অগ্নিগর্ভ কাশ্মির নিয়ে মোদি সরকারের পরিকল্পনা আসলে কী? by রঞ্জন বসু
গত ১০
আগস্ট শনিবার, ভারতীয় সময় বেলা দুটো বেজে চার মিনিট। দিল্লিতে বিবিসি-র
দক্ষিণ এশিয়া ব্যুরো চিফ নিকোলা করিম নিজের টুইটারে একটি ভিডিও পোস্ট করেন।
সেখানে তিনি লিখলেন, ‘সরকার যদিও অস্বীকার করছে যে শ্রীনগরের সোউরা-তে
বিক্ষোভের খবর সম্পূর্ণ বানোয়াট, সত্যিটা জানতে বিবিসির এই এক্সক্লুসিভ
ভিডিওটা দেখুন। হাজার হাজার মানুষ সেখানে মিছিল করেছেন, পুলিশ সেখানে
ফায়ারিং করেছে – বহু লোক আহত হয়েছেন।’
সংক্ষিপ্ত
ওই ভিডিওতে সত্যিই বহু মানুষকে আজাদি বা স্বাধীনতার স্লোগান দিয়ে যেতে
দেখা যাচ্ছিল। এমন কী, কারও কারও হাতে ইংরেজিতে লেখা ব্যানারও ছিল ‘৩৭০
ধারার বিলোপ মানছি না, মানবো না। শব্দ শোনা যাচ্ছিল ফায়ারিংয়ের, পেছনে দেখা
যাচ্ছিল ধোঁয়ার কুণ্ডলীও - সম্ভবত টিয়ার গ্যাস থেকে। এমন কী একটি সমাবেশ
থেকে বক্তারা যখন আওয়াজ তুলছিলেন, ‘হাম ক্যায়া চাহতে হ্যায়?’ - হাজারো
কণ্ঠে জবাব আসছিল ‘আজাদি, আজাদি।
বিকেল পাঁচটার দিকে নিকোলা করিম আরেকটি টুইটে বলেন, ‘এটুকু পরিষ্কার করতে চাই যে এই ভিডিওটা শুক্রবার শ্রীনগরের সোউরাতে জুমার নামাজের পর বিকেল সাড়ে তিনটার সময় তোলা। ভিডিও-র র’ ফুটেজও শিগগির প্রকাশ করা হবে।’
মাত্র কয়েক ঘণ্টার ভেতরই অস্বীকার করলো ভারত। জানালো,‘ এসব ফায়ারিং-টায়ারিং নাকি একদম বাজে কথা। জম্মু ও কাশ্মির সরকারের শীর্ষ আমলা ও পুলিশ প্রধান একযোগে বিবৃতি দিলেন, ‘বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত খবরে একেবারেই কান দেবেন না। জেনে রাখুন, গত ছয় দিনে পুলিশ কাশ্মিরে একটাও বুলেট চালায়নি।’
রবিবার সকালে দিল্লিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সেই বিবৃতি আবার রিটুইট করলেন। তিনি এর আগেই রয়টার্স ও বিবিসিকে একহাত নিয়েছেন, ‘দশ হাজার মানুষে’র কথিত বিক্ষোভের খবরকে ভিত্তিহীন বলে বর্ণনা করে। জানিয়েছেন, শ্রীনগর বা বারামুলায় ছোটখাটো বিচ্ছিন্ন প্রতিবাদ হলেও তার কোনওটিতেই ২০ জনের বেশি লোক ছিল না।
ইতোমধ্যে কাশ্মির পুলিশের আইজি স্বয়মপ্রকাশ পানি নিজে ভিডিও বার্তা রেকর্ড করে টুইটারে পোস্ট করলেন, ‘গত এক সপ্তাহ ধরে কাশ্মীর ভ্যালি কিন্তু শান্তিপূর্ণই আছে।’ সঙ্গে ছিল মিডিয়ার প্রতি তার প্রচ্ছন্ন হুঁশিয়ারি, ‘সংবাদমাধ্যমকে বলবো তারা যেন দায়িত্বশীল আচরণ করে!’
