সড়ক দুর্ঘটনা বিরাট হত্যাকাণ্ডের মহড়া: -সাক্ষাৎকারে ইকবাল হাবিব
বাংলাদেশের সড়কে যেসব দুর্ঘটনা ঘটছে তা অবাঞ্ছিত এবং
অবহেলাজনিত এক বিরাট হত্যাকাণ্ডের মহড়া। রেডিও তেহরানাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে
এমন মন্তব্য করেছেন বিশিষ্ট নগর পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন
বাপার যুগ্ম সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব।
তিনি বলেন, মালিক-শ্রমিক সমিতির অবাঞ্ছিত,
অযাচিত এবং দায়িত্ব কাণ্ডজ্ঞানহীন রাজনৈতিক ও পেশিশক্তির বাধার মুখে সড়ক
দুর্ঘটনা রোধে ও সড়কে নিরাপত্তা সৃষ্টিতে যথাযত উদ্যোগ গ্রহণ করা সম্ভব
হচ্ছে না। যে কারণে এত বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে।
- সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ জবাহদিহিতাহীন ও আইনের প্রয়োগহীন সড়ক ব্যবস্থাপনা।
- সড়ক দুর্ঘটনারোধে শুধু প্রয়োজন দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং জবাবদিহীতার মধ্য দিয়ে কার্যকর ব্যবস্থাপনা তৈরি করা।
সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ ও উপস্থাপনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ। পুরো সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো।
রেডিও তেহরান: জনাব ইকবাল হাবিব,
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এবছর ঈদুল ফিতরের
ছুটিতে সারা দেশে ১২৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৮৪ জন। আর আহত হয়েছেন
৩৩২ জন। এই যে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে এর কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?
ইকবাল হাবিব: প্রকৃত
উদ্যোগ গ্রহণ না করাই মূলত সড়ক দুর্ঘটনা এবং সড়কে নিরাপত্তাহীনতার মূল কারণ
বলে আমি মনে করি। আর এই প্রকৃত উদ্যোগ গ্রহণ করতে গেলেই মালিক-শ্রমিক
সমিতির অবাঞ্ছিত, অযাচিত এবং দায়িত্ব কাণ্ডজ্ঞানহীন রাজনৈতিক এবং
পেশিশক্তির বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে। তাদের কারণেই প্রকৃত উদ্যোগ গ্রহণ করা
সম্ভব হচ্ছে না।
আমরা যখন কথা বলছি তখন সড়ক দুর্ঘটনা ও
নিরাপত্তার ব্যাপারে নানা আন্দোলন সংগ্রামের কারণে অনেকগুলো সুপারিশ ও
নির্দেশনা এসেছে। একইসাথে উচ্চ আদালতেরও সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। ফলে এ
ব্যাপারে একটা প্রক্রিয়া শুরু হতে যাচ্ছে। আমরা অদূর ভবিষ্যতে যথাযথ
নিরাপত্তা সম্বলিত একটি সড়ক ব্যবস্থাপনার দিকে যাব। তবে এই যাব যাব যখন
বলছি তখন আমাদের মহাসড়কগুলো সাংঘাতিকভাবে অরক্ষিত।
এবারের দুর্ঘটনাগুলো যদি একটু পর্যাবেক্ষণ
করা যায় তাহলে দেখব, বিরাট অংশের দুর্ঘটনা ঘটেছে মোটরসাইকেলে। এছাড়া
অনেকগুলো দুর্ঘটনার মূল কারণ ছিল মহাসড়কে অবাঞ্ছিত অবৈধ ভটভটি ধরনের যেসব
কনভার্টেট যান্ত্রিক বাহন তৈরি করা হয়েছে সেসব এবং এসবের চালকরা কখনও কোনো
ধরনের আইন কানুন সম্পর্কে জ্ঞাত না পাশাপাশি লাইসেন্সও নেই। মূলত তাদের
কারণেই বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটেছে।
