মুজাহিদের বিরুদ্ধে মামলার রায় যে কোনো দিন
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের আরেকটি মামলার রায় আসছে। জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে এ মামলার রায় ঘোষণা করা হবে যেকোনো দিন। গতকাল বৃহস্পতিবার এ মামলার কার্যক্রম শেষে রায় অপেক্ষাধীন (সিএভি) রেখেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও মো. শাহিনুর ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-২-এ গতকাল রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষ হলে রায় অপেক্ষাধীন রাখা হয়। এর মধ্য দিয়ে এ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন চারটি মামলার কার্যক্রম শেষ হলো। এগুলোর তিনটির রায় ইতিমধ্যে ঘোষিত হয়েছে। এদিকে ট্রাইব্যুনাল-১-এ জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে করা মামলাটিও রায়ের অপেক্ষায় রয়েছে। ট্রাইব্যুনাল-১ ইতিমধ্যে একটি মামলার রায় দিয়েছেন। গতকাল রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি তুরিন আফরোজ আসামিপক্ষের যুক্তি খণ্ডন করতে গিয়ে বলেন, একাত্তরে মুজাহিদ ছিলেন ইসলামী ছাত্র সংঘের (জামায়াতের তৎকালীন ছাত্রসংগঠন) পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতি। তিনি ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জায়গা যেমন রংপুর, ফরিদপুর, কুমিল্লা ও বগুড়ায় ছাত্র সংঘের সদস্যদের উজ্জীবিত করতেন এবং পাকিস্তানি সেনাদের সহায়তা করার আহ্বান জানাতেন। বিভিন্ন সভা-সমাবেশে তিনি ‘বুদ্ধিজীবী-সাংবাদিক কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না’, ‘অস্ত্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র, যুক্তি নয়’—এসব স্লোগান দিতেন। এগুলো নথিতে প্রমাণিত। তাই তিনি কোনোভাবেই ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায় (সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি) এবং যৌথ দায়বদ্ধতা (জয়েন্ট ক্রিমিনাল এন্টারপ্রাইজ) এড়াতে পারেন না। সাক্ষ্যে পাওয়া গেছে, অপরাধ সংঘটনস্থলের আশপাশে মুজাহিদ থাকতেন। কিন্তু আসামিপক্ষ বলছে, তিনি সরাসরি অপরাধ করেননি। তাহলে কি তিনি অপরাধের সঙ্গে কোনোভাবেই যুক্ত নন? রাষ্ট্রপক্ষের এই কৌঁসুলি বলেন, ‘মুজাহিদ ওই সব অপরাধের অক্সিজেন হিসেবে কাজ করেছেন। আমরা অক্সিজেন দেখতে পারি না। কিন্তু অক্সিজেন ছাড়া আমরা কেউ-ই বাঁচতে পারব না।’ তিনি বলেন, স্বাধীনতার সূর্যসন্তান যাঁরা একটি নতুন দেশ গড়ার পরিকল্পনা করেছিলেন, তাঁদের তুলে নিয়ে একই কায়দায় একই স্থানে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। অনেক নথিতে দেখা গেছে, আলবদররাই বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে। যেহেতু মুজাহিদ ছিলেন আলবদরের নেতা, তাই তিনি দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। পরে এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি মোকলেছুর রহমান ট্রাইব্যুনাল, রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের আইনজীবীদের ধন্যবাদ জানান। এরপর আসামিপক্ষের আইনজীবী ইমরান এ সিদ্দিক দুই মিনিট পাল্টা জবাব দেন। যুক্তি উপস্থাপন শেষে ট্রাইব্যুনাল সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, যেকোনো দিন মামলার রায় হতে পারে। এ ট্রাইব্যুনাল গত ২১ জানুয়ারি মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার প্রথম রায়ে জামায়াতের সাবেক সদস্য (রুকন) পলাতক আবুল কালাম আযাদকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। ৫ ফেব্রুয়ারি আরেক মামলায় জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ এবং ৯ মে আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মাদ কামারুজ্জামানকে ফাঁসির আদেশ দেন। এদিকে ট্রাইব্যুনাল-১ গত ২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। কাদের মোল্লা ও সাঈদীর দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল বর্তমানে আপিল বিভাগে বিচারাধীন। গত বছরের ২১ জুন মুজাহিদের বিরুদ্ধে সাতটি অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল-২। এ মামলায় তদন্ত কর্মকর্তাসহ রাষ্ট্রপক্ষে ১৭ জন সাক্ষ্য দেন, আসামিপক্ষে সাক্ষ্য দেন মুজাহিদের ছেলে। ৭ মে যুক্তি উপস্থাপন শুরু হয়ে গতকাল শেষ হয়। মুজাহিদের বিরুদ্ধে সাত অভিযোগ: মুজাহিদের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ, একাত্তরে ইত্তেফাক-এর তৎকালীন কার্যনির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে অপহরণ ও হত্যা। দ্বিতীয় অভিযোগ হলো, ফরিদপুরের হিন্দু-অধ্যুষিত তিনটি গ্রাম বৈদ্যডাঙ্গি, মাঝিডাঙ্গি ও বালাডাঙ্গিতে হামলা ও অর্ধশতাধিক হিন্দুকে হত্যার সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা। তৃতীয় ও চতুর্থ অভিযোগ হলো, ফরিদপুরের রথখোলা গ্রামের রণজিৎ নাথ ও গোয়ালচামট খোদাবক্সপুর গ্রামের মো. আবু ইউসুফকে নির্যাতন। পঞ্চম অভিযোগ অনুসারে, একাত্তরের ৩০ আগস্ট মতিউর রহমান নিজামীকে নিয়ে মুজাহিদ নাখালপাড়ার পুরোনো এমপি হোস্টেলে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে যান। সেখানে আটক সুরকার আলতাফ মাহমুদ, বদি, রুমি, জুয়েল, আজাদকে দেখে একজন পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনকে বলেন, রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আগে এঁদের মেরে ফেলতে হবে। ওই সিদ্ধান্ত অনুসারে মুজাহিদ সঙ্গীদের সহযোগিতায় তাঁদের অমানবিক নির্যাতন করে হত্যা করেন। ষষ্ঠ অভিযোগ অনুসারে, মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে (বর্তমানে শারীরিক শিক্ষা কলেজ) পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে মুজাহিদ দলীয় নেতাদের নিয়ে বাঙালি নিধনের পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র করতেন। সপ্তম অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের ১৩ মে পাকিস্তানি সেনা ও স্থানীয় রাজাকারদের নিয়ে মুজাহিদ ফরিদপুরের হিন্দু-অধ্যুষিত বাকচর গ্রামে হামলা চালান। সেখানে নির্বিচার হত্যাকাণ্ড, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে।
No comments