তবু অগত্যা এই দলগুলোকেই প্রশ্রয় দেয় এবং প্রতিদিনই প্রত্যাশা করে, নিশ্চয়ই এসব দলের ভেতর দেশপ্রেমিক নেতা-নেত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে আর একসময় তারা যূথবদ্ধ হবেন। তাঁদের প্রভাবে অন্ধকার পথ হেঁটে গোষ্ঠীস্বার্থ সিদ্ধির জন্য ক্ষমতাসীন হওয়াকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করবেন না এখনকার ক্ষমতাপ্রত্যাশীরা। এর চেয়ে বেশি জরুরি মনে করবেন গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া। পরিতাপের বিষয়, এখন পর্যন্ত তেমন আশাবাদী হওয়ার মতো লক্ষণ আমাদের মহান রাজনীতিকরা দেখাতে পারছেন না।
বিএনপির বিগত সরকার পরিচালনার নানা ব্যর্থতা, অপশাসন, দুর্নীতি ও বিশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সব অপকীর্তির উন্মোচন দলটিকে মুমূর্ষু দশায় এনে দাঁড় করিয়েছিল। এর সম্পূর্ণ সুবিধা এসে জমা হয় আওয়ামী লীগের ভাণ্ডারে। কিঞ্চিৎ আওয়ামী লীগকে ভালোবেসে আর বাকিটা বিকল্প না থাকায় সাধারণ মানুষ মহাজোটকে সমর্থন দেয়। আওয়ামী লীগের সুবিধা ছিল, নেতা-নেত্রীদের পারফরম্যান্স যাই হোক দলটির কাঠামোতে একটি আদর্শিক ভিত্তি রয়েছে। তা ছাড়া দলটি মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে। পাশাপাশি বিপন্ন সময়ে মানুষের সামনে মহাজোট নিয়ে এসেছিল আধুনিক ও লাগসই নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। দিন বদলের কথা, ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা, মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার করার প্রতিশ্রুতি ইত্যাদির ভেতর মানুষ তাদের অন্তরের আকাঙ্ক্ষার খোঁজ পেয়েছিল। বিপরীতে ওই অবস্থায় বিএনপির 'দেশ বাঁচাও-মানুষ বাঁচাও' স্লোগানটিকে ভূতের মুখে রাম নামই মনে হয়েছে। সময়ের বাস্তবতায় তাই বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছিল মহাজোট। আশাবাদী মানুষ ধারণা করেছিল, আওয়ামী লীগ এবার গণতান্ত্রিক শক্তিতে ইতিবাচক রাজনীতি করার মতো সাহসী হবে। এক-এগারোর শিক্ষা ধারণ করে দুর্নীতিমুক্ত সরকার পরিচালনা করার পথে হাঁটবে। দলীয় সংকীর্ণতায় বন্দি না থেকে মানুষের রাজনীতি করায় মতো সাহসী হবে।
কিন্তু বাস্তবে মানুষকে খুব স্বস্তি দিতে পারল না আওয়ামী লীগ সরকার। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করা ও আংশিকভাবে ডিজিটাল বাংলাদেশের দিকে পা ফেলায় নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির দায় কিছুটা মিটিয়েছে আওয়ামী লীগ। 'দিন বদলে'র এই একটি প্রতিশ্রুতি পালন করার পথে হাঁটতে পারলে মানুষের যাপিত জীবনের অনেকটা প্রত্যাশা পূরণই সম্ভব হতো। কিন্তু দুর্ভাগ্য বলা যায়, এ পথে আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যর্থতার পাল্লাটাই বেশি ভারী।
এই বাস্তবতার সুবিধাটি পেয়ে যায় বিএনপি। কোমর সোজা করে দাঁড়ানোর মওকা পায় দলটি। আওয়ামী লীগ নেতা-নেত্রী অনেকের স্থূল বক্তব্য, অশাণিত আচরণ বিএনপির পায়ের নিচের মাটি অনেকটা শক্ত করে দেয়। এই সুযোগটি বিপন্নদশা বিএনপির যেভাবে গ্রহণ করা উচিত ছিল ব্যক্তিক, পারিবারিক ও গোষ্ঠীস্বার্থ চিন্তার বলয়বন্দি হয়ে বিএনপি নেতা-নেত্রীরা তা হাতছাড়া করে ফেললেন। একটু আধুনিক চিন্তায় পরিমার্জিত হয়ে অতীতের কলঙ্কিত অধ্যায়ের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে মানুষের আস্থার জায়গায় ফিরতে পারত। অথচ দূরদর্শিতার অভাবে বিএনপি নেতৃত্ব গতানুগতিকতার গণ্ডি এড়াতে পারলেন না। জামায়াতে ইসলামীর ৪ শতাংশ ভোটের নির্ভরতা বিএনপির আপন সক্ষমতা বৃদ্ধির পথ তৈরি করল না। দেশব্যাপী দল পুনর্গঠনের পথে হাঁটল না।
বাংলাদেশের মানুষ বিপ্লবী চেতনা ধারণ করে বেড়ে উঠেছে। এ দেশের মানুষের সাংস্কৃতিক গড়নে অসাম্প্রদায়িক মনোভাব সক্রিয়। সেখানে বিএনপির মতো একটি দলের নেতা-নেত্রীদের দশবার ভাবা উচিত ছিল, জামায়াত প্রযোজিত এ ধারার সাম্প্রদায়িক ষড়যন্ত্রের পরিণতি কেমন হওয়ার কথা।
রাজনীতিতে যেমন শেষ কথা বলে কিছু থাকে না; তেমনি সর্বনাশের চোরাবালিতে দাঁড়িয়ে বিএনপিরও ভাবা উচিত অন্ধকারের ক্লেদ ঝেড়ে ফেলে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ আছে। আওয়ামী লীগ তার ক্ষমতাকালে দিন বদলাতে পারেনি। সে চেষ্টা করেছে বলেও মানুষ বিশ্বাস করে না। দুর্নীতি আর দলীয়করণের রাজনীতি একইভাবে চলছে। সুতরাং গণমানুষের রাজনীতি করার মতো খোলা ময়দান এখনো পড়ে আছে। একে ব্যবহার করতে চাইলে বিএনপিকে খোলা মন নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। ছাড়তে হবে অসৎসঙ্গ। দেশজুড়ে অসংখ্য কর্মী-সমর্থক আছে বিএনপির। তারা দলকে ভালোবাসে। এই শক্তির ওপর ভর করতে পারলে রাজনীতির ময়দানে বিএনপি আবার নায়ক হতে পারবে, এ বিশ্বাস রাখা অযৌক্তিক নয়।

লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawazju@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.