এখন মোটরসাইকেলে যেসব দুর্ঘটনা ঘটেছে সে ব্যাপারে বলব গত তিন চার বছরে দেশে
মোটরসাইকেলের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। আর এই প্রবলভাবে বেড়ে যাওয়ার
অন্যতম কারণ হচ্ছে- রাজনৈতিক কারণে আমাদের যুব সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশ
কোনো কাজ করতে পারছে না। তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। রাজনৈতিক কোনো না কোনো
কারণে তারা হয়তো কোণঠাসা। তারা এই মোটর সাইকেলের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহের
একটা প্রচেষ্টার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। আর এই যুব সমাজের মধ্যে একটা উদ্যমতা ও
দুর্বিনীত মনোভাব আছে। রাজনৈতিক কারণে যখন কেউ চাপের মধ্যে থাকে তখন তাদের
অভিব্যক্তি ও বোডি ল্যাঙ্গুয়েজ কার্যক্রম সবকিছুতেই কিন্তু মারদাঙ্গা
মানসিকতা থাকে। আর এ বিষয়টি আমরা অনেক দিন থেকে বলছিলাম। পুরো শহরজুড়ে
'পাঠাও' উবার' এর মাধ্যমে দুর্ঘটনা প্রবণতাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
এবারের ঈদ যাত্রায় বা ঈদ শেষে কর্মস্থলে
ফেরার সময় যেসব দুর্ঘটনা ঘটেছে তা মোটরসাইকেল ও ভটভটিধরনের যেসব যান রয়েছে
তাদের কারণে। আর তাদের কারণে বহু অমূল্য প্রাণ ঝরে গেছে। যে সংখ্যাটি আপনি
বলেছেন সেটি নিবন্ধিত। এর বাইরে অসংখ্য দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং বহু প্রাণ
হারিয়েছে। পুলিশি ঝামেলাসহ নানা কারণে এসব ঘটনা প্রকাশ্যে আসে নি। এ ধরনের
বহু দুর্ঘটনার খবরও আমাদের কাছে এসেছে। অতএব সড়ক বা মহাসড়কে নিয়মকানুনহীন
একটা কর্মসূচির মধ্যে থাকা হলে বা ছুটি ছাটার সময় মানুষের সফরের ব্যাপারটা
যেহেতু একটু বেশি হয় ফলে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে যা অবাঞ্ছিত এবং অবহেলাজনিত
এক বিরাট হত্যাকাণ্ডের মহড়া।
রেডিও তেহরান: সড়ক দুর্ঘটনার জন্য প্রধানত আপনি কাকে বা কোন বিষয়টিকে দায়ী করবেন?
ইকবাল হাবিব: সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হিসেবে আমি বলব জবাহদিহিতাহীন ও আইনের প্রয়োগহীন সড়ক ব্যবস্থাপনা।
দ্বিতীয়ত কারণ হিসেবে আমি বলব, সড়কে করিডোরভিত্তিক যান চলাচলের নিরাপত্তাজনিত অবকাঠামো যথাযথকরণের অভাব।
তৃতীয়ত, সড়ক চলাচল ব্যবস্থার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের দায়িত্ব কাণ্ডজ্ঞানহীন ও জবাবদিদিতার মনোভাভের অভাব।
চতুর্থত, সরকারি যেসব সংস্থা এসব দেখভালের
দায়িত্বে রয়েছে তাদের দীর্ঘদিনের অবহেলা এবং তাদের পেশাগত দক্ষ জনগোষ্ঠীর
অভাব এবং পরিবির্ততভাবে পুরো ব্যবস্থাকে সাজিয়ে একটি জনবান্ধব নিরাপদ
ব্যবস্থাপনায় যাওয়ার উদ্যোগের অভাব। এগুলো মূল বিষয়। এরসঙ্গে সচেতনার অভাব
রয়েছে। অবকাঠামোগত দিকের উন্নয়নে অর্থনৈতিক সামর্থ্যের অভাব রয়েছে।
রেডিও তেহরান: বলা হয়ে থাকে,
দেশের চালক শ্রেণীর মধ্যে শিক্ষার আলো কম এবং তাদের অনেকেই মাদকসেবী। এদের
কাছে মানবতাবোধ একদম তুচ্ছ। এই সমস্যাগুলো কীভাবে সমাধান করা সম্ভব?
কাউন্সেলিং কী এ বিষয়ে সমাধানের মাধ্যম হতে পারে?
ইকবাল হাবিব: আপনি যেসব
কারণ বললেন তার সাথে আরও একটি কারণ যুক্ত করতে হবে। সেটি হচ্ছে চালকদের
অনেকেই মানসিক এবং দৈহিকভাবে অসুস্থ। অনেক চোখে দেখেন না। এসব বিষয়
বিবেচনায় নিয়ে এক্ষেত্রটিতে পরিশীলিত করণের উদ্যোগ নিতে হবে সরকার ও মালিক
উভয়পক্ষের। যারা এরইমধ্যে চালক হয়েছেন তাদের যদি অবৈধ লাইসেন্স থাকে
সেগুলোতে প্রক্রিয়ার মধ্যে আনতে হবে। আমাদের প্রশিক্ষণের স্কুলগুলোতে তাদের
শারিরীক মানসিক পরীক্ষার মাধ্যমে উপযুক্ততার ভিত্তিতে গাড়ি চালানোর
অনুমতি দিতে হবে। এছাড়া আমাদের চালকের সংকট প্রচুর। সরকারি বেসরকারি যৌথ
উদ্যোগে বেশি বেশি চালক প্রশিক্ষণ স্কুল তৈরি করে এ খাতে বিনিয়োগ করতে হবে
যাতে অতি দ্রুততম সময়ে যোগ্য চালক তৈরি করতে হবে।এই প্রক্রিয়াটা মূলত
উদ্যোগের অভাবে হচ্ছে না। কারণ চাহিদা আছে এবং আমাদের অসংখ্য বেকার ও অদক্ষ
জনগোষ্ঠী রয়েছে। অথচ আমরা দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরি করতে পারছি না। আর অদক্ষ
জনগোষ্ঠীর কারণে দুর্ঘটনা বাড়ছে। এ জায়গাতে আমাদের মনোযোগ ও বিনিয়োগ
জরুরিভিত্তিতে প্রয়োগ করা প্রয়োজন।
রেডিও তেহরান: সড়ক দুর্ঘটনা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় কমিয়ে আনা কী অসম্ভব? নিরাপদ সড়ক গড়ে তোলার জন্য কী কী পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে?
ইকবাল হাবিব: দেখুন,
অবশ্যই সড়ক দুর্ঘটনা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় কমিয়ে আনা সম্ভব। শুধু তাই নয়
দ্রুততম সময়ে সম্ভব। শুধু প্রয়োজন দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং জবাবদিহীতার
মধ্য দিয়ে কার্যকর ব্যবস্থাপনা তৈরি করা।
করণীয় সম্পর্কে এরইমধ্যে মাননীয়
প্রধানমন্ত্রীর কাছে ১১১ টি বিষয় দাখিল করা হয়েছে। যদিও আমরা সেটাকে
ক্যাটিগরি করে দেখেছি যে এগুলো ৬৪ টির মধ্যে আনা সম্ভব। যারমধ্যে স্বল্প,
মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী কার্যক্রম রয়েছে। এছাড়া আদালতের রায় আছে এবং
প্রধানমন্ত্রীর গত দুই ঈদে দেয়া কতগুলো সুস্পস্ট অনুশাসন রয়েছে। আমি মনে
করি শুধুমাত্র এগুলোতেই সময় নির্ভর পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়ন করলে আমরা
কাঙ্ক্ষিতমাত্রায় বা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে সড়কের নিরাপত্তাকেও আনা সম্ভব
একইসাথে দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব।
সড়কে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা |
No comments