শনিবার মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, শ্রীনগরে ৩৭০ ধারা বিলোপের দাবিতে কাশ্মিরি নারীরাও পথে নেমেছেন। সে খবরও উড়িয়ে দিয়েছে সরকার।
বস্তুত গত আটচল্লিশ ঘণ্টায় ভারত সরকার কাশ্মির প্রসঙ্গে বিবিসি, আল জাজিরা, নিউ ইয়র্ক টাইমস, রয়টার্স-সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে যেভাবে নস্যাৎ করার চেষ্টা করেছে ভারতীয় গণতন্ত্রের সত্তর বছরের ইতিহাসে তা কখনও ঘটেনি বললেও বোধহয় ভুল হবে না।
আর এই দাবি আর পাল্টা দাবির বিস্তারিত বিবরণ এই জন্যই পেশ করলাম যে ভারতে পর্যবেক্ষক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা অনেকেই মনে করছেন কাশ্মির নিয়ে ভারত এবারে যে একটা ‘হেস্তনেস্ত করার লড়াইয়ে নেমেছে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলোর সঙ্গে এই মুখোমুখি সংঘাতেই তা স্পষ্ট। কাশ্মিরে এবারকার মর্যাদার যুদ্ধটা জেতার জন্য ভারতীয় গণতন্ত্র যে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিজের ভাবমূর্তি বা ইমেজ নিয়েও ভাবিত নয় – সেই লক্ষণও এরই মধ্যে পরিষ্কার।
সামরিক শক্তিতে বুলডোজ করা যাবে কাশ্মিরের ভাবাবেগ?
বিখ্যাত প্রতিরক্ষা সাময়িকী জেনস ডিফেন্স উইকলি-র নিরাপত্তা বিশ্লেষক রাহুল বেদী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দেখুন, অনেকেই হয়তো ভাবছেন ভারত সরকার কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করার সিদ্ধান্ত একেবারে হঠাৎ করে নিয়েছে। কাউকে কোনও আভাস না-দিয়ে পার্লামেন্টে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই পদক্ষেপ ঘোষণা করেছেন ঠিকই, তবে আমি কিন্তু বলবো সরকার অনেক ভেবেচিন্তেই কাশ্মির নিয়ে এখানে একটা বিরাট ফাটকা খেলেছে।’
রাহুল বেদীর বক্তব্য, সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করে কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা বা স্বীকৃতি রাতারাতি ছিনিয়ে নেওয়া হলে ওই প্রদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমরা যে তাকে স্বাগত জানাতে রাস্তায় নেমে মিছিল করবেন না নরেন্দ্র মোদি সরকারেরও তা বিলক্ষণ জানা আছে।
কিন্তু সরকার এখন যেভাবেই হোক এই আত্মবিশ্বাসটা অর্জন করেছে লক্ষ লক্ষ ফৌজ ও আধাসেনা নামিয়ে কাশ্মীরের ভাবাবেগকে দমিয়ে রাখা সম্ভব। সেটা পুরো কাশ্মিরকে গ্যারিসন বানিয়ে করা হলেও ক্ষতি নেই।’
তিনি বলেন, ‘কাশ্মির যতই ক্ষুব্ধ হোক, তারা খুব বেশিদিন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে পারবে না বলেও মোদি সরকারের বিশ্বাস। যেমন ২০১৬তে বুরহান ওয়ানি নিহত হওয়ার পর কাশ্মিরের স্বত:স্ফূর্ত প্রতিবাদও তিন চার মাসের বেশি টেকেনি।’
দিল্লিতে একাধিক নিরাপত্তা বিশ্লেষকের সঙ্গে কথা বলেও এই ধারণা পাওয়া যাচ্ছে যে প্রয়োজন হলে ভারত সরকার কাশ্মিরে আরও সেনা ‘মোবিলাইজ’ করতেও প্রস্তুত। তারা জানাচ্ছেন, সমগ্র ভারত-শাসিত কাশ্মিরে এখনই প্রায় সাত লাখ সেনা মোতায়েন আছে, আরও দুলক্ষ সৈন্য আনা নিয়ে আসা সম্ভব মাত্র কয়েক দিনের নোটিশেই।
কী ভূমিকা মোদির ‘জেমস বন্ড’অজিত ডোভালের?
