বিদেশমুখী তারুণ্য by মোহাম্মদ ওমর ফারুক
বাংলাদেশ
প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। প্রতিষ্ঠানটির কম্পিউটার ও প্রকৌশল
বিভাগের ১৯৮৬ এর ব্যাচে মোট শিক্ষার্থী ছিলেন ৩১ জন। তাদের ২৫ জনই এখন
বিদেশে। একই বিভাগের ১৯৯৪ এর ব্যাচের ৪৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩৫ জন রয়েছেন
দেশের বাইরে। ১৯৯৮-এর ব্যাচের ৬৫ জনের মধ্যে ৩০ জন বিদেশে। তারা বিশ্বের
নানান স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। একপর্যায়ে বিভিন্ন দেশে নাগরিকত্ব
নিয়ে সেই দেশেই থেকে যান তারা। এ তথ্য দিয়েছেন বুয়েটের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও
প্রকৌশল বিভাগের কার্যালয় ও অ্যালামনাই এসোসিয়েশন।
শুধু বুয়েট নয়, সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা ভিড় করছেন বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য। একবার বিদেশ পাড়ি জমাতে পারলে দেশের প্রতি আগ্রহ হারিরে ফেলেন তরুণ-তরুণীরা। অথচ এসব শিক্ষার্থীর গ্র্যাজুয়েট তৈরি করতে সরকারের খরচ হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। জানা যায়, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি শেষ করতে একজন শিক্ষার্থীর পেছনে ব্যয় হচ্ছে ৫ লাখ টাকার অধিক, বুয়েটের একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষা সমাপনীতে ব্যয় হচ্ছে ১০ লাখ টাকা, আর একজন সরকারি মেডিকেলের শিক্ষার্থীর পেছনে ১৫ লাখ টাকার ওপর। বাংলাদেশের এই অর্থ ব্যয় হচ্ছে জনগণের করের টাকায়।
দেশ থেকে প্রতিবছর অসংখ্য শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার উদ্দেশে পাড়ি জমান বিদেশে। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই পড়াশোনা শেষ করে সেখানে চাকরিতে প্রবেশ পরবর্তী সময়ে সেখানকার স্থায়ী নাগরিক হয়ে যান। এতে করে বাংলাদেশ প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক মেধাবী তরুণ-তরুণী হারাচ্ছে। সঙ্গে মেধাও পাচার হচ্ছে বিদেশে। এমনটা মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশের তরুণ মেধাবী শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ, বিশেষজ্ঞ এবং দক্ষ জনশক্তির নিজ দেশ ত্যাগ করে বিদেশকে কর্মক্ষেত্র হিসেবে স্থায়ীভাবে বেছে নিচ্ছে। এই ধরনের ঘটনা কেন ঘটছে? বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য দেশে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, সুযোগ-সুবিধাসহ নানান কারণে দেশ ছাড়ছেন এসব মেধাবী। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে উপযুক্ত কর্মসংস্থানের অভাব ও মেধার স্বীকৃতি না দেয়া মেধাবী শিক্ষার্থীরা দেশে থাকছেন না। তাছাড়া দেশে বেকারত্ব সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো সমপ্রতি প্রকাশিত শ্রমজনশক্তি জরিপ অনুযায়ী ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সারা দেশে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৭৭ হাজার। এরমধ্যে ১০ লাখ ৪৩ হাজার শিক্ষিত তরুণ-তরুণী। যারা উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস। অর্থাৎ শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রায় ৪০ শতাংশ।
এদিকে দেশে সরকারি চাকরিতে যোগদানের জন্য মেধাবীদের প্রথম পছন্দ বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস)। অষ্টম পে-স্কেল ঘোষণার পর বিসিএসসহ সরকারি চাকরিতে আগ্রহ ও প্রতিযোগিতা বেড়েছে কয়েকগুন। তবে বিসিএসও কোটার কাছে পরাজিত হচ্ছে মেধা। গত একবছর আগেও শতকরা ৫৬ ভাগ নিয়োগই ছিলো কোটা। সরকারি ও বেসরকারি চাকরিতে কোটা তো আছেই। যার কারণে অনেক মেধাবী তরুণ দেশে ছেড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউনেস্কোর ‘গ্লোবাল ফ্লো অব টারশিয়ারি লেভেল স্টুডেন্টস’- শীর্ষক এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৬ সালে বাংলাদেশ থেকে উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে ৬০ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী। ২০১৫ সালে এ সংখ্যা ছিল ৩৩ হাজার ১৩৯। একবছরের ব্যবধানে এ সংখ্যা বেড়েছে ৮২ শতাংশ। বিদেশ যাওয়া শিক্ষার্থীদের হার বিশ্লেষণ করে সংশ্লিষ্টরা ধারণা করেছিলেলেন ২০১৭ সালে লাখ ছাড়িয়েছে যাবে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে ১৭ এবং ১৮-তে এই সংখ্যা লাখ ছাড়িয়েছে। বিদেশ যাওয়ার মাধ্যমে একদিকে বাংলাদেশি টাকাও বিদেশে চলে যাচ্ছে। অন্যদিকে এসব শিক্ষার্থীরা উচ্চ শিক্ষা শেষে আর দেশে ফিরে আসছে না। এভাবে অর্থ ও মেধা উভয় পাচার হচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি পলিসি-২০১০ (সংশোধিত)-এ বলা হয়েছে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকার বেশ কয়েকটি কারণের একটি হচ্ছে মেধা পাচার বা মেধাবী তরুণ্যের বিদেশে চলে যাওয়া। মেধা পাচার ও দক্ষ জনশক্তির ইমিগ্রেশন সমস্যার বিষয়টি গুরুত্ব আরোপ করে তা বন্ধ করার কথাও নীতিমালায় বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, দেশে বিজ্ঞান থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের কর্মক্ষেত্র সীমিত। ফলে শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান বিষয়ে পড়ালেখার আগ্রহ কমছে। এদিকে দেশে ৪০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সংখ্যা ৫০ হাজারের মতো। অথচ উচ্চশিক্ষার জন্য স্বপ্ন দেখেন দেশের আট থেকে নয় লাখ শিক্ষার্থী। আসন সংখ্যা কম থাকায় অনেকেরই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে উচ্চশিক্ষার স্বপ্নপূরণ হয় না। আবার দেশে প্রথম সারির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়তে খরচ হচ্ছে প্রচুর অর্থ। বিপরীত দিকে বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একই টাকা যেমন পড়াশোনা করতে পারছে পাশাপাশি সুযোগ রয়েছে উপার্জন করার। সবমিলিয়ে এমন সুযোগ হাত ছাড়া করতে চায় না তরুণরা। রাজধানীর আইএলটিএস ও জিআরই শিক্ষা বিভিন্ন প্রষ্ঠিানগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা য়ায়, প্রতিনিয়ত তাদের প্রতিটি ব্যাচে চল্লিশ জনের বেশি করে শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছে। এ রকম একেকটি প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন দশ থেকে বারোটি ব্যাচ পরিচালনা করা হয়। জানা গেছে, এসব শিক্ষার্থী শুধু বিদেশ যাওয়ার জন্যই এ কোর্সগুলো করছেন। এ রকম একজন শিক্ষার্থী আল-আমিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা শেষ করেছেন। এখন আইএলটিএস করার জন্য ভর্তি হয়েছেন মেন্টোসে। তিনি বলেন, দেশে কোনো কর্মসংস্থান নেই। এখানে ভালো করার কোনো সুযোগ নেই। তাই দেশের বাইরে চলে যাওয়ার ইচ্ছা। সেখানে দারুণ সব সুযোগ-সুবিধা রয়েছে।
শুধু শিক্ষার্থীই নয়, মেধাবী তরুণ পেশাজীবীরাও ভিড় করছেন বিদেশে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৫ সালে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ১৫ জন শিক্ষক অনুমতি ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুপস্থিত ছিলেন। এর আগের বছরে এ সংখ্যা ছিল ১৪ জন।
এসব শিক্ষক উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে আর ফিরে আসেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিতে যোগ দেয়ার কারণে শিক্ষকদের উচ্চতর ডিগ্রির জন্য শিক্ষা ঋণ বা শিক্ষা বৃত্তি পাওয়া অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকেও শিক্ষকদের উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণকে সাধুবাদ জানানো হয়। শিক্ষকরা উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে অবস্থানকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরির সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পান। বিদেশ যাওয়ার সময় শিক্ষকদের ছয় মাসের বেতন বা চাহিদা অনুযায়ী অর্থ দিয়ে থাকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিদেশে অবস্থানকালেও তারা প্রতিমাসে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কিস্তিতে টাকা পেয়ে থাকেন। এসব কারণে দেশের সরকারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বিদেশমুখী হচ্ছেন। কিন্তু গিয়ে আর ফিরে আসছেন না। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকই নন, নানান পেশার মানুষ উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে চলে গেলেও তারা আর দেশে ফিরছেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সূত্রে জানা যায়, শুধুমাত্র বিদেশ গিয়ে ফেরত না আসার কারণে নানান সময় সিন্ডিকেট সভায় অনেক শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করা হয়। নিয়মানুযায়ী কোনো শিক্ষক ছয় মাস বা একবছরের জন্য বিদেশে গেলে একাধিক কিস্তিতে সর্বাধিক চারবছরের জন্য ছুটিতে থাকতে পারবেন। উচ্চশিক্ষা শেষে শুধু দেশে ফিরে কাজে যোগদানই নয়, ভোগকৃত ছুটির সমপরিমাণ সময়কাল তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করাও বাধ্যতামূলক। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির অনেক শিক্ষকই বিদেশ যাওয়ার পর দেশে ফিরে আসেন না।
মেধাবীদের বিদেশমুখী হওয়ার কারণ জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, বিষয়টিকে নেগেটিভভাবে দেখছি না। সারা বিশ্ব এখন গ্লোবাল ভিলেজ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- বিভিন্ন দেশে গিয়ে দেশের কথা মনে রাখছে কি না। তবে আমার কাছে আরো একটি বিষয় মনে হয় দেশে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা না দিতে পারা, চাকরি না থাকা বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ বা বিশেষজ্ঞদের প্রয়োজনীয় ল্যাব সুবিধা না দিতে পারার কারণে তারা বিদেশমুখী হচ্ছেন। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য কাজ করা উচিত সরকারকে।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, যেখানে মাখন রুটি পাবে মানুষ সেখানেই যাবে। দেশে চাকরি-বাকরি, সামাজিক নিরাপত্তা তেমন কিছু একটা পর্যাপ্ত নেই। যার কারণে বিদেশে দৌড়াচ্ছে তারুণ্য। আগে তো অনেকের মাঝে দেশপ্রেম ছিলো। ফলে দেশে ফিরে আসতো। এখন সেটাও অনেক কমে গেছে।
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, দেশের প্রতি ভালোবাসা থাকলে দেশে অবশ্যই ফিরে আসবে এবং আসা উচিত। শিক্ষিত তরুণদের দিকেই চেয়ে আছে দেশ। দেশের প্রতি দায়বদ্ধতার মূল্যবোধে ঘাটতির কারণেই অনেকে ফিরে আসছে না। সবার আগে দেশের কথা ভাবলে এমন হতো না। বর্তমান সরকার তরুণদের জন্য অনেক কাজ করে যাচ্ছে।
শুধু বুয়েট নয়, সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা ভিড় করছেন বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য। একবার বিদেশ পাড়ি জমাতে পারলে দেশের প্রতি আগ্রহ হারিরে ফেলেন তরুণ-তরুণীরা। অথচ এসব শিক্ষার্থীর গ্র্যাজুয়েট তৈরি করতে সরকারের খরচ হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। জানা যায়, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি শেষ করতে একজন শিক্ষার্থীর পেছনে ব্যয় হচ্ছে ৫ লাখ টাকার অধিক, বুয়েটের একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষা সমাপনীতে ব্যয় হচ্ছে ১০ লাখ টাকা, আর একজন সরকারি মেডিকেলের শিক্ষার্থীর পেছনে ১৫ লাখ টাকার ওপর। বাংলাদেশের এই অর্থ ব্যয় হচ্ছে জনগণের করের টাকায়।
দেশ থেকে প্রতিবছর অসংখ্য শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার উদ্দেশে পাড়ি জমান বিদেশে। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই পড়াশোনা শেষ করে সেখানে চাকরিতে প্রবেশ পরবর্তী সময়ে সেখানকার স্থায়ী নাগরিক হয়ে যান। এতে করে বাংলাদেশ প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক মেধাবী তরুণ-তরুণী হারাচ্ছে। সঙ্গে মেধাও পাচার হচ্ছে বিদেশে। এমনটা মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশের তরুণ মেধাবী শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ, বিশেষজ্ঞ এবং দক্ষ জনশক্তির নিজ দেশ ত্যাগ করে বিদেশকে কর্মক্ষেত্র হিসেবে স্থায়ীভাবে বেছে নিচ্ছে। এই ধরনের ঘটনা কেন ঘটছে? বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য দেশে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, সুযোগ-সুবিধাসহ নানান কারণে দেশ ছাড়ছেন এসব মেধাবী। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে উপযুক্ত কর্মসংস্থানের অভাব ও মেধার স্বীকৃতি না দেয়া মেধাবী শিক্ষার্থীরা দেশে থাকছেন না। তাছাড়া দেশে বেকারত্ব সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো সমপ্রতি প্রকাশিত শ্রমজনশক্তি জরিপ অনুযায়ী ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সারা দেশে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৭৭ হাজার। এরমধ্যে ১০ লাখ ৪৩ হাজার শিক্ষিত তরুণ-তরুণী। যারা উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস। অর্থাৎ শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রায় ৪০ শতাংশ।
এদিকে দেশে সরকারি চাকরিতে যোগদানের জন্য মেধাবীদের প্রথম পছন্দ বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস)। অষ্টম পে-স্কেল ঘোষণার পর বিসিএসসহ সরকারি চাকরিতে আগ্রহ ও প্রতিযোগিতা বেড়েছে কয়েকগুন। তবে বিসিএসও কোটার কাছে পরাজিত হচ্ছে মেধা। গত একবছর আগেও শতকরা ৫৬ ভাগ নিয়োগই ছিলো কোটা। সরকারি ও বেসরকারি চাকরিতে কোটা তো আছেই। যার কারণে অনেক মেধাবী তরুণ দেশে ছেড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউনেস্কোর ‘গ্লোবাল ফ্লো অব টারশিয়ারি লেভেল স্টুডেন্টস’- শীর্ষক এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৬ সালে বাংলাদেশ থেকে উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে ৬০ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী। ২০১৫ সালে এ সংখ্যা ছিল ৩৩ হাজার ১৩৯। একবছরের ব্যবধানে এ সংখ্যা বেড়েছে ৮২ শতাংশ। বিদেশ যাওয়া শিক্ষার্থীদের হার বিশ্লেষণ করে সংশ্লিষ্টরা ধারণা করেছিলেলেন ২০১৭ সালে লাখ ছাড়িয়েছে যাবে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে ১৭ এবং ১৮-তে এই সংখ্যা লাখ ছাড়িয়েছে। বিদেশ যাওয়ার মাধ্যমে একদিকে বাংলাদেশি টাকাও বিদেশে চলে যাচ্ছে। অন্যদিকে এসব শিক্ষার্থীরা উচ্চ শিক্ষা শেষে আর দেশে ফিরে আসছে না। এভাবে অর্থ ও মেধা উভয় পাচার হচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি পলিসি-২০১০ (সংশোধিত)-এ বলা হয়েছে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকার বেশ কয়েকটি কারণের একটি হচ্ছে মেধা পাচার বা মেধাবী তরুণ্যের বিদেশে চলে যাওয়া। মেধা পাচার ও দক্ষ জনশক্তির ইমিগ্রেশন সমস্যার বিষয়টি গুরুত্ব আরোপ করে তা বন্ধ করার কথাও নীতিমালায় বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, দেশে বিজ্ঞান থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের কর্মক্ষেত্র সীমিত। ফলে শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান বিষয়ে পড়ালেখার আগ্রহ কমছে। এদিকে দেশে ৪০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সংখ্যা ৫০ হাজারের মতো। অথচ উচ্চশিক্ষার জন্য স্বপ্ন দেখেন দেশের আট থেকে নয় লাখ শিক্ষার্থী। আসন সংখ্যা কম থাকায় অনেকেরই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে উচ্চশিক্ষার স্বপ্নপূরণ হয় না। আবার দেশে প্রথম সারির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়তে খরচ হচ্ছে প্রচুর অর্থ। বিপরীত দিকে বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একই টাকা যেমন পড়াশোনা করতে পারছে পাশাপাশি সুযোগ রয়েছে উপার্জন করার। সবমিলিয়ে এমন সুযোগ হাত ছাড়া করতে চায় না তরুণরা। রাজধানীর আইএলটিএস ও জিআরই শিক্ষা বিভিন্ন প্রষ্ঠিানগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা য়ায়, প্রতিনিয়ত তাদের প্রতিটি ব্যাচে চল্লিশ জনের বেশি করে শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছে। এ রকম একেকটি প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন দশ থেকে বারোটি ব্যাচ পরিচালনা করা হয়। জানা গেছে, এসব শিক্ষার্থী শুধু বিদেশ যাওয়ার জন্যই এ কোর্সগুলো করছেন। এ রকম একজন শিক্ষার্থী আল-আমিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা শেষ করেছেন। এখন আইএলটিএস করার জন্য ভর্তি হয়েছেন মেন্টোসে। তিনি বলেন, দেশে কোনো কর্মসংস্থান নেই। এখানে ভালো করার কোনো সুযোগ নেই। তাই দেশের বাইরে চলে যাওয়ার ইচ্ছা। সেখানে দারুণ সব সুযোগ-সুবিধা রয়েছে।
শুধু শিক্ষার্থীই নয়, মেধাবী তরুণ পেশাজীবীরাও ভিড় করছেন বিদেশে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৫ সালে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ১৫ জন শিক্ষক অনুমতি ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুপস্থিত ছিলেন। এর আগের বছরে এ সংখ্যা ছিল ১৪ জন।
এসব শিক্ষক উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে আর ফিরে আসেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিতে যোগ দেয়ার কারণে শিক্ষকদের উচ্চতর ডিগ্রির জন্য শিক্ষা ঋণ বা শিক্ষা বৃত্তি পাওয়া অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকেও শিক্ষকদের উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণকে সাধুবাদ জানানো হয়। শিক্ষকরা উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে অবস্থানকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরির সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পান। বিদেশ যাওয়ার সময় শিক্ষকদের ছয় মাসের বেতন বা চাহিদা অনুযায়ী অর্থ দিয়ে থাকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিদেশে অবস্থানকালেও তারা প্রতিমাসে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কিস্তিতে টাকা পেয়ে থাকেন। এসব কারণে দেশের সরকারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বিদেশমুখী হচ্ছেন। কিন্তু গিয়ে আর ফিরে আসছেন না। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকই নন, নানান পেশার মানুষ উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে চলে গেলেও তারা আর দেশে ফিরছেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সূত্রে জানা যায়, শুধুমাত্র বিদেশ গিয়ে ফেরত না আসার কারণে নানান সময় সিন্ডিকেট সভায় অনেক শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করা হয়। নিয়মানুযায়ী কোনো শিক্ষক ছয় মাস বা একবছরের জন্য বিদেশে গেলে একাধিক কিস্তিতে সর্বাধিক চারবছরের জন্য ছুটিতে থাকতে পারবেন। উচ্চশিক্ষা শেষে শুধু দেশে ফিরে কাজে যোগদানই নয়, ভোগকৃত ছুটির সমপরিমাণ সময়কাল তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করাও বাধ্যতামূলক। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির অনেক শিক্ষকই বিদেশ যাওয়ার পর দেশে ফিরে আসেন না।
মেধাবীদের বিদেশমুখী হওয়ার কারণ জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, বিষয়টিকে নেগেটিভভাবে দেখছি না। সারা বিশ্ব এখন গ্লোবাল ভিলেজ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- বিভিন্ন দেশে গিয়ে দেশের কথা মনে রাখছে কি না। তবে আমার কাছে আরো একটি বিষয় মনে হয় দেশে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা না দিতে পারা, চাকরি না থাকা বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ বা বিশেষজ্ঞদের প্রয়োজনীয় ল্যাব সুবিধা না দিতে পারার কারণে তারা বিদেশমুখী হচ্ছেন। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য কাজ করা উচিত সরকারকে।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, যেখানে মাখন রুটি পাবে মানুষ সেখানেই যাবে। দেশে চাকরি-বাকরি, সামাজিক নিরাপত্তা তেমন কিছু একটা পর্যাপ্ত নেই। যার কারণে বিদেশে দৌড়াচ্ছে তারুণ্য। আগে তো অনেকের মাঝে দেশপ্রেম ছিলো। ফলে দেশে ফিরে আসতো। এখন সেটাও অনেক কমে গেছে।
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, দেশের প্রতি ভালোবাসা থাকলে দেশে অবশ্যই ফিরে আসবে এবং আসা উচিত। শিক্ষিত তরুণদের দিকেই চেয়ে আছে দেশ। দেশের প্রতি দায়বদ্ধতার মূল্যবোধে ঘাটতির কারণেই অনেকে ফিরে আসছে না। সবার আগে দেশের কথা ভাবলে এমন হতো না। বর্তমান সরকার তরুণদের জন্য অনেক কাজ করে যাচ্ছে।
No comments