গণতন্ত্রের জন্য সংবাদপত্র, কোনো গোত্রের জন্য নয় by সৈয়দ আবুল মকসুদ
যাঁদের ধূমপানের নেশা আছে, তাঁরা সকালে ঘুম থেকে উঠেই হুক্কা বা সিগারেটে টান না দিলে অস্বস্তি বোধ করেন। ধূমপান না করলে অনেকের কোষ্ঠ পরিষ্কার হয় না। সিগারেট ধরিয়ে পায়খানায় ঢোকেন। এমন অনেক পাঠকও আছেন, যাঁরা সকালে খবরের কাগজে চোখ না বোলালে অস্বস্তি বোধ করেন। যাঁদের কোষ্ঠবদ্ধতা আছে, তাঁরা কেউ খবরের কাগজ হাতে নিয়ে নজরুল ইসলামের মতো লম্বা সময়ের জন্য বাথরুমে গিয়ে বসে থাকেন।
খবরের কাগজটি কীভাবে তৈরি হয়? কারা, কোথায় বসে লেখাগুলো লেখেন? সারা রাত কোথায় ছাপা হয়? সেসব বিষয় খুব অল্প পাঠকই জানেন, বা তাঁদের জানার প্রয়োজন আছে। ভোরবেলা পাঠক তাঁর হাতে কাগজটি পান অনেকটা অলৌকিকভাবে। রাস্তার পাঠক পত্রিকা কেনেন হকারের কাছ থেকে অথবা পত্রপত্রিকার স্ট্যান্ড থেকে। গ্রাহকদের যাঁরা একতলার বাড়িতে থাকেন, তাঁরা সকালে কাগজ পান জানালার নিচে। যাঁরা বহুতল ভবনে থাকেন, তাঁদের কাগজ আসে দরজার তলা দিয়ে। একালের অনেক আধুনিক পাঠক কাগজ স্পর্শ না করে নাশতার টেবিলে বসেন না। কারও থাকে এক হাতে চায়ের ধূমায়িত কাপ, আরেক হাতে খবরের কাগজ। আধুনিক জীবন ও খবরের কাগজ অবিচ্ছিন্ন। সংবাদপত্র ছাড়া আধুনিক রাজনীতিও অচল। গণতন্ত্রের জন্য সংবাদপত্র চাই-ই।
অনুমান করি, পৃথিবীতে এসে প্রথম চোখ মেলেই দেখে থাকব খবরের কাগজ। নিশ্চয়ই আমার আঁতুড়ঘরের বেড়ায় খবরের কাগজ সাঁটানো ছিল। কার্তিকের বিষণ্ন রাতে পদ্মার ঠান্ডা হাওয়া বেড়ার ফাঁকফোকর দিয়ে আঁতুড়ঘরে না ঢুকতে পারে, সে জন্য পুরোনো খবরের কাগজ ব্যবহূত হয়ে থাকবে। আমার বাল্যশিক্ষা পড়া আর খবরের কাগজের শিরোনাম বানান করে পড়া একই সময় শুরু হয়। আমার বাবা ছিলেন খবরের কাগজের পোকা। পত্রিকা একটা হলেই হলো। আজাদ বা আনন্দবাজার পত্রিকা, মর্নিং নিউজ বা স্টেটসম্যান। সেকালে কাগজ সহজলভ্য ছিল না, গ্রামের পাঠক বা গ্রাহকদের জন্য তো নয়ই। গ্রামে কাগজ সকালবেলায় জানালার নিচে বা দরজার তলায় পাওয়া যেত না। কলকাতা ও ঢাকার কাগজ গ্রামে যেত তিন দিন পর। মঙ্গলবারের কাগজ পাওয়া যেত শুক্রবার সন্ধ্যায়। পোস্টাপিসের ডাকপিয়ন এসে দিয়ে যেতেন।
আমার অতি শৈশবে তিনটি ভাষার কাগজ আমি বাড়িতে দেখেছি। আমার মা বাংলা বলতে পারতেন না, বাংলা অক্ষরও চিনতেন না। তিনি পড়তেন উর্দু সাপ্তাহিক রোজানা-ই-হিন্দ্ বা কলকাতার অন্য কোনো কাগজ। খুব নিয়মিতও নয়। কাগজে লেখা হয় দুনিয়ার কোথায় কী ঘটছে। কে কোন দেশের প্রধানমন্ত্রী, কে চিয়াং কাই-শেক, কে মাও সেতুং, কে দেশের রেলমন্ত্রী, চালের বাজারে আগুন লাগল কি না, আলু ও এলাচের দাম হঠাৎ কেন বাড়ল, কোন বেশরম মেয়েটি তার প্রাইভেট শিক্ষককে ভালোবেসে তার সঙ্গে পালিয়ে গেছে—এসব জানার আগ্রহ সব পাঠকের থাকে না।
শৈশবে যখন গ্রামে ছিলাম, বিশেষ করে আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের আগে, ভরসা ছিল আজাদ ও ইত্তেফাক। তাও কয়েক দিনের বাসি কাগজ। সেটাই টাটকা মনে হতো। মাঝেমধ্যে কলকাতা থেকে আসত দৈনিক যুগান্তর। সেটার ছাপা ও লেখা আরও উন্নত। স্বাধীনতার পর প্রথম ১০ বছর, মোটের ওপর স্বাভাবিক সম্পর্ক ছিল, আইয়ুব ক্ষমতায় আসার পর পাকিস্তান-ভারত সম্পর্কের মাঝখানে বিরাট প্রাচীর উঠে যায়। কলকাতার কাগজ আসা বন্ধ হয়ে যায়। মাঝেমধ্যে আমার ছোট চাচা, যিনি গ্রহণ করেছিলেন ভারতের নাগরিকত্ব, লোকের হাতে কলকাতার দৈনিক-সাপ্তাহিকের বান্ডিল পাঠাতেন।
সব মানুষের মতোই আমিও একদিন ছিলাম পাঠক, তারপর হয়ে গেলাম সংবাদপত্রের লেখক। তারপর পেশাদার সাংবাদিক। স্বাধীনতার আগে অনিয়মিতভাবে লিখলেও স্বাধীনতার পর দেশের প্রধান তিনটি কাগজ—ইত্তেফাক, সংবাদ ও দৈনিক বাংলার সাহিত্য সাময়িকীর প্রধান লেখকদের আমি ছিলাম একজন। বছরের পর বছর দৈনিক বাংলায় কবি আহসান হাবীব, ইত্তেফাক-এ রোকনুজ্জামান খান (দাদা ভাই) এবং সংবাদ-এ আবুল হাসনাত আমার লেখাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে প্রধান রচনা করেছেন। তাঁদের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
তারপর শুরু হয় উপসম্পাদকীয় নিবন্ধ রচনা। ইংরেজি-বাংলা সব কাগজেই লিখতাম। নিয়মিত লেখা শুরু হয় আজকের কাগজ থেকে। তারপর ভোরের কাগজ, প্রথম পর্যায়ের বাংলাবাজার পত্রিকা, প্রথম আলো, যুগান্তর, সমকাল প্রভৃতি। ডেইলি স্টার পত্রিকায়ও বহুদিন লিখেছি। প্রধান কাগজের সম্পাদকদের অকৃপণ ভালোবাসা ও প্রীতি বর্ষিত হয়েছে আমার ওপর। মালিক-সম্পাদকদের মধ্যে সংবাদ-এর আহমদুল কবির, ইত্তেফাক-এর মইনুল হোসেন এবং আজকের কাগজ-এর কাজী শাহেদ আহমেদ আমাকে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের যে সুযোগ দিয়েছেন, এর জন্য তাঁদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। যত দিন শামসুর রাহমান দৈনিক বাংলার সম্পাদক ছিলেন, তত দিন ওই কাগজ ছিল আমাদের নিজস্ব।
নব্বইয়ের দশক এবং এই শতকের প্রথম দশকে কয়েকজন সম্পাদক বাংলাদেশের সংবাদপত্রে নতুন যুগের সূচনা করেন। তোয়াব খানের নেতৃত্বে জনকণ্ঠ, মতিউর রহমানের ভোরের কাগজ ও প্রথম আলো, মতিউর রহমান চৌধুরীর প্রথমে বাংলাবাজার পত্রিকা এবং পরে মানবজমিন, গোলাম সারওয়ারের যুগান্তর ও সমকাল এবং আবেদ খানের সমকাল এবং এখন কালের কণ্ঠ বাংলাদেশের সংবাদপত্রের দিগন্তকে প্রসারিত করেছে। ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার-এর সম্পাদক মাহফুজ আনাম নতুন এক বলিষ্ঠ ধারার সৃষ্টি করেছেন। এসব দক্ষ সম্পাদকের দ্বারা যে আধুনিক সাংবাদিকতার সূচনা হয়েছে, তার জন্য তাঁদের সহযোগী একদল যোগ্য তরুণ সাংবাদিকের অবদানও বিরাট। তাঁরা নতুন যুগের সাংবাদিক। তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি ও ভাষা নতুন ও আধুনিক। তৈরি হয়েছে গত পনেরো বছরে একদল দক্ষ ফটোসাংবাদিক। অর্থাৎ একটি উঁচু জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে আজ আমাদের সংবাদপত্র।
আমার চিন্তা প্রকাশে বিভিন্ন পর্যায়ে কাজী শাহেদ আহমেদ, মাহফুজ আনাম, মতিউর রহমান, গোলাম সারওয়ার, মতিউর রহমান চৌধুরী, আবেদ খান যে স্বাধীনতা দিয়েছেন, নিশ্চয়ই অন্য লেখকেরাও তেমনটি ভোগ করেছেন। পত্রিকায় সম্পাদকের পাতায় রচনা লিখলেও আমি তো একজন পাঠকও বটে। শৈশবে একটি কাগজের জন্য পোস্টাপিসের পিয়নের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আজ সম্পাদক-প্রকাশকদের দয়ায় দরজার তলা ভরে যায় কাগজে। সবচেয়ে পুরোনো সৌজন্য কপিটি ইত্তেফাক। ৪১ বছর ধরে পাচ্ছি। সিরাজুদ্দীন হোসেন দিয়ে গিয়েছিলেন, আর বন্ধ হয়নি। ১০-১৫টি কাগজে প্রতিদিন চোখ বোলানোর সৌভাগ্য হয়। সংবাদপত্র পাঠ করে আজ সব সময় ভালো লাগে না। ভালো না লাগার কারণ অনেক রকম।
কয়েক দিন আগে ঢাকার বাইরে থেকে ফিরছিলাম। হাইওয়ের পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ড্রাইভার অদূরে ঝোপের আড়ালে গেল। আমি গাড়ি থেকে নেমে একটু হাঁটাহাঁটি করছিলাম। রাস্তার পাশের এক সবজির খেতে এক ভদ্রলোক কী যেন করছিলেন; তিনি উঠে এলেন সড়কের ওপর। কোনোভাবে তিনি আমাকে চিনলেন। ঝাড়া দিয়ে লুঙ্গির মাটি ফেলে তিনি ক্ষোভের সুরে বললেন, ‘কাগজে আপনারা সরকারের, বিরোধী দলের, প্রধানমন্ত্রীর, বিরোধীদলীয় নেত্রীর, মন্ত্রীদের দোষ, দুর্নীতি ও দুর্বলতার জন্য লেখালেখি করেন। পত্রিকার ভুলভ্রান্তি ও দোষের সমালোচনা করার উপায় কী?’
