চালের দাম ও খাদ্যসমস্যার ইতিবৃত্ত by এ এম এম শওকত আলী
খোলাবাজারে চালের মূল্য বৃদ্ধিতে সরকার বিচলিত। বিচলিত হওয়ারই কথা। পত্রিকান্তরে দেখা যায়, তিন দিনের ব্যবধানে চালের মূল্য কেজিতে দুই টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। চালের দাম বাড়লে সরকারের একমাত্র উপায় হচ্ছে, খোলাবাজারে চাল সহজলভ্য মূল্যে বিক্রির ব্যবস্থা নেওয়া। এখন অবশ্য আরেকটি উপায়ও রয়েছে; তা হলো, সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় যে খাদ্যশস্য বিতরণ করা হয়, তার মেয়াদ ও পরিমাণ বাড়ানো। অবশ্য এ উপায়টির সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। কারণ, এ ধরনের ব্যবস্থা সরকারের মজুদের পরিমাণের ওপর নির্ভরশীল। খোলাবাজারে চাল বিক্রির জন্যও একই যুক্তি প্রযোজ্য। অন্য একটি উপায় হচ্ছে, টেস্ট রিলিফ ও কাবিখার আওতায় কাজের গতি বাড়ানো। অবস্থাভেদে সরকার তিনটি উপায়ই যুগপত্ ব্যবহার করে থাকে। ২০০৮ সালে বিশ্বব্যাপী খাদ্যশস্যের প্রাপ্তি হ্রাস ও মূল্যবৃদ্ধির কারণে এর সঙ্গে যোগ করা হয়েছিল আরও একটি উপায় বা কৌশল; তা হলো, নগদ টাকার বিনিময়ে গ্রামীণ অবকাঠামোর সংস্কার, রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রয়োজনে নতুন অবকাঠামো নির্মাণ করা। এ ধরনের কৌশল খাদ্য মন্ত্রণালয় শুরু করে ২০০৮ সালের মে মাসে। তখন এর পরিমাণ ছিল ১০০ কোটি টাকা। কিছু সুফলও পাওয়া গিয়েছিল। সুফল পাওয়ার কারণে পরবর্তী পর্যায়ে সরকার খাদ্য ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে দুই হাজার ১০০ কোটি টাকার এক কর্মসূচি নেয়। প্রথম দফা বাস্তবায়িত হয় ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে। এরপর নির্বাচিত সরকার এ কর্মসূচিকে আরও নিখুঁত করার লক্ষ্যে দ্বিতীয় দফা বাস্তবায়ন করে স্থগিত করে দেয়। বিশ্বব্যাংক এ বিষয়ে সহায়তা দিতে আগ্রহী হয়। খাদ্য মন্ত্রণালয়ে কয়েক দফা বৈঠকের পর প্রায় এক বছর অতিক্রান্ত হলেও নিখুঁত ব্যবস্থার রূপরেখা আজও চূড়ান্ত করা সম্ভব হয়নি।
বিশ্বব্যাপী সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় নগদ অর্থের বিনিময়ে ছোট ছোট পূর্তকাজ করানোর ব্যবস্থা স্বীকৃত। এশিয়া ও আফ্রিকার বহু দেশেই এ প্রথা প্রচলিত। পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতও পাঁচ-ছয় বছর আগে একটি আইনের মাধ্যমে এ প্রথার প্রচলন করে। এ কর্মসূচির নামকরণ করা হয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চিতকরণ কর্মসূচি। ওই রাষ্ট্রের মহা হিসাব নিরীক্ষক সংসদে যে প্রতিবেদন প্রথমে দাখিল করেছিলেন, তাতে বহু অর্থ অপচয়ের অভিযোগ বা আপত্তি ছিল। কিন্তু সে কারণে এ প্রথা স্থগিত বা বাতিল করা হয়নি, যা বাংলাদেশে হয়েছে। বরং গবেষকদের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে ভারতের তুলনায় অপচয় হয়েছে অপেক্ষাকৃত কম।
