আঞ্চলিক সংহতি বিনষ্টের দায় কার -প্রস্তাবিত ভৈরব জেলা by সামিউল হক
প্রথম আলোতে কথাসাহিত্যিক সুমন রহমানের ১ নভেম্বর প্রকাশিত ‘প্রস্তাবিত ভৈরব জেলার মানচিত্র কীভাবে আঁকা হবে’ এবং ২১ নভেম্বর ‘সুপ্রভাত ভৈরব, আস্তা লা ভিস্তা কিশোরগঞ্জ!’ শীর্ষক লেখা দুটি পড়েছি। আমার মতো কিশোরগঞ্জ জেলায় অসংখ্য পাঠকও তা পড়েছেন।
সুমন রহমান খোলা কলমে নিবন্ধটিতে ভৈরবকে জেলায় উন্নীত করার দাবিটিকে নিরপেক্ষ লেখক সেজে পরোক্ষভাবে ভৈরবের প্রতি সমর্থন করেছেন। তিনি এক জায়গায় বলেছেন, ‘আদিতে ময়মনসিংহ জেলার অংশ ছিল ভৈরব। তারপর কিশোরগঞ্জকে জেলা করার সময় ভৈরবকে কিশোরগঞ্জ জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। জেলা হিসেবে কিশোরগঞ্জও ময়মনসিংহ মাতৃকার সিজারিয়ান বেবি। এ কথা বর্তমান অখণ্ড কিশোরগঞ্জের প্রবক্তারা বোধহয় ভুলে গেছেন। বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে ভৈরবের ঐতিহ্য অনেক পুরোনো। এ জায়গায় কিশোরগঞ্জের জেলা পরিচয়ের দ্বারস্থ কখনোই ছিল না ভৈরব।’
কথাটি কতটুকু সত্য তা নিয়ে লেখক নিজেই দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছেন। কারণ তিনি ভুলে গেছেন ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে কিশোরগঞ্জকে মহকুমা করা হয়। ১৩টি থানার মধ্যে ভৈরবও একটি থানা ছিল। পুরোনো জেলাগুলোকে বাদ দিলে ১৯৮৪ সালে ৬৪ জেলার ৪১টি জেলা কোনো না কোনো পুরোনো জেলার সিজারিয়ান বেবি। দেশের প্রশাসনিক কাঠামোর এ ঐতিহাসিক সত্যকে তিনি পাশ কাটিয়ে ভৈরবের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন এবং পাঠককে বিভ্রান্তও করেছেন।
আবার তিনি বলেছেন, কিশোরগঞ্জের ম্যাপ কেটেছিঁড়ে একটি ভৈরব জেলা বের করে আনলে ফল খুব স্বস্তিদায়ক নাও হতে পারে। আপত্তি ও আগ্রহগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখা দরকার। নিকলী ও বাজিতপুর উপজেলা সম্পর্কে দ্বিপক্ষীয় সংলাপ অনুষ্ঠান করে সংকট নিরসনের কথা বলেছেন। পক্ষান্তরে, লেখক নিরপেক্ষতার আড়ালে ফাঁকফোকর দিয়ে ভৈরবের পক্ষেই থাকতে চেয়েছেন।
২১ নভেম্বর ‘সুপ্রভাত ভৈরব, আস্তা লা ভিস্তা কিশোরগঞ্জ!’ লেখাটা সত্যিই বিস্ময়কর। তিনি লিখেছেন, একটা জেলা ঘোষণাকে কেন্দ্র করে উষ্মা ও হিংসার বিস্তার আঞ্চলিক সংহতি যেভাবে বিনষ্ট করছে তার দায়দায়িত্ব কে নেবে? এ ক্ষেত্রে তিনি আগের লেখাটি না লিখলে ভালো করতেন। কারণ তার লেখাটি সংহতি বিনষ্টে ভৈরববাসীকে কিছুটা হলেও অনুপ্রাণিত করেছে।
একজন প্রতিশ্রুতিশীল সাহিত্যিক হিসেবে তাঁর সত্যটা অকপটে বলার কথা ছিল। কারণ আঞ্চলিক সংহতি বিনষ্ট করছে মুষ্টিমেয় একটি জনগোষ্ঠী। জেলার ৩২ লাখ জনগণের মধ্যে ১১টি উপজেলার ২৮ লাখ জনগোষ্ঠী যেখানে ভৈরব যেতে চাচ্ছে না, তার তোয়াক্কা না করে একটি ছোট এলাকার ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর দাবি প্রাধান্য পেতে পারে না। ভৌগোলিক সুবিধার কারণে মানুষকে জিম্মি করে সাইনবোর্ড থেকে কিশোরগঞ্জ থেকে নাম মুছে ফেলা, রেললাইন উপড়ে ফেলা কী রাষ্ট্রীয় আইন ও প্রশাসনিক কাঠামোকে অবজ্ঞা করার শামিল নয়?
কিশোরগঞ্জ জেলার মানচিত্রটির দিকে তাকালে জেলার দক্ষিণ-পূর্ব এক কোণে ভৈরবের অবস্থান। একদিকে মেঘলা, অন্যদিকে ব্রহ্মপুত্র, সামনে বাজার, পেছনে উত্তর-পশ্চিমে জেলার অন্যান্য উপজেলা। ঢাকা-সিলেট সড়কের ভৈরবের দুর্জয়মোড়ে দাঁড়িয়ে চারদিক তাকালে দ্বিতীয় দুর্জয় মোড় খুঁজে পাওয়া যাবে না।
দেড় বর্গকিলোমিটার ভৈরব শহর তিনদিক থেকে নদীবেষ্টিত। যা দেশের একটি বদ্বীপের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। ভৈরবকে জেলায় উন্নীত করতে হলে কিশোরগঞ্জের অন্য কিছু উপজেলাকেও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। মানুষ সামনের দিকে চলতে চায়, পেছনে নয়—এ কথা মনে রাখতে হবে। ১৩টি উপজেলার ১১টি উপজেলা যেখানে অখণ্ডতা রক্ষার দাবিতে সোচ্চার, সেখানে মুষ্টিমেয় কিছু লোকের চাওয়াকে সবার ওপরে চাপিয়ে দেওয়া ভালো হবে কি?
ভৈরববাসী বলেন, তাঁদের আয়-রাজস্ব বেশি। সেই আয়-রাজস্ব দেশের সবার জন্যই ব্যয় হয়। কিশোরগঞ্জ তা নিয়ে যায় না। আয়-রাজস্ব নিয়ে একটি উদাহরণ থেকে ভৈরবকে জেলা করার দাবিটি যুক্তিযুক্ত নয় বলে প্রমাণিত হবে।
নরসিংদী জেলার বাবুরহাট, মাধবদীকে বলা হয় প্রাচ্যের ম্যানচেস্টার। ব্যবসা-বাণিজ্য-অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড-রাজস্ব ভৈরব থেকে অনেক বেশি। ঢাকা-সিলেট সড়কের নরসিংদীর মাধবদী আজও উপজেলার মর্যাদা পায়নি। থানা নেই, পৌরসভার মধ্যেই তার প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড চলছে। ভৈরববাসী রাজস্ব আয়ের যে দাবি তুলেছেন, তাহলে বেনাপোল, মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দরকেও আলাদা জেলা করতে হয়।
পরিশেষে বলতে চাই, এক-এগারোর পর অনেকেই ভেবেছিল, দেশ থেকে রাজনীতি উঠে যাবে। কিন্তু রাজনীতিই প্রমাণ করেছে রাজনীতি ছাড়া দেশ চলতে পারে না। দেশে ভালো কিছু করতে হলে রাজনীতিবিদদের সদিচ্ছা অপরিহার্য। বিষয়টি বিবেচনা করলে বর্তমান সরকার তথা রাজনীতি জনগণের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষার সঠিক ও বাস্তবধর্মী প্রতিফলন ঘটাবে। ৩২ লাখ মানুষের ২৮ লাখ মানুষ যেখানে ভৈরবকে জেলায় উন্নীত করার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন সে, সত্যটি বর্তমান নির্বাচিত সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ সবাই নিশ্চয়ই বিবেচনায় নেবেন। অন্যথায় সারা জীবন ক্ষমতাসীন দলকে এর মাশুল গুনতে হবে। জনমতকে উপেক্ষা করা সঠিক কাজ হবে না।
সামিউল হক: শিক্ষক, নুরুল উলুম মহিলা মাদ্রাসা, কিশোরগঞ্জ।
সুমন রহমান খোলা কলমে নিবন্ধটিতে ভৈরবকে জেলায় উন্নীত করার দাবিটিকে নিরপেক্ষ লেখক সেজে পরোক্ষভাবে ভৈরবের প্রতি সমর্থন করেছেন। তিনি এক জায়গায় বলেছেন, ‘আদিতে ময়মনসিংহ জেলার অংশ ছিল ভৈরব। তারপর কিশোরগঞ্জকে জেলা করার সময় ভৈরবকে কিশোরগঞ্জ জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। জেলা হিসেবে কিশোরগঞ্জও ময়মনসিংহ মাতৃকার সিজারিয়ান বেবি। এ কথা বর্তমান অখণ্ড কিশোরগঞ্জের প্রবক্তারা বোধহয় ভুলে গেছেন। বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে ভৈরবের ঐতিহ্য অনেক পুরোনো। এ জায়গায় কিশোরগঞ্জের জেলা পরিচয়ের দ্বারস্থ কখনোই ছিল না ভৈরব।’
কথাটি কতটুকু সত্য তা নিয়ে লেখক নিজেই দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছেন। কারণ তিনি ভুলে গেছেন ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে কিশোরগঞ্জকে মহকুমা করা হয়। ১৩টি থানার মধ্যে ভৈরবও একটি থানা ছিল। পুরোনো জেলাগুলোকে বাদ দিলে ১৯৮৪ সালে ৬৪ জেলার ৪১টি জেলা কোনো না কোনো পুরোনো জেলার সিজারিয়ান বেবি। দেশের প্রশাসনিক কাঠামোর এ ঐতিহাসিক সত্যকে তিনি পাশ কাটিয়ে ভৈরবের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন এবং পাঠককে বিভ্রান্তও করেছেন।
আবার তিনি বলেছেন, কিশোরগঞ্জের ম্যাপ কেটেছিঁড়ে একটি ভৈরব জেলা বের করে আনলে ফল খুব স্বস্তিদায়ক নাও হতে পারে। আপত্তি ও আগ্রহগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখা দরকার। নিকলী ও বাজিতপুর উপজেলা সম্পর্কে দ্বিপক্ষীয় সংলাপ অনুষ্ঠান করে সংকট নিরসনের কথা বলেছেন। পক্ষান্তরে, লেখক নিরপেক্ষতার আড়ালে ফাঁকফোকর দিয়ে ভৈরবের পক্ষেই থাকতে চেয়েছেন।
২১ নভেম্বর ‘সুপ্রভাত ভৈরব, আস্তা লা ভিস্তা কিশোরগঞ্জ!’ লেখাটা সত্যিই বিস্ময়কর। তিনি লিখেছেন, একটা জেলা ঘোষণাকে কেন্দ্র করে উষ্মা ও হিংসার বিস্তার আঞ্চলিক সংহতি যেভাবে বিনষ্ট করছে তার দায়দায়িত্ব কে নেবে? এ ক্ষেত্রে তিনি আগের লেখাটি না লিখলে ভালো করতেন। কারণ তার লেখাটি সংহতি বিনষ্টে ভৈরববাসীকে কিছুটা হলেও অনুপ্রাণিত করেছে।
একজন প্রতিশ্রুতিশীল সাহিত্যিক হিসেবে তাঁর সত্যটা অকপটে বলার কথা ছিল। কারণ আঞ্চলিক সংহতি বিনষ্ট করছে মুষ্টিমেয় একটি জনগোষ্ঠী। জেলার ৩২ লাখ জনগণের মধ্যে ১১টি উপজেলার ২৮ লাখ জনগোষ্ঠী যেখানে ভৈরব যেতে চাচ্ছে না, তার তোয়াক্কা না করে একটি ছোট এলাকার ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর দাবি প্রাধান্য পেতে পারে না। ভৌগোলিক সুবিধার কারণে মানুষকে জিম্মি করে সাইনবোর্ড থেকে কিশোরগঞ্জ থেকে নাম মুছে ফেলা, রেললাইন উপড়ে ফেলা কী রাষ্ট্রীয় আইন ও প্রশাসনিক কাঠামোকে অবজ্ঞা করার শামিল নয়?
কিশোরগঞ্জ জেলার মানচিত্রটির দিকে তাকালে জেলার দক্ষিণ-পূর্ব এক কোণে ভৈরবের অবস্থান। একদিকে মেঘলা, অন্যদিকে ব্রহ্মপুত্র, সামনে বাজার, পেছনে উত্তর-পশ্চিমে জেলার অন্যান্য উপজেলা। ঢাকা-সিলেট সড়কের ভৈরবের দুর্জয়মোড়ে দাঁড়িয়ে চারদিক তাকালে দ্বিতীয় দুর্জয় মোড় খুঁজে পাওয়া যাবে না।
দেড় বর্গকিলোমিটার ভৈরব শহর তিনদিক থেকে নদীবেষ্টিত। যা দেশের একটি বদ্বীপের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। ভৈরবকে জেলায় উন্নীত করতে হলে কিশোরগঞ্জের অন্য কিছু উপজেলাকেও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। মানুষ সামনের দিকে চলতে চায়, পেছনে নয়—এ কথা মনে রাখতে হবে। ১৩টি উপজেলার ১১টি উপজেলা যেখানে অখণ্ডতা রক্ষার দাবিতে সোচ্চার, সেখানে মুষ্টিমেয় কিছু লোকের চাওয়াকে সবার ওপরে চাপিয়ে দেওয়া ভালো হবে কি?
ভৈরববাসী বলেন, তাঁদের আয়-রাজস্ব বেশি। সেই আয়-রাজস্ব দেশের সবার জন্যই ব্যয় হয়। কিশোরগঞ্জ তা নিয়ে যায় না। আয়-রাজস্ব নিয়ে একটি উদাহরণ থেকে ভৈরবকে জেলা করার দাবিটি যুক্তিযুক্ত নয় বলে প্রমাণিত হবে।
নরসিংদী জেলার বাবুরহাট, মাধবদীকে বলা হয় প্রাচ্যের ম্যানচেস্টার। ব্যবসা-বাণিজ্য-অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড-রাজস্ব ভৈরব থেকে অনেক বেশি। ঢাকা-সিলেট সড়কের নরসিংদীর মাধবদী আজও উপজেলার মর্যাদা পায়নি। থানা নেই, পৌরসভার মধ্যেই তার প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড চলছে। ভৈরববাসী রাজস্ব আয়ের যে দাবি তুলেছেন, তাহলে বেনাপোল, মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দরকেও আলাদা জেলা করতে হয়।
পরিশেষে বলতে চাই, এক-এগারোর পর অনেকেই ভেবেছিল, দেশ থেকে রাজনীতি উঠে যাবে। কিন্তু রাজনীতিই প্রমাণ করেছে রাজনীতি ছাড়া দেশ চলতে পারে না। দেশে ভালো কিছু করতে হলে রাজনীতিবিদদের সদিচ্ছা অপরিহার্য। বিষয়টি বিবেচনা করলে বর্তমান সরকার তথা রাজনীতি জনগণের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষার সঠিক ও বাস্তবধর্মী প্রতিফলন ঘটাবে। ৩২ লাখ মানুষের ২৮ লাখ মানুষ যেখানে ভৈরবকে জেলায় উন্নীত করার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন সে, সত্যটি বর্তমান নির্বাচিত সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ সবাই নিশ্চয়ই বিবেচনায় নেবেন। অন্যথায় সারা জীবন ক্ষমতাসীন দলকে এর মাশুল গুনতে হবে। জনমতকে উপেক্ষা করা সঠিক কাজ হবে না।
সামিউল হক: শিক্ষক, নুরুল উলুম মহিলা মাদ্রাসা, কিশোরগঞ্জ।
No comments