অন্যান্য দেশের আলোকে সংসদীয় কমিটির প্রস্তাব-সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরে অনুমতির প্রয়োজন নেই দুদকের

ইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি মনে করছে, দুর্নীতির অভিযোগে সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে সরকারের কাছ থেকে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পূর্বানুমতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এমন বিধান নেই। কমিটি বলেছে, দুদককে প্রকৃত অর্থে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হলে অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক ও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনাসহ সব ক্ষেত্রে স্বাধীনতা দিতে হবে।
অষ্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া ঘুরে এসে সংসদীয় প্রতিনিধিদলের দেওয়া প্রতিবেদনের আলোকে এই সুপারিশ প্রণয়ন করে তা সরকারের কাছে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংসদীয় কমিটি।


গতকাল শনিবার জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত কমিটির বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এ বিষয়ে সরকারের মতামত পাওয়ার পর দুর্নীতি দমন কমিশন (সংশোধন) বিল, ২০১১-এর সংশোধনী চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, 'দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আইন ২০০৪' সংশোধনের জন্য গত ২৮ ফেব্রুয়ারি সংসদে 'দুর্নীতি দমন কমিশন (সংশোধন) বিল, ২০১১' উত্থাপন করা হয়। উত্থাপিত বিলের ৩২ (ক) ধারায় বলা হয়, এ আইনের অধীনে জজ, ম্যাজিস্ট্রেট বা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে হলে সরকারের পূর্বানুমোদন নিতে হবে। এই ধারাটির ব্যাপারে আপত্তি জানায় সংসদীয় কমিটির বেশির ভাগ সদস্য। এরপর গত ২৬ জুন অনুষ্ঠিত বৈঠকে ধারাটি সংশোধনের ব্যাপারে সংসদীয় কমিটির সঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত একমত প্রকাশ করলেও কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বিপক্ষে অবস্থান নেন। ওই বৈঠকে দুদকের মতো প্রতিষ্ঠান আছে এমন দেশের অভিজ্ঞতা নিয়ে বিলটি চূড়ান্ত করার প্রস্তাব গৃহীত হয়। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নেতৃত্বে কমিটির আট সদস্যের প্রতিনিধিদল গত ১০ সেপ্টেম্বর থেকে ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া সফর করে। ওই তিন দেশের অভিজ্ঞতার আলোকে তারা পাঁচ দফা সুপারিশসহ ২৪ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন গতকাল সংসদীয় কমিটির বৈঠকে তুলে ধরে। কমিটি এই প্রতিবেদন গ্রহণ করে তা অর্থমন্ত্রী ও কৃষিমন্ত্রীসহ সরকারের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের কাছে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বৈঠক শেষে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সাংবাদিকদের জানান, তিন দেশের দুদকের কার্যক্রম পর্যালোচনা করে একটি প্রতিবেদন কমিটির বৈঠকে উপস্থাপন ও তা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তিনি বলেন, 'ওই তিন দেশে অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক ও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে স্বাধীন সংস্থা দুদক। সেখানে কোনো কর্মকর্তার দুর্নীতির বিরুদ্ধে ইনকোয়ারি, ইনভেস্টিগেশন ও প্রসিকিউশনে কোনো পূর্বানুমতির বিধান নেই। দুদককে স্বাধীন ও শক্তিশালী করতে হলে আমাদেরও একই বিধান রাখতে হবে। একই সঙ্গে দুদকের জন্য আলাদা বাজেট বরাদ্দ ও দুদককে জনবল নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়া প্রয়োজন।' তিনি জানান, ১৯৪৭ সাল থেকেই দুর্নীতি দমন ব্যুরো নামে দুদক ছিল। কিন্তু আগে ছিল সরকারের অধীনে। এখন দুদক সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের মতো স্বাধীন একটি সংস্থা। আর বাংলাদেশ জাতিসংঘের দুর্নীতি দমনবিষয়ক কনভেনশনে স্বাক্ষর করায় দুদক একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হয়ে গেছে। সুরঞ্জিত বলেন, দুদক কর্তৃক সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে সরকারের পূর্বানুমোদন নেওয়ার প্রস্তাবিত বিধান যৌক্তিক নয় বলে কমিটি মনে করে। 'সরকারের কাছ থেকে পূর্বানুমোদন নিতে হলে কমিশনের দরকার কি! পুলিশই তো আছে।'
সুরঞ্জিত জানান, সংসদীয় প্রতিনিধিদলের প্রতিবেদনের কপি অর্থমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী, সরকারি হিসাব কমিটির সভাপতি, মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও জনপ্রশাসনের সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে পাঠানো হয়েছে। তাঁরা বিষয়গুলো নতুন করে বিবেচনা করবেন। এরপর পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে দুই পক্ষের দূরত্ব কমে আসবে বলে আশা করা যায়। যত দ্রুত সম্ভব বিলটি যাচাই-বাছাই শেষ করে সংসদে উপস্থাপন করা হবে।
আদালত অবমাননা বিল আরো পর্যালোচনা
সংসদে উত্থাপিত 'আদালত অবমাননা বিল, ২০১১'-এর খসড়া যথেষ্ট নয় বলে মনে করছে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। প্রস্তাবিত বিলে আদালত অবমাননার সংজ্ঞা ও এর শাস্তির বিধানে দুর্বলতা রয়েছে দাবি করে তা পর্যালোচনার জন্য একটি সংসদীয় উপকমিটি গঠন করা হয়েছে। সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে একটি প্রস্তাবনা দেওয়ার কথা বলা হলেও উপকমিটিকে নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়নি।
বৈঠক শেষে সংসদীয় কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রস্তাবিত বিলে ব্যাপক অসঙ্গতি ও দূর্বলতা রয়েছে দাবি করে বলেন, বৈঠকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরাও বিলটির বিষয়ে মতামত তুলে ধরেন। বিলটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও যাচাই-বাছাই করে এ বিষয়ে রিপোর্ট প্রদানের জন্য কমিটির সদস্য মো. ফজলে রাব্বী মিয়াকে আহ্বায়ক এবং নূরল ইসলাম সুজন ও শেখ ফজলে নূর তাপসকে সদস্য করে উপকমিটি গঠন করা হয়েছে।
চলতি অধিবেশনে বিলটি পাস হওয়ার সম্ভাবনা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, সবার জন্য গ্রহণযোগ্য এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়ক একটি যুগোপযোগী আইন প্রণয়নের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে কমিটি। কারণ এই আইনের সঙ্গে সংবিধান জড়িত। তাই এ ক্ষেত্রে সময় বিবেচ্য নয়। উপকমিটি সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করে রিপোর্ট দিলে কমিটির বৈঠকে আলোচনা করে বিলটির সুপারিশ চূড়ান্ত করা হবে।
উল্লেখ্য, গত ১৪ জুন বিলটি সংসদে উত্থাপন করেন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। পরে এটি পর্যালোচনা করতে সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়।

No comments

Powered by Blogger.