বাজারসুবিধা ও আমেরিকার দ্বৈতনীতি by আসজাদুল কিবরিয়া
কোনো তথ্য এড়িয়ে যাওয়ার বা অস্বীকার করার একটি ভালো উপায় হলো সেই তথ্য সম্পর্কে অজ্ঞতা প্রকাশ করা। গত বছরের শেষ ভাগে (৩০ নভেম্বর থেকে ২ ডিসেম্বর) জেনেভায় বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সপ্তম মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে এ রকম একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি (ইউএসটিআর) রন কার্ক। সম্মেলনের শেষ দিন সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে অবাধ বাজারসুবিধা দেওয়ার বিষয়ে যখন বিভিন্ন প্রশ্ন করা হচ্ছিল, তখন একপর্যায়ে তিনি এ রকম অজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
গরিব দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশি পণ্য আমেরিকার বাজারে প্রবেশ করতে গড়ে ১৫ শতাংশ হারে শুল্ক দিতে হয় আর কম্বোডিয়ার পণ্যের ক্ষেত্রে দিতে হয় ১৭ শতাংশ। অথচ একই সময়ে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য ১ শতাংশের কম হারে শুল্ক প্রদান করে। রন কার্ককে প্রশ্ন করা হয়েছিল, কেন এ ধরনের শুল্কবৈষম্য। তাকে এও বলা হয়েছিল, আমেরিকা ২০০৮ সালে বাংলাদেশ থেকে ২৫৬ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করে। এ জন্য অবশ্য আমদানি শুল্ক বাবদ আমেরিকার আয় হয়েছে ৩৯ কোটি ২০ লাখ ডলার। একইভাবে কম্বোডিয়া ১২৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করলেও মার্কিন কোষাগারে এর বিপরীতে আদায় করা হয়েছে ২১ কোটি ডলার। অথচ একই সময়ে ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্র যথাক্রমে দুই হাজার ২৩০ কোটি ডলার ও তিন হাজার কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানির বিপরীতে মাত্র ১৮ কোটি ডলার করে শুল্ক প্রদান করেছে। এ ধরনের শুল্কবৈষম্যের পেছনে যুক্তি কী?
জবাবে রন কার্ক এসব তথ্য-পরিসংখ্যানে সত্য-মিথ্যা নিয়ে কিছুই বলেননি। তিনি বেশ সাবলীলভাবে শুধু এটাই বলেছেন, এই প্রথমবার এ ধরনের কোনো তথ্য-পরিসংখ্যান শুনতে পেলেন তিনি। এ কথার পর আর কিছু বলার থাকে না। মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি এভাবেই গরিব দেশের বাজারসুবিধা ও শুল্কবৈষম্যের বিষয়টি এড়িয়ে যান। এর ফলে আরেকবার প্রমাণ হয়ে গেল যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত বাজারসুবিধা পাওয়া বাংলাদেশের জন্য সুদূরপরাহত বিষয়। যুক্তরাষ্ট্র তো স্বীকারই করতে চাইছে না, এ ধরনের কোনো শুল্কবৈষম্য আছে। আর তাই বৈষম্য দূর করার বিষয়টিও আসতে পারছে না।
রন ক্লার্ক বা যুক্তরাষ্ট্র সরকার সচেতনভাবে শুল্কবৈষম্যের বিষয়টি নাও জানতে পারে। না জানাটাই তাদের জন্য ভালো কৌশল। তবে আমেরিকার ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ডেমোক্রেটিক লিডারশিপ কাউন্সিল (ডিএলসি) প্রতি সপ্তাহে ওয়েবসাইটে (www.dlc.org) যে ‘ট্রেড ফ্যাক্ট অব দ্য উইক’ প্রকাশ করে থাকে, তাতে গরিব দেশগুলোর শুল্কবৈষম্যের এ বিষয়টি বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে গত ১৪ অক্টোবর, ২০০৯-এ। এতে বলা হয়েছে, ‘যুক্তরাষ্ট্র মোটরগাড়ির ওপর শুল্কের তুলনায় জুতার ওপর শুল্ক থেকে বেশি আয় করে।’ প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়েছে, ধনী দেশগুলো যারা উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন, ভারী শিল্পপণ্য ও তেল রপ্তানি করে এবং গরিব দেশ যারা প্রাকৃতিক সম্পদ রপ্তানি করে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারকে ব্যাপকভাবে উন্মুক্ত পায়। কিন্তু এশিয়া ও মুসলিম বিশ্বের নিম্নআয়ের এবং মুক্তবাণিজ্য চুক্তি ও অগ্রাধিকার কর্মসূচিবহির্ভূত দেশগুলো পায় নির্দয় আচরণ। বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া ও পাকিস্তান বছরে সামান্য পরিমাণ তৈরি পোশাক ও তোয়ালে রপ্তানি করে, যার মূল্য মাত্র ৯০০ কোটি ডলার। এ জন্য দেশগুলোকে জরিমানা হিসাবে শুল্ক গুনতে হয় ১৩০ কোটি ডলার। অথচ পরিমাণগতভাবে অনেক বেশি উড়োজাহাজ, মদ, ওষুধ ও তথ্যপ্রযুক্তিপণ্য আসে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য থেকে, যার মূল্য ১০ হাজার কোটি ডলার। এ জন্য শুল্ক গুনতে হয় মাত্র ৭৫ কোটি ডলারের মতো।
প্রতিবেদনে আমদানিমূল্য ও আরোপিত শুল্কের বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। আরও বলা হয়েছে, গরিব দেশগুলোর প্রতি বিরূপ আচরণ আসলে নিজ দেশে গরিব মানুষের প্রতি বিরূপ আচরণেরই শামিল। কারণ, এসব দেশ থেকে পোশাকসহ যেসব পণ্য আমদানি করা হয়, তার বেশির ভাগই আমেরিকার নিম্নআয়ের মানুষের প্রয়োজনে।
মজার বিষয় হলো, আমদানি শুল্ক আমেরিকার রাজস্ব-আয়ের সবচেয়ে ছোট উত্স। ২০০৮ সালে আমেরিকার মোট কর রাজস্বের মধ্যে শীর্ষে ছিল আয়কর, যার পরিমাণ এক লাখ ১৫ হাজার কোটি ডলার। এরপর যথাক্রমে বেতন কর ৯০ হাজার কোটি ডলার; প্রাতিষ্ঠানিক আয়কর ৩০ হাজার ৪০০ কোটি ডলার; মদ, সিগারেট ও গ্যাসোলিনের ওপর আবগারি কর ছয় হাজার ৭০০ কোটি ডলার; উপহার কর দুই হাজার ৯০০ কোটি ডলার এবং আমদানি শুল্ক দুই হাজার ৬০০ কোটি ডলার। আমদানি শুল্ক আমেরিকার সবচেয়ে পুরোনো রাজস্ব উত্স, যা একসময়ে দেশটির মোট রাজস্বের প্রায় অর্ধেক জোগান দিত। এখন তা মোট রাজস্বের ১ শতাংশও নয়। তার পরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমদানি শুল্কনীতি বৈষম্যমূলকভাবে প্রয়োগ করে চলেছে, যা নিয়ে সে দেশের ভেতরেই সমালোচনা ও আপত্তি রয়েছে।
আমেরিকার এই বৈষম্যমূলক শুল্কারোপের নীতিটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতির কারণ হচ্ছে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) কর্মকাঠামোর আওতায় স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে উন্নত বিশ্বে বাজারসুবিধা দেওয়ার যে কথা রয়েছে, তা বাস্তবায়নে প্রধান বাধাও এখন কার্যত আমেরিকা। কারণ, আমেরিকা বাদে প্রায় সব উন্নত দেশই গরিব দেশগুলোকে শুল্কমুক্ত বাজারসুবিধা দিয়ে ফেলেছে। হংকং ঘোষণা অনুযায়ী, স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে ৯৭ শতাংশ পণ্যে বাজারসুবিধা প্রদানের সিদ্ধান্তটিও বাস্তবায়িত হচ্ছে না মূলত আমেরিকার অনাগ্রহে। অবশ্য এটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি আছে। কারণ, যে ৩ শতাংশ পণ্য এই সুবিধার বাইরে থাকবে, তার মধ্যে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানিপণ্যসহ রপ্তানিযোগ্য প্রায় সব পণ্যই অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতে পারে।
তার চেয়েও বড় কথা, আমেরিকার বাজারে আফ্রিকার দেশগুলো প্রবেশাধিকার পেয়ে গেছে অনেক আগেই। একই রকম সুবিধা পেয়ে আসছে ক্যারিবীয় দেশগুলো। ফলে বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া, নেপালসহ এশিয়ার কয়েকটি স্বল্পোন্নত দেশ এখন এই সুবিধা পেতে বাকি রয়েছে। আর এটা দিতে যত আপত্তি।
এদিকে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা অক্সফাম গত বছরের নভেম্বর মাসেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কমিটি অন ওয়েজ অ্যান্ড মিনসের এক শুনানিতে বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে শুল্কমুক্ত বাজারসুবিধা দেওয়ার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে। সংস্থাটির ভাইস প্রেসিডেন্ট পল ও ব্রায়ান এই শুনানিতে বলেন, ‘এটার কোনো মানেই হয় না যে আমরা কম্বোডিয়াকে যে সহায়তা প্রদান করি, তার সাত গুণ বেশি শুল্ক হিসেবে আদায় করি। অথবা গত বছর আমেরিকা থেকে পাওয়া প্রতি এক ডলার সহায়তা দেওয়ার বিপরীতে আমেরিকায় পণ্য রপ্তানির জন্য চার ডলার করে শুল্ক দিতে হয়েছে বাংলাদেশকে।’
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে জিম ম্যাকডরমুটের ‘নিউ পার্টনারশিপ ফর ট্রেড ডেভেলপমেন্ট অ্যাক্ট’ নামে যে বিল উপস্থাপন করেছেন, তার প্রতি সমর্থন জানিয়েছে অক্সফাম আমেরিকা। বলেছে যে এই বিল অনুমোদন করার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য ও বাণিজ্যনীতির বৈপরীত্যগুলো দূর করা সম্ভব হবে। সব স্বল্পোন্নত দেশকে কোটামুক্ত ও শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়ে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহ বাস্তবায়ন ও ডব্লিউটিরও আওতায় আমেরিকার প্রতিশ্রুতি পূরণ করা হবে।
সমস্যা হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকেরা এত সহজে এসব যুক্তি মানতে রাজি নন। তা ছাড়া বাংলাদেশকে বাণিজ্যিকভাবে সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে দেশটির বিভিন্ন ধরনের স্বার্থ আদায় নিশ্চিত করার বিষয় রয়েছে। সাম্প্রতিক কালে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ রূপরেখা চুক্তি (টিফা) স্বাক্ষর করার জন্য আমেরিকার পক্ষ থেকে বাংলাদেশের ওপর যে চাপ তৈরি করা হয়েছে, তাতে এই স্বার্থের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেছে। সর্বোপরি বাজারসুবিধা না দেওয়ার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষ থেকে অনেকটা খোলামেলা বক্তব্যও দেওয়া হয়েছে।
গত বছরের অক্টোবর মাসে ঢাকা সফরে এসে যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী বাণিজ্য প্রতিনিধি মাইকেল জে ডিলেনি স্পষ্ট করেই বলেছেন যে, শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার চেষ্টা বাদ দিয়ে বাংলাদেশের বরং শুল্কহ্রাস ও অগ্রাধিকার কর্মসূচির দিকে মনোযোগী হওয়া উচিত। এর কয়েক দিন পর ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি মেট্রো চেম্বারের এক আলোচনা সভায় বলেছেন, বাজারসুবিধা পেতে হলে টিফা সম্পাদন করা জরুরি।
বস্তুত, জেনেভায় ডব্লিউটিওর মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনের অল্প কিছুদিন আগে মার্কিন সরকারের এসব বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়ে যায়, জেনেভায় আমেরিকার কাছ থেকে কোনো ইতিবাচক কিছু পাওয়া যাবে না। বাস্তবেও হয়েছে তাই। জেনেভায় রন কার্ক আমেরিকার বাণিজ্যের দ্বিমুখী নীতিকেই আরেকবার স্পষ্ট করেছেন। বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর হতাশাও দীর্ঘায়িত হয়েছে।
আসজাদুল কিবরিয়া: সাংবাদিক।
asjadullk@gmail.com
গরিব দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশি পণ্য আমেরিকার বাজারে প্রবেশ করতে গড়ে ১৫ শতাংশ হারে শুল্ক দিতে হয় আর কম্বোডিয়ার পণ্যের ক্ষেত্রে দিতে হয় ১৭ শতাংশ। অথচ একই সময়ে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য ১ শতাংশের কম হারে শুল্ক প্রদান করে। রন কার্ককে প্রশ্ন করা হয়েছিল, কেন এ ধরনের শুল্কবৈষম্য। তাকে এও বলা হয়েছিল, আমেরিকা ২০০৮ সালে বাংলাদেশ থেকে ২৫৬ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করে। এ জন্য অবশ্য আমদানি শুল্ক বাবদ আমেরিকার আয় হয়েছে ৩৯ কোটি ২০ লাখ ডলার। একইভাবে কম্বোডিয়া ১২৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করলেও মার্কিন কোষাগারে এর বিপরীতে আদায় করা হয়েছে ২১ কোটি ডলার। অথচ একই সময়ে ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্র যথাক্রমে দুই হাজার ২৩০ কোটি ডলার ও তিন হাজার কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানির বিপরীতে মাত্র ১৮ কোটি ডলার করে শুল্ক প্রদান করেছে। এ ধরনের শুল্কবৈষম্যের পেছনে যুক্তি কী?
জবাবে রন কার্ক এসব তথ্য-পরিসংখ্যানে সত্য-মিথ্যা নিয়ে কিছুই বলেননি। তিনি বেশ সাবলীলভাবে শুধু এটাই বলেছেন, এই প্রথমবার এ ধরনের কোনো তথ্য-পরিসংখ্যান শুনতে পেলেন তিনি। এ কথার পর আর কিছু বলার থাকে না। মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি এভাবেই গরিব দেশের বাজারসুবিধা ও শুল্কবৈষম্যের বিষয়টি এড়িয়ে যান। এর ফলে আরেকবার প্রমাণ হয়ে গেল যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত বাজারসুবিধা পাওয়া বাংলাদেশের জন্য সুদূরপরাহত বিষয়। যুক্তরাষ্ট্র তো স্বীকারই করতে চাইছে না, এ ধরনের কোনো শুল্কবৈষম্য আছে। আর তাই বৈষম্য দূর করার বিষয়টিও আসতে পারছে না।
রন ক্লার্ক বা যুক্তরাষ্ট্র সরকার সচেতনভাবে শুল্কবৈষম্যের বিষয়টি নাও জানতে পারে। না জানাটাই তাদের জন্য ভালো কৌশল। তবে আমেরিকার ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ডেমোক্রেটিক লিডারশিপ কাউন্সিল (ডিএলসি) প্রতি সপ্তাহে ওয়েবসাইটে (www.dlc.org) যে ‘ট্রেড ফ্যাক্ট অব দ্য উইক’ প্রকাশ করে থাকে, তাতে গরিব দেশগুলোর শুল্কবৈষম্যের এ বিষয়টি বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে গত ১৪ অক্টোবর, ২০০৯-এ। এতে বলা হয়েছে, ‘যুক্তরাষ্ট্র মোটরগাড়ির ওপর শুল্কের তুলনায় জুতার ওপর শুল্ক থেকে বেশি আয় করে।’ প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়েছে, ধনী দেশগুলো যারা উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন, ভারী শিল্পপণ্য ও তেল রপ্তানি করে এবং গরিব দেশ যারা প্রাকৃতিক সম্পদ রপ্তানি করে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারকে ব্যাপকভাবে উন্মুক্ত পায়। কিন্তু এশিয়া ও মুসলিম বিশ্বের নিম্নআয়ের এবং মুক্তবাণিজ্য চুক্তি ও অগ্রাধিকার কর্মসূচিবহির্ভূত দেশগুলো পায় নির্দয় আচরণ। বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া ও পাকিস্তান বছরে সামান্য পরিমাণ তৈরি পোশাক ও তোয়ালে রপ্তানি করে, যার মূল্য মাত্র ৯০০ কোটি ডলার। এ জন্য দেশগুলোকে জরিমানা হিসাবে শুল্ক গুনতে হয় ১৩০ কোটি ডলার। অথচ পরিমাণগতভাবে অনেক বেশি উড়োজাহাজ, মদ, ওষুধ ও তথ্যপ্রযুক্তিপণ্য আসে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য থেকে, যার মূল্য ১০ হাজার কোটি ডলার। এ জন্য শুল্ক গুনতে হয় মাত্র ৭৫ কোটি ডলারের মতো।
প্রতিবেদনে আমদানিমূল্য ও আরোপিত শুল্কের বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। আরও বলা হয়েছে, গরিব দেশগুলোর প্রতি বিরূপ আচরণ আসলে নিজ দেশে গরিব মানুষের প্রতি বিরূপ আচরণেরই শামিল। কারণ, এসব দেশ থেকে পোশাকসহ যেসব পণ্য আমদানি করা হয়, তার বেশির ভাগই আমেরিকার নিম্নআয়ের মানুষের প্রয়োজনে।
মজার বিষয় হলো, আমদানি শুল্ক আমেরিকার রাজস্ব-আয়ের সবচেয়ে ছোট উত্স। ২০০৮ সালে আমেরিকার মোট কর রাজস্বের মধ্যে শীর্ষে ছিল আয়কর, যার পরিমাণ এক লাখ ১৫ হাজার কোটি ডলার। এরপর যথাক্রমে বেতন কর ৯০ হাজার কোটি ডলার; প্রাতিষ্ঠানিক আয়কর ৩০ হাজার ৪০০ কোটি ডলার; মদ, সিগারেট ও গ্যাসোলিনের ওপর আবগারি কর ছয় হাজার ৭০০ কোটি ডলার; উপহার কর দুই হাজার ৯০০ কোটি ডলার এবং আমদানি শুল্ক দুই হাজার ৬০০ কোটি ডলার। আমদানি শুল্ক আমেরিকার সবচেয়ে পুরোনো রাজস্ব উত্স, যা একসময়ে দেশটির মোট রাজস্বের প্রায় অর্ধেক জোগান দিত। এখন তা মোট রাজস্বের ১ শতাংশও নয়। তার পরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমদানি শুল্কনীতি বৈষম্যমূলকভাবে প্রয়োগ করে চলেছে, যা নিয়ে সে দেশের ভেতরেই সমালোচনা ও আপত্তি রয়েছে।
আমেরিকার এই বৈষম্যমূলক শুল্কারোপের নীতিটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতির কারণ হচ্ছে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) কর্মকাঠামোর আওতায় স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে উন্নত বিশ্বে বাজারসুবিধা দেওয়ার যে কথা রয়েছে, তা বাস্তবায়নে প্রধান বাধাও এখন কার্যত আমেরিকা। কারণ, আমেরিকা বাদে প্রায় সব উন্নত দেশই গরিব দেশগুলোকে শুল্কমুক্ত বাজারসুবিধা দিয়ে ফেলেছে। হংকং ঘোষণা অনুযায়ী, স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে ৯৭ শতাংশ পণ্যে বাজারসুবিধা প্রদানের সিদ্ধান্তটিও বাস্তবায়িত হচ্ছে না মূলত আমেরিকার অনাগ্রহে। অবশ্য এটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি আছে। কারণ, যে ৩ শতাংশ পণ্য এই সুবিধার বাইরে থাকবে, তার মধ্যে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানিপণ্যসহ রপ্তানিযোগ্য প্রায় সব পণ্যই অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতে পারে।
তার চেয়েও বড় কথা, আমেরিকার বাজারে আফ্রিকার দেশগুলো প্রবেশাধিকার পেয়ে গেছে অনেক আগেই। একই রকম সুবিধা পেয়ে আসছে ক্যারিবীয় দেশগুলো। ফলে বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া, নেপালসহ এশিয়ার কয়েকটি স্বল্পোন্নত দেশ এখন এই সুবিধা পেতে বাকি রয়েছে। আর এটা দিতে যত আপত্তি।
এদিকে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা অক্সফাম গত বছরের নভেম্বর মাসেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কমিটি অন ওয়েজ অ্যান্ড মিনসের এক শুনানিতে বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে শুল্কমুক্ত বাজারসুবিধা দেওয়ার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে। সংস্থাটির ভাইস প্রেসিডেন্ট পল ও ব্রায়ান এই শুনানিতে বলেন, ‘এটার কোনো মানেই হয় না যে আমরা কম্বোডিয়াকে যে সহায়তা প্রদান করি, তার সাত গুণ বেশি শুল্ক হিসেবে আদায় করি। অথবা গত বছর আমেরিকা থেকে পাওয়া প্রতি এক ডলার সহায়তা দেওয়ার বিপরীতে আমেরিকায় পণ্য রপ্তানির জন্য চার ডলার করে শুল্ক দিতে হয়েছে বাংলাদেশকে।’
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে জিম ম্যাকডরমুটের ‘নিউ পার্টনারশিপ ফর ট্রেড ডেভেলপমেন্ট অ্যাক্ট’ নামে যে বিল উপস্থাপন করেছেন, তার প্রতি সমর্থন জানিয়েছে অক্সফাম আমেরিকা। বলেছে যে এই বিল অনুমোদন করার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য ও বাণিজ্যনীতির বৈপরীত্যগুলো দূর করা সম্ভব হবে। সব স্বল্পোন্নত দেশকে কোটামুক্ত ও শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়ে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহ বাস্তবায়ন ও ডব্লিউটিরও আওতায় আমেরিকার প্রতিশ্রুতি পূরণ করা হবে।
সমস্যা হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকেরা এত সহজে এসব যুক্তি মানতে রাজি নন। তা ছাড়া বাংলাদেশকে বাণিজ্যিকভাবে সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে দেশটির বিভিন্ন ধরনের স্বার্থ আদায় নিশ্চিত করার বিষয় রয়েছে। সাম্প্রতিক কালে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ রূপরেখা চুক্তি (টিফা) স্বাক্ষর করার জন্য আমেরিকার পক্ষ থেকে বাংলাদেশের ওপর যে চাপ তৈরি করা হয়েছে, তাতে এই স্বার্থের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেছে। সর্বোপরি বাজারসুবিধা না দেওয়ার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষ থেকে অনেকটা খোলামেলা বক্তব্যও দেওয়া হয়েছে।
গত বছরের অক্টোবর মাসে ঢাকা সফরে এসে যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী বাণিজ্য প্রতিনিধি মাইকেল জে ডিলেনি স্পষ্ট করেই বলেছেন যে, শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার চেষ্টা বাদ দিয়ে বাংলাদেশের বরং শুল্কহ্রাস ও অগ্রাধিকার কর্মসূচির দিকে মনোযোগী হওয়া উচিত। এর কয়েক দিন পর ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি মেট্রো চেম্বারের এক আলোচনা সভায় বলেছেন, বাজারসুবিধা পেতে হলে টিফা সম্পাদন করা জরুরি।
বস্তুত, জেনেভায় ডব্লিউটিওর মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনের অল্প কিছুদিন আগে মার্কিন সরকারের এসব বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়ে যায়, জেনেভায় আমেরিকার কাছ থেকে কোনো ইতিবাচক কিছু পাওয়া যাবে না। বাস্তবেও হয়েছে তাই। জেনেভায় রন কার্ক আমেরিকার বাণিজ্যের দ্বিমুখী নীতিকেই আরেকবার স্পষ্ট করেছেন। বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর হতাশাও দীর্ঘায়িত হয়েছে।
আসজাদুল কিবরিয়া: সাংবাদিক।
asjadullk@gmail.com
No comments