স্মৃতিময় সেই বোশেজো
বিশ্বকাপের ছোঁয়ায় অনেকটাই বদলে গেছে, তার পরও মাঠটায় পা রাখতেই চোখের সামনে নাচতে শুরু করল ছয় বছর আগের সেই দৃশ্যগুলো।
অসাধারণ এক সেঞ্চুরির পর ব্যাট তুলছেন হাবিবুল বাশার। সেঞ্চুরি করে নিজেই অবাক মোহাম্মদ রফিক বলছেন, ‘নয় নম্বরে নাইমা সেঞ্চুরি মাইরা দিছি! আমার নিজেরই তো বিশ্বাস হইতাছে না!’ প্রথম ইনিংসে এই দুজন। দ্বিতীয় ইনিংসে খালেদ মাসুদ। এক ম্যাচে তিন সেঞ্চুরিতে টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম বৃষ্টির দাক্ষিণ্যহীন নিজেদের কৃতিত্বে ড্র। খেলা শেষে মাঠে বাংলাদেশ দলের গ্রুপ ছবি।
ছয় বছর হয়ে গেছে! সময় যেন উড়ে উড়ে চলে যায়। মাঝখানে আরও দুবার ওয়েস্ট ইন্ডিজ ঘুরে গেছি। সেন্ট লুসিয়ায় আসা হয়নি। বোশেজো ক্রিকেট স্টেডিয়ামে গিয়ে মনে পড়ল, এখানে আসার আগে এই নামটার কত বিচিত্র উচ্চারণই না করেছি। ইংরেজি বানানটা লিখলে আপনিও তা-ই করবেন—‘ Beausejour’।
এবার আপনিই বলুন, এর উচ্চারণ বোশেজো কেন হবে? হয়েছে, কারণ শব্দটা ফরাসি। আর ফরাসি মানেই তো উচ্চারণের ফাঁদে ফেলার বন্দোবস্ত। ইংরেজিতে লেখা হবে ‘মিটেরান্ড’ পড়তে হবে মিতেরাঁ; লেখা হবে ‘কানেস’ পড়তে হবে কান...। মনে আছে, ২০০৪ সালের ওই টেস্টের আগে মাঠে বসেই স্থানীয় এক ভদ্রলোকের কাছে ওই বোশেজোর উচ্চারণ ও অর্থ জেনেছিলাম। বো মানে গুড, শেজো মানে ডে—দুটি মিলে গুড ডে।
শহর থেকে একটু দূরে ওই স্টেডিয়াম। চারপাশে টিলাকৃতির পাহাড়। ওখানে স্টেডিয়াম বানানোর কারণ, ওই জায়গাটাতেই নাকি সেন্ট লুসিয়ায় সবচেয়ে কম বৃষ্টি হয়। বৃষ্টি না হওয়া মানেই ‘গুড ডে’, এ কারণেই বোশেজো। স্কুলে থাকতে পরীক্ষায় গল্প-কবিতার নামকরণের সার্থকতা প্রমাণ করতে হতো। বোশেজো দেখি সেই স্মৃতি ফিরিয়ে আনল!
স্টেডিয়ামের ফরাসি নাম থেকেই সেন্ট লুসিয়ায় ফ্রেঞ্চ প্রভাব অনুমান করে ফেলার কথা। এখানে অনেক জায়গারই ফরাসি নাম। ক্যারিবিয়ানের প্রায় সব দ্বীপ নিয়েই ইংরেজ আর ফরাসিরা বিস্তর মারামারি করেছে। সেন্ট লুসিয়াকে পেতে বোধহয় সবচেয়ে বেশি। ১৪ বার হাতবদল হয়েছে এই দ্বীপের মালিকানা। হোটেল রুমে পাওয়া আইল্যান্ড গাইডে দেখলাম, কোন এক ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ সেন্ট লুসিয়ার নাম দিয়েছিলেন—‘হেলেন অব ওয়েস্ট ইন্ডিজ’। হেলেন অব ট্রয়ের অনুকরণে। অনিন্দ্যসুন্দর হেলেনের জন্য যেমন ট্রয়ের যুদ্ধ, সেন্ট লুসিয়াও অমন সুন্দর না হলে কি ইংরেজ আর ফরাসিরা বছরের পর বছর যুদ্ধ করে যায়! শেষ পর্যন্ত ফরাসিরাই বোধ হয় বেশি ছাপ রেখে গেছে এই দ্বীপে।
এক দিক থেকে ক্ষতিই হয়েছে তাতে। ইংরেজি-ভাষী হয়েও সেন্ট লুসিয়ার ক্রিকেট-ঐতিহ্য বলে কিছু নেই। এই তো মাত্র কয়েক বছর আগে সেন্ট লুসিয়া থেকে প্রথম কোনো ক্রিকেটার ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে সুযোগ পেয়েছেন। ড্যারেন স্যামিকে তাই রসিকতা করে অনেকে ‘ফাদার অব সেন্ট লুসিয়ান ক্রিকেট’ বলে ডাকে বলেও শুনেছি।
ক্ষতির কথাটা ব্যাখ্যা করি। ক্রিকেট ক্যারিবিয়ানে পর্যটনেরও বাহন। ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে এলে রথ দেখা ও কলা বেচা দুটিই একসঙ্গে সেরে নেয় ওই দুই দেশের হাজার হাজার পর্যটক। অনেক বছর সেটি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখার পর সেন্ট লুসিয়াও এর ভাগ নিতে এই বোশেজো স্টেডিয়ামটা বানায়। ২০০৭ বিশ্বকাপ অন্য অনেক দ্বীপকেই আধুনিক সব স্টেডিয়াম উপহার দিয়েছে। তবে এর আগ পর্যন্ত ওয়েস্ট ইন্ডিজের সবচেয়ে সুন্দর ও আধুনিক স্টেডিয়াম ছিল এই বোশেজোই। স্টেডিয়ামের গুণেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ পেতে শুরু করে সেন্ট লুসিয়া। ক্রিকেট-ঐতিহ্যে অন্য অনেক দ্বীপদেশ এগিয়ে থাকার পরও ২০০৭ বিশ্বকাপের একটা সেমিফাইনাল হয়েছে এখানে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দুটি সেমিফাইনালও হচ্ছে এখানেই।
সাগর-সৈকত এসব তো ক্যারিবিয়ানের সব দ্বীপেরই সম্পত্তি। সেন্ট লুসিয়ার অহংকার প্রাকৃতিক সব হারবার নিয়ে। ‘পাম হাভেন’ নামে যে হোটেলে উঠেছি, সবচেয়ে বিখ্যাত হারবারটি সেটির সামনেই। নাম রডনি বে। ইয়ট আর বোটের ছড়াছড়ি। চারপাশে পর্যটক মনোরঞ্জক নানা আয়োজন।
সবচেয়ে বড় আয়োজনটা অবশ্য শুরু হচ্ছে শনিবার থেকে। সেন্ট লুসিয়ার জ্যাজ ফেস্টিভাল ক্যারিবিয়ানে সবচেয়ে বিখ্যাত। এয়ারপোর্টে নেমেই সেটির সাদর আমন্ত্রণ পেয়েছি। বিশ্বের কোন কোন বিখ্যাত জ্যাজশিল্পী আসছেন, সেটির তালিকাসংবলিত প্রচারপত্র। জ্যাজ-ফ্যাজ সেভাবে শুনিইনি, খোঁজখবরও রাখি না। জগদ্বিখ্যাত অমুক, বিশ্ব কাঁপানো তমুক—পড়তে পড়তে নিজেকে একটু গাধা-গাধাই মনে হলো। একটা নামের সঙ্গেও তো আমার পরিচয় নেই!
দেখি, সময়-সুযোগ পেলে একটা চক্কর দিয়ে আসব ওই জ্যাজ ফেস্টিভালে। জ্যাজও শোনা হবে, ওই বিখ্যাত সব শিল্পীর সঙ্গে পরিচয়ও হবে। কোনো ব্যাপারেই আকাট মূর্খ থাকা কোনো কাজের কথা নয়।
৩০ এপ্রিল, সেন্ট লুসিয়া
অসাধারণ এক সেঞ্চুরির পর ব্যাট তুলছেন হাবিবুল বাশার। সেঞ্চুরি করে নিজেই অবাক মোহাম্মদ রফিক বলছেন, ‘নয় নম্বরে নাইমা সেঞ্চুরি মাইরা দিছি! আমার নিজেরই তো বিশ্বাস হইতাছে না!’ প্রথম ইনিংসে এই দুজন। দ্বিতীয় ইনিংসে খালেদ মাসুদ। এক ম্যাচে তিন সেঞ্চুরিতে টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম বৃষ্টির দাক্ষিণ্যহীন নিজেদের কৃতিত্বে ড্র। খেলা শেষে মাঠে বাংলাদেশ দলের গ্রুপ ছবি।
ছয় বছর হয়ে গেছে! সময় যেন উড়ে উড়ে চলে যায়। মাঝখানে আরও দুবার ওয়েস্ট ইন্ডিজ ঘুরে গেছি। সেন্ট লুসিয়ায় আসা হয়নি। বোশেজো ক্রিকেট স্টেডিয়ামে গিয়ে মনে পড়ল, এখানে আসার আগে এই নামটার কত বিচিত্র উচ্চারণই না করেছি। ইংরেজি বানানটা লিখলে আপনিও তা-ই করবেন—‘ Beausejour’।
এবার আপনিই বলুন, এর উচ্চারণ বোশেজো কেন হবে? হয়েছে, কারণ শব্দটা ফরাসি। আর ফরাসি মানেই তো উচ্চারণের ফাঁদে ফেলার বন্দোবস্ত। ইংরেজিতে লেখা হবে ‘মিটেরান্ড’ পড়তে হবে মিতেরাঁ; লেখা হবে ‘কানেস’ পড়তে হবে কান...। মনে আছে, ২০০৪ সালের ওই টেস্টের আগে মাঠে বসেই স্থানীয় এক ভদ্রলোকের কাছে ওই বোশেজোর উচ্চারণ ও অর্থ জেনেছিলাম। বো মানে গুড, শেজো মানে ডে—দুটি মিলে গুড ডে।
শহর থেকে একটু দূরে ওই স্টেডিয়াম। চারপাশে টিলাকৃতির পাহাড়। ওখানে স্টেডিয়াম বানানোর কারণ, ওই জায়গাটাতেই নাকি সেন্ট লুসিয়ায় সবচেয়ে কম বৃষ্টি হয়। বৃষ্টি না হওয়া মানেই ‘গুড ডে’, এ কারণেই বোশেজো। স্কুলে থাকতে পরীক্ষায় গল্প-কবিতার নামকরণের সার্থকতা প্রমাণ করতে হতো। বোশেজো দেখি সেই স্মৃতি ফিরিয়ে আনল!
স্টেডিয়ামের ফরাসি নাম থেকেই সেন্ট লুসিয়ায় ফ্রেঞ্চ প্রভাব অনুমান করে ফেলার কথা। এখানে অনেক জায়গারই ফরাসি নাম। ক্যারিবিয়ানের প্রায় সব দ্বীপ নিয়েই ইংরেজ আর ফরাসিরা বিস্তর মারামারি করেছে। সেন্ট লুসিয়াকে পেতে বোধহয় সবচেয়ে বেশি। ১৪ বার হাতবদল হয়েছে এই দ্বীপের মালিকানা। হোটেল রুমে পাওয়া আইল্যান্ড গাইডে দেখলাম, কোন এক ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ সেন্ট লুসিয়ার নাম দিয়েছিলেন—‘হেলেন অব ওয়েস্ট ইন্ডিজ’। হেলেন অব ট্রয়ের অনুকরণে। অনিন্দ্যসুন্দর হেলেনের জন্য যেমন ট্রয়ের যুদ্ধ, সেন্ট লুসিয়াও অমন সুন্দর না হলে কি ইংরেজ আর ফরাসিরা বছরের পর বছর যুদ্ধ করে যায়! শেষ পর্যন্ত ফরাসিরাই বোধ হয় বেশি ছাপ রেখে গেছে এই দ্বীপে।
এক দিক থেকে ক্ষতিই হয়েছে তাতে। ইংরেজি-ভাষী হয়েও সেন্ট লুসিয়ার ক্রিকেট-ঐতিহ্য বলে কিছু নেই। এই তো মাত্র কয়েক বছর আগে সেন্ট লুসিয়া থেকে প্রথম কোনো ক্রিকেটার ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে সুযোগ পেয়েছেন। ড্যারেন স্যামিকে তাই রসিকতা করে অনেকে ‘ফাদার অব সেন্ট লুসিয়ান ক্রিকেট’ বলে ডাকে বলেও শুনেছি।
ক্ষতির কথাটা ব্যাখ্যা করি। ক্রিকেট ক্যারিবিয়ানে পর্যটনেরও বাহন। ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে এলে রথ দেখা ও কলা বেচা দুটিই একসঙ্গে সেরে নেয় ওই দুই দেশের হাজার হাজার পর্যটক। অনেক বছর সেটি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখার পর সেন্ট লুসিয়াও এর ভাগ নিতে এই বোশেজো স্টেডিয়ামটা বানায়। ২০০৭ বিশ্বকাপ অন্য অনেক দ্বীপকেই আধুনিক সব স্টেডিয়াম উপহার দিয়েছে। তবে এর আগ পর্যন্ত ওয়েস্ট ইন্ডিজের সবচেয়ে সুন্দর ও আধুনিক স্টেডিয়াম ছিল এই বোশেজোই। স্টেডিয়ামের গুণেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ পেতে শুরু করে সেন্ট লুসিয়া। ক্রিকেট-ঐতিহ্যে অন্য অনেক দ্বীপদেশ এগিয়ে থাকার পরও ২০০৭ বিশ্বকাপের একটা সেমিফাইনাল হয়েছে এখানে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দুটি সেমিফাইনালও হচ্ছে এখানেই।
সাগর-সৈকত এসব তো ক্যারিবিয়ানের সব দ্বীপেরই সম্পত্তি। সেন্ট লুসিয়ার অহংকার প্রাকৃতিক সব হারবার নিয়ে। ‘পাম হাভেন’ নামে যে হোটেলে উঠেছি, সবচেয়ে বিখ্যাত হারবারটি সেটির সামনেই। নাম রডনি বে। ইয়ট আর বোটের ছড়াছড়ি। চারপাশে পর্যটক মনোরঞ্জক নানা আয়োজন।
সবচেয়ে বড় আয়োজনটা অবশ্য শুরু হচ্ছে শনিবার থেকে। সেন্ট লুসিয়ার জ্যাজ ফেস্টিভাল ক্যারিবিয়ানে সবচেয়ে বিখ্যাত। এয়ারপোর্টে নেমেই সেটির সাদর আমন্ত্রণ পেয়েছি। বিশ্বের কোন কোন বিখ্যাত জ্যাজশিল্পী আসছেন, সেটির তালিকাসংবলিত প্রচারপত্র। জ্যাজ-ফ্যাজ সেভাবে শুনিইনি, খোঁজখবরও রাখি না। জগদ্বিখ্যাত অমুক, বিশ্ব কাঁপানো তমুক—পড়তে পড়তে নিজেকে একটু গাধা-গাধাই মনে হলো। একটা নামের সঙ্গেও তো আমার পরিচয় নেই!
দেখি, সময়-সুযোগ পেলে একটা চক্কর দিয়ে আসব ওই জ্যাজ ফেস্টিভালে। জ্যাজও শোনা হবে, ওই বিখ্যাত সব শিল্পীর সঙ্গে পরিচয়ও হবে। কোনো ব্যাপারেই আকাট মূর্খ থাকা কোনো কাজের কথা নয়।
৩০ এপ্রিল, সেন্ট লুসিয়া
No comments