চালের মূল্যবৃদ্ধি রোধের উপায় হিসেবে সরকার চাল আমদানি করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বর্তমানে একমাত্র উত্স মিয়ানমার। এ উত্স থেকে চাল আমদানির সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। ১. ভারতের তুলনায় আমদানির পরিমাণ কম। দুই. মূলত এ উত্স থেকে আতপ চাল আমদানি করা হয়ে থাকে, যা বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ গ্রহণে ইচ্ছুক নয়। এর সঙ্গে যোগ করা যায় সরকারি গুদামের খাদ্যশস্য ধারণক্ষমতা। বর্তমানে এ ক্ষমতা বাস্তবে ১৪ বা ১৫ লাখ টন। অথচ সরকারের উদ্যোগে খাদ্যশস্যজনিত সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৩২ লাখ টন। বাস্তব ধারণক্ষমতার সঙ্গে পরিকল্পনার এ বিরাট ব্যবধান বিগত বিভিন্ন সরকারের ক্রমপুঞ্জীভূত নিদারুণ অবহেলার ফল। উল্লেখ্য, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এ বিষয়টি উপলব্ধি করেই মোট চার লাখ টন ধারণক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছিল। প্রথম পর্যায়ে ২০০৯-১০ সালে এক লাখ টন খাদ্য ধারণক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে একটি পরিকল্পনাপত্র প্রণীত হয়। ওই সময় খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে খাদ্য বিভাগকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, ধারণক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ১ শতাংশ জমিও অধিগ্রহণ করা যাবে না। বিদ্যমান গুদামের এলাকায় পরিকল্পিত ধারণক্ষমতা বাড়াতে হবে। এ ধরনের নির্দেশের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল দীর্ঘসূত্রতা পরিহার করা। অধিগ্রহণ-প্রক্রিয়া একটি সময়সাপেক্ষ বিষয়।
কিন্তু পরবর্তীকালে জানা যায়, আজ পর্যন্ত ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। বাদ সাধল পরিকল্পনা কমিশন। একজন পৃথক প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ করতে হবে। পরিকল্পিত এক লাখ টন খাদ্যশস্য ধারণ করার ক্ষমতা প্রকল্প এখন ঝুলে আছে। সরকারের কোনো মাথাব্যথা নেই। অথচ সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য সরকারি খাদ্য ধারণক্ষমতা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। এর আগে খাদ্যশস্যের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিকারে মূলত যে কৌশলের কথা বলা হয়েছে, তার জন্য এ উপায় অপরিহার্য।
প্রকাশিত সংবাদে চালের মূল্য বৃদ্ধির জন্য দুটি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছিল। এক. আমনের ফলন কম হওয়া। দুই. সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দেশে চালসংকট প্রসঙ্গে নানা ধরনের বক্তব্য। এ দুটি কারণে কিছু অসম্পূর্ণতা রয়েছে। আমনের মোট উত্পাদন হয়েছে এক কোটি ৩১ লাখ টন। লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক কোটি ২৭ লাখ টন। এ হিসাব কৃষি মন্ত্রণালয়ের। জানা গেছে, এ হিসাব রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে করা হয়েছে। হেক্টরপ্রতি উত্পাদন নির্ণয় করা হয়েছে দুই থেকে চার টন। যে হিসাব ১০ বছর আগের। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের এক হিসাব অনুযায়ী, আমনের জমির পরিমাণ এ বছর মোট শতকরা ৬ ভাগ বেড়েছে। ইউএসএইডের তথ্যও ইতিবাচক বলে জানা গেছে। এডিবির হিসাব ভিন্নধর্মী। সামষ্টিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রক্ষেপণে তারা বলেছে, এ বছর প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাবে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ৬ শতাংশ অর্জন করা সম্ভব হবে না। কারণ হিসাবে তারা কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি হ্রাসের বিষয়টিও উল্লেখ করেছে।
তবে এ ধরনের হ্রাস শস্য খাতে না অন্যান্য খাতে, সে বিষয়ে কিছু অস্পষ্টতা রয়ছে। বিষয়টি স্পষ্টীকরণের দাবি রাখে। সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দেশের চাল উত্পাদনে সংকটের বিষয় অস্বীকার করার উপায় নেই। এর মূল কারণ, অন্য দেশের তুলনায় ভারতের বিদ্যমান সংকট, ভারতকেই চালের মূল্য বৃদ্ধির নিয়ন্ত্রক হিসেবে গণ্য করা হয়। কারণ, এ দেশ থেকেই সরকারি ও বেসরকারি খাতে সর্বাধিক চাল আমদানি করা হয়। সুতরাং ভারতের বিদ্যমান সংকটের সুযোগ ব্যবসায়ীরা কখনো উপেক্ষা করবেন না। এর সুযোগ তাঁরা গ্রহণ অবশ্যই করবেন। সরকার খাদ্যশস্য আমদানির জন্য যে বিশাল লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল, তা সময়মতো বাস্তবায়নের মূল প্রতিবন্ধকতা ছিল খাদ্যগুদামের ধারণক্ষমতার সীমাবদ্ধতা। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রাক্কালে মোট ১৪ লাখ টন খাদ্যশস্য মজুদ করেছিল ২০০৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। বর্তমান মজুদ ১০ লাখ টন। বর্তমান মৌসুমে আমন চাল সংগ্রহে মূল প্রতিবন্ধকতা হলো খোলাবাজারে চালের মূল্য বৃদ্ধি। সরকারি সংগ্রহমূল্য ছিল কেজিপ্রতি ২২ টাকা। বাজারে বর্তমান মূল্য মানভেদে ২৭-২৮ টাকা। অর্থাত্ ছয় টাকা বেশি। এ পরিস্থিতিতে আমন চাল সরকারের কাছে বিক্রি করতে চালকল-মালিকেরা আগ্রহী হবেন না। কারণ তাঁরা ব্যবসায়ী। মুনাফা বৃদ্ধিই তাঁদের লক্ষ্য। এ কারণে প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়, কিছু বিশেষজ্ঞ এ মুহূর্তে খোলাবাজারে চাল বিক্রি সমর্থন করছেন না। তাঁদের মতে, এতে মজুদ শেষ হবে। সরকারি মজুদ পর্যাপ্ত না হলে মূল্য নিয়ন্ত্রণ করবে ব্যবসায়ী মিল-মালিকেরা। এ যুক্তি একেবারে অগ্রাহ্য করা যায় না। অন্যদিকে কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ীদের মতে, খোলাবাজারে চাল বিক্রি শুরু হলে দাম কিছুটা কমবে। এর সঙ্গে যোগ করা যায় আরেকটি যুক্তি; তা হলো, এ কার্যক্রমের ফলে নিম্ন-আয়ের জনগোষ্ঠী স্বস্তি লাভ করবে।
তবে এ প্রসঙ্গে সঠিক পরিস্থিতি কিছুটা অস্পষ্ট। সঠিক পরিস্থিতিতে গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিষয়টিই মুখ্য। এ বছর কোনো মঙ্গা ছিল না। এ কথা সবাই স্বীকার করেন। এ ছাড়া পত্রিকান্তরে দেখা যায়, খোরাকি অর্থনীতি থেকে উত্তরণের পথে উত্তরবঙ্গ। এ শিরোনামের প্রতিবেদন উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলা ভ্রমণ করেই লিখেছেন প্রতিবেদক। প্রতিবেদনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়টিতে গুরুত্ব পেয়েছে শিল্প-উত্পাদনসহ কৃষিকর্মে এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর যথেষ্ট উদ্যোগী হওয়ার প্রবণতা। এর ফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। মঙ্গাপীড়িত অঞ্চলে এ ছাড়া খাদ্য আর কর্মসংস্থানের জন্য অবদান রেখেছে ওই অঞ্চলের উপযোগী একটি নবজাত ধানের বীজ। ফলে অপেক্ষাকৃত কম সময়ে ধান উত্পাদন করা সম্ভব হয়েছে। এতে মরা কার্তিকের কর্মহীনতার কোনো প্রভাব পরিলক্ষিত হয়নি বর্তমান বছরে।
