উচ্চ আদালতের রায় ও তাহেরের রাজনীতি by মুশতাক হোসেন
২২ মার্চ, ২০১১। বাংলাদেশের উচ্চ আদালত এক ঐতিহাসিক রায়ে কর্নেল (অব.) আবু তাহেরের (বীর উত্তম) ফাঁসি ও সহ-অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দণ্ডাদেশ অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করেছেন। ১৯৭৬ সালের জুন-জুলাইয়ে গোপন বিশেষ সামরিক আদালতে কর্নেল তাহের, মেজর (অব.) এম এ জলিল, আবু ইউসুফ খান বীর বিক্রম, আ স ম আবদুর রব, হাসানুল হক ইনু, শরীফ নূরুল আম্বিয়া, মেজর জিয়াউদ্দিন, আনোয়ার হোসেনসহ ৩৩ জনের বিচার করা হয়, ১৭ জনকে শাস্তি দেওয়া হয়। ১৭ জুলাই রায় দেওয়ার পর ২১ জুলাই ভোর চারটায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মুক্তিযুদ্ধে ১১ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক, সিপাহি জনতার অভ্যুত্থানের স্থপতি আবু তাহেরকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়। আদালত গোটা মামলাকে বাতিল ঘোষণা করেন, তাহেরসহ অন্য সহ-অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দেশপ্রেমিক এবং তাহেরকে শহীদ হিসেবে আখ্যায়িত করেন, সরকারকে মামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলেন।
২২ মার্চ ঘোষিত এ রায়ের আগে ও পরে বেশ কিছু লেখকের লেখা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, যা বিশদ আলোচনার দাবি রাখে। তবে সেসব লেখা পড়ে একদিকে ভালো লেগেছে যে তাঁরা ৭ নভেম্বরের সিপাহি জনতার অভ্যুত্থান ও পূর্বাপর প্রসঙ্গের রাজনৈতিক বিভিন্ন পুরোনো প্রশ্নের নতুন করে অবতারণা করেছেন, যা নতুন প্রজন্মের কাছে পরিষ্কার হওয়া দরকার।
আসিফ নজরুল (প্রথম আলো, উপসম্পাদকীয়, ১৮-০৩-১১), ‘বিপ্লব বা মুক্তিসংগ্রাম মানেই হচ্ছে বিদ্যমান একটি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যুদ্ধ। সেখানে পরাজয় মানে মৃত্যু, জয় মানে সর্বোচ্চ সম্মান।’ কিন্তু সেসব দেশে হত্যাকারী শাসককে কোনো গণতন্ত্রমনা লেখক কি বিপ্লবীদের সঙ্গে এক কাতারে পাঁচ ফুটের চেয়ে উঁচু মানব হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন? মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ সালে ব্যর্থ হলে বঙ্গবন্ধু ও অন্য নেতাদের পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হত্যা করলেও কি তা পৃথিবীতে জায়েজ হতো? নাকি চরমভাবে ঘৃণিত হতো? তিনি আরও লিখেছেন, ‘এ রকম হত্যাকাণ্ডের (কখনো বিনা বিচারে, কখনো বিচারের নামে প্রহসনের মাধ্যমে) শিকার হয়েছেন চে গুয়েভারা থেকে আমাদের মাস্টারদা সূর্য সেনসহ সারা পৃথিবীর নানা বিপ্লবী।’ কথাটা সত্য। ইতিহাস কি হত্যাকারীদের হত্যার শিকার বিপ্লবীদের সঙ্গে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে উভয়কেই পাঁচ ফুটের চেয়ে উঁচু মানব বলেছে, না তাঁদের ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করেছে? তাঁর পদ্ধতি ব্যর্থ হওয়ার পরিণতি আর কী হতে পারত? পদ্ধতি ব্যর্থ হলে বিপ্লবীরা জীবন দেয়, কিন্তু যারা জীবন নেয়, তারা ভেসে যায় গণপ্রতিরোধের মুখে, মুখ লুকায় অন্ধকার গর্তে। সূর্য সেন, চে গুয়েভারার পদ্ধতি নিয়ে নানা তর্ক-বিতর্ক এখনো আছে, কিন্তু তাঁদের হত্যাকাণ্ডের সাফাই গাওয়ার কোনো মানুষ আজ খুঁজে পাওয়া যাবে না, পাঁচ ফুটের বেশি লম্বা মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করা তো দূরের কথা!
কর্নেল তাহের ও তাঁর রাজনৈতিক অনুসারীরা নিশ্চয়ই চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে শ্রেণীহীন সমাজব্যবস্থায় বিশ্বাসী। কিন্তু ৭ নভেম্বর সিপাহি বিপ্লবের রাজনৈতিক কর্মসূচি ও স্লোগান শ্রেণীহীন সামরিক বাহিনী বা সমাজতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা ছিল না, ছিল গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা, যা গণতন্ত্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করত এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে এগিয়ে নিত। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ১২ দফায় গণবাহিনী প্রতিষ্ঠা করার দাবি, প্রতিরক্ষা বাহিনী পুনর্গঠনের মুক্তিযুদ্ধের দর্শনকেই তুলে ধরেছিল। ১২ দফায় দাসত্বমূলক ব্যাটম্যান প্রথা বাতিল, কমিশন-ননকমিশন নামে দুই রকম নিয়োগের প্রথা বাতিল করে একই নিয়মে সেনা সদস্যদের রিক্রুট করে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে উচ্চতর পদে নিয়োগ, কর্মকর্তা ও সেনাসদস্যদের একই মেসে খাবার ব্যবস্থা, একই রেশন-ব্যবস্থার দাবি প্রভৃতি ছিল। দাবির যৌক্তিকতা অনুধাবন করে তাৎক্ষণিকভাবেই দাসত্বমূলক ব্যাটম্যান প্রথা বাতিল করা হয়েছিল। এখন প্রতিরক্ষা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো কোনো অংশে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একই রেশনিং ব্যবস্থা চালু হয়েছে।
সোহরাব হাসান (প্রথম আলো, কালের পুরাণ, ৩০-৩১ মার্চ ২০১১) কর্নেল তাহের তথা জাসদ ১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বর সিপাহি গণ-অভ্যুত্থানের সময় বাকশালকে বাদ দিয়ে গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার গঠনের দাবি করা হলো কেন, সেই প্রশ্ন তুলেছেন। বাকশালকে বাদ দিয়েই সেটা করতে হতো। কারণ, বাকশালকে মেনে নিলে একদলীয় ব্যবস্থায় অন্য কোনো দলের অস্তিত্ব থাকে না। বাকশাল বিলুপ্ত হলে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ (মোজাফ্ফর), সিপিবি পুনরুজ্জীবিত হতো (যেটা ১৯৭৬ সালে হয়েছে)। তখন জাসদ বাদেও বেশ কয়েকটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল ছিল। যেমন—ইউপিপি, জাগমুই, শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল, ন্যাপ (ভাসানী), সাম্যবাদী দল, জাতীয় লীগ প্রভৃতি। লেখক তাদের সম্ভবত ধর্তব্যের মধ্যে আনেননি।
তিনি তাঁর লেখার শিরোনামেই প্রশ্ন তুলেছেন, ‘তাহেরের বিচার অবৈধ, খালেদ হত্যা অবৈধ হবে কেন?’। এ যেন গায়ে পড়ে ঝগড়া করার মতো। খালেদ মোশাররফ হত্যাকে কর্নেল তাহের ও তাঁর অনুসারীরা কখনো বৈধ বলেননি। খালেদ মোশাররফ, হুদা, হায়দারকে বিক্ষুব্ধ সেনারা হত্যা করেননি। তিনি গভীর রাতে শেরেবাংলা নগরের সেনাশিবিরে ঢোকার সময় সেনাসদস্যরা তাঁকে আশ্রয় দিয়েছেন। সকালেও তাঁরা কিছু বলেননি। যখন কর্মকর্তাদের সবাইকে নিয়ে খালেদ-হুদা-হায়দার নাশতার টেবিলে বসেছেন, তখন কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার নেতৃত্বে তাঁকে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করা হয়। জিয়া সেই হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার তো দূরের কথা, পরবর্তী সময়েও কোনো জিজ্ঞাসাবাদ করেননি। কর্নেল হামিদের বইয়ে তার সুস্পষ্ট বর্ণনা আছে। এখানে কর্নেল তাহেরের বা বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সংশ্লিষ্টতা কোথায়?
৭ নভেম্বর সিপাহি জনতার অভ্যুত্থানের অব্যবহিত পরেই যে কয়েকজন সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা ও পরিবারের কিছু সদস্য নিহত হয়েছেন, তার সুষ্ঠু তদন্তেও কখনো কর্নেল তাহের ও তাঁর অনুসারীরা আপত্তি করেননি। হত্যাকাণ্ডগুলো পরিকল্পিত, না অন্য কিছু, তা অবশ্যই তদন্ত করে বের করা দরকার।
প্রকৃতপক্ষে যে অভিযোগ তোলা হয়েছিল (লিফশুলজ কর্তৃক প্রকাশিত কর্নেল তাহেরের জবানবন্দি থেকে যতটুকু অনুমান করা যায়), তার বিচার করতে হলে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এ দেশে রাষ্ট্রপতি হত্যা, মন্ত্রিসভার সদস্যদের হত্যা, সেনাবাহিনীর সদস্যদের হত্যাসহ সব অপরাধের বিচার করতে হয় সবার আগে। আর ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেওয়ার জন্য কর্নেল তাহেরকে বীরের মর্যাদা দিতে হয়।
জাসদের জনপরিচিত নেতাদের পরবর্তী পদস্খলন থেকে ১৯৭২-৭৫ সময়কালের বিপ্লবী রাজনীতির যৌক্তিকতা নিয়ে লেখক প্রশ্ন তুলেছেন (প্রাগুক্ত)। লেখক কর্নেল তাহের তথা জাসদ রাজনীতিকে এক হাত দেখাতে গিয়ে সেসব ব্যক্তির উদ্ধৃতি দিয়েছেন, যাঁরা জাসদের প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলের তাত্ত্বিক ও জাসদ থেকে বের হয়ে যাওয়া নেতা। জাসদের প্রতিষ্ঠাতাদের একাংশের আদর্শচ্যুতি জাসদের বিপ্লবী প্রয়াসের যৌক্তিকতাকে ভুল প্রমাণ করে না, কিংবা আজ পর্যন্ত বিপ্লব সফল না হওয়ায়ও ৭ নভেম্বরের বিপ্লবী তাৎপর্যকে ম্লান করে না।
বাংলাদেশে একমাত্র কর্নেল তাহের, তথা জাসদই বিপ্লবী রাজনীতি শুধু কেতাব আর মুখের বুলির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেনি, বাস্তব কাজের মধ্য দিয়ে বিপ্লবী রাজনীতি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। কৌশলে ভুল থাকতে পারে কিন্তু লক্ষ্য ছিল স্থির। লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থতা থাকলেই লক্ষ্য ভুল প্রমাণিত হয় না। কর্নেল তাহের ও জাসদ শুধু বিপ্লবী বুলি কপচালে কোনো কোনো লেখক হয়তো রাগ করতেন না (ডেইলি স্টার, সম্পাদকীয় পাতা, ৩১-০৩-১১)।
ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাহেরের আদর্শ ধরে উঠে দাঁড়াবে। কর্নেল তাহেরের সমগ্র কর্মকাণ্ড ও বীরোচিত জীবনদান ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সমাজবিপ্লবের বাস্তব কাজ করতে নিশ্চয়ই অনুপ্রেরণা জোগাবে।
মুশতাক হোসেন: সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ডাকসু।
mushtuq_husain@col-taher.com
২২ মার্চ ঘোষিত এ রায়ের আগে ও পরে বেশ কিছু লেখকের লেখা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, যা বিশদ আলোচনার দাবি রাখে। তবে সেসব লেখা পড়ে একদিকে ভালো লেগেছে যে তাঁরা ৭ নভেম্বরের সিপাহি জনতার অভ্যুত্থান ও পূর্বাপর প্রসঙ্গের রাজনৈতিক বিভিন্ন পুরোনো প্রশ্নের নতুন করে অবতারণা করেছেন, যা নতুন প্রজন্মের কাছে পরিষ্কার হওয়া দরকার।
আসিফ নজরুল (প্রথম আলো, উপসম্পাদকীয়, ১৮-০৩-১১), ‘বিপ্লব বা মুক্তিসংগ্রাম মানেই হচ্ছে বিদ্যমান একটি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যুদ্ধ। সেখানে পরাজয় মানে মৃত্যু, জয় মানে সর্বোচ্চ সম্মান।’ কিন্তু সেসব দেশে হত্যাকারী শাসককে কোনো গণতন্ত্রমনা লেখক কি বিপ্লবীদের সঙ্গে এক কাতারে পাঁচ ফুটের চেয়ে উঁচু মানব হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন? মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ সালে ব্যর্থ হলে বঙ্গবন্ধু ও অন্য নেতাদের পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হত্যা করলেও কি তা পৃথিবীতে জায়েজ হতো? নাকি চরমভাবে ঘৃণিত হতো? তিনি আরও লিখেছেন, ‘এ রকম হত্যাকাণ্ডের (কখনো বিনা বিচারে, কখনো বিচারের নামে প্রহসনের মাধ্যমে) শিকার হয়েছেন চে গুয়েভারা থেকে আমাদের মাস্টারদা সূর্য সেনসহ সারা পৃথিবীর নানা বিপ্লবী।’ কথাটা সত্য। ইতিহাস কি হত্যাকারীদের হত্যার শিকার বিপ্লবীদের সঙ্গে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে উভয়কেই পাঁচ ফুটের চেয়ে উঁচু মানব বলেছে, না তাঁদের ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করেছে? তাঁর পদ্ধতি ব্যর্থ হওয়ার পরিণতি আর কী হতে পারত? পদ্ধতি ব্যর্থ হলে বিপ্লবীরা জীবন দেয়, কিন্তু যারা জীবন নেয়, তারা ভেসে যায় গণপ্রতিরোধের মুখে, মুখ লুকায় অন্ধকার গর্তে। সূর্য সেন, চে গুয়েভারার পদ্ধতি নিয়ে নানা তর্ক-বিতর্ক এখনো আছে, কিন্তু তাঁদের হত্যাকাণ্ডের সাফাই গাওয়ার কোনো মানুষ আজ খুঁজে পাওয়া যাবে না, পাঁচ ফুটের বেশি লম্বা মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করা তো দূরের কথা!
কর্নেল তাহের ও তাঁর রাজনৈতিক অনুসারীরা নিশ্চয়ই চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে শ্রেণীহীন সমাজব্যবস্থায় বিশ্বাসী। কিন্তু ৭ নভেম্বর সিপাহি বিপ্লবের রাজনৈতিক কর্মসূচি ও স্লোগান শ্রেণীহীন সামরিক বাহিনী বা সমাজতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা ছিল না, ছিল গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা, যা গণতন্ত্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করত এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে এগিয়ে নিত। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ১২ দফায় গণবাহিনী প্রতিষ্ঠা করার দাবি, প্রতিরক্ষা বাহিনী পুনর্গঠনের মুক্তিযুদ্ধের দর্শনকেই তুলে ধরেছিল। ১২ দফায় দাসত্বমূলক ব্যাটম্যান প্রথা বাতিল, কমিশন-ননকমিশন নামে দুই রকম নিয়োগের প্রথা বাতিল করে একই নিয়মে সেনা সদস্যদের রিক্রুট করে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে উচ্চতর পদে নিয়োগ, কর্মকর্তা ও সেনাসদস্যদের একই মেসে খাবার ব্যবস্থা, একই রেশন-ব্যবস্থার দাবি প্রভৃতি ছিল। দাবির যৌক্তিকতা অনুধাবন করে তাৎক্ষণিকভাবেই দাসত্বমূলক ব্যাটম্যান প্রথা বাতিল করা হয়েছিল। এখন প্রতিরক্ষা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো কোনো অংশে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একই রেশনিং ব্যবস্থা চালু হয়েছে।
সোহরাব হাসান (প্রথম আলো, কালের পুরাণ, ৩০-৩১ মার্চ ২০১১) কর্নেল তাহের তথা জাসদ ১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বর সিপাহি গণ-অভ্যুত্থানের সময় বাকশালকে বাদ দিয়ে গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার গঠনের দাবি করা হলো কেন, সেই প্রশ্ন তুলেছেন। বাকশালকে বাদ দিয়েই সেটা করতে হতো। কারণ, বাকশালকে মেনে নিলে একদলীয় ব্যবস্থায় অন্য কোনো দলের অস্তিত্ব থাকে না। বাকশাল বিলুপ্ত হলে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ (মোজাফ্ফর), সিপিবি পুনরুজ্জীবিত হতো (যেটা ১৯৭৬ সালে হয়েছে)। তখন জাসদ বাদেও বেশ কয়েকটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল ছিল। যেমন—ইউপিপি, জাগমুই, শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল, ন্যাপ (ভাসানী), সাম্যবাদী দল, জাতীয় লীগ প্রভৃতি। লেখক তাদের সম্ভবত ধর্তব্যের মধ্যে আনেননি।
তিনি তাঁর লেখার শিরোনামেই প্রশ্ন তুলেছেন, ‘তাহেরের বিচার অবৈধ, খালেদ হত্যা অবৈধ হবে কেন?’। এ যেন গায়ে পড়ে ঝগড়া করার মতো। খালেদ মোশাররফ হত্যাকে কর্নেল তাহের ও তাঁর অনুসারীরা কখনো বৈধ বলেননি। খালেদ মোশাররফ, হুদা, হায়দারকে বিক্ষুব্ধ সেনারা হত্যা করেননি। তিনি গভীর রাতে শেরেবাংলা নগরের সেনাশিবিরে ঢোকার সময় সেনাসদস্যরা তাঁকে আশ্রয় দিয়েছেন। সকালেও তাঁরা কিছু বলেননি। যখন কর্মকর্তাদের সবাইকে নিয়ে খালেদ-হুদা-হায়দার নাশতার টেবিলে বসেছেন, তখন কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার নেতৃত্বে তাঁকে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করা হয়। জিয়া সেই হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার তো দূরের কথা, পরবর্তী সময়েও কোনো জিজ্ঞাসাবাদ করেননি। কর্নেল হামিদের বইয়ে তার সুস্পষ্ট বর্ণনা আছে। এখানে কর্নেল তাহেরের বা বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সংশ্লিষ্টতা কোথায়?
৭ নভেম্বর সিপাহি জনতার অভ্যুত্থানের অব্যবহিত পরেই যে কয়েকজন সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা ও পরিবারের কিছু সদস্য নিহত হয়েছেন, তার সুষ্ঠু তদন্তেও কখনো কর্নেল তাহের ও তাঁর অনুসারীরা আপত্তি করেননি। হত্যাকাণ্ডগুলো পরিকল্পিত, না অন্য কিছু, তা অবশ্যই তদন্ত করে বের করা দরকার।
প্রকৃতপক্ষে যে অভিযোগ তোলা হয়েছিল (লিফশুলজ কর্তৃক প্রকাশিত কর্নেল তাহেরের জবানবন্দি থেকে যতটুকু অনুমান করা যায়), তার বিচার করতে হলে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এ দেশে রাষ্ট্রপতি হত্যা, মন্ত্রিসভার সদস্যদের হত্যা, সেনাবাহিনীর সদস্যদের হত্যাসহ সব অপরাধের বিচার করতে হয় সবার আগে। আর ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেওয়ার জন্য কর্নেল তাহেরকে বীরের মর্যাদা দিতে হয়।
জাসদের জনপরিচিত নেতাদের পরবর্তী পদস্খলন থেকে ১৯৭২-৭৫ সময়কালের বিপ্লবী রাজনীতির যৌক্তিকতা নিয়ে লেখক প্রশ্ন তুলেছেন (প্রাগুক্ত)। লেখক কর্নেল তাহের তথা জাসদ রাজনীতিকে এক হাত দেখাতে গিয়ে সেসব ব্যক্তির উদ্ধৃতি দিয়েছেন, যাঁরা জাসদের প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলের তাত্ত্বিক ও জাসদ থেকে বের হয়ে যাওয়া নেতা। জাসদের প্রতিষ্ঠাতাদের একাংশের আদর্শচ্যুতি জাসদের বিপ্লবী প্রয়াসের যৌক্তিকতাকে ভুল প্রমাণ করে না, কিংবা আজ পর্যন্ত বিপ্লব সফল না হওয়ায়ও ৭ নভেম্বরের বিপ্লবী তাৎপর্যকে ম্লান করে না।
বাংলাদেশে একমাত্র কর্নেল তাহের, তথা জাসদই বিপ্লবী রাজনীতি শুধু কেতাব আর মুখের বুলির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেনি, বাস্তব কাজের মধ্য দিয়ে বিপ্লবী রাজনীতি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। কৌশলে ভুল থাকতে পারে কিন্তু লক্ষ্য ছিল স্থির। লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থতা থাকলেই লক্ষ্য ভুল প্রমাণিত হয় না। কর্নেল তাহের ও জাসদ শুধু বিপ্লবী বুলি কপচালে কোনো কোনো লেখক হয়তো রাগ করতেন না (ডেইলি স্টার, সম্পাদকীয় পাতা, ৩১-০৩-১১)।
ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাহেরের আদর্শ ধরে উঠে দাঁড়াবে। কর্নেল তাহেরের সমগ্র কর্মকাণ্ড ও বীরোচিত জীবনদান ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সমাজবিপ্লবের বাস্তব কাজ করতে নিশ্চয়ই অনুপ্রেরণা জোগাবে।
মুশতাক হোসেন: সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ডাকসু।
mushtuq_husain@col-taher.com
No comments