একদা একটা শহর ছিল ঢাকা নামে by আনিসুল হক
একদা একটা শহর ছিল ঢাকা নামে। সেই শহরে বাস করত দেড় কোটি মানুষ। সেই শহরটা এখন একটা পরিত্যক্ত মৃত নগর।
নগরটা কীভাবে পরিত্যক্ত হলো, পরিণত হলো পোড়ো এলাকায়, সেই কাহিনি পৃথিবীর মানুষের জানা। সারা পৃথিবীর স্কুল কলেজেই একটি শহরের মৃত্যুকাহিনি নামের প্রবন্ধ পড়ানো হয়ে থাকে।
শহরটা আগে খুবই সুন্দর ছিল। ছিল একটা উদ্যানগর।
বুদ্ধদেব বসু নামের একজন বাঙালি কবি-লেখক ঢাকা সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘কার্জন-কল্পিত পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের রাজধানী হিসেবে তৈরি হয়েছিলো রমনা—অনেকের মুখে তখনও নাম ছিল “নিউ টাউন”।...ভিতরে বাইরে এক জমকালো ব্যাপার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। নিখিলবাংলার একমাত্র উদ্যান-নগরে পনেরো-কুড়িটি অট্টালিকা নিয়ে ছড়িয়ে আছে তার কলেজ-বাড়ি, ল্যাবরেটরি, ছাত্রাবাস: আছে ব্যায়ামাগার ও ক্রীড়াঙ্গন ও জলক্রীড়ার জন্য পুস্করণী—যেখানে সেখানে সবুজ মাঠ বিস্তীর্ণ।...স্থাপত্যে কোনো একঘেঁয়েমি নেই, সরণি ও উদ্যান রচনায় নয়াদিলির্ল জ্যামিতিক দুঃস্বপ্ন স্থান পায়নি।...সর্বত্র প্রচুর স্থান, ঘেঁষাঘেঁষি ঠেলাঠেলির কোনো কথাই ওঠে না।’
১৯০৮ সালে গভর্নর হেয়ার সাহেব তার বন্ধু বিশ্বখ্যাত কিউ গার্ডেনস-এর ইন্সট্রাকটর মি. প্রাউডলককে নিয়ে এসেছিলেন ঢাকাকে বৃক্ষশোভিত করার জন্যে। সবুজ শ্যামল ঢাকা দেখে মুগ্ধ প্রাউডলক ঘোষণা দেন, আমি রমনাকে গড়ে তুলব দ্বিতীয় পারি হিসেবে। ১৯০৮ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত প্রাউডলক ঢাকার পথতরু আর বাগান নিয়ে কাজ করেন। যে রমনা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু।
ঢাকা ছিল নদীর শহর। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, চারদিকে তার নদী। ছিল বাগান আর বাগান। গুলিস্তান, গুলবাগ, সেগুনবাগিচা, কাঁঠালবাগান, কলাবাগান, শান্তিবাগ শহরের এলাকার নামগুলোই বলে দিত কত ধরনের বাগান ছিল শহরে। আর ছিল খাল। মহাখালী, ধোলাইখাল, মতিঝিল—এমনই কত খাল বিল ঝিলের নামে জায়গার নাম ছিল সেই শহরে।
সেই শহরে ছিল শেরেবাংলা নগর নামের একটা পরিকল্পিত এলাকা। পৃথিবীবিখ্যাত স্থপতি লুই কান ওই এলাকাটার নকশা করেছিলেন। জাতীয় সংসদ ভবন ছিল তারই অংশ। লুই কানের করা ঢাকা শহরের সংসদ ভবনটা ছিল সারা পৃথিবীর মধ্যে একটা শ্রেষ্ঠ স্থাপত্য নিদর্শন। পুরো শেরেবাংলা নগরের যতটা লুই কানের পরিকল্পনা মতো করা হয়েছিল, তা ছিল যেকোনো বিচারে একটা আদর্শ নগর এলাকা।