আমি তাঁকে বললাম, ‘সে সমালোচনা আপনারা করবেন। আপনাদের মতামতের মূল্য খুব বেশি।’ তখন তিনি কয়েকটি সংবাদের উল্লেখ করলেন উদাহরণ হিসেবে। তিনি জানতে চাইলেন, এসব সংবাদের উদ্দেশ্য কী, এসব সংবাদের ভিত্তি কী, এতে দেশের কোনো উপকার হবে কি না, এসব সংবাদে আদৌ কোনো সত্যতা আছে কি না।
ভদ্রলোকের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আমি কেউ নই। যেসব কাগজে ওই সব প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, সেসব কাগজের সম্পাদক এবং যিনি বা যাঁরা ওই প্রতিবেদন তৈরি করেছেন, তাঁরাই সঠিক উত্তর দিতে পারতেন। ওই ভদ্রলোকই প্রথম নন, তাঁর মতো প্রশ্ন আরও অনেকেই করেন। জবাব দিতে পারি না। ৩৫ বছরের বেশি আমি প্রত্যক্ষভাবে সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত ছিলাম। সহকারী সম্পাদক থেকে সম্পাদক পর্যন্ত হয়েছিলাম। পত্রপত্রিকার দোষ-গুণ আমার অজানা নয়। সমস্যাও আমার অজ্ঞাত নয়। বাঙালির গণতান্ত্রিক সংগ্রামে আমাদের সংবাদপত্র পাকিস্তানি আমলে এবং স্বাধীন বাংলাদেশে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু তার পরও বলব, সব সময় কাগজের ভূমিকা ইতিবাচক ও নির্মল ছিল না। অনেক সময় সত্য ও ন্যায় থেকে বিচ্যুতি ঘটেছে এবং তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গোটা জাতি। সেই ক্ষতির মাশুল গুনতে হয়েছে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে।
১৯৪৮ সালে এক ব্যক্তিগত চিরকুটে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে ক্ষুব্ধ হয়ে লিখেছিলেন, ‘কী করছে আনন্দবাজার পত্রিকা, যুগান্তর, অমৃতবাজার পত্রিকা আর হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড এবং ওদিকে আজাদ পত্রিকা। এরা চাইছে, দাঙ্গা ভালোমতো লাগুক। যাচ্ছেতাই মিথ্যাচার করছে এই কাগজগুলো। এপার থেকে মুসলমানরা ওপার চলে যাক, আর পূর্ববাংলা থেকে হিন্দুরা ভয়ে বাড়িঘর ফেলে এদিকে চলে আসুক। এদের থামাতে পারো কি না দ্যাখো।’
উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে কেউ কিছু করলে কে তাকে রুধিবে দিয়ে বালির বাঁধ। কোটি কোটি মানুষের সর্বনাশ হয়েছে, লাভবান হয়েছে কয়েকজন। পত্রিকা শুধু ঘটে যাওয়া খবর দেয় না, জনমত গঠন করে, বিশেষ পরিস্থিতির জন্য মানুষের মন তৈরি করে। তা ছাড়া একটি রাষ্ট্রে সরকার ছাড়াও বিভিন্ন কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী থাকে। তারাও সংবাদপত্রকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে।
স্বাধীন সংবাদপত্র ছাড়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। আবার গণতন্ত্রকে হত্যা করতেও একশ্রেণীর সংবাদপত্র খুব বড় ভূমিকা রাখে। হিটলার দানব হয়ে ওঠার আগে সংবাদপত্র ছিল তাঁর প্রধান সহায়। তাঁর কাজকে অনেক দিন অন্ধভাবে সমর্থন দিয়ে গেছে সংবাদপত্র। তাঁর নীলনকশাকে দিয়েছে সমর্থন। তা ছাড়া বিভিন্ন দেশ আক্রমণের আগে ওই সব দেশের সরকারগুলোও হিটলারের নিন্দা করেনি। সুতরাং সেখানকার কাগজগুলোও করেনি। বহুকাল স্পেনের কাগজগুলো রিপাবলিকপন্থীদের নয়, স্বৈরাচারী ফ্রানসিসকো ফ্রাঙ্কোকেই সমর্থন দিয়েছে। পর্তুগালে একনায়ক আন্তনিও সালাজারকে টিকিয়ে রাখে সংবাদপত্র। ফিলিপাইনে ফার্দিনান্দ মার্কোসের স্বৈরশাসনকে পাকাপোক্ত করতে সংবাদপত্রই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে। পরিহাসের মতো মনে হয়, তাদের পতনের পরে হিটলার, ফ্রাঙ্কো, সালাজার, মার্কোসকে ওই সব কাগজই বেশি নিন্দা করেছে। ইঙ্গো-মার্কিনপন্থী ইরানের শাহকে পত্রিকাগুলো প্রশংসায় সিক্ত করেছে বহু বছর। তারপর যেদিন আয়াতুল্লাহ খোমেনি তাঁকে এক কাপড়ে দেশ থেকে বিতাড়ন করেন, বিমানবন্দর পর্যন্ত জনগণ তাঁকে তাড়া করে, সেদিন ঘুরে যায় কাগজের সুর। লেখা হতে থাকে শাহ কত খারাপ শাসক ছিলেন। পঁচাত্তরের আগে এবং পরে আমরা তা দেখেছি।