চালের দাম হঠাত্ কেজিপ্রতি দুই-তিন টাকা বাড়ার কারণ হিসেবে সরকারের সংশ্লিষ্ট একজন নীতিনির্ধারক দায়ী করেছেন ব্যবসায়ীদের। এ ধরনের বক্তব্য সম্পূর্ণ সত্যি নয়। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ধানের দাম বাড়াসহ আন্তর্জাতিক উত্স থেকে চাল আমদানির সংকটের কথা। অন্যদিকে দেশের সব বাজারেই খুচরা হোক, পাইকারি হোক, চাল পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যাচ্ছে। এ যেন অনেকটা গোলকধাঁধার মতো। এ কথা সত্যি, ধানের দাম বাড়লে চালের দামও বাড়বে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক উত্স থেকে চাল আমদানির সংকট থাকলে এ দেশের বাজারেও এর প্রভাব অনুভূত হবে। এটাই মুক্তবাজারের প্রতিষ্ঠিত রীতি। সরকারের উচিত হবে, সব বিষয়ের নির্ভরযোগ্য তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ নেওয়া। একে অপরকে দোষারোপ করে কোনো সুফল পাওয়া যাবে না।
খোলাবাজারে যথেষ্ট পরিমাণ চাল মজুদ থাকলেই খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। খাদ্যনিরাপত্তার জন্য এ বিষয়টি প্রয়োজনীয় হলেও যথেষ্ট নয়। যথেষ্ট তখনই হবে, যখন কেজিপ্রতি চালের মূল্য জনপ্রতি আয়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হবে। খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া রয়েছে অন্য একটি প্রশ্ন; তা হলো, কৃষকের উত্পাদন-খরচের সঙ্গে যেকোনো কৃষিজাত পণ্যের একটি নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। খাদ্যনীতিতে দুটি কিছুটা পরস্পরবিরোধী উদ্দেশ্যের কথা বলা হয়ে থাকে—কৃষককে ন্যায্যমূল্য দেওয়া, একই সঙ্গে সাধারণ ভোক্তাদেরও ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার বিষয়টি। এ দুইয়ের সমতা বজায় রাখা সব সময় সম্ভব হয়ে ওঠে না। একই সঙ্গে জনপ্রতি খাদ্যশস্য নিশ্চিত করার হিসাবও যত দূর সম্ভব নির্ভুল হওয়া বাঞ্ছনীয়।
এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। ওই বিষয়টি পুনরায় পরীক্ষা করা প্রয়োজন। ওই সময় জনপ্রতি খাদ্যশস্য ৫৮৮ গ্রাম থেকে ৫৯৮ গ্রামে উন্নীত করা হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল, দেশের জনসংখ্যার অনুপাতে খাদ্যশস্যের জনপ্রতি পরিমাণ নির্ধারণ করা।
এ এম এম শওকত আলী: সাবেক সচিব। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা।
বিশ্বব্যাপী সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় নগদ অর্থের বিনিময়ে ছোট ছোট পূর্তকাজ করানোর ব্যবস্থা স্বীকৃত। এশিয়া ও আফ্রিকার বহু দেশেই এ প্রথা প্রচলিত। পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতও পাঁচ-ছয় বছর আগে একটি আইনের মাধ্যমে এ প্রথার প্রচলন করে। এ কর্মসূচির নামকরণ করা হয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চিতকরণ কর্মসূচি। ওই রাষ্ট্রের মহা হিসাব নিরীক্ষক সংসদে যে প্রতিবেদন প্রথমে দাখিল করেছিলেন, তাতে বহু অর্থ অপচয়ের অভিযোগ বা আপত্তি ছিল। কিন্তু সে কারণে এ প্রথা স্থগিত বা বাতিল করা হয়নি, যা বাংলাদেশে হয়েছে। বরং গবেষকদের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে ভারতের তুলনায় অপচয় হয়েছে অপেক্ষাকৃত কম।
চালের মূল্যবৃদ্ধি রোধের উপায় হিসেবে সরকার চাল আমদানি করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বর্তমানে একমাত্র উত্স মিয়ানমার। এ উত্স থেকে চাল আমদানির সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। ১. ভারতের তুলনায় আমদানির পরিমাণ কম। দুই. মূলত এ উত্স থেকে আতপ চাল আমদানি করা হয়ে থাকে, যা বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ গ্রহণে ইচ্ছুক নয়। এর সঙ্গে যোগ করা যায় সরকারি গুদামের খাদ্যশস্য ধারণক্ষমতা। বর্তমানে এ ক্ষমতা বাস্তবে ১৪ বা ১৫ লাখ টন। অথচ সরকারের উদ্যোগে খাদ্যশস্যজনিত সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৩২ লাখ টন। বাস্তব ধারণক্ষমতার সঙ্গে পরিকল্পনার এ বিরাট ব্যবধান বিগত বিভিন্ন সরকারের ক্রমপুঞ্জীভূত নিদারুণ অবহেলার ফল। উল্লেখ্য, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এ বিষয়টি উপলব্ধি করেই মোট চার লাখ টন ধারণক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছিল। প্রথম পর্যায়ে ২০০৯-১০ সালে এক লাখ টন খাদ্য ধারণক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে একটি পরিকল্পনাপত্র প্রণীত হয়। ওই সময় খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে খাদ্য বিভাগকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, ধারণক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ১ শতাংশ জমিও অধিগ্রহণ করা যাবে না। বিদ্যমান গুদামের এলাকায় পরিকল্পিত ধারণক্ষমতা বাড়াতে হবে। এ ধরনের নির্দেশের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল দীর্ঘসূত্রতা পরিহার করা। অধিগ্রহণ-প্রক্রিয়া একটি সময়সাপেক্ষ বিষয়।
কিন্তু পরবর্তীকালে জানা যায়, আজ পর্যন্ত ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। বাদ সাধল পরিকল্পনা কমিশন। একজন পৃথক প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ করতে হবে। পরিকল্পিত এক লাখ টন খাদ্যশস্য ধারণ করার ক্ষমতা প্রকল্প এখন ঝুলে আছে। সরকারের কোনো মাথাব্যথা নেই। অথচ সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য সরকারি খাদ্য ধারণক্ষমতা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। এর আগে খাদ্যশস্যের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিকারে মূলত যে কৌশলের কথা বলা হয়েছে, তার জন্য এ উপায় অপরিহার্য।
প্রকাশিত সংবাদে চালের মূল্য বৃদ্ধির জন্য দুটি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছিল। এক. আমনের ফলন কম হওয়া। দুই. সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দেশে চালসংকট প্রসঙ্গে নানা ধরনের বক্তব্য। এ দুটি কারণে কিছু অসম্পূর্ণতা রয়েছে। আমনের মোট উত্পাদন হয়েছে এক কোটি ৩১ লাখ টন। লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক কোটি ২৭ লাখ টন। এ হিসাব কৃষি মন্ত্রণালয়ের। জানা গেছে, এ হিসাব রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে করা হয়েছে। হেক্টরপ্রতি উত্পাদন নির্ণয় করা হয়েছে দুই থেকে চার টন। যে হিসাব ১০ বছর আগের। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের এক হিসাব অনুযায়ী, আমনের জমির পরিমাণ এ বছর মোট শতকরা ৬ ভাগ বেড়েছে। ইউএসএইডের তথ্যও ইতিবাচক বলে জানা গেছে। এডিবির হিসাব ভিন্নধর্মী। সামষ্টিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রক্ষেপণে তারা বলেছে, এ বছর প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাবে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ৬ শতাংশ অর্জন করা সম্ভব হবে না। কারণ হিসাবে তারা কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি হ্রাসের বিষয়টিও উল্লেখ করেছে।
তবে এ ধরনের হ্রাস শস্য খাতে না অন্যান্য খাতে, সে বিষয়ে কিছু অস্পষ্টতা রয়ছে। বিষয়টি স্পষ্টীকরণের দাবি রাখে। সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দেশের চাল উত্পাদনে সংকটের বিষয় অস্বীকার করার উপায় নেই। এর মূল কারণ, অন্য দেশের তুলনায় ভারতের বিদ্যমান সংকট, ভারতকেই চালের মূল্য বৃদ্ধির নিয়ন্ত্রক হিসেবে গণ্য করা হয়। কারণ, এ দেশ থেকেই সরকারি ও বেসরকারি খাতে সর্বাধিক চাল আমদানি করা হয়। সুতরাং ভারতের বিদ্যমান সংকটের সুযোগ ব্যবসায়ীরা কখনো উপেক্ষা করবেন না। এর সুযোগ তাঁরা গ্রহণ অবশ্যই করবেন। সরকার খাদ্যশস্য আমদানির জন্য যে বিশাল লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল, তা সময়মতো বাস্তবায়নের মূল প্রতিবন্ধকতা ছিল খাদ্যগুদামের ধারণক্ষমতার সীমাবদ্ধতা। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রাক্কালে মোট ১৪ লাখ টন খাদ্যশস্য মজুদ করেছিল ২০০৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। বর্তমান মজুদ ১০ লাখ টন। বর্তমান মৌসুমে আমন চাল সংগ্রহে মূল প্রতিবন্ধকতা হলো খোলাবাজারে চালের মূল্য বৃদ্ধি। সরকারি সংগ্রহমূল্য ছিল কেজিপ্রতি ২২ টাকা। বাজারে বর্তমান মূল্য মানভেদে ২৭-২৮ টাকা। অর্থাত্ ছয় টাকা বেশি। এ পরিস্থিতিতে আমন চাল সরকারের কাছে বিক্রি করতে চালকল-মালিকেরা আগ্রহী হবেন না। কারণ তাঁরা ব্যবসায়ী। মুনাফা বৃদ্ধিই তাঁদের লক্ষ্য। এ কারণে প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়, কিছু বিশেষজ্ঞ এ মুহূর্তে খোলাবাজারে চাল বিক্রি সমর্থন করছেন না। তাঁদের মতে, এতে মজুদ শেষ হবে। সরকারি মজুদ পর্যাপ্ত না হলে মূল্য নিয়ন্ত্রণ করবে ব্যবসায়ী মিল-মালিকেরা। এ যুক্তি একেবারে অগ্রাহ্য করা যায় না। অন্যদিকে কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ীদের মতে, খোলাবাজারে চাল বিক্রি শুরু হলে দাম কিছুটা কমবে। এর সঙ্গে যোগ করা যায় আরেকটি যুক্তি; তা হলো, এ কার্যক্রমের ফলে নিম্ন-আয়ের জনগোষ্ঠী স্বস্তি লাভ করবে।
তবে এ প্রসঙ্গে সঠিক পরিস্থিতি কিছুটা অস্পষ্ট। সঠিক পরিস্থিতিতে গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিষয়টিই মুখ্য। এ বছর কোনো মঙ্গা ছিল না। এ কথা সবাই স্বীকার করেন। এ ছাড়া পত্রিকান্তরে দেখা যায়, খোরাকি অর্থনীতি থেকে উত্তরণের পথে উত্তরবঙ্গ। এ শিরোনামের প্রতিবেদন উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলা ভ্রমণ করেই লিখেছেন প্রতিবেদক। প্রতিবেদনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়টিতে গুরুত্ব পেয়েছে শিল্প-উত্পাদনসহ কৃষিকর্মে এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর যথেষ্ট উদ্যোগী হওয়ার প্রবণতা। এর ফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। মঙ্গাপীড়িত অঞ্চলে এ ছাড়া খাদ্য আর কর্মসংস্থানের জন্য অবদান রেখেছে ওই অঞ্চলের উপযোগী একটি নবজাত ধানের বীজ। ফলে অপেক্ষাকৃত কম সময়ে ধান উত্পাদন করা সম্ভব হয়েছে। এতে মরা কার্তিকের কর্মহীনতার কোনো প্রভাব পরিলক্ষিত হয়নি বর্তমান বছরে।
চালের দাম হঠাত্ কেজিপ্রতি দুই-তিন টাকা বাড়ার কারণ হিসেবে সরকারের সংশ্লিষ্ট একজন নীতিনির্ধারক দায়ী করেছেন ব্যবসায়ীদের। এ ধরনের বক্তব্য সম্পূর্ণ সত্যি নয়। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ধানের দাম বাড়াসহ আন্তর্জাতিক উত্স থেকে চাল আমদানির সংকটের কথা। অন্যদিকে দেশের সব বাজারেই খুচরা হোক, পাইকারি হোক, চাল পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যাচ্ছে। এ যেন অনেকটা গোলকধাঁধার মতো। এ কথা সত্যি, ধানের দাম বাড়লে চালের দামও বাড়বে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক উত্স থেকে চাল আমদানির সংকট থাকলে এ দেশের বাজারেও এর প্রভাব অনুভূত হবে। এটাই মুক্তবাজারের প্রতিষ্ঠিত রীতি। সরকারের উচিত হবে, সব বিষয়ের নির্ভরযোগ্য তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ নেওয়া। একে অপরকে দোষারোপ করে কোনো সুফল পাওয়া যাবে না।
খোলাবাজারে যথেষ্ট পরিমাণ চাল মজুদ থাকলেই খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। খাদ্যনিরাপত্তার জন্য এ বিষয়টি প্রয়োজনীয় হলেও যথেষ্ট নয়। যথেষ্ট তখনই হবে, যখন কেজিপ্রতি চালের মূল্য জনপ্রতি আয়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হবে। খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া রয়েছে অন্য একটি প্রশ্ন; তা হলো, কৃষকের উত্পাদন-খরচের সঙ্গে যেকোনো কৃষিজাত পণ্যের একটি নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। খাদ্যনীতিতে দুটি কিছুটা পরস্পরবিরোধী উদ্দেশ্যের কথা বলা হয়ে থাকে—কৃষককে ন্যায্যমূল্য দেওয়া, একই সঙ্গে সাধারণ ভোক্তাদেরও ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার বিষয়টি। এ দুইয়ের সমতা বজায় রাখা সব সময় সম্ভব হয়ে ওঠে না। একই সঙ্গে জনপ্রতি খাদ্যশস্য নিশ্চিত করার হিসাবও যত দূর সম্ভব নির্ভুল হওয়া বাঞ্ছনীয়।
এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। ওই বিষয়টি পুনরায় পরীক্ষা করা প্রয়োজন। ওই সময় জনপ্রতি খাদ্যশস্য ৫৮৮ গ্রাম থেকে ৫৯৮ গ্রামে উন্নীত করা হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল, দেশের জনসংখ্যার অনুপাতে খাদ্যশস্যের জনপ্রতি পরিমাণ নির্ধারণ করা।
এ এম এম শওকত আলী: সাবেক সচিব। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা।
No comments