মোদি সরকারের এই ‘কাশ্মির গেমপ্ল্যানে’ একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (এনএসএ) অজিত ডোভাল – যাকে অনেকেই মোদির ‘জেমস বন্ড’ বলে ডাকেন।
ভারতের এই সাবেক গোয়েন্দা-প্রধান তার ডাকাবুকো স্বভাব ও দুঃসাহসী নানা সিদ্ধান্তের জন্য পরিচিত। ইসলামাবাদে একটা সময় তিনি টানা সাত বছর মুসলিম সেজে কীভাবে ভারতের হয়ে কাজ করেছেন, দিল্লিতে সে গল্পও মুখে মুখে ফেরে।
পাঁচ বছর আগে এনএসএ-র দায়িত্বে আসার পর থেকেই অজিত ডোভাল কিন্তু গোপনে কাশ্মির নিয়ে নানা তৎপরতা ও স্ট্র্যাটেজি ফর্মুলেশনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
ভারতের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর একটি সূত্র জানাচ্ছে, ‘শুনলে অবাক হবেন গত কয়েক বছর ধরে দু-চারটে সপ্তাহ বাদ দিলে প্রতি শুক্র বা শনিবার অজিত ডোভাল কাশ্মির আসছেন। চলে যাচ্ছেন নানা সেনানিবাসে বা স্থানীয়দের মহল্লায়। কাশ্মিরে গিয়ে তিনি শুধু ফৌজের সঙ্গেই নয়, সমাজের নানা স্তরের মানুষের সঙ্গেও মিশছেন ও কথাবার্তা বলছেন।’
গত সোমবার পার্লামেন্টে অমিত শাহ-র নাটকীয় ঘোষণার পর থেকেই কাশ্মির ভ্যালিতে ঘাঁটি গেড়ে পড়ে আছেন অজিত ডোভাল। বুধবার তাকে দেখা গেছে শোপিয়ানে সরকারি লঙ্গর থেকে বিরিয়ানি নিয়ে স্থানীয় মানুষজনের সঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেতে। ‘সব ঠিক হয়ে যাবে’ বলে তাদের ভরসা দিয়েছেন, কাশ্মির পুলিশের মনোবল চাঙ্গা করতে ভাষণও দিয়েছেন।
এরপর শুক্রবার তিনি গিয়ে হাজির হন অনন্তনাগে। সেখানে রাস্তার ধারে ঈদের কোরবানির জন্য ভেড়া বিক্রি করছিলেন এক স্থানীয় ব্যাপারি, তার কাছে গিয়ে ভেড়ার দরদামও করেন অজিত ডোভাল। জানতে চান, দশ হাজার রুপির ওই ভেড়াতে কতটা মাংস মিলবে, ইত্যাদি। ব্যাপারি তাকে প্রথমে চিনতে পারেননি অবশ্য, তবে সংবাদ সংস্থার তোলা সেই দৃশ্যের ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে ভারতের নানা টিভি চ্যানেলে।
লন্ডন-ভিত্তিক কাশ্মিরি অ্যাক্টিভিস্ট শামিমা শল এ কারণেই মনে করছেন, ‘কাশ্মিরে আমরা আজ যা ঘটতে দেখছি তা কিন্তু তথাকথিত ‘ডোভাল ডকট্রিনে’রই পরিণাম। কাশ্মিরকে জোর করে ভারতের অংশ বানানোর লক্ষ্য নিয়েই অজিত ডোভাল তৈরি করেছেন এই নীতিমালা বা স্ট্য্যাটেজি পেপার, ধাপে ধাপে এখন যার বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে।’
কাশ্মিরের ‘আত্মনিয়ন্ত্রণ’ বা সেলফ-ডিটারমিনেশনের জোরালো সমর্থক শামিমা শল বাংলা ট্রিবিউনকে আরও বলছিলেন, ‘এই ডোভাল ডকট্রিনের অংশ হিসেবেই ভারতের নানা প্রান্ত থেকে হিন্দুদের কাশ্মিরে এনে জমি-বাড়ি দিয়ে বসত করানোর চেষ্টা হচ্ছে। তৈরি করা হচ্ছে শিল্প শ্রমিক বা রিটায়ার্ড সেনা সদস্যদের আলাদা কলোনি।’
‘৩৭০ ধারা বিলোপ করে কাশ্মিরের যে স্বতন্ত্র একটা মর্যাদা আছে, জাতিসংঘের চোখে বা আন্তর্জাতিকভাবে যে বিতর্কিত ভূখন্ড হিসেবে স্বীকৃতি আছে – এই ডকট্রিন সেটাই ধ্বংস করতে চাইছে।’
বাবরি মসজিদ ভাঙার সঙ্গে অদ্ভুত মিল?
কাশ্মির নিয়ে এই নাটকীয় ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে ভারতের সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর কিন্তু তেমন শোনাই যাচ্ছে না বলা চলে। গত এক সপ্তাহ ধরে নরেন্দ্র মোদির স্পর্ধা ও সাহস, অমিত শাহ্-র আত্মবিশ্বাসের প্রশংসায় ভেসে যাচ্ছে ভারতের সোশ্যাল মিডিয়া – ‘দুর্বিনীত’ কাশ্মিরকে অবশেষে একটা ‘সবক’ শেখানো গেল, এ কথা বলতেও দ্বিধা করছেন না অনেকেই।
এই যেখানে পাবলিক ডিসকোর্সের অবস্থা, সেখানে ৩৭০ ধারা বিলোপের বিরুদ্ধে বাকি ভারতে প্রতিবাদের মাত্রা যে স্তিমিত হবে তা বলাই বাহুল্য। দিল্লির জেএনইউ, কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অথবা বামপন্থী দলগুলোর উদ্যোগে ইতস্তত বিক্ষোভ হলেও ভারতীয়দের সমবেত হর্ষোল্লোসে তা এর মধ্যেই চাপা পড়ে গেছে।
এই পটভূমিতেই বিষয়টি নিয়ে একটি ব্যতিক্রমী নিবন্ধ লিখেছেন ভারতের ঐতিহাসিক-দার্শনিক রামচন্দ্র গুহ, যিনি প্রথম দিন থেকে এই সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করে আসছেন। সামাজিক মাধ্যমে তীব্র বিদ্রুপের শিকার হয়েও রাম গুহ লিখতে দ্বিধা করেননি, ‘সাতাশ বছর আগে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভাঙার সঙ্গে ভয়ঙ্কর সাদৃশ্য আছে এই ঘটনার।’
তার যুক্তি, এই দুটো ঘটনার পক্ষেই সাফাই দেওয়া হয়েছে এর মাধ্যমে ‘ঐতিহাসিক ভুল’ শোধরানো হয়েছে। দুটো ঘটনাই ঘটেছে কট্টর হিন্দুত্ববাদী সঙ্ঘ পরিবার ও তার সমর্থকদের হাতে। সর্বোপরি, ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের সাংবিধানিক মূল্যবোধকে যারা সম্মান করেন ও মর্যাদা দেন – তাদের নীরবেই এই দুটো ঘটনাতে শোকের ধাক্কা সামলাতে হচ্ছে।
ভারতের সুপরিচিত শিক্ষাবিদ ও ঐতিহাসিক তনিকা সরকারেরও বলতে দ্বিধা নেই, ‘বাবরি মসজিদ ভাঙার মধ্যে দিয়ে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে যদি ছিন্নভিন্ন করার চেষ্টা হয়ে থাকে, তাহলে বলা যেতে পারে ৩৭০ ধারা বিলোপের মধ্যে দিয়ে তার কফিনেই শেষ পেরেকটা মারার চেষ্টা হল।’
ফলে সার্বিকভাবে বার্তাটা খুব পরিষ্কার, প্রেসিডেন্সিয়াল ডিক্রির মাধ্যমে কাশ্মিরের বিশেষ ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া ভারত সরকারের নেওয়া আচমকা কোনও পদক্ষেপ নয় – এর পেছনে আছে দীর্ঘদিনের ভাবনাচিন্তা, স্ট্র্যাটেজি বা কৌশল প্রণয়ন এবং একটি সুপরিকল্পিত লক্ষ্য বা ‘ডিজাইন’।
সেই লক্ষ্য সফল হলে ভারতের ইতিহাসে হয়তো স্থায়ীভাবে জায়গা করে নেবেন নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদি, আর ব্যর্থ হলে কাশ্মির অবধারিতবাবে আরও রক্তাক্ত হতে থাকবে আগামী বহু বছর ধরে।
বিকেল পাঁচটার দিকে নিকোলা করিম আরেকটি টুইটে বলেন, ‘এটুকু পরিষ্কার করতে চাই যে এই ভিডিওটা শুক্রবার শ্রীনগরের সোউরাতে জুমার নামাজের পর বিকেল সাড়ে তিনটার সময় তোলা। ভিডিও-র র’ ফুটেজও শিগগির প্রকাশ করা হবে।’
মাত্র কয়েক ঘণ্টার ভেতরই অস্বীকার করলো ভারত। জানালো,‘ এসব ফায়ারিং-টায়ারিং নাকি একদম বাজে কথা। জম্মু ও কাশ্মির সরকারের শীর্ষ আমলা ও পুলিশ প্রধান একযোগে বিবৃতি দিলেন, ‘বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত খবরে একেবারেই কান দেবেন না। জেনে রাখুন, গত ছয় দিনে পুলিশ কাশ্মিরে একটাও বুলেট চালায়নি।’
রবিবার সকালে দিল্লিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সেই বিবৃতি আবার রিটুইট করলেন। তিনি এর আগেই রয়টার্স ও বিবিসিকে একহাত নিয়েছেন, ‘দশ হাজার মানুষে’র কথিত বিক্ষোভের খবরকে ভিত্তিহীন বলে বর্ণনা করে। জানিয়েছেন, শ্রীনগর বা বারামুলায় ছোটখাটো বিচ্ছিন্ন প্রতিবাদ হলেও তার কোনওটিতেই ২০ জনের বেশি লোক ছিল না।
ইতোমধ্যে কাশ্মির পুলিশের আইজি স্বয়মপ্রকাশ পানি নিজে ভিডিও বার্তা রেকর্ড করে টুইটারে পোস্ট করলেন, ‘গত এক সপ্তাহ ধরে কাশ্মীর ভ্যালি কিন্তু শান্তিপূর্ণই আছে।’ সঙ্গে ছিল মিডিয়ার প্রতি তার প্রচ্ছন্ন হুঁশিয়ারি, ‘সংবাদমাধ্যমকে বলবো তারা যেন দায়িত্বশীল আচরণ করে!’
শনিবার মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, শ্রীনগরে ৩৭০ ধারা বিলোপের দাবিতে কাশ্মিরি নারীরাও পথে নেমেছেন। সে খবরও উড়িয়ে দিয়েছে সরকার।
বস্তুত গত আটচল্লিশ ঘণ্টায় ভারত সরকার কাশ্মির প্রসঙ্গে বিবিসি, আল জাজিরা, নিউ ইয়র্ক টাইমস, রয়টার্স-সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে যেভাবে নস্যাৎ করার চেষ্টা করেছে ভারতীয় গণতন্ত্রের সত্তর বছরের ইতিহাসে তা কখনও ঘটেনি বললেও বোধহয় ভুল হবে না।
আর এই দাবি আর পাল্টা দাবির বিস্তারিত বিবরণ এই জন্যই পেশ করলাম যে ভারতে পর্যবেক্ষক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা অনেকেই মনে করছেন কাশ্মির নিয়ে ভারত এবারে যে একটা ‘হেস্তনেস্ত করার লড়াইয়ে নেমেছে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলোর সঙ্গে এই মুখোমুখি সংঘাতেই তা স্পষ্ট। কাশ্মিরে এবারকার মর্যাদার যুদ্ধটা জেতার জন্য ভারতীয় গণতন্ত্র যে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিজের ভাবমূর্তি বা ইমেজ নিয়েও ভাবিত নয় – সেই লক্ষণও এরই মধ্যে পরিষ্কার।
সামরিক শক্তিতে বুলডোজ করা যাবে কাশ্মিরের ভাবাবেগ?
বিখ্যাত প্রতিরক্ষা সাময়িকী জেনস ডিফেন্স উইকলি-র নিরাপত্তা বিশ্লেষক রাহুল বেদী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দেখুন, অনেকেই হয়তো ভাবছেন ভারত সরকার কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করার সিদ্ধান্ত একেবারে হঠাৎ করে নিয়েছে। কাউকে কোনও আভাস না-দিয়ে পার্লামেন্টে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই পদক্ষেপ ঘোষণা করেছেন ঠিকই, তবে আমি কিন্তু বলবো সরকার অনেক ভেবেচিন্তেই কাশ্মির নিয়ে এখানে একটা বিরাট ফাটকা খেলেছে।’
রাহুল বেদীর বক্তব্য, সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করে কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা বা স্বীকৃতি রাতারাতি ছিনিয়ে নেওয়া হলে ওই প্রদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমরা যে তাকে স্বাগত জানাতে রাস্তায় নেমে মিছিল করবেন না নরেন্দ্র মোদি সরকারেরও তা বিলক্ষণ জানা আছে।
কিন্তু সরকার এখন যেভাবেই হোক এই আত্মবিশ্বাসটা অর্জন করেছে লক্ষ লক্ষ ফৌজ ও আধাসেনা নামিয়ে কাশ্মীরের ভাবাবেগকে দমিয়ে রাখা সম্ভব। সেটা পুরো কাশ্মিরকে গ্যারিসন বানিয়ে করা হলেও ক্ষতি নেই।’
তিনি বলেন, ‘কাশ্মির যতই ক্ষুব্ধ হোক, তারা খুব বেশিদিন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে পারবে না বলেও মোদি সরকারের বিশ্বাস। যেমন ২০১৬তে বুরহান ওয়ানি নিহত হওয়ার পর কাশ্মিরের স্বত:স্ফূর্ত প্রতিবাদও তিন চার মাসের বেশি টেকেনি।’
দিল্লিতে একাধিক নিরাপত্তা বিশ্লেষকের সঙ্গে কথা বলেও এই ধারণা পাওয়া যাচ্ছে যে প্রয়োজন হলে ভারত সরকার কাশ্মিরে আরও সেনা ‘মোবিলাইজ’ করতেও প্রস্তুত। তারা জানাচ্ছেন, সমগ্র ভারত-শাসিত কাশ্মিরে এখনই প্রায় সাত লাখ সেনা মোতায়েন আছে, আরও দুলক্ষ সৈন্য আনা নিয়ে আসা সম্ভব মাত্র কয়েক দিনের নোটিশেই।
কী ভূমিকা মোদির ‘জেমস বন্ড’অজিত ডোভালের?
মোদি সরকারের এই ‘কাশ্মির গেমপ্ল্যানে’ একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (এনএসএ) অজিত ডোভাল – যাকে অনেকেই মোদির ‘জেমস বন্ড’ বলে ডাকেন।
ভারতের এই সাবেক গোয়েন্দা-প্রধান তার ডাকাবুকো স্বভাব ও দুঃসাহসী নানা সিদ্ধান্তের জন্য পরিচিত। ইসলামাবাদে একটা সময় তিনি টানা সাত বছর মুসলিম সেজে কীভাবে ভারতের হয়ে কাজ করেছেন, দিল্লিতে সে গল্পও মুখে মুখে ফেরে।
পাঁচ বছর আগে এনএসএ-র দায়িত্বে আসার পর থেকেই অজিত ডোভাল কিন্তু গোপনে কাশ্মির নিয়ে নানা তৎপরতা ও স্ট্র্যাটেজি ফর্মুলেশনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
ভারতের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর একটি সূত্র জানাচ্ছে, ‘শুনলে অবাক হবেন গত কয়েক বছর ধরে দু-চারটে সপ্তাহ বাদ দিলে প্রতি শুক্র বা শনিবার অজিত ডোভাল কাশ্মির আসছেন। চলে যাচ্ছেন নানা সেনানিবাসে বা স্থানীয়দের মহল্লায়। কাশ্মিরে গিয়ে তিনি শুধু ফৌজের সঙ্গেই নয়, সমাজের নানা স্তরের মানুষের সঙ্গেও মিশছেন ও কথাবার্তা বলছেন।’
গত সোমবার পার্লামেন্টে অমিত শাহ-র নাটকীয় ঘোষণার পর থেকেই কাশ্মির ভ্যালিতে ঘাঁটি গেড়ে পড়ে আছেন অজিত ডোভাল। বুধবার তাকে দেখা গেছে শোপিয়ানে সরকারি লঙ্গর থেকে বিরিয়ানি নিয়ে স্থানীয় মানুষজনের সঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেতে। ‘সব ঠিক হয়ে যাবে’ বলে তাদের ভরসা দিয়েছেন, কাশ্মির পুলিশের মনোবল চাঙ্গা করতে ভাষণও দিয়েছেন।
এরপর শুক্রবার তিনি গিয়ে হাজির হন অনন্তনাগে। সেখানে রাস্তার ধারে ঈদের কোরবানির জন্য ভেড়া বিক্রি করছিলেন এক স্থানীয় ব্যাপারি, তার কাছে গিয়ে ভেড়ার দরদামও করেন অজিত ডোভাল। জানতে চান, দশ হাজার রুপির ওই ভেড়াতে কতটা মাংস মিলবে, ইত্যাদি। ব্যাপারি তাকে প্রথমে চিনতে পারেননি অবশ্য, তবে সংবাদ সংস্থার তোলা সেই দৃশ্যের ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে ভারতের নানা টিভি চ্যানেলে।
লন্ডন-ভিত্তিক কাশ্মিরি অ্যাক্টিভিস্ট শামিমা শল এ কারণেই মনে করছেন, ‘কাশ্মিরে আমরা আজ যা ঘটতে দেখছি তা কিন্তু তথাকথিত ‘ডোভাল ডকট্রিনে’রই পরিণাম। কাশ্মিরকে জোর করে ভারতের অংশ বানানোর লক্ষ্য নিয়েই অজিত ডোভাল তৈরি করেছেন এই নীতিমালা বা স্ট্য্যাটেজি পেপার, ধাপে ধাপে এখন যার বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে।’
কাশ্মিরের ‘আত্মনিয়ন্ত্রণ’ বা সেলফ-ডিটারমিনেশনের জোরালো সমর্থক শামিমা শল বাংলা ট্রিবিউনকে আরও বলছিলেন, ‘এই ডোভাল ডকট্রিনের অংশ হিসেবেই ভারতের নানা প্রান্ত থেকে হিন্দুদের কাশ্মিরে এনে জমি-বাড়ি দিয়ে বসত করানোর চেষ্টা হচ্ছে। তৈরি করা হচ্ছে শিল্প শ্রমিক বা রিটায়ার্ড সেনা সদস্যদের আলাদা কলোনি।’
‘৩৭০ ধারা বিলোপ করে কাশ্মিরের যে স্বতন্ত্র একটা মর্যাদা আছে, জাতিসংঘের চোখে বা আন্তর্জাতিকভাবে যে বিতর্কিত ভূখন্ড হিসেবে স্বীকৃতি আছে – এই ডকট্রিন সেটাই ধ্বংস করতে চাইছে।’
বাবরি মসজিদ ভাঙার সঙ্গে অদ্ভুত মিল?
কাশ্মির নিয়ে এই নাটকীয় ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে ভারতের সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর কিন্তু তেমন শোনাই যাচ্ছে না বলা চলে। গত এক সপ্তাহ ধরে নরেন্দ্র মোদির স্পর্ধা ও সাহস, অমিত শাহ্-র আত্মবিশ্বাসের প্রশংসায় ভেসে যাচ্ছে ভারতের সোশ্যাল মিডিয়া – ‘দুর্বিনীত’ কাশ্মিরকে অবশেষে একটা ‘সবক’ শেখানো গেল, এ কথা বলতেও দ্বিধা করছেন না অনেকেই।
এই যেখানে পাবলিক ডিসকোর্সের অবস্থা, সেখানে ৩৭০ ধারা বিলোপের বিরুদ্ধে বাকি ভারতে প্রতিবাদের মাত্রা যে স্তিমিত হবে তা বলাই বাহুল্য। দিল্লির জেএনইউ, কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অথবা বামপন্থী দলগুলোর উদ্যোগে ইতস্তত বিক্ষোভ হলেও ভারতীয়দের সমবেত হর্ষোল্লোসে তা এর মধ্যেই চাপা পড়ে গেছে।
এই পটভূমিতেই বিষয়টি নিয়ে একটি ব্যতিক্রমী নিবন্ধ লিখেছেন ভারতের ঐতিহাসিক-দার্শনিক রামচন্দ্র গুহ, যিনি প্রথম দিন থেকে এই সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করে আসছেন। সামাজিক মাধ্যমে তীব্র বিদ্রুপের শিকার হয়েও রাম গুহ লিখতে দ্বিধা করেননি, ‘সাতাশ বছর আগে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভাঙার সঙ্গে ভয়ঙ্কর সাদৃশ্য আছে এই ঘটনার।’
তার যুক্তি, এই দুটো ঘটনার পক্ষেই সাফাই দেওয়া হয়েছে এর মাধ্যমে ‘ঐতিহাসিক ভুল’ শোধরানো হয়েছে। দুটো ঘটনাই ঘটেছে কট্টর হিন্দুত্ববাদী সঙ্ঘ পরিবার ও তার সমর্থকদের হাতে। সর্বোপরি, ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের সাংবিধানিক মূল্যবোধকে যারা সম্মান করেন ও মর্যাদা দেন – তাদের নীরবেই এই দুটো ঘটনাতে শোকের ধাক্কা সামলাতে হচ্ছে।
ভারতের সুপরিচিত শিক্ষাবিদ ও ঐতিহাসিক তনিকা সরকারেরও বলতে দ্বিধা নেই, ‘বাবরি মসজিদ ভাঙার মধ্যে দিয়ে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে যদি ছিন্নভিন্ন করার চেষ্টা হয়ে থাকে, তাহলে বলা যেতে পারে ৩৭০ ধারা বিলোপের মধ্যে দিয়ে তার কফিনেই শেষ পেরেকটা মারার চেষ্টা হল।’
ফলে সার্বিকভাবে বার্তাটা খুব পরিষ্কার, প্রেসিডেন্সিয়াল ডিক্রির মাধ্যমে কাশ্মিরের বিশেষ ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া ভারত সরকারের নেওয়া আচমকা কোনও পদক্ষেপ নয় – এর পেছনে আছে দীর্ঘদিনের ভাবনাচিন্তা, স্ট্র্যাটেজি বা কৌশল প্রণয়ন এবং একটি সুপরিকল্পিত লক্ষ্য বা ‘ডিজাইন’।
সেই লক্ষ্য সফল হলে ভারতের ইতিহাসে হয়তো স্থায়ীভাবে জায়গা করে নেবেন নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদি, আর ব্যর্থ হলে কাশ্মির অবধারিতবাবে আরও রক্তাক্ত হতে থাকবে আগামী বহু বছর ধরে।
No comments