সরকারের বিভিন্ন বিভাগ থেকে, বিশেষ করে গোয়েন্দা বিভাগ থেকে খবর সংগ্রহ করা সাংবাদিকদের প্রচলিত রীতি। চিরকাল সব দেশেই তা করা হয়। নানা কারণে সূত্রের নাম গোপন রাখা হয়। ১২-১৩ বছর ধরে দেখছি, গোয়েন্দা বিভাগই আগ বাড়িয়ে সাংবাদিকদের দিয়ে সংবাদ করাচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে সরবরাহ করা তথ্য নিজে যাচাই না করে সাংবাদিক প্রকাশ করতে পারেন না। আমাদের তা করা হচ্ছে।
তিনোদ্দীনের বিশেষ সরকারের সময় থেকে শুরু হয়েছে আরেক ধারা: অপরাধী বা রাজনৈতিক নেতাদের আটক করে রিমান্ডে নেওয়া হচ্ছে। তারপর সম্পূর্ণ অনৈতিকভাবে একতরফা বলা হচ্ছে: ওই ব্যক্তি এই বলেছেন, ওই করেছেন এবং তাঁর অমুক অমুক নাশকতামূলক কাজ করার পরিকল্পনা ছিল। সব কাগজে নয়, কোনো কোনো কাগজে সেসব বানোয়াট কাহিনি বিশাল শিরোনাম দিয়ে প্রকাশ করা হচ্ছে। রিমান্ডের গোপন ঘরে ভয়-ভীতির মধ্যে কে কী বলল, তা সংবাদ নয়। সাংবাদিকদের কাছে অপরাধী কী বলল, তাই সংবাদ। কয়েক দিন বাদ দিয়েই সম্ভাব্য নাশকতার সংবাদ প্রচার করা হচ্ছে। আজ কতভাবে বাংলাদেশের ক্ষতি করা হচ্ছে, তার কিছু কিছু হিসাব জনগণ ঠিকই রাখে। কয়েক মাস আগে আমি কলকাতায় যাব। টিকিট করার জন্য বিমান অফিসে গেছি। ঢুকছি, দেখি দলবেঁধে অনেক লোক বেরোচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে বিদেশি আছেন দুজন। ওই দিন একটি বা একাধিক কাগজে ‘ভারতের একটি গোয়েন্দা সংস্থার বরাত’ দিয়ে প্রতিবেদন করা হয়েছে ইসলামি জঙ্গিরা বাংলাদেশ বিমানে হামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ খবর জানার পর কে চড়বে বিমানে? বিমান অফিস থেকে লোকগুলো দৌড়ে চলে গেলেন অন্য এয়ারলাইনসের অফিসে। তাঁদের পিছে পিছে আমিও দিলাম দৌড়। অন্য এয়ারলাইনসের টিকিট কিনলাম। এক খবরেই আমার বন্ধু জি এম কাদেরের কয়েক কোটি টাকা লোকসান হয়ে গেল।
ঢাকার বিদেশি দূতাবাসে হামলার সংবাদ হামেশাই হচ্ছে। এ জাতীয় সংবাদ প্রকাশের সুবিধা অনেক রকম। যদি সত্যি কখনো হামলা হয়, তাহলে যে কাগজে রিপোর্ট হয়েছে, তাঁরা লাফিয়ে উঠবেন। বলবেন: এ তো আমরা জানতাম, তাই আগেই সাবধান করে দিয়েছিলাম। অন্যদিকে এই ভুয়া বা বায়বীয় সংবাদ প্রকাশের পর যখন কিছুই ঘটবে না, তখন ওই সাংবাদিক বলবেন: আমরা লিখেছিলাম বলেই হামলাটি হয়নি। তা না হলে বিমানের সব উড়োজাহাজ জঙ্গিরা উড়িয়ে দিত। গুঁড়িয়ে দিত দূতাবাস।
এ জাতীয় সংবাদে অট্টহাসি হাসে দুই পক্ষ: এক পক্ষ, যাদের সম্পর্কে ইঙ্গিত করা হয়েছে। তারা হাসতে হাসতে বলে: কত বড় বেকুব দেখো। কিছুই জানে না। আর হাসে সেই পক্ষ, যারা সত্যি সত্যি অপরাধ ঘটাবে। কখন ঘটাবে, তা শুধু তারাই জানে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে বর্বরতার পর গত সপ্তাহে চ্যানেল আইয়ের এক আলোচনায় মাহমুদুর রহমান মান্না, রিজভী আহমেদ ও আমি ছিলাম। আলোচনার মধ্যে উপস্থাপক মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর একটি প্রধান দৈনিকের একটি রিপোর্ট আমাদের দেখালেন। তাতে রিপোর্টার একটি গোয়েন্দা সংস্থার বরাত দিয়ে লিখেছেন: ছাত্রলীগের বর্তমান যে কমিটি, এটি হাওয়া ভবন থেকে মনোনীত হয়ে আসে ইত্যাদি ইত্যাদি। রিপোর্টটি পড়ে আমার মনে হলো, রিপোর্টার বলতে চান, হাওয়া ভবনের সাবেক সর্বাধিনায়ক তারেক রহমান কয়েক বছর আগেই জানতে পারেন, আগামী ২০০৮-এর নির্বাচনে তাঁর আম্মা জিততে পারবেন না। সরকার গঠন করবেন শেখ হাসিনা। তখন সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য প্রয়োজন হবে ছাত্রলীগের। সুতরাং আগেভাগে ছাত্রলীগে এমন নেতৃত্ব বসিয়ে যাবেন, যাঁরা চাপাতি ও রামদার সদ্ব্যবহারে সুদক্ষ এবং সহপাঠীদের খড়কুটোর মতো তিনতলা থেকে মাটিতে ছুড়ে ফেলবেন। মান্না ও রিজভী উভয়েই রিপোর্টটিকে বাজে ও রাবিশ বলে উড়িয়ে দিলেন। আমি বলেছিলাম, এ খবরটি গোয়েন্দারা সাত-আট বছর গোপন রাখলেন কেন? জাহাঙ্গীরনগরের ঘটনার আগের দিন তথ্যটি প্রধানমন্ত্রীর অফিসে পৌঁছে দেননি কেন? অর্থাৎ এ খবরটি কোনো গোয়েন্দা সূত্র দেয়নি, রিপোর্টারের মাথা দিয়েছে।
আমি যা বলতে চাই তা হলো সংবাদপত্রের কাছে মানুষের প্রত্যাশা প্রচুর। সেই প্রত্যাশা নষ্ট হয়ে গেলে পাঠক হতাশায় ভোগে। আমার এ লেখার দীর্ঘ ভূমিকায় আমি যা বলেছি, তার অর্থ হলো সংবাদপত্রের সঙ্গে আমার সম্পর্ক সারা জীবনের। সাংবাদিকতা ও লেখালেখি ছিল আমার জীবিকার একমাত্র উপায়। সংবাদপত্রকে যখন কেউ সমালোচনা করে এবং সংগত কারণেই করে, তখন আমার গায়ে লাগে। আমি আহত হই।
পৃথিবীতে মন্দ গণতন্ত্র যেমন আছে, তেমনই অপসাংবাদিকতাও আছে। ভালো গণতন্ত্রের জন্য ভালো সংবাদপত্র অপরিহার্য। ব্যক্তিস্বার্থের কারণে রাজনীতিকদের কেউ খারাপ হতে পারেন, নীতি বিসর্জন দিতে পারেন, কিন্তু সাংবাদিকের নীতিভ্রষ্ট হওয়ার উপায় নেই। কোনো গোষ্ঠীর বা শাসকের লাঠিয়াল হওয়া সাংবাদিকের কাজ নয়। দেশ, জাতি ও জনগণের স্বার্থ রক্ষাই তাঁর ব্রত। সত্যের পক্ষে অনড় থেকেই সেই ব্রত পালন করা সম্ভব। সত্য থেকে বিচ্যুত হওয়া তাঁর জন্য আত্মহত্যার শামিল।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
খবরের কাগজটি কীভাবে তৈরি হয়? কারা, কোথায় বসে লেখাগুলো লেখেন? সারা রাত কোথায় ছাপা হয়? সেসব বিষয় খুব অল্প পাঠকই জানেন, বা তাঁদের জানার প্রয়োজন আছে। ভোরবেলা পাঠক তাঁর হাতে কাগজটি পান অনেকটা অলৌকিকভাবে। রাস্তার পাঠক পত্রিকা কেনেন হকারের কাছ থেকে অথবা পত্রপত্রিকার স্ট্যান্ড থেকে। গ্রাহকদের যাঁরা একতলার বাড়িতে থাকেন, তাঁরা সকালে কাগজ পান জানালার নিচে। যাঁরা বহুতল ভবনে থাকেন, তাঁদের কাগজ আসে দরজার তলা দিয়ে। একালের অনেক আধুনিক পাঠক কাগজ স্পর্শ না করে নাশতার টেবিলে বসেন না। কারও থাকে এক হাতে চায়ের ধূমায়িত কাপ, আরেক হাতে খবরের কাগজ। আধুনিক জীবন ও খবরের কাগজ অবিচ্ছিন্ন। সংবাদপত্র ছাড়া আধুনিক রাজনীতিও অচল। গণতন্ত্রের জন্য সংবাদপত্র চাই-ই।
অনুমান করি, পৃথিবীতে এসে প্রথম চোখ মেলেই দেখে থাকব খবরের কাগজ। নিশ্চয়ই আমার আঁতুড়ঘরের বেড়ায় খবরের কাগজ সাঁটানো ছিল। কার্তিকের বিষণ্ন রাতে পদ্মার ঠান্ডা হাওয়া বেড়ার ফাঁকফোকর দিয়ে আঁতুড়ঘরে না ঢুকতে পারে, সে জন্য পুরোনো খবরের কাগজ ব্যবহূত হয়ে থাকবে। আমার বাল্যশিক্ষা পড়া আর খবরের কাগজের শিরোনাম বানান করে পড়া একই সময় শুরু হয়। আমার বাবা ছিলেন খবরের কাগজের পোকা। পত্রিকা একটা হলেই হলো। আজাদ বা আনন্দবাজার পত্রিকা, মর্নিং নিউজ বা স্টেটসম্যান। সেকালে কাগজ সহজলভ্য ছিল না, গ্রামের পাঠক বা গ্রাহকদের জন্য তো নয়ই। গ্রামে কাগজ সকালবেলায় জানালার নিচে বা দরজার তলায় পাওয়া যেত না। কলকাতা ও ঢাকার কাগজ গ্রামে যেত তিন দিন পর। মঙ্গলবারের কাগজ পাওয়া যেত শুক্রবার সন্ধ্যায়। পোস্টাপিসের ডাকপিয়ন এসে দিয়ে যেতেন।
আমার অতি শৈশবে তিনটি ভাষার কাগজ আমি বাড়িতে দেখেছি। আমার মা বাংলা বলতে পারতেন না, বাংলা অক্ষরও চিনতেন না। তিনি পড়তেন উর্দু সাপ্তাহিক রোজানা-ই-হিন্দ্ বা কলকাতার অন্য কোনো কাগজ। খুব নিয়মিতও নয়। কাগজে লেখা হয় দুনিয়ার কোথায় কী ঘটছে। কে কোন দেশের প্রধানমন্ত্রী, কে চিয়াং কাই-শেক, কে মাও সেতুং, কে দেশের রেলমন্ত্রী, চালের বাজারে আগুন লাগল কি না, আলু ও এলাচের দাম হঠাৎ কেন বাড়ল, কোন বেশরম মেয়েটি তার প্রাইভেট শিক্ষককে ভালোবেসে তার সঙ্গে পালিয়ে গেছে—এসব জানার আগ্রহ সব পাঠকের থাকে না।
শৈশবে যখন গ্রামে ছিলাম, বিশেষ করে আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের আগে, ভরসা ছিল আজাদ ও ইত্তেফাক। তাও কয়েক দিনের বাসি কাগজ। সেটাই টাটকা মনে হতো। মাঝেমধ্যে কলকাতা থেকে আসত দৈনিক যুগান্তর। সেটার ছাপা ও লেখা আরও উন্নত। স্বাধীনতার পর প্রথম ১০ বছর, মোটের ওপর স্বাভাবিক সম্পর্ক ছিল, আইয়ুব ক্ষমতায় আসার পর পাকিস্তান-ভারত সম্পর্কের মাঝখানে বিরাট প্রাচীর উঠে যায়। কলকাতার কাগজ আসা বন্ধ হয়ে যায়। মাঝেমধ্যে আমার ছোট চাচা, যিনি গ্রহণ করেছিলেন ভারতের নাগরিকত্ব, লোকের হাতে কলকাতার দৈনিক-সাপ্তাহিকের বান্ডিল পাঠাতেন।
সব মানুষের মতোই আমিও একদিন ছিলাম পাঠক, তারপর হয়ে গেলাম সংবাদপত্রের লেখক। তারপর পেশাদার সাংবাদিক। স্বাধীনতার আগে অনিয়মিতভাবে লিখলেও স্বাধীনতার পর দেশের প্রধান তিনটি কাগজ—ইত্তেফাক, সংবাদ ও দৈনিক বাংলার সাহিত্য সাময়িকীর প্রধান লেখকদের আমি ছিলাম একজন। বছরের পর বছর দৈনিক বাংলায় কবি আহসান হাবীব, ইত্তেফাক-এ রোকনুজ্জামান খান (দাদা ভাই) এবং সংবাদ-এ আবুল হাসনাত আমার লেখাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে প্রধান রচনা করেছেন। তাঁদের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
তারপর শুরু হয় উপসম্পাদকীয় নিবন্ধ রচনা। ইংরেজি-বাংলা সব কাগজেই লিখতাম। নিয়মিত লেখা শুরু হয় আজকের কাগজ থেকে। তারপর ভোরের কাগজ, প্রথম পর্যায়ের বাংলাবাজার পত্রিকা, প্রথম আলো, যুগান্তর, সমকাল প্রভৃতি। ডেইলি স্টার পত্রিকায়ও বহুদিন লিখেছি। প্রধান কাগজের সম্পাদকদের অকৃপণ ভালোবাসা ও প্রীতি বর্ষিত হয়েছে আমার ওপর। মালিক-সম্পাদকদের মধ্যে সংবাদ-এর আহমদুল কবির, ইত্তেফাক-এর মইনুল হোসেন এবং আজকের কাগজ-এর কাজী শাহেদ আহমেদ আমাকে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের যে সুযোগ দিয়েছেন, এর জন্য তাঁদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। যত দিন শামসুর রাহমান দৈনিক বাংলার সম্পাদক ছিলেন, তত দিন ওই কাগজ ছিল আমাদের নিজস্ব।
নব্বইয়ের দশক এবং এই শতকের প্রথম দশকে কয়েকজন সম্পাদক বাংলাদেশের সংবাদপত্রে নতুন যুগের সূচনা করেন। তোয়াব খানের নেতৃত্বে জনকণ্ঠ, মতিউর রহমানের ভোরের কাগজ ও প্রথম আলো, মতিউর রহমান চৌধুরীর প্রথমে বাংলাবাজার পত্রিকা এবং পরে মানবজমিন, গোলাম সারওয়ারের যুগান্তর ও সমকাল এবং আবেদ খানের সমকাল এবং এখন কালের কণ্ঠ বাংলাদেশের সংবাদপত্রের দিগন্তকে প্রসারিত করেছে। ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার-এর সম্পাদক মাহফুজ আনাম নতুন এক বলিষ্ঠ ধারার সৃষ্টি করেছেন। এসব দক্ষ সম্পাদকের দ্বারা যে আধুনিক সাংবাদিকতার সূচনা হয়েছে, তার জন্য তাঁদের সহযোগী একদল যোগ্য তরুণ সাংবাদিকের অবদানও বিরাট। তাঁরা নতুন যুগের সাংবাদিক। তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি ও ভাষা নতুন ও আধুনিক। তৈরি হয়েছে গত পনেরো বছরে একদল দক্ষ ফটোসাংবাদিক। অর্থাৎ একটি উঁচু জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে আজ আমাদের সংবাদপত্র।
আমার চিন্তা প্রকাশে বিভিন্ন পর্যায়ে কাজী শাহেদ আহমেদ, মাহফুজ আনাম, মতিউর রহমান, গোলাম সারওয়ার, মতিউর রহমান চৌধুরী, আবেদ খান যে স্বাধীনতা দিয়েছেন, নিশ্চয়ই অন্য লেখকেরাও তেমনটি ভোগ করেছেন। পত্রিকায় সম্পাদকের পাতায় রচনা লিখলেও আমি তো একজন পাঠকও বটে। শৈশবে একটি কাগজের জন্য পোস্টাপিসের পিয়নের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আজ সম্পাদক-প্রকাশকদের দয়ায় দরজার তলা ভরে যায় কাগজে। সবচেয়ে পুরোনো সৌজন্য কপিটি ইত্তেফাক। ৪১ বছর ধরে পাচ্ছি। সিরাজুদ্দীন হোসেন দিয়ে গিয়েছিলেন, আর বন্ধ হয়নি। ১০-১৫টি কাগজে প্রতিদিন চোখ বোলানোর সৌভাগ্য হয়। সংবাদপত্র পাঠ করে আজ সব সময় ভালো লাগে না। ভালো না লাগার কারণ অনেক রকম।
কয়েক দিন আগে ঢাকার বাইরে থেকে ফিরছিলাম। হাইওয়ের পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ড্রাইভার অদূরে ঝোপের আড়ালে গেল। আমি গাড়ি থেকে নেমে একটু হাঁটাহাঁটি করছিলাম। রাস্তার পাশের এক সবজির খেতে এক ভদ্রলোক কী যেন করছিলেন; তিনি উঠে এলেন সড়কের ওপর। কোনোভাবে তিনি আমাকে চিনলেন। ঝাড়া দিয়ে লুঙ্গির মাটি ফেলে তিনি ক্ষোভের সুরে বললেন, ‘কাগজে আপনারা সরকারের, বিরোধী দলের, প্রধানমন্ত্রীর, বিরোধীদলীয় নেত্রীর, মন্ত্রীদের দোষ, দুর্নীতি ও দুর্বলতার জন্য লেখালেখি করেন। পত্রিকার ভুলভ্রান্তি ও দোষের সমালোচনা করার উপায় কী?’
আমি তাঁকে বললাম, ‘সে সমালোচনা আপনারা করবেন। আপনাদের মতামতের মূল্য খুব বেশি।’ তখন তিনি কয়েকটি সংবাদের উল্লেখ করলেন উদাহরণ হিসেবে। তিনি জানতে চাইলেন, এসব সংবাদের উদ্দেশ্য কী, এসব সংবাদের ভিত্তি কী, এতে দেশের কোনো উপকার হবে কি না, এসব সংবাদে আদৌ কোনো সত্যতা আছে কি না।
ভদ্রলোকের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আমি কেউ নই। যেসব কাগজে ওই সব প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, সেসব কাগজের সম্পাদক এবং যিনি বা যাঁরা ওই প্রতিবেদন তৈরি করেছেন, তাঁরাই সঠিক উত্তর দিতে পারতেন। ওই ভদ্রলোকই প্রথম নন, তাঁর মতো প্রশ্ন আরও অনেকেই করেন। জবাব দিতে পারি না। ৩৫ বছরের বেশি আমি প্রত্যক্ষভাবে সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত ছিলাম। সহকারী সম্পাদক থেকে সম্পাদক পর্যন্ত হয়েছিলাম। পত্রপত্রিকার দোষ-গুণ আমার অজানা নয়। সমস্যাও আমার অজ্ঞাত নয়। বাঙালির গণতান্ত্রিক সংগ্রামে আমাদের সংবাদপত্র পাকিস্তানি আমলে এবং স্বাধীন বাংলাদেশে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু তার পরও বলব, সব সময় কাগজের ভূমিকা ইতিবাচক ও নির্মল ছিল না। অনেক সময় সত্য ও ন্যায় থেকে বিচ্যুতি ঘটেছে এবং তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গোটা জাতি। সেই ক্ষতির মাশুল গুনতে হয়েছে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে।
১৯৪৮ সালে এক ব্যক্তিগত চিরকুটে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে ক্ষুব্ধ হয়ে লিখেছিলেন, ‘কী করছে আনন্দবাজার পত্রিকা, যুগান্তর, অমৃতবাজার পত্রিকা আর হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড এবং ওদিকে আজাদ পত্রিকা। এরা চাইছে, দাঙ্গা ভালোমতো লাগুক। যাচ্ছেতাই মিথ্যাচার করছে এই কাগজগুলো। এপার থেকে মুসলমানরা ওপার চলে যাক, আর পূর্ববাংলা থেকে হিন্দুরা ভয়ে বাড়িঘর ফেলে এদিকে চলে আসুক। এদের থামাতে পারো কি না দ্যাখো।’
উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে কেউ কিছু করলে কে তাকে রুধিবে দিয়ে বালির বাঁধ। কোটি কোটি মানুষের সর্বনাশ হয়েছে, লাভবান হয়েছে কয়েকজন। পত্রিকা শুধু ঘটে যাওয়া খবর দেয় না, জনমত গঠন করে, বিশেষ পরিস্থিতির জন্য মানুষের মন তৈরি করে। তা ছাড়া একটি রাষ্ট্রে সরকার ছাড়াও বিভিন্ন কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী থাকে। তারাও সংবাদপত্রকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে।
স্বাধীন সংবাদপত্র ছাড়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। আবার গণতন্ত্রকে হত্যা করতেও একশ্রেণীর সংবাদপত্র খুব বড় ভূমিকা রাখে। হিটলার দানব হয়ে ওঠার আগে সংবাদপত্র ছিল তাঁর প্রধান সহায়। তাঁর কাজকে অনেক দিন অন্ধভাবে সমর্থন দিয়ে গেছে সংবাদপত্র। তাঁর নীলনকশাকে দিয়েছে সমর্থন। তা ছাড়া বিভিন্ন দেশ আক্রমণের আগে ওই সব দেশের সরকারগুলোও হিটলারের নিন্দা করেনি। সুতরাং সেখানকার কাগজগুলোও করেনি। বহুকাল স্পেনের কাগজগুলো রিপাবলিকপন্থীদের নয়, স্বৈরাচারী ফ্রানসিসকো ফ্রাঙ্কোকেই সমর্থন দিয়েছে। পর্তুগালে একনায়ক আন্তনিও সালাজারকে টিকিয়ে রাখে সংবাদপত্র। ফিলিপাইনে ফার্দিনান্দ মার্কোসের স্বৈরশাসনকে পাকাপোক্ত করতে সংবাদপত্রই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে। পরিহাসের মতো মনে হয়, তাদের পতনের পরে হিটলার, ফ্রাঙ্কো, সালাজার, মার্কোসকে ওই সব কাগজই বেশি নিন্দা করেছে। ইঙ্গো-মার্কিনপন্থী ইরানের শাহকে পত্রিকাগুলো প্রশংসায় সিক্ত করেছে বহু বছর। তারপর যেদিন আয়াতুল্লাহ খোমেনি তাঁকে এক কাপড়ে দেশ থেকে বিতাড়ন করেন, বিমানবন্দর পর্যন্ত জনগণ তাঁকে তাড়া করে, সেদিন ঘুরে যায় কাগজের সুর। লেখা হতে থাকে শাহ কত খারাপ শাসক ছিলেন। পঁচাত্তরের আগে এবং পরে আমরা তা দেখেছি।
সরকারের বিভিন্ন বিভাগ থেকে, বিশেষ করে গোয়েন্দা বিভাগ থেকে খবর সংগ্রহ করা সাংবাদিকদের প্রচলিত রীতি। চিরকাল সব দেশেই তা করা হয়। নানা কারণে সূত্রের নাম গোপন রাখা হয়। ১২-১৩ বছর ধরে দেখছি, গোয়েন্দা বিভাগই আগ বাড়িয়ে সাংবাদিকদের দিয়ে সংবাদ করাচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে সরবরাহ করা তথ্য নিজে যাচাই না করে সাংবাদিক প্রকাশ করতে পারেন না। আমাদের তা করা হচ্ছে।
তিনোদ্দীনের বিশেষ সরকারের সময় থেকে শুরু হয়েছে আরেক ধারা: অপরাধী বা রাজনৈতিক নেতাদের আটক করে রিমান্ডে নেওয়া হচ্ছে। তারপর সম্পূর্ণ অনৈতিকভাবে একতরফা বলা হচ্ছে: ওই ব্যক্তি এই বলেছেন, ওই করেছেন এবং তাঁর অমুক অমুক নাশকতামূলক কাজ করার পরিকল্পনা ছিল। সব কাগজে নয়, কোনো কোনো কাগজে সেসব বানোয়াট কাহিনি বিশাল শিরোনাম দিয়ে প্রকাশ করা হচ্ছে। রিমান্ডের গোপন ঘরে ভয়-ভীতির মধ্যে কে কী বলল, তা সংবাদ নয়। সাংবাদিকদের কাছে অপরাধী কী বলল, তাই সংবাদ। কয়েক দিন বাদ দিয়েই সম্ভাব্য নাশকতার সংবাদ প্রচার করা হচ্ছে। আজ কতভাবে বাংলাদেশের ক্ষতি করা হচ্ছে, তার কিছু কিছু হিসাব জনগণ ঠিকই রাখে। কয়েক মাস আগে আমি কলকাতায় যাব। টিকিট করার জন্য বিমান অফিসে গেছি। ঢুকছি, দেখি দলবেঁধে অনেক লোক বেরোচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে বিদেশি আছেন দুজন। ওই দিন একটি বা একাধিক কাগজে ‘ভারতের একটি গোয়েন্দা সংস্থার বরাত’ দিয়ে প্রতিবেদন করা হয়েছে ইসলামি জঙ্গিরা বাংলাদেশ বিমানে হামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ খবর জানার পর কে চড়বে বিমানে? বিমান অফিস থেকে লোকগুলো দৌড়ে চলে গেলেন অন্য এয়ারলাইনসের অফিসে। তাঁদের পিছে পিছে আমিও দিলাম দৌড়। অন্য এয়ারলাইনসের টিকিট কিনলাম। এক খবরেই আমার বন্ধু জি এম কাদেরের কয়েক কোটি টাকা লোকসান হয়ে গেল।
ঢাকার বিদেশি দূতাবাসে হামলার সংবাদ হামেশাই হচ্ছে। এ জাতীয় সংবাদ প্রকাশের সুবিধা অনেক রকম। যদি সত্যি কখনো হামলা হয়, তাহলে যে কাগজে রিপোর্ট হয়েছে, তাঁরা লাফিয়ে উঠবেন। বলবেন: এ তো আমরা জানতাম, তাই আগেই সাবধান করে দিয়েছিলাম। অন্যদিকে এই ভুয়া বা বায়বীয় সংবাদ প্রকাশের পর যখন কিছুই ঘটবে না, তখন ওই সাংবাদিক বলবেন: আমরা লিখেছিলাম বলেই হামলাটি হয়নি। তা না হলে বিমানের সব উড়োজাহাজ জঙ্গিরা উড়িয়ে দিত। গুঁড়িয়ে দিত দূতাবাস।
এ জাতীয় সংবাদে অট্টহাসি হাসে দুই পক্ষ: এক পক্ষ, যাদের সম্পর্কে ইঙ্গিত করা হয়েছে। তারা হাসতে হাসতে বলে: কত বড় বেকুব দেখো। কিছুই জানে না। আর হাসে সেই পক্ষ, যারা সত্যি সত্যি অপরাধ ঘটাবে। কখন ঘটাবে, তা শুধু তারাই জানে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে বর্বরতার পর গত সপ্তাহে চ্যানেল আইয়ের এক আলোচনায় মাহমুদুর রহমান মান্না, রিজভী আহমেদ ও আমি ছিলাম। আলোচনার মধ্যে উপস্থাপক মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর একটি প্রধান দৈনিকের একটি রিপোর্ট আমাদের দেখালেন। তাতে রিপোর্টার একটি গোয়েন্দা সংস্থার বরাত দিয়ে লিখেছেন: ছাত্রলীগের বর্তমান যে কমিটি, এটি হাওয়া ভবন থেকে মনোনীত হয়ে আসে ইত্যাদি ইত্যাদি। রিপোর্টটি পড়ে আমার মনে হলো, রিপোর্টার বলতে চান, হাওয়া ভবনের সাবেক সর্বাধিনায়ক তারেক রহমান কয়েক বছর আগেই জানতে পারেন, আগামী ২০০৮-এর নির্বাচনে তাঁর আম্মা জিততে পারবেন না। সরকার গঠন করবেন শেখ হাসিনা। তখন সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য প্রয়োজন হবে ছাত্রলীগের। সুতরাং আগেভাগে ছাত্রলীগে এমন নেতৃত্ব বসিয়ে যাবেন, যাঁরা চাপাতি ও রামদার সদ্ব্যবহারে সুদক্ষ এবং সহপাঠীদের খড়কুটোর মতো তিনতলা থেকে মাটিতে ছুড়ে ফেলবেন। মান্না ও রিজভী উভয়েই রিপোর্টটিকে বাজে ও রাবিশ বলে উড়িয়ে দিলেন। আমি বলেছিলাম, এ খবরটি গোয়েন্দারা সাত-আট বছর গোপন রাখলেন কেন? জাহাঙ্গীরনগরের ঘটনার আগের দিন তথ্যটি প্রধানমন্ত্রীর অফিসে পৌঁছে দেননি কেন? অর্থাৎ এ খবরটি কোনো গোয়েন্দা সূত্র দেয়নি, রিপোর্টারের মাথা দিয়েছে।
আমি যা বলতে চাই তা হলো সংবাদপত্রের কাছে মানুষের প্রত্যাশা প্রচুর। সেই প্রত্যাশা নষ্ট হয়ে গেলে পাঠক হতাশায় ভোগে। আমার এ লেখার দীর্ঘ ভূমিকায় আমি যা বলেছি, তার অর্থ হলো সংবাদপত্রের সঙ্গে আমার সম্পর্ক সারা জীবনের। সাংবাদিকতা ও লেখালেখি ছিল আমার জীবিকার একমাত্র উপায়। সংবাদপত্রকে যখন কেউ সমালোচনা করে এবং সংগত কারণেই করে, তখন আমার গায়ে লাগে। আমি আহত হই।
পৃথিবীতে মন্দ গণতন্ত্র যেমন আছে, তেমনই অপসাংবাদিকতাও আছে। ভালো গণতন্ত্রের জন্য ভালো সংবাদপত্র অপরিহার্য। ব্যক্তিস্বার্থের কারণে রাজনীতিকদের কেউ খারাপ হতে পারেন, নীতি বিসর্জন দিতে পারেন, কিন্তু সাংবাদিকের নীতিভ্রষ্ট হওয়ার উপায় নেই। কোনো গোষ্ঠীর বা শাসকের লাঠিয়াল হওয়া সাংবাদিকের কাজ নয়। দেশ, জাতি ও জনগণের স্বার্থ রক্ষাই তাঁর ব্রত। সত্যের পক্ষে অনড় থেকেই সেই ব্রত পালন করা সম্ভব। সত্য থেকে বিচ্যুত হওয়া তাঁর জন্য আত্মহত্যার শামিল।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments