সফলতার দাবি গতানুগতিক by মওদুদ আহমদ
একটা অস্বাভাবিক ও চরম প্রতিকূল অবস্থান থেকে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয় এই বিশ্বাসে যে একটি অনির্বাচিত, অসাংবিধানিক, বেআইনি ও স্বৈরাচারী সরকারের চেয়ে নির্বাচিত একটি সরকার দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে। যদিও বিএনপি আশা করেছিল নির্বাচনে জয়লাভ করবে, কিন্তু সেই নির্বাচনের ফলাফল বিএনপির জন্য একটি বিপর্যয় নিয়ে আসে। এর ফলে সারা দেশে বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে হতাশা নেমে আসাটা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেশের ও জনগণের স্বার্থের কথা চিন্তা করে এবং গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার জন্য সংসদে একটি ক্ষুদ্র দল হলেও বিএনপি একটি ইতিবাচক ও সহযোগিতামূলক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে যায়। গত তিনটি সংসদের অতীত চর্চা থেকে বেরিয়ে এসে বিএনপি সংসদের প্রথম অধিবেশনে যোগ দেয় এবং সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করার আশ্বাস দেয়।
বিএনপির প্রত্যাশা ছিল, অতীতের কথা ভুলে গিয়ে সরকার বাংলাদেশে একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির সূচনা করবে। দেশের সার্বিক রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন করার জন্য সরকার বিরোধী দলকে সম্মান ও সহনশীলতার সঙ্গে দেখবে। সংসদে বিরোধী দলকে একটি কার্যকর ভূমিকা পালনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করবে। প্রতিহিংসার রাজনীতি বর্জন করে একটি উদার মনোভাব নিয়ে সংসদ এবং সরকার পরিচালনা করবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন এবং জাতীয় স্বার্থসম্পর্কিত বিষয়গুলো যেমন—টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ, গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা, ট্রানজিট এবং সমুদ্রসীমা নির্ধারণের ক্ষেত্রে সরকার দ্বিদলীয় সমঝোতার ভিত্তিতে কাজ করার নতুন রাজনৈতিক চর্চা শুরু করবে। এটা জাতিরও প্রত্যাশা ছিল। এসব কথা বিবেচনা করে বছরজুড়ে আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিদ্যুত্, গ্যাস, পানি-সংকটসহ বিভিন্ন সমস্যা থাকা সত্ত্বেও বিএনপি ধৈর্য এবং দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছে এবং কোনো হরতালের কর্মসূচি দেয়নি।
কিন্তু এই প্রত্যাশার কোনোটাই বাস্তবে রূপ নেয়নি। বরং দেখা গেছে, বিরোধী দলের প্রতি সরকারের মনোভাব ও আচরণ সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী হয়েছে। ২৮ বছর ধরে যে বাড়িতে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বসবাস করছেন, সেখানে থেকে তাঁকে উচ্ছেদের চেষ্টা, সংসদে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ওপর দেওয়া খালেদা জিয়ার বক্তৃতা টেলিভিশনে প্রচার না করা, সংসদের প্রথম সারিতে বিএনপির জন্য আসন বরাদ্দ নিয়ে সংকট সৃষ্টি করা এবং মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে দেশের সব স্থাপনা থেকে জিয়াউর রহমানের নাম তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত বিরোধী দলের প্রতি সরকারের অসহনীয় আচরণ ও মনোভাবের পরিচয় দেয়। এর মাধ্যমে সমঝোতার পথে না এগিয়ে সরকার রাজনীতিকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দিতে চায় বলে মনে হয়।
এ ছাড়া একই বৈরী আচরণ আমরা আরও তিনটি বিষয়ে দেখতে পাই, যেখানে চরম অগণতান্ত্রিক এবং বৈষম্যমূলক ব্যবহার প্রতিফলিত হয়েছে—
১. রাজনৈতিকভাবে হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে দেখা গেল, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দায়ের করা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৪টি মামলা প্রত্যাহারসহ আওয়ামী লীগের সব নেতার মামলা প্রত্যাহারের জন্য সরকার সুপারিশ করেছে। কিন্তু বিরোধী দলের নেতা বেগম খালেদা জিয়াসহ অন্যদের মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়নি। বরং আইন প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, বিরোধী দলের মামলা প্রত্যাহারের জন্য তিনি মন্ত্রীর আসনে বসেননি।
২. তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অনেক নেতার ব্যাংক হিসাব রাজনৈতিক কারণে জব্দ করা হয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনের পর সরকার আওয়ামী লীগের নেতাদের জব্দ করা ব্যাংক হিসাবগুলো মুক্ত করে দিয়েছে। কিন্তু বিএনপির নেতাদের জব্দ করা ব্যাংক হিসাবগুলো অবরুদ্ধই আছে। সরকারের সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেগুলো মুক্ত করা হবে না।
৩. তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিএনপি ও আওয়ামী লীগের অনেক নেতার বিদেশে যাওয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। নির্বাচনের পর দেখা গেল, সরকার আওয়ামী লীগের নেতাদের ওপর থাকা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিয়েছে কিন্তু বিএনপির নেতাদের ওপর তা বহাল আছে। সংবিধানের ৩৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘বাংলাদেশ ত্যাগ ও বাংলাদেশে পুনঃপ্রবেশের অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে।’ অথচ এই মৌলিক অধিকারটুকু বিরোধী দলের নেতাদের নেই।
৪. বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর আজ প্রায় এক বছর বাংলাদেশের তিনবার নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী এবং বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বাড়িতে কোনো নেতা-কর্মী, এমনকি তাঁর ব্যক্তিগত স্টাফদেরও সাক্ষাত্ করতে দেওয়া হয় না। আর সংসদের দৈনিক কার্যাবলির কপি সেখানে গ্রহণ করতে দেওয়া হয় না। সরকারের এ ধরনের আচরণ গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় অকল্পনীয় ও অমার্জনীয়।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিএনপির প্রতি যে আচরণ করা হয়েছিল, আজকে আওয়ামী লীগ সরকারও একই ধরনের অসাংবিধানিক ও বেআইনি আচরণ অব্যাহত রেখেছে। তাই একটি অগণতান্ত্রিক, অনির্বাচিত ও স্বৈরাচারী সরকারের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের কোনো পার্থক্য বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি দেখতে পায় না। অর্থাত্ দেশে নির্বাচিত সরকার থাকতে পারে, কিন্তু বিরোধী দলের জন্য গণতন্ত্র নেই। দেশে সংবিধান আছে, কিন্তু বিরোধী দলের জন্য আইনের শাসন বা সম-অধিকার নেই।
বর্তমান সরকারের এত বড় একটি বিজয়ের পর দেশের মানুষের অনেক প্রত্যাশার মধ্যে চারটি প্রত্যাশা ছিল প্রবল। যথা—
১. আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে, যেন দেশের মানুষ নিরাপদে জীবন যাপন করতে পারে।
২. নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমিয়ে একটি সহনশীল অবস্থায় আনা হবে।
৩. দেশে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ব্যাপক আকারে বিনিয়োগ ও উত্পাদন বাড়বে এবং নতুন কর্মসংস্থানের মাধ্যমে লাখ লাখ বেকার যুবকের চাকরির ব্যবস্থা করা হবে।
৪. সংসদের ভেতরে এবং বাইরে দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে একটি নতুন সংস্কৃতির সূচনা হবে।
কিন্তু এই চারটি প্রত্যাশার প্রতিটির ব্যাপারে সরকার চরমভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে এবং দেশের মানুষের মধ্যে চরম হতাশা নেমে এসেছে। গত এক বছরে সরকার যেসব সফলতার কথা বলছে, তা গতানুগতিক অর্জন। এতে কোনো নতুনত্ব বা অভাবনীয় কিছু নেই।
এখন যা প্রয়োজন তা হলো, দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে দেশ ও জাতির স্বার্থে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা এবং ভবিষ্যতে যেন কোনো ধরনের অগণতান্ত্রিক শক্তি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করতে না পারে, সে জন্য খোলা মনে আন্তরিকতার সঙ্গে দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের জন্য অত্যন্ত জরুরি হলো, একটি সমঝোতায় পৌঁছানো। আওয়ামী লীগ যদি মনে করে, তারা যেহেতু ক্ষমতায় আছে, তাই তারা যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে দেশ চালাবে এবং পুরোনো রাজনৈতিক সংস্কৃতি অব্যাহত রাখবে, তাহলে তারা ভুল করবে। তাদের বুঝতে হবে, কোনো সরকারই শেষ সরকার নয়। তাদের বর্তমান অবস্থানও নিরাপদ নয়। বিরোধী দল বিএনপি তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী বটে, কিন্তু তাদের শত্রু নয়। শত্রু আছে অন্যত্র। তাই দেশে একটি সামগ্রিক সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য দুটি বৃহত্ দলের মধ্যে সমঝোতা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। এখনো সময় আছে সরকারের তরফ থেকে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়ার।
মওদুদ আহমদ: সদস্য, স্থায়ী কমিটি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল।
বিএনপির প্রত্যাশা ছিল, অতীতের কথা ভুলে গিয়ে সরকার বাংলাদেশে একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির সূচনা করবে। দেশের সার্বিক রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন করার জন্য সরকার বিরোধী দলকে সম্মান ও সহনশীলতার সঙ্গে দেখবে। সংসদে বিরোধী দলকে একটি কার্যকর ভূমিকা পালনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করবে। প্রতিহিংসার রাজনীতি বর্জন করে একটি উদার মনোভাব নিয়ে সংসদ এবং সরকার পরিচালনা করবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন এবং জাতীয় স্বার্থসম্পর্কিত বিষয়গুলো যেমন—টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ, গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা, ট্রানজিট এবং সমুদ্রসীমা নির্ধারণের ক্ষেত্রে সরকার দ্বিদলীয় সমঝোতার ভিত্তিতে কাজ করার নতুন রাজনৈতিক চর্চা শুরু করবে। এটা জাতিরও প্রত্যাশা ছিল। এসব কথা বিবেচনা করে বছরজুড়ে আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিদ্যুত্, গ্যাস, পানি-সংকটসহ বিভিন্ন সমস্যা থাকা সত্ত্বেও বিএনপি ধৈর্য এবং দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছে এবং কোনো হরতালের কর্মসূচি দেয়নি।
কিন্তু এই প্রত্যাশার কোনোটাই বাস্তবে রূপ নেয়নি। বরং দেখা গেছে, বিরোধী দলের প্রতি সরকারের মনোভাব ও আচরণ সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী হয়েছে। ২৮ বছর ধরে যে বাড়িতে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বসবাস করছেন, সেখানে থেকে তাঁকে উচ্ছেদের চেষ্টা, সংসদে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ওপর দেওয়া খালেদা জিয়ার বক্তৃতা টেলিভিশনে প্রচার না করা, সংসদের প্রথম সারিতে বিএনপির জন্য আসন বরাদ্দ নিয়ে সংকট সৃষ্টি করা এবং মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে দেশের সব স্থাপনা থেকে জিয়াউর রহমানের নাম তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত বিরোধী দলের প্রতি সরকারের অসহনীয় আচরণ ও মনোভাবের পরিচয় দেয়। এর মাধ্যমে সমঝোতার পথে না এগিয়ে সরকার রাজনীতিকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দিতে চায় বলে মনে হয়।
এ ছাড়া একই বৈরী আচরণ আমরা আরও তিনটি বিষয়ে দেখতে পাই, যেখানে চরম অগণতান্ত্রিক এবং বৈষম্যমূলক ব্যবহার প্রতিফলিত হয়েছে—
১. রাজনৈতিকভাবে হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে দেখা গেল, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দায়ের করা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৪টি মামলা প্রত্যাহারসহ আওয়ামী লীগের সব নেতার মামলা প্রত্যাহারের জন্য সরকার সুপারিশ করেছে। কিন্তু বিরোধী দলের নেতা বেগম খালেদা জিয়াসহ অন্যদের মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়নি। বরং আইন প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, বিরোধী দলের মামলা প্রত্যাহারের জন্য তিনি মন্ত্রীর আসনে বসেননি।
২. তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অনেক নেতার ব্যাংক হিসাব রাজনৈতিক কারণে জব্দ করা হয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনের পর সরকার আওয়ামী লীগের নেতাদের জব্দ করা ব্যাংক হিসাবগুলো মুক্ত করে দিয়েছে। কিন্তু বিএনপির নেতাদের জব্দ করা ব্যাংক হিসাবগুলো অবরুদ্ধই আছে। সরকারের সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেগুলো মুক্ত করা হবে না।
৩. তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিএনপি ও আওয়ামী লীগের অনেক নেতার বিদেশে যাওয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। নির্বাচনের পর দেখা গেল, সরকার আওয়ামী লীগের নেতাদের ওপর থাকা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিয়েছে কিন্তু বিএনপির নেতাদের ওপর তা বহাল আছে। সংবিধানের ৩৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘বাংলাদেশ ত্যাগ ও বাংলাদেশে পুনঃপ্রবেশের অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে।’ অথচ এই মৌলিক অধিকারটুকু বিরোধী দলের নেতাদের নেই।
৪. বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর আজ প্রায় এক বছর বাংলাদেশের তিনবার নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী এবং বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বাড়িতে কোনো নেতা-কর্মী, এমনকি তাঁর ব্যক্তিগত স্টাফদেরও সাক্ষাত্ করতে দেওয়া হয় না। আর সংসদের দৈনিক কার্যাবলির কপি সেখানে গ্রহণ করতে দেওয়া হয় না। সরকারের এ ধরনের আচরণ গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় অকল্পনীয় ও অমার্জনীয়।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিএনপির প্রতি যে আচরণ করা হয়েছিল, আজকে আওয়ামী লীগ সরকারও একই ধরনের অসাংবিধানিক ও বেআইনি আচরণ অব্যাহত রেখেছে। তাই একটি অগণতান্ত্রিক, অনির্বাচিত ও স্বৈরাচারী সরকারের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের কোনো পার্থক্য বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি দেখতে পায় না। অর্থাত্ দেশে নির্বাচিত সরকার থাকতে পারে, কিন্তু বিরোধী দলের জন্য গণতন্ত্র নেই। দেশে সংবিধান আছে, কিন্তু বিরোধী দলের জন্য আইনের শাসন বা সম-অধিকার নেই।
বর্তমান সরকারের এত বড় একটি বিজয়ের পর দেশের মানুষের অনেক প্রত্যাশার মধ্যে চারটি প্রত্যাশা ছিল প্রবল। যথা—
১. আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে, যেন দেশের মানুষ নিরাপদে জীবন যাপন করতে পারে।
২. নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমিয়ে একটি সহনশীল অবস্থায় আনা হবে।
৩. দেশে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ব্যাপক আকারে বিনিয়োগ ও উত্পাদন বাড়বে এবং নতুন কর্মসংস্থানের মাধ্যমে লাখ লাখ বেকার যুবকের চাকরির ব্যবস্থা করা হবে।
৪. সংসদের ভেতরে এবং বাইরে দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে একটি নতুন সংস্কৃতির সূচনা হবে।
কিন্তু এই চারটি প্রত্যাশার প্রতিটির ব্যাপারে সরকার চরমভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে এবং দেশের মানুষের মধ্যে চরম হতাশা নেমে এসেছে। গত এক বছরে সরকার যেসব সফলতার কথা বলছে, তা গতানুগতিক অর্জন। এতে কোনো নতুনত্ব বা অভাবনীয় কিছু নেই।
এখন যা প্রয়োজন তা হলো, দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে দেশ ও জাতির স্বার্থে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা এবং ভবিষ্যতে যেন কোনো ধরনের অগণতান্ত্রিক শক্তি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করতে না পারে, সে জন্য খোলা মনে আন্তরিকতার সঙ্গে দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের জন্য অত্যন্ত জরুরি হলো, একটি সমঝোতায় পৌঁছানো। আওয়ামী লীগ যদি মনে করে, তারা যেহেতু ক্ষমতায় আছে, তাই তারা যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে দেশ চালাবে এবং পুরোনো রাজনৈতিক সংস্কৃতি অব্যাহত রাখবে, তাহলে তারা ভুল করবে। তাদের বুঝতে হবে, কোনো সরকারই শেষ সরকার নয়। তাদের বর্তমান অবস্থানও নিরাপদ নয়। বিরোধী দল বিএনপি তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী বটে, কিন্তু তাদের শত্রু নয়। শত্রু আছে অন্যত্র। তাই দেশে একটি সামগ্রিক সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য দুটি বৃহত্ দলের মধ্যে সমঝোতা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। এখনো সময় আছে সরকারের তরফ থেকে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়ার।
মওদুদ আহমদ: সদস্য, স্থায়ী কমিটি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল।
No comments