প্রভাষকদের টাইম স্কেল ব্য মাহবুব আলী
অবশেষে বেসরকারি প্রভাষকদের টাইম স্কেল বাদ দিয়ে বেসরকারি সব শিক্ষকের ২০১১ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারির বেতন-ভাতার সরকারি অংশ ব্যাংকে পৌঁছেছে। শিক্ষকেরা দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর দুই মাসের বেতন-ভাতা ব্যাংক থেকে নিজ নিজ অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে তুলছেন, যখন মার্চের তৃতীয় সপ্তাহ শুরু হয়ে গেছে। শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড এবং শিক্ষকেরা মানুষ গড়ার কারিগর—সনাতন এসব বাণীর মুখে সরকারি এই অনীহা, জটিলতা এবং শেষমেশ শম্বুকগতির তৎপরতা বেসরকারি শিক্ষকদের ওপর একধরনের আঘাত ছাড়া আর কিছু নয়। কেননা বসন্তের গান বর্ষায় মানায় না। ঘটনা আরও দুঃখ ও অপমানজনক এই যে কলেজ ও মাদ্রাসার ১৮ হাজার প্রভাষক, যাঁরা ২০১০ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বরের বেতন-ভাতার সরকারি অংশে টাইম স্কেল পেয়েছিলেন, তাঁদের সেই বর্ধিত অর্থ স্থগিত করা হয়েছে। অর্থাৎ যেসব প্রভাষক টাইম স্কেল পেয়ে ওই দুই মাস তিন থেকে চার হাজার টাকা ন্যায্য হিসেবে পেয়েছিলেন, তাঁদের সেই অংশ ২০১১-এর জানুয়ারি থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
সরকারি ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন না নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০১০-এর নভেম্বর ও ডিসেম্বরে প্রভাষকদের টাইম স্কেল বাবদ যে বর্ধিত অর্থ দিয়েছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) এর যথাযথ ব্যাখ্যা অর্থ মন্ত্রণালয়কে দিতে পারেনি। টাইম স্কেলপ্রাপ্ত প্রভাষকদের বর্ধিত অঙ্ক দিতে ৬৪২ কোটি টাকা অতিরিক্ত প্রয়োজন। দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রভাষকদের টাইম স্কেল দিয়ে আবার স্থগিত করায় নিন্দা, বিক্ষোভ, মানববন্ধন, মিছিল ইত্যাদি প্রক্রিয়ার সঙ্গে অবিলম্বে টাইম স্কেল চালু করে বকেয়া হিসেবে পূর্ণ বেতন-ভাতাসহ ২০১১-এর মার্চের বেতন দাবি করা হয়েছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন স্থানে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে শিক্ষামন্ত্রীকে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি রাশেদ খান মেননও তাঁদের দাবির যৌক্তিকতা স্বীকার করেছেন।
দেশে প্রায় ২৭ হাজার এমপিওভুক্ত স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে বলে এক তথ্যে জানা গেছে, যার মধ্যে কলেজ দুই হাজার ৩৭০টি এবং মাদ্রাসা সাত হাজার ৫৯৭টি। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন তিন লাখ ৫৭ হাজার ২৮৮ জন শিক্ষক-প্রভাষক এবং এক লাখ পাঁচ হাজার ৩৭৪ জন কর্মচারী। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে দেশের অন্যূন ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা শিখে থাকে। এর মধ্যে বৃহদাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোনো বেতন বা ফি নেওয়া হয় না। কেননা শিক্ষকেরা নিজেদের চাকরি বাঁচাতে অভিভাবকদের অনুরোধ-উপরোধের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রী সংগ্রহ করে থাকেন। এরপর সেই ছাত্রছাত্রীকে পাস করানোর জন্য প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালান। এ কথাও সত্য যে শুধু পাস করানোর জন্য বেসরকারি শিক্ষকেরা অনৈতিক কাজও করে থাকেন। কেননা নির্দিষ্টসংখ্যক বা ৩০ শতাংশ ছাত্রছাত্রী পাস না করলে এমপিও বাতিল হতে পারে। এ জন্য কোনো কোনো অনৈতিকতারও আশ্রয় নেওয়া হয়।
শিক্ষকতা একটি মহান পেশা। তাঁরা সমাজকে দেন, বিনিময়ে তেমন কিছু চান না। কিন্তু বর্তমান সময়ে চরম বেকারসমস্যার কারণে সেই শাশ্বত কমিটমেন্ট নিয়ে অনেকেই শিক্ষকতা করেন না, করতে পারেন না। এটি একটি চাকরি। মাস গেলে বেতন বা কয়েকটি মুদ্রা পাওয়া যায়, ব্যস। অন্যদিকে, যার নেই কোনো গতি সে-ই করে পণ্ডিতি। ভালো চাকরি না জোটার কারণে কোনো মেধাবী লোক শিক্ষকতা পেশায় আসছেন বটে, তবে তাঁদের অধিকাংশেরই সেই মানুষ গড়ে তোলার কমিটমেন্ট নেই। কেননা বঞ্চিত মানুষ শুধু চাকরি করেন। দেশে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে কর্মরত অধিকাংশ শিক্ষক সাধারণ জ্ঞান ও মেধার নিচে অবস্থান করছেন। তাঁদের দ্বারা শিক্ষা প্রদান হয় না। সুতরাং তাঁদের মধ্য থেকে যাচাই-বাছাই করে প্রকৃত মেধাবী শিক্ষক নির্বাচন করে সরকারি অনুদানভুক্ত করা যায়। কিন্তু সেই কাজটি করার জন্য যাঁদের দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাঁরা নিজেরাই যদি ভূত হয়ে বসেন, তাহলে শর্ষের মধ্য থেকে ভূত তাড়ানো মুশকিল। আর এটিই হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের মূল্যায়ন ও মাঠপর্যায়ে তথ্য গ্রহণে যাঁরা যান, তাঁদের বেশির ভাগ টাকা খেয়ে অযোগ্য ও দায়িত্বহীন শিক্ষককে ‘অনুমোদন’ দিয়ে আসেন। ফলে বেসরকারি শিক্ষা আরও প্রস্ফুটিত হতে পারেনি।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় বেসরকারি প্রভাষকদের মধ্যে বৈষম্য তৈরি করে রেখেছে। যেখানে একটি ডিগ্রি কলেজে বিষয়ভিত্তিক দুই বা ততোধিক প্রভাষক রয়েছেন, সেখানে ফাজিল মাদ্রাসায় একজন প্রভাষককে একাদশ-দ্বাদশ থেকে ডিগ্রি পর্যন্ত সমস্ত চাপ সামলাতে হয়। প্রভাষকদের চাকরির আট বছর অতিক্রান্ত হলে যে টাইম স্কেল দেওয়া হয়, তার জন্য ওই প্রভাষককে গভর্নিং বডির হাতে-পায়ে তেল লাগানো ছাড়াও অতিরিক্ত খরচাপাতি করতে হয়। এটি স্বয়ংক্রিয় হলে সমস্যা থাকে না এবং তাঁদের মধ্যেও কাজে সন্তুষ্টি আসে। এদিকে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে উচ্চতর স্কেলের বিষয়ে আনুপাতিক হিসাব। অর্থাৎ তিনজন প্রভাষকের মধ্যে একজনমাত্র উচ্চতর স্কেলপ্রাপ্ত হবেন, অন্যরা হবেন না। এটি কোন ধরনের সামাজিক ন্যায়বিচার, তা বোধগম্য নয়। এতে দেখা যায়, সামান্য দু-এক ঘণ্টার জন্যও কাউকে বঞ্চিত হতে হয়।
আমরা বেসরকারি শিক্ষার মানোন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপসহ প্রভাষকদের টাইম স্কেল পুনর্বহাল করে বকেয়াসহ বেতন-ভাতা দেওয়ার জন্য সরকারের উদ্যোগ দেখতে চাই। প্রত্যাশা করি, একটি সমন্বিত ও মর্যাদাপূর্ণ শিক্ষাপদ্ধতির বাস্তবায়ন করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এগিয়ে নেওয়া হোক।
মাহবুব আলী: কলেজশিক্ষক।
mahbubali007@gmail.com
No comments