জানা হল না এরশাদের সেই না বলা কথা
বহু
আলোচিত- বহু সমালোচিত- বহু বিতর্কিত… বাংলাদেশের এক সময়ের শাসক হুসেইন
মুহম্মদ এরশাদ জীবনভর থেকে গেলেন নানাবিধ চর্চায়। সামরিক শাসক থেকে
ভোট-রাজনীতিবিদের খাতায় নাম লিখিয়েছিলেন। নামের পাশে জুটেছিল বেশ কিছু
পরস্পর বিরোধী বিশেষণ। ‘স্বৈরশাসক’ থেকে শুরু করে ‘বিশ্ব বেহায়া’ পর্যন্ত
বলা হয়েছে যাঁকে, বহু দুর্নীতি বা নারী কেলেঙ্কারীতে অভিযুক্ত হয়েছেন যিনি,
সেই মানুষটিই আবার অনেকের কাছে ‘পল্লিবন্ধু’ বিশেষণও পেয়েছেন।
এরশাদ মারা গেলেন গত ১৪ জুলাই রবিবার বাংলাদেশি সময় সকাল পৌনে ৮টায়। ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ)-এ চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হল। গত ২৭ জুন সকালে অসুস্থবোধ করলে তাঁকে সিএমএইচে ভর্তি করা হয়। তিনি হিমোগ্লোবিনের স্বল্পতা, ফুসফুসে সংক্রমণ ও কিডনির জটিলতায় ভুগছিলেন।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর, আগের সেনাশাসকের মতো এরশাদও রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন। এরশাদের সেই রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টির অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে দেওয়া জীবনবৃত্তান্তে বলা হয়েছে, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৩০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রংপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। আবার বাংলাদেশের কিছু সংবাদমাধ্যমের তথ্য, এরশাদের জন্ম বর্তমান ভারতের কোচবিহার জেলার দিনহাটায়। এরশাদ আবার নিজের আত্মজীবনীতে লিখেছেন, তাঁর জন্ম কুড়িগ্রামে মামা বাড়িতে। রংপুরে কলেজের পড়াশোনা শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৫২ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এরশাদ। পাকিস্তান আমলে চট্টগ্রাম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে অ্যাডজুট্যান্ট, পশ্চিম পাকিস্তানের ৫৪তম ব্রিগেডের মেজর, তৃতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে অধিনায়ক এবং সপ্তম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি। পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর)-এ সেক্টর কমান্ডার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পশ্চিম পাকিস্তানেই ছিলেন এরশাদ। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ ঘুরে যাওয়ার তত্য তুলে ধরে অনেকে তাঁর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। পাকিস্তান থেকে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে ফেরেন। তার পর অন্য অনেকের মত তাঁকেও সেনাবাহিনীর চাকরিতে নেওয়া হয়।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল হন তিনি। তখন তাঁর পদমর্যাদা ছিল কর্নেল। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর, জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান হলে, এরশাদকে উপপ্রধান করেন। মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্তারা সে সময় এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন।
১৯৮১ সালের ৩০ মে সেনা অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমান নিহত হলে, জিয়ার পরিবার থেকে এরাশাদকেই দায়ী করা হয়েছিল। তবে জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়া একাধিকবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন, এ হত্যায় এরশাদকে অভিযুক্ত করে কোনও আইনি প্রক্রিয়াতেই যাননি। এ ছাড়া জিয়া হত্যার ঘটনার পর, নিহত মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল মহম্মদ আবুল মঞ্জুরকে হত্যার দায়েও অভিযুক্ত ছিলেন এরশাদ। সে মামলার রায় এখনও চূড়ান্ত হয়নি। অনেকের ধারনা, জিয়া হত্যায় নিজের জড়িত থাকার বিষয়টি ধামাচাপা দিতেই মঞ্জুরকে হত্যা করান এরশাদ।
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে উৎখাত করে বাংলাদেশে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন এরশাদ। নিজেকে সশস্ত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করে সামরিক শাসন জারি করে সংবিধান স্থগিত করেন। প্রথমে বিচারপতি এএফএম আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতির পদে বসিয়েছিলেন। কিন্তু সব ক্ষমতা ছিল এরশাদেরই হাতে। এক বছর পর আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে সরিয়ে নিজেই রাষ্ট্রপতির চেয়ারে বসেন এরশাদ, যদিও এই ক্ষমতা দখল অবৈধ বলে পরে রায় দেয় আদালত। ক্ষমতা দখল করে এরশাদ গড়ে তোলেন রাজনৈতিক দল ‘জাতীয় পার্টি’। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের উদ্যোগে উপজেলা গঠন, তাতে নির্বাচন এবং উপজেলা নির্বাচনের পর রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন দিয়ে নিজের ক্ষমতা দখলকে পোক্ত করেন এরশাদ। এর পর ১৯৮৬ সালে সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ব্যাপক প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও, অন্যান্য দল ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে। ১৯৮৮ সালে এরশাদ সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী এনে ইসলামকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম করেন, যা বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র বদলে দেয়। এ ছাড়া গণমাধ্যম ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত করা-সহ নানা পদক্ষেপে বিতর্কিত ছিল এরশাদের ক্ষমতার যুগ।
এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে ছাত্র আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। ১৯৮৩ সালে সালে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে গুলিতে প্রাণ হারান জাফর, জয়নাল, দীপালী সাহা-সহ বেশ কয়েকজন। সে সময় শিক্ষার্থীদের মরদেহও গুম করে ফেলে পুলিশ। তার পরের বছরই ছাত্রদের মিছিলে পুলিশ ট্রাক তুলে দিয়ে হত্যা করে সেলিম-দেলোয়ারকে। একের পর এক আন্দোলন আছড়ে পড়তে থাকে এরশাদের মসনদে। শ্রমিক নুর হোসেন, বিএমএ নেতা শামসুল আলম মিলন ও ছাত্রনেতা নাজির উদ্দিন জেহাদকে হত্যা করা হয় এ সব আন্দোলনের নানা পর্যায়ে। ১৯৮ সালের ২৮ নভেম্বর এরশাদ বাংলাদেশে জারি করেন জরুরি অবস্থা। এর পর তুমুল আন্দোলনের মুখে, ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর ঘোষণা করে, তার দু’দিনের মাথায় ৬ ডিসেম্বর এরশাদ ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন।
১৯৯০-এর গণ আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত এরশাদকে বন্দি করে তার বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামলা দায়ের করা হয়। কিন্তু তার মধ্যেই চমক দেখিয়ে ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে রংপুরের ৫টি আসনে বিজয়ী হন এরশাদ। গণ আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হলেও, পরের তিন দশক বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভাল মতোই টিকে থাকেন এরশাদ। বরং বলা যায়, আওয়ামি লিগ ও বিএনপির পাল্টাপাল্টিতে এরশাদ নিজের জায়গা ঠিক পেয়ে গিয়েছিলেন। কখনও আওয়ামি লিগের দিকে ঝুঁকে, কখনও বা বিএনপির দিকে ঝুঁকে নিজের পথ করতে দেখা গিয়েছে তাঁকে।
৪৩টি মামলা হয়েছিল এরশাদের বিরুদ্ধে। যার মধ্যে একটিতে খালাস পান। দুই মামলায় তিনি সাজা খাটেন। বাকি মামলাগুলোর নিষ্পত্তি হলেও মঞ্জুর হত্যা মামলাটি ঝুলে ছিল তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত।
রাষ্ট্রপতি থাকাকালে পাওয়া উপহার রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা না দেওয়ার মামলায় ঢাকার বিশেষ জজ আদালত এরশাদকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেয়। তবে দুই যুগ পর হাইকোর্ট সেই সাজা বাতিল করে। জাপানি নৌযান কেনায় অনিয়মের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় দুই বছরের কারাদণ্ড হয়। জনতা টাওয়ার দুর্নীতি মামলায় এরশাদকে ৫ বছরের কারাদণ্ড এবং ৫ কোটি ৪৮ লাখ ৭০ হাজার ৮০০ টাকা জরিমানা করা হয়। এ ছাড়া সোনা চোরাচালান, টেলিকম দুর্নীতি, পোল্ট্রি ফার্ম দুর্নীতি মামলা, আয়কর ফাঁকি, জাহাজ কেনায় দুর্নীতি, রাজউকের প্লট বরাদ্দে অনিয়ম, হরিপুরে তেল অনুসন্ধানে দুর্নীতি এবং রাডার কেনায় দুর্নীতি-সহ বিভিন্ন অভিযোগে আরও ১৯টি মামলা ছিল এরশাদের বিরুদ্ধে।
১৯৯৭ সালের ৯ জানুয়ারি জামিনে মুক্তি পান এরশাদ। এর পর থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে ট্রাম্প কার্ড হিসেবে ব্যবহৃত হন তিনি। ২০১৪ সালে আওয়ামি লিগের নেতৃত্বে মহাজোট গঠিত হলে তাতে যোগ দেয় এরশাদের জাতীয় পার্টি। নির্বাচনে মহাজোট জয়ী হলে মন্ত্রী পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হন এরশাদ।
বাংলাদেশে প্রতি বারই নির্বাচন এলে উঠে আসতেