সাদাকালো-'সীমাহীন অংশীদারিত্বে' বাংলাদেশের ভাবনা by আহমদ রফিক
প্রশংসা কার না ভালো লাগে! যখন তা কোনো
গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তথা গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রের কোনো প্রতিনিধির কণ্ঠে
উচ্চারিত হয়, তখন রাজনৈতিক-রাষ্ট্রনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে পা পিছলে
যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
বিশেষ করে সে বক্তব্য যখন হয়ে ওঠে
আঁটসাঁট, সংহত, যুক্তিনিষ্ঠ ও তথ্যপূর্ণ। সম্প্রতি 'রূপসী বাংলা' হোটেলে
আয়োজিত অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিবিষয়ক আন্ডারসেক্রেটারি ওয়েন্ডি আর
শারম্যানের বক্তৃতা পড়ে কথাগুলো মাথায় এলো।
ওয়েন্ডি শারম্যান বাংলাদেশের প্রশংসায় সাহিত্য-সংস্কৃতির সমৃদ্ধ সৃষ্টি, বৈশ্বিক মহলে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী বাহিনীর অবদান, নাগরিকদের গড় আয়ুর বৃদ্ধি, শিশু মৃত্যুর সংখ্যা হ্রাস, নারী-শিক্ষার উন্নয়ন হার, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, ধান উৎপাদন বৃদ্ধি ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার সম্ভাবনা, সর্বোপরি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারীর অবস্থান ইত্যাদি বিষয়ের উল্লেখ করেছেন। কিন্তু বলতে ভোলেননি চ্যালেঞ্জগুলোর কথা।
ভদ্র ভাষায় যা চ্যালেঞ্জ, তা সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের জন্য অপ্রিয় বচন। রাস্তাঘাটে চলাচলের বেহাল অবস্থায় অসহনীয় যানজট, আপত্তিকর হরতালের পর হরতাল ও সহিংসতা, যে সহিংসতা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিরোধী। বিরোধী বলেই তা সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাতে দেয়নি। আর একই কারণে তা সংখ্যালঘুদের মধ্যে ভয়ের উদ্রেক করে। জনসংখ্যার একটি অংশ নির্বিবাদে চরমপন্থী হয়ে ওঠে।
ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ না করেও অনায়াসে মেনে নিতে হয় এসব অভিযোগ, যা দেশের কিছুসংখ্যক মানুষের মুখেও শোনা গেছে, কারো কারো লেখায় দেখা গেছে। তাতে দেশের রাজনৈতিক শক্তির নাক-কান কাটা না গেলেও গেছে সাধারণ মানুষের, যাঁরা দেশ নিয়ে ভাবেন কিংবা গেছে যুক্তিবাদী মানুষের, যাঁরা রাজনীতির ভালো-মন্দ নিয়ে নিরপেক্ষ মতামত প্রকাশে দ্বিধা করেন না।
তবে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে তাজরীন ফ্যাশনস ও রানা প্লাজার ট্র্যাজেডি নিয়ে কথাবার্তায়, কী করা যেত এবং কী করা হয়নি তার বিচার-ব্যাখ্যায়। সংগত কারণে পোশাকশিল্পের বিষয়গুলো গুরুত্ব পেয়েছে। বিশেষ করে শ্রমিকদের নিরাপত্তা, মানসম্মত পরিবেশ রক্ষা, শ্রমমান ও শ্রমকল্যাণের বিষয়ে শ্রমিকদের মতামতের গুরুত্ব ইত্যাদি। শেষোক্ত বিষয়টি নিয়ে এ দেশে অনেক অভিযোগ ও সমালোচনা প্রকাশ পেয়েছে। এর প্রকৃত তাৎপর্য শক্তিশালী ট্রেড ইউনিয়নের দাবি, যা শ্রমিকদের সার্বিক প্রয়োজনের দিকগুলো নিশ্চিত করবে। সেই সঙ্গে করবে আন্তর্জাতিক শ্রম আইনের বাস্তবায়নও। প্রসঙ্গত একটি বিষয় স্মরণ করতে হয় যে পোশাক খাতের ট্রেড ইউনিয়ন নেতা আমিনুল ইসলাম হত্যার সঠিক তদন্ত, রহস্য উদ্ঘাটন ও বিচার এখনো হয়নি এবং এ বিষয় নিয়ে বিদেশি শক্তির, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের কৌতূহল, প্রশ্ন ও তাগিদ কম ছিল না। তবু বিষয়টির কোনো সুরাহা হয়নি। কার বা কাদের স্বার্থে আমিনুল হত্যা, তা এখনো অন্ধকারে রয়ে গেছে। বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের এ আলোচনায় পোশাকশিল্পের ভবিষ্যৎ সমস্যা ও সম্ভাবনা গুরুত্ব পেয়েছে।
পেয়েছে এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের কারণে। আর আগ্রহ তখনই দেখা যায়, যখন তাতে অর্থনৈতিক বা অন্য কোনো স্বার্থ জড়িত থাকে। বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের বরাতে যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় করপোরেট ব্র্যান্ড ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাণিজ্যস্বার্থের পরিমাণ মোটেই তুচ্ছ করার মতো নয়। এ ক্ষেত্রে পোশাক মালিকদের মুনাফা যতটা সত্য, তার চেয়ে অনেক বড় সত্য ক্রেতাদের নিজ বাজার থেকে বিপুল আয়।
এই দুই মুনাফার মধ্যে রয়েছে পাট-পোশাক শ্রমিকদের তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘস্থায়ী স্বার্থ। রাষ্ট্রযন্ত্র এ ক্ষেত্রে শ্রমশক্তিকে প্রয়োজনীয় সমর্থন নিশ্চিত করতে পেরে ওঠেনি। বরং তাদের অধিকতর দৃষ্টি স্থানীয় পুঁজিপতি ও করপোরেট পুঁজির দিকে। তাই পোশাক কারখানার মালিক বিশ্বের সর্বনিম্নমূল্যে শ্রম ক্রয় করে, অবকাঠামো তৈরিতেও সর্বনিম্ন ব্যয় নিশ্চিত করে মুনাফার সর্বোচ্চ আদায়ের ব্যবস্থা করে। এ সাহায্য সে করপোরেট প্রতিষ্ঠানকেও দিয়ে থাকে।
বিদেশি হুমকিতে তার আত্মবিশ্বাস চিড় খায় না এ কারণে যে বাংলাদেশের মতো এত সস্তাশ্রম ও সস্তা দামে পণ্য বিক্রি বিশ্বের অন্য কোথাও সম্ভব হবে না। এর অর্থ সর্বোচ্চ মাত্রায় শ্রমিক শোষণ। এমন এক আপত্তিকর পথে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে অমিত সম্ভাবনা দেখতে পায় এর মালিক, আপন বুদ্ধিমত্তায় বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র ও বিদেশি ক্রেতাদের পরামর্শক বুদ্ধিজীবী। তাঁদের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার নানা দিক উঠে আসে। কিন্তু বাংলাদেশে এর বিপরীত প্রতিবেদন অপেক্ষাকৃত কম। তাই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অর্থনৈতিক লেনদেন বাণিজ্যে বাংলাদেশের কতটা অর্জন, আর কতটা বিসর্জন, সে হিসাবের দিকে আমরা বড় একটা নজর ফেরাই না। সাবেক ও চলতি আমলাতন্ত্র বরাবর তা জায়েজ করার পক্ষে। পোশাকশিল্প সে ক্ষেত্রে একটা উদাহরণযোগ্য প্রতীক মাত্র। মার্কিন ও ইউরোপীয় করপোরেট ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠানগুলোর বেহিসাবি মুনাফার সমালোচনা কমই উঠে আসে, এমনকি ওঠে যুক্তরাষ্ট্রে আরোপিত উচ্চ শুল্ক হারের কথা, যা যুক্তিসংগতভাবেই কম হওয়া উচিত।অথচ বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের জন্য ওয়েন্ডি প্রমুখের যেখানে সহৃদয়তার প্রকাশ, সেখানে এমন দাবি তাদের দিক থেকে আকাঙ্ক্ষিত যে ওই বিপুল মুনাফা থেকে সামান্য একটু ছাড় দিলে এবং তা বাংলাদেশের শ্রমিকদের জন্য ব্যবহারের শর্ত জুড়ে দেওয়া হলে জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত বাংলাদেশি পোশাক শ্রমিকদের পক্ষে তা একচিলতে স্বস্তির কারণ হতো। কিন্তু বাস্তবে সে সুযোগ তৈরি হচ্ছে না। ওয়েন্ডি শারম্যানের এত সুন্দর বক্তব্য এ-জাতীয় দাবি বেশ জুতসই হতো বলে আমাদের বিশ্বাস। সেই সঙ্গে মালিকের একটুখানি ছাড় দেওয়ার, অর্থাৎ একটু কম মুনাফার প্রসঙ্গও প্রত্যাশিত।
অথচ যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ অংশীদারিত্ব এবং এর উজ্জ্বল সম্ভাবনা নিয়ে অনেক কথা বলা হয়েছে ওই বক্তৃতায়, বিশেষ করে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যৌথ উদ্যোগ, সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তাতে এসেছে অর্থনীতির কথা, এসেছে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবিরোধী তৎপরতার কথা এবং যথারীতি মাদক, জলবায়ু, খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও মাতৃমঙ্গল, দুর্যোগ মোকাবিলার মতো বহু প্রসঙ্গ। এমনকি জোর দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ-ভারত সুসম্পর্কের ওপরও।
কিন্তু বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো এ ধরনের সৌহার্দ্যমূলক অংশীদারিত্বের ক্ষেত্রে যে পারস্পরিক বৈষম্য তথা অর্থনৈতিক লেনদেনের বৈষম্য বড় হয়ে থাকে তা দূর করার কোনো প্রচেষ্টা দেখা যায় না। যেমন পোশাক খাতে, তেমনি অন্যত্র। বিশ্বায়ন ও মুক্তবাজার অর্থনীতি আমাদের যা দিচ্ছে, তার চেয়ে অনেক বেশি নিচ্ছে। এদিকটাতে আমেরিকান প্রশাসনকে গুরুত্ব আরোপ করতে দেখা যায় না।
তাই 'সীমাহীন অংশীদারিত্বের' ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পক্ষে একটি প্রশ্ন থেকেই যায় যে সমানে-অসমানে অর্থাৎ বৈষম্যকে জিইয়ে রেখে অংশীদারিত্বে লাভের শিকে কোন দিকে ছিঁড়ে, তা কার হাতের মুঠোয় ধরা থাকে সেটাই মূলত দেখার বিষয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশ সে প্রশ্নের জবাব পেতে যথেষ্ট আগ্রহ দেখাতে পারছে না।
লেখক : কবি, গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী
ওয়েন্ডি শারম্যান বাংলাদেশের প্রশংসায় সাহিত্য-সংস্কৃতির সমৃদ্ধ সৃষ্টি, বৈশ্বিক মহলে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী বাহিনীর অবদান, নাগরিকদের গড় আয়ুর বৃদ্ধি, শিশু মৃত্যুর সংখ্যা হ্রাস, নারী-শিক্ষার উন্নয়ন হার, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, ধান উৎপাদন বৃদ্ধি ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার সম্ভাবনা, সর্বোপরি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারীর অবস্থান ইত্যাদি বিষয়ের উল্লেখ করেছেন। কিন্তু বলতে ভোলেননি চ্যালেঞ্জগুলোর কথা।
ভদ্র ভাষায় যা চ্যালেঞ্জ, তা সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের জন্য অপ্রিয় বচন। রাস্তাঘাটে চলাচলের বেহাল অবস্থায় অসহনীয় যানজট, আপত্তিকর হরতালের পর হরতাল ও সহিংসতা, যে সহিংসতা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিরোধী। বিরোধী বলেই তা সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাতে দেয়নি। আর একই কারণে তা সংখ্যালঘুদের মধ্যে ভয়ের উদ্রেক করে। জনসংখ্যার একটি অংশ নির্বিবাদে চরমপন্থী হয়ে ওঠে।
ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ না করেও অনায়াসে মেনে নিতে হয় এসব অভিযোগ, যা দেশের কিছুসংখ্যক মানুষের মুখেও শোনা গেছে, কারো কারো লেখায় দেখা গেছে। তাতে দেশের রাজনৈতিক শক্তির নাক-কান কাটা না গেলেও গেছে সাধারণ মানুষের, যাঁরা দেশ নিয়ে ভাবেন কিংবা গেছে যুক্তিবাদী মানুষের, যাঁরা রাজনীতির ভালো-মন্দ নিয়ে নিরপেক্ষ মতামত প্রকাশে দ্বিধা করেন না।
তবে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে তাজরীন ফ্যাশনস ও রানা প্লাজার ট্র্যাজেডি নিয়ে কথাবার্তায়, কী করা যেত এবং কী করা হয়নি তার বিচার-ব্যাখ্যায়। সংগত কারণে পোশাকশিল্পের বিষয়গুলো গুরুত্ব পেয়েছে। বিশেষ করে শ্রমিকদের নিরাপত্তা, মানসম্মত পরিবেশ রক্ষা, শ্রমমান ও শ্রমকল্যাণের বিষয়ে শ্রমিকদের মতামতের গুরুত্ব ইত্যাদি। শেষোক্ত বিষয়টি নিয়ে এ দেশে অনেক অভিযোগ ও সমালোচনা প্রকাশ পেয়েছে। এর প্রকৃত তাৎপর্য শক্তিশালী ট্রেড ইউনিয়নের দাবি, যা শ্রমিকদের সার্বিক প্রয়োজনের দিকগুলো নিশ্চিত করবে। সেই সঙ্গে করবে আন্তর্জাতিক শ্রম আইনের বাস্তবায়নও। প্রসঙ্গত একটি বিষয় স্মরণ করতে হয় যে পোশাক খাতের ট্রেড ইউনিয়ন নেতা আমিনুল ইসলাম হত্যার সঠিক তদন্ত, রহস্য উদ্ঘাটন ও বিচার এখনো হয়নি এবং এ বিষয় নিয়ে বিদেশি শক্তির, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের কৌতূহল, প্রশ্ন ও তাগিদ কম ছিল না। তবু বিষয়টির কোনো সুরাহা হয়নি। কার বা কাদের স্বার্থে আমিনুল হত্যা, তা এখনো অন্ধকারে রয়ে গেছে। বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের এ আলোচনায় পোশাকশিল্পের ভবিষ্যৎ সমস্যা ও সম্ভাবনা গুরুত্ব পেয়েছে।
পেয়েছে এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের কারণে। আর আগ্রহ তখনই দেখা যায়, যখন তাতে অর্থনৈতিক বা অন্য কোনো স্বার্থ জড়িত থাকে। বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের বরাতে যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় করপোরেট ব্র্যান্ড ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাণিজ্যস্বার্থের পরিমাণ মোটেই তুচ্ছ করার মতো নয়। এ ক্ষেত্রে পোশাক মালিকদের মুনাফা যতটা সত্য, তার চেয়ে অনেক বড় সত্য ক্রেতাদের নিজ বাজার থেকে বিপুল আয়।
এই দুই মুনাফার মধ্যে রয়েছে পাট-পোশাক শ্রমিকদের তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘস্থায়ী স্বার্থ। রাষ্ট্রযন্ত্র এ ক্ষেত্রে শ্রমশক্তিকে প্রয়োজনীয় সমর্থন নিশ্চিত করতে পেরে ওঠেনি। বরং তাদের অধিকতর দৃষ্টি স্থানীয় পুঁজিপতি ও করপোরেট পুঁজির দিকে। তাই পোশাক কারখানার মালিক বিশ্বের সর্বনিম্নমূল্যে শ্রম ক্রয় করে, অবকাঠামো তৈরিতেও সর্বনিম্ন ব্যয় নিশ্চিত করে মুনাফার সর্বোচ্চ আদায়ের ব্যবস্থা করে। এ সাহায্য সে করপোরেট প্রতিষ্ঠানকেও দিয়ে থাকে।
বিদেশি হুমকিতে তার আত্মবিশ্বাস চিড় খায় না এ কারণে যে বাংলাদেশের মতো এত সস্তাশ্রম ও সস্তা দামে পণ্য বিক্রি বিশ্বের অন্য কোথাও সম্ভব হবে না। এর অর্থ সর্বোচ্চ মাত্রায় শ্রমিক শোষণ। এমন এক আপত্তিকর পথে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে অমিত সম্ভাবনা দেখতে পায় এর মালিক, আপন বুদ্ধিমত্তায় বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র ও বিদেশি ক্রেতাদের পরামর্শক বুদ্ধিজীবী। তাঁদের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার নানা দিক উঠে আসে। কিন্তু বাংলাদেশে এর বিপরীত প্রতিবেদন অপেক্ষাকৃত কম। তাই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অর্থনৈতিক লেনদেন বাণিজ্যে বাংলাদেশের কতটা অর্জন, আর কতটা বিসর্জন, সে হিসাবের দিকে আমরা বড় একটা নজর ফেরাই না। সাবেক ও চলতি আমলাতন্ত্র বরাবর তা জায়েজ করার পক্ষে। পোশাকশিল্প সে ক্ষেত্রে একটা উদাহরণযোগ্য প্রতীক মাত্র। মার্কিন ও ইউরোপীয় করপোরেট ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠানগুলোর বেহিসাবি মুনাফার সমালোচনা কমই উঠে আসে, এমনকি ওঠে যুক্তরাষ্ট্রে আরোপিত উচ্চ শুল্ক হারের কথা, যা যুক্তিসংগতভাবেই কম হওয়া উচিত।অথচ বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের জন্য ওয়েন্ডি প্রমুখের যেখানে সহৃদয়তার প্রকাশ, সেখানে এমন দাবি তাদের দিক থেকে আকাঙ্ক্ষিত যে ওই বিপুল মুনাফা থেকে সামান্য একটু ছাড় দিলে এবং তা বাংলাদেশের শ্রমিকদের জন্য ব্যবহারের শর্ত জুড়ে দেওয়া হলে জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত বাংলাদেশি পোশাক শ্রমিকদের পক্ষে তা একচিলতে স্বস্তির কারণ হতো। কিন্তু বাস্তবে সে সুযোগ তৈরি হচ্ছে না। ওয়েন্ডি শারম্যানের এত সুন্দর বক্তব্য এ-জাতীয় দাবি বেশ জুতসই হতো বলে আমাদের বিশ্বাস। সেই সঙ্গে মালিকের একটুখানি ছাড় দেওয়ার, অর্থাৎ একটু কম মুনাফার প্রসঙ্গও প্রত্যাশিত।
অথচ যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ অংশীদারিত্ব এবং এর উজ্জ্বল সম্ভাবনা নিয়ে অনেক কথা বলা হয়েছে ওই বক্তৃতায়, বিশেষ করে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যৌথ উদ্যোগ, সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তাতে এসেছে অর্থনীতির কথা, এসেছে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবিরোধী তৎপরতার কথা এবং যথারীতি মাদক, জলবায়ু, খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও মাতৃমঙ্গল, দুর্যোগ মোকাবিলার মতো বহু প্রসঙ্গ। এমনকি জোর দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ-ভারত সুসম্পর্কের ওপরও।
কিন্তু বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো এ ধরনের সৌহার্দ্যমূলক অংশীদারিত্বের ক্ষেত্রে যে পারস্পরিক বৈষম্য তথা অর্থনৈতিক লেনদেনের বৈষম্য বড় হয়ে থাকে তা দূর করার কোনো প্রচেষ্টা দেখা যায় না। যেমন পোশাক খাতে, তেমনি অন্যত্র। বিশ্বায়ন ও মুক্তবাজার অর্থনীতি আমাদের যা দিচ্ছে, তার চেয়ে অনেক বেশি নিচ্ছে। এদিকটাতে আমেরিকান প্রশাসনকে গুরুত্ব আরোপ করতে দেখা যায় না।
তাই 'সীমাহীন অংশীদারিত্বের' ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পক্ষে একটি প্রশ্ন থেকেই যায় যে সমানে-অসমানে অর্থাৎ বৈষম্যকে জিইয়ে রেখে অংশীদারিত্বে লাভের শিকে কোন দিকে ছিঁড়ে, তা কার হাতের মুঠোয় ধরা থাকে সেটাই মূলত দেখার বিষয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশ সে প্রশ্নের জবাব পেতে যথেষ্ট আগ্রহ দেখাতে পারছে না।
লেখক : কবি, গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী
No comments