তারপর শহরটিতে এল বর্গিরা। তারা লুট করে নিতে লাগল সব বাগান, জলাশয় আর নদ-নদী, খাল। নিচু জমি, ফাঁকা মাঠ, উদ্যান। ফুলবনে মত্ত হস্তীর মতো তাদের তাণ্ডবে তছনছ হয়ে যেতে লাগল সবকিছু, আইনকানুন, নগর পরিকল্পনা, সরকারি উদ্যোগ। কতিপয় বর্গির সীমাহীন লোভ, আগ্রাসন, আস্ফাালনের কাছে পর্যুদস্ত হয়ে গেল নাগরিকদের বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা, স্বাভাবিক শুভবোধ ও জীবনবোধ। সর্বভুক আগুনের মতো তাদের চকচকে জিহ্বার লেলিহান শিখা গ্রাস করে ফেলল পুরোটা শহরের টিকে থাকার শেষ অবলম্বনটুকুও।
চারদিকে নদী ছিল, এখন নদী নেই। যাও আছে, তার পানি হয়ে উঠল শোধনের অযোগ্য। ফলে ক্রমাগতভাবে মাটির নিচের পানি ওঠানো হতে লাগল শহরবাসীর জলের প্রয়োজন মেটাতে। তখন পানির স্তর নিচে নেমে যেতে লাগল। কিন্তু শহরের সব খোলা জায়গা, মাঠ, খাল-বিল, জলাশয় ভরাট করার ফলে ওপরের পানি চুইয়ে মাটির নিচের জলাধারে পৌঁছানোর সব সুযোগ গেল বন্ধ হয়ে। শহরের মাটির নিচটা হয়ে গেল ফাঁপা।
আর বৃষ্টির পানি নামার সব রাস্তাও হয়ে গেল বন্ধ। বর্ষাকালে বৃষ্টি হলেই সব ঘরবাড়ি ডুবে যায়। রাস্তাঘাট অচল হয়ে পড়ে। প্রত্যেকের গ্যারেজে গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে দুটো করে নৌকাও স্থান পেল সগৌরবে।
আবার ভূগর্ভের পানির আধারগুলো ফাঁকা।
একসময় পরিস্থিতি এমন হলো, গভীর নলকূপ বসিয়েও পানি পাওয়া যায় না। ওই শহরের লোকজন খাওয়ার পানি আগে থেকেই কিনে খেত। এরপর গোসলের পানি, রান্নার পানি, কাপড় কাচার পানিও কেনা শুরু করল তারা। সিঙ্গাপুর থেকে, থাইল্যান্ড থেকে জাহাজে করে আসতে লাগল পানি।
তবুও শহরটা একেবারেই পরিত্যক্ত হয়ে যায়নি।
একবার একটা ভূমিকম্প হলো। জলাধার ভরাট করে বানানো আবাসিক এলাকাগুলোর ভবনগুলো সব হেলে পড়ল এদিক-ওদিক। মাটির নিচের পানিশূন্য আধারগুলো তৈরি করল সমূহ বিপদ। পুরো শহরটা দেবে গেল ২০-৩০-৪০ ফুট পর্যন্ত। বাড়িঘর সব ভেঙে পড়ল তাসের ঘরের মতো।
আর ভূমিকম্পের সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুতের শর্ট সার্কিট থেকে বিভিন্ন জায়গায় আগুন উঠল জ্বলে। সেই আগুন যে নেভানো হবে, পানি কই। আর কে-ই বা নেভাবে।
শহরময় শুধু ধ্বংস আর মৃত্যুর চিহ্ন। দেখা দিল রোগশোক মহামারি। অবস্থা এমন হলো যে জীবিতরা ঈর্ষা করতে লাগল মৃতদের।
ওই শহর থেকে ভেসে আসত ধোঁয়া আর লাশের গন্ধ। মৃত্যুর দুর্বিষহ গন্ধে ওই দেশটা তো বটেই, আশপাশের দেশের মানুষও বহুদিন নাকে রুমাল বেঁধে রাখতে বাধ্য হয়েছিল।
ওই শহরটা থেকে খুব অল্পসংখ্যক লোকই পালিয়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছিল। তারা আর কেউই ওই শহরে ফিরে যায়নি। একটা শহরের খোলা প্রান্তর, জলাশয়, উদ্যান, নদী মরে গেলে যে শহরটাও মরে যায়, তার উদাহরণ হয়ে রয়েছে ওই ঢাকা শহরের ইতিহাস।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
নগরটা কীভাবে পরিত্যক্ত হলো, পরিণত হলো পোড়ো এলাকায়, সেই কাহিনি পৃথিবীর মানুষের জানা। সারা পৃথিবীর স্কুল কলেজেই একটি শহরের মৃত্যুকাহিনি নামের প্রবন্ধ পড়ানো হয়ে থাকে।
শহরটা আগে খুবই সুন্দর ছিল। ছিল একটা উদ্যানগর।
বুদ্ধদেব বসু নামের একজন বাঙালি কবি-লেখক ঢাকা সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘কার্জন-কল্পিত পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের রাজধানী হিসেবে তৈরি হয়েছিলো রমনা—অনেকের মুখে তখনও নাম ছিল “নিউ টাউন”।...ভিতরে বাইরে এক জমকালো ব্যাপার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। নিখিলবাংলার একমাত্র উদ্যান-নগরে পনেরো-কুড়িটি অট্টালিকা নিয়ে ছড়িয়ে আছে তার কলেজ-বাড়ি, ল্যাবরেটরি, ছাত্রাবাস: আছে ব্যায়ামাগার ও ক্রীড়াঙ্গন ও জলক্রীড়ার জন্য পুস্করণী—যেখানে সেখানে সবুজ মাঠ বিস্তীর্ণ।...স্থাপত্যে কোনো একঘেঁয়েমি নেই, সরণি ও উদ্যান রচনায় নয়াদিলির্ল জ্যামিতিক দুঃস্বপ্ন স্থান পায়নি।...সর্বত্র প্রচুর স্থান, ঘেঁষাঘেঁষি ঠেলাঠেলির কোনো কথাই ওঠে না।’
১৯০৮ সালে গভর্নর হেয়ার সাহেব তার বন্ধু বিশ্বখ্যাত কিউ গার্ডেনস-এর ইন্সট্রাকটর মি. প্রাউডলককে নিয়ে এসেছিলেন ঢাকাকে বৃক্ষশোভিত করার জন্যে। সবুজ শ্যামল ঢাকা দেখে মুগ্ধ প্রাউডলক ঘোষণা দেন, আমি রমনাকে গড়ে তুলব দ্বিতীয় পারি হিসেবে। ১৯০৮ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত প্রাউডলক ঢাকার পথতরু আর বাগান নিয়ে কাজ করেন। যে রমনা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু।
ঢাকা ছিল নদীর শহর। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, চারদিকে তার নদী। ছিল বাগান আর বাগান। গুলিস্তান, গুলবাগ, সেগুনবাগিচা, কাঁঠালবাগান, কলাবাগান, শান্তিবাগ শহরের এলাকার নামগুলোই বলে দিত কত ধরনের বাগান ছিল শহরে। আর ছিল খাল। মহাখালী, ধোলাইখাল, মতিঝিল—এমনই কত খাল বিল ঝিলের নামে জায়গার নাম ছিল সেই শহরে।
সেই শহরে ছিল শেরেবাংলা নগর নামের একটা পরিকল্পিত এলাকা। পৃথিবীবিখ্যাত স্থপতি লুই কান ওই এলাকাটার নকশা করেছিলেন। জাতীয় সংসদ ভবন ছিল তারই অংশ। লুই কানের করা ঢাকা শহরের সংসদ ভবনটা ছিল সারা পৃথিবীর মধ্যে একটা শ্রেষ্ঠ স্থাপত্য নিদর্শন। পুরো শেরেবাংলা নগরের যতটা লুই কানের পরিকল্পনা মতো করা হয়েছিল, তা ছিল যেকোনো বিচারে একটা আদর্শ নগর এলাকা।
তারপর শহরটিতে এল বর্গিরা। তারা লুট করে নিতে লাগল সব বাগান, জলাশয় আর নদ-নদী, খাল। নিচু জমি, ফাঁকা মাঠ, উদ্যান। ফুলবনে মত্ত হস্তীর মতো তাদের তাণ্ডবে তছনছ হয়ে যেতে লাগল সবকিছু, আইনকানুন, নগর পরিকল্পনা, সরকারি উদ্যোগ। কতিপয় বর্গির সীমাহীন লোভ, আগ্রাসন, আস্ফাালনের কাছে পর্যুদস্ত হয়ে গেল নাগরিকদের বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা, স্বাভাবিক শুভবোধ ও জীবনবোধ। সর্বভুক আগুনের মতো তাদের চকচকে জিহ্বার লেলিহান শিখা গ্রাস করে ফেলল পুরোটা শহরের টিকে থাকার শেষ অবলম্বনটুকুও।
চারদিকে নদী ছিল, এখন নদী নেই। যাও আছে, তার পানি হয়ে উঠল শোধনের অযোগ্য। ফলে ক্রমাগতভাবে মাটির নিচের পানি ওঠানো হতে লাগল শহরবাসীর জলের প্রয়োজন মেটাতে। তখন পানির স্তর নিচে নেমে যেতে লাগল। কিন্তু শহরের সব খোলা জায়গা, মাঠ, খাল-বিল, জলাশয় ভরাট করার ফলে ওপরের পানি চুইয়ে মাটির নিচের জলাধারে পৌঁছানোর সব সুযোগ গেল বন্ধ হয়ে। শহরের মাটির নিচটা হয়ে গেল ফাঁপা।
আর বৃষ্টির পানি নামার সব রাস্তাও হয়ে গেল বন্ধ। বর্ষাকালে বৃষ্টি হলেই সব ঘরবাড়ি ডুবে যায়। রাস্তাঘাট অচল হয়ে পড়ে। প্রত্যেকের গ্যারেজে গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে দুটো করে নৌকাও স্থান পেল সগৌরবে।
আবার ভূগর্ভের পানির আধারগুলো ফাঁকা।
একসময় পরিস্থিতি এমন হলো, গভীর নলকূপ বসিয়েও পানি পাওয়া যায় না। ওই শহরের লোকজন খাওয়ার পানি আগে থেকেই কিনে খেত। এরপর গোসলের পানি, রান্নার পানি, কাপড় কাচার পানিও কেনা শুরু করল তারা। সিঙ্গাপুর থেকে, থাইল্যান্ড থেকে জাহাজে করে আসতে লাগল পানি।
তবুও শহরটা একেবারেই পরিত্যক্ত হয়ে যায়নি।
একবার একটা ভূমিকম্প হলো। জলাধার ভরাট করে বানানো আবাসিক এলাকাগুলোর ভবনগুলো সব হেলে পড়ল এদিক-ওদিক। মাটির নিচের পানিশূন্য আধারগুলো তৈরি করল সমূহ বিপদ। পুরো শহরটা দেবে গেল ২০-৩০-৪০ ফুট পর্যন্ত। বাড়িঘর সব ভেঙে পড়ল তাসের ঘরের মতো।
আর ভূমিকম্পের সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুতের শর্ট সার্কিট থেকে বিভিন্ন জায়গায় আগুন উঠল জ্বলে। সেই আগুন যে নেভানো হবে, পানি কই। আর কে-ই বা নেভাবে।
শহরময় শুধু ধ্বংস আর মৃত্যুর চিহ্ন। দেখা দিল রোগশোক মহামারি। অবস্থা এমন হলো যে জীবিতরা ঈর্ষা করতে লাগল মৃতদের।
ওই শহর থেকে ভেসে আসত ধোঁয়া আর লাশের গন্ধ। মৃত্যুর দুর্বিষহ গন্ধে ওই দেশটা তো বটেই, আশপাশের দেশের মানুষও বহুদিন নাকে রুমাল বেঁধে রাখতে বাধ্য হয়েছিল।
ওই শহরটা থেকে খুব অল্পসংখ্যক লোকই পালিয়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছিল। তারা আর কেউই ওই শহরে ফিরে যায়নি। একটা শহরের খোলা প্রান্তর, জলাশয়, উদ্যান, নদী মরে গেলে যে শহরটাও মরে যায়, তার উদাহরণ হয়ে রয়েছে ওই ঢাকা শহরের ইতিহাস।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments