অপার বিস্ময়ে বারবার আবিষ্কার করি বঙ্গবন্ধুকে -সপ্তাহের হালচাল by আব্দুল কাইয়ুম

হেমন্তের শ্বেতশুভ্র সকাল। ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের সঙ্গে আমি সোজা চলে এসেছি ৩২ নম্বর রোডে বঙ্গবন্ধুর বাসায়। আকাশ ভেঙে সোনালি রোদ ঝরে পড়ছে ৩২ নম্বরের বারান্দায়। সেলিম তখন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি আর আমি সাধারণ সম্পাদক। পূর্ব বার্লিনে আন্তর্জাতিক যুব উত্সবের প্রস্তুতি সম্মেলনে আমি যাব। তাই দ্রুত পাসপোর্ট দরকার। সে জন্যই আমরা বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়েছি। বঙ্গবন্ধু তখনই নিচে নেমে এসেছেন। ভোরে সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে যাবেন অফিস করতে। আমাদের দেখে বললেন, ‘কিরে, কী দরকার, আয় আমার সঙ্গে গাড়িতে উঠে পড়!’
সাধারণ গাড়ি। সামনের আসনে একজন নিরাপত্তাকর্মী। পেছনের আসনে বঙ্গবন্ধুর পাশে আমরা দুজন। বিশ্ববিদ্যালয় ও দেশের পরিস্থিতি নিয়ে টুকটাক কথা হচ্ছে। নিউ এলিফ্যান্ট রোডে বাটার সিগন্যাল মোড়ে গাড়ি থেমে গেল। ট্রাফিক সিগন্যালের জন্য কিনা, জানি না। দেখলাম, একদল ভিখারি বঙ্গবন্ধুর গাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে। ট্রাফিক পুলিশ সিগন্যাল মোড়ে দাঁড়িয়ে হাসছে। মনে হয় তার কাছে খুব পরিচিত দৃশ্য। হয়তো প্রায়ই এ রকম হয়। বঙ্গবন্ধু পাঞ্জাবির পকেট থেকে বের করে তাদের টাকা দিচ্ছেন। সবাই হাসিমুখে টাকা নিয়ে চলে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু তাদের সঙ্গে কুশল বিনিময়ও করছেন, ‘কী রে, তুই ভালো তো!’ মনে হয় কত আপন।
মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো রক্তস্নাত বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধু সেদিনের এই ছোট্ট ঘটনা দিয়ে আরও কয়েক ধাপ উঁচুতে স্থাপন করলেন। সে সময় ঢাকাসহ সারা দেশ স্বাধীনতার আবেগে আপ্লুত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সবার মনের মণিকোঠায়। বাঙালি আর বঙ্গবন্ধু এক সুতায় গাঁথা। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু তো সাধারণের বটেই, কিন্তু তিনি তো প্রধানমন্ত্রীও। সেই প্রধানমন্ত্রীর গাড়ি রাস্তায় ট্রাফিক সিগন্যালে থেমেছে, এটা কি ভাবা যায়? আর তাঁর গাড়ি থামার সুযোগে হতদরিদ্ররা তাঁর সান্নিধ্যলাভের সুযোগ পাচ্ছে। শুধু তাই নয়, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নিজ হাতে তাদের টাকা দিচ্ছেন। এ যে অকল্পনীয় ব্যাপার। সেদিনের সেই দৃশ্য আজও আমার স্মৃতিপটে অম্লান হয়ে আছে।
সেদিন আর এই দিনের মধ্যে বৈপরীত্য চোখে পড়ার মতো। গত ৪ নভেম্বর প্রথম আলোর একাদশ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকার রবীন্দ্রসরোবরে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সাংসদ, গণমানুষের শিল্পী মমতাজ গাইলেন, ‘সোনারগাঁ থেকে বেরোতেই, গোলচক্কর না পেরোতেই,...’। অসাধারণ ছন্দ ও সুরে তিনি গাইলেন, শোনালেন চির পরিচিত দৃশ্যের কথা, সিগন্যাল বাতিতে থেমে থাকা গাড়ির যাত্রীর কাছে এক দুঃখী ভিখারিনী কোলের অভুক্ত শিশুর জন্য এক মুঠো ভাত চাইছে। তাঁর গান শুনে প্রশ্ন জাগল, আমরা কি ওই হতভাগ্যদের জন্য কিছু করতে পারছি? অথচ ৩৭ বছর আগে বঙ্গবন্ধুর কাছে সবাই ছিলেন সমাদৃত।
সবাইকে আপন করে নেওয়ার এক অবিশ্বাস্য গুণ ছিল বঙ্গবন্ধুর। বিশেষভাবে, আমরা যারা সে সময় ছাত্রনেতা ছিলাম, তাঁর দলের না হলেও, আমাদের তিনি পর ভাবতেন না। আমরাও ভাবতে পারতাম না, তিনি আমাদের দূরের কেউ। সে জন্যই ছোটখাটো সামান্য প্রয়োজনে আমরা তাঁর কাছে উপস্থিত হতাম। ’৭২ সালের ওই সকালেও একান্ত আমাদেরই মানুষ, এই দাবিতে সেলিম ও আমি হাজির হয়েছিলাম ৩২ নম্বরের সেই বাড়িতে। বাটার সিগন্যাল মোড় পার হয়ে আমরা সচিবালয়ে পৌঁছে গেছি। নিজের দপ্তরে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘দে, কাগজটা দে।’ হাতে লেখা দরখাস্তের ওপর বঙ্গবন্ধু নিজ হাতে কালির কলমে লিখে দিলেন, অবিলম্বে পাসপোর্ট দেওয়া হোক। নিচে স্বাক্ষর করলেন। সেই কাগজ নিয়ে সোজা চলে গেলাম ইস্কাটন রোডের পাসপোর্ট অফিসে। কর্মকর্তারা দরখাস্ত দেখে খুব বেশি অবাকও হলেন না, কারণ এ রকম চিঠি তাঁরা প্রায়ই হয়তো পেতেন। সঙ্গে সঙ্গে পাসপোর্ট। বলা বাহুল্য, গ্র্যাটিস পাসপোর্ট।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যে আত্মপ্রত্যয়ী ও নির্ভীক ছিলেন, সে কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু সবচেয়ে ভালোভাবে জানে বোধ হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের লোকজন। রাজনৈতিক কারণে আমি দুবার জেল খাটি, অর্থাত্ বিনা বিচারে আটক থাকি, রাজবন্দীর মর্যাদায়। প্রথমটি ছিল ১৯৮০ সালে জিয়াউর রহমানের আমলে। সচিবালয়ে কর্মচারীদের নিজস্ব দাবিদাওয়া নিয়ে ধর্মঘট চলছিল। একে কেন্দ্র করে দুর্বোধ্য কোনো কারণে কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) বেশ কিছু নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের মধ্যে আমিও ছিলাম। দ্বিতীয়বার ১৯৯০ সালে এরশাদের সময়। ২৭ নভেম্বর ডা. মিলন হত্যার পর জরুরি আইন জারি করলে পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী সব সাংবাদিক একযোগে কাজ বন্ধ করে দেন, পত্রিকা প্রকাশ স্থগিত থাকে। আমি তখন দৈনিক সংবাদ-এ সহকারী সম্পাদক। কোনো রাজনৈতিক দলে নেই। তাও গভীর রাতে বাসা থেকে আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। সম্ভবত সেটা ছিল ১০ বছর আগের গ্রেপ্তারের জের।
যা হোক, কারাবরণের সুবাদে জেলখানায় বঙ্গবন্ধুর বন্দিজীবনের অনেক কিছু জানতে পারি। পাকিস্তান আমলে তাঁকে যে সেলে আটক রাখা হয়েছিল, সেটা জাদুঘর হিসেবে সংরক্ষিত। প্রায়ই সেখানে যেতাম। মিয়াসাহেব বলে অভিহিত জেল পুলিশ ও জাদুঘরের পরিচ্ছন্নতাকর্মী কয়েদিদের কাছে তখন শুনেছি বঙ্গবন্ধুর বীরত্বগাথা। তারা বেশ গর্ব করে, অনেকটা অভিনয় করে বলতেন একটা কাহিনী। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলনের দায়ে বঙ্গবন্ধুকে বারবার জেলখানায় আটক করা হচ্ছে। সেই আটকাবস্থায় ১৯৬৮ সালের ৩ জানুয়ারি সামরিক স্বৈরাচার আইয়ুবশাহী বঙ্গবন্ধুকে এক নম্বর আসামি করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আটক দেখিয়েছে। বন্দীকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হবে। কারারক্ষীরা গভীর রাতে তাঁকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সেল থেকে বের করে গেটে নিয়ে গেলেন। বিশাল লোহার গেটের এক পাশে ছোট খুপরির মতো দরজাটা খোলা হলো। সাধারণত বন্দীরা ওই গেট দিয়েই পারাপার হন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু যাবেন না। বললেন, ‘বড় গেট খুলতে হবে, শেখ মুজিব মাথা নিচু করবে না!’ আসলে এই সাধারণ ব্যাপারটা আমাদের মনেই আসে না যে, ও রকম ছোট গেট দিয়ে পার হতে হলে তো মাথা নোয়াতে হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তো বাঙালির স্বাধীনতার প্রতীক। তিনি কেন মাথা নত করবেন? শেষ পর্যন্ত বড় গেট খুলতে হলো। এ কাহিনী হয়তো এখনো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রজন্মের পর প্রজন্ম মুখে মুখে পরিবাহিত হয়ে চলেছে।
বঙ্গবন্ধুর কাছে নীতিনিষ্ঠ ছাত্রনেতাদের স্থান ছিল অনেক উঁচুতে। ১৯৭২ সালের শেষ দিকের কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা ভিসির অফিস ঘেরাও করেছে। পরীক্ষা পেছাতে হবে। ডাকসুর ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম অনেক বোঝাল যে, এটা ঠিক না। পরীক্ষা পেছানো সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু কে শোনে কার কথা। এ অবস্থায় সেলিম সোজা চলে গেল বঙ্গবন্ধুর বাসায়। বঙ্গবন্ধু সেলিমকে নিয়ে নিজেই চলে এলেন ভিসির অফিসে। কিসের নিরাপত্তা, কিসের কী! বললেন, ‘তোরা এখানে কী করছিস?’ কিছুক্ষণের মধ্যে ঘেরাও শেষ। সমস্যার সমাধান।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে দেশের রাজনীতি ছিল উত্তাল। ছাত্রদের মধ্যে বাম রাজনীতির ঝোঁক ছিল প্রবল। সে সময় ভিয়েতনামের মুক্তিসংগ্রামের সমর্থনে ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি ছাত্র ইউনিয়নের মিছিলে পুলিশ গুলিবর্ষণ করলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন ছাত্রনেতা মতিউল ও কাদের নিহত এবং অনেকে গুরুতর আহত হন। এক সংঘাতময় পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে। ছাত্র ইউনিয়ন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অপসারণ, সুষ্ঠু তদন্ত, আহতদের সুচিকিত্সা, ভিয়েতনামের অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারকে স্বীকৃতিদান প্রভৃতি দাবি জানায়। সরকার বেশির ভাগ দাবি মেনে নেয়। অবশ্য ছাত্র ইউনিয়নও স্বীকার করে যে তাদের আন্দোলন কিছুটা ভুল পথে চলে গিয়েছিল, তারা বঙ্গবন্ধু বা তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে নয়। এর কিছুদিন পর সেলিম ও আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করার জন্য তাঁর বাসায় যাই। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এসে জানালেন, বঙ্গবন্ধু আমাদের উপরে যেতে বলেছেন। চলে গেলাম সোজা খাওয়ার ঘরে। তিনি তখন দুপুরের খাওয়া শেষ করেছেন মাত্র। বেগম মুজিবকে ডেকে বললেন, ‘কামালের মা, এই দেখো সেলিম এসেছে।’ তারপর হাসতে হাসতে বললেন, ‘কামালের মা আমাকে বলে, সেলিমের মতো ছেলে কীভাবে তোমার বিরুদ্ধে গেল? আমি বলি, জনতাকে শান্ত করতে হলে অনেক সময় অনেক কথা বলতে হয়।’ অন্যদের ভুলত্রুটিগুলো বঙ্গবন্ধু কত সহজে আপন করে নিতেন!
ছাত্রলীগের সঙ্গে ছাত্র ইউনিয়নের অনেক পাল্টাপাল্টি ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কাছে এ নিয়ে কোনো আপন-পর ছিল না। ১৯৭২ সালে তিনি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্র ইউনিয়নের ত্রয়োদশ জাতীয় সম্মেলন উদ্বোধন করেন। তিনি ছিলেন প্রধান অতিথি। পরের বছরও প্রধান অতিথি হিসেবে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের জাতীয় সম্মেলন উদ্বোধন করেন। তিনি ছিলেন আমাদের ‘মুজিব ভাই’। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছিলেন সাধারণের মধ্যে অসাধারণ।
তাঁকে কেউ হত্যা করতে পারে, এটা ছিল অকল্পনীয়। আগস্টের দিনগুলো ছিল বেশ থমথমে। রাজনীতি ছিল আপাত নিথর কিন্তু সংঘাতময়। ১৪ আগস্ট বিকেলে কাকরাইলে (সার্কিট হাউস রোড) ঢাকা মহানগর বাকশাল কার্যালয়ে একজন ওয়ার্ড নেতার মৃত্যুতে মিলাদ ও দোয়ার আয়োজন করা হয়েছিল। এরপর একটি সাংগঠনিক সভায় আলোচনা হয় পরদিন ১৫ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসির চারপাশে, নীলক্ষেত থেকে শাহবাগ-রমনা এলাকাজুড়ে বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধনা জানানোর জন্য ব্যাপক জনসমাগমের আয়োজনের ব্যাপারে। একজন কর্মী হিসেবে আমি সে সভায় ছিলাম। সিদ্ধান্ত হয়, মহানগরের সব ওয়ার্ড থেকে উদ্যোগ নেওয়া হবে। জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত সমাবেশের আয়োজন করা হবে। সেদিন বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন। তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ শুনবে মানুষ। তার প্রস্তুতি চলছিল নগর বাকশালে।
পরদিন সকালে ঘুম ভেঙে শুনি, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যাই র্যাংকিন স্ট্রিটে, যেখানে সাতটি ট্রাকে করে স্থানীয় জনসাধারণ ও কর্মীদের যাওয়ার কথা টিএসসির মোড়ে। ভাবছিলাম, সবাই মিলে প্রতিবাদ মিছিল বের করব। কিন্তু না, সেখানে গিয়ে দেখি, কেউ নেই। মনের মধ্যে এক ধরনের রক্তক্ষরণ ঘটতে থাকে। ভাঙা মন নিয়ে ফিরে আসি।
৩৪ বছর পর বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে। রায় কার্যকর হলে হয়তো মনের সেই রক্তক্ষরণ বন্ধ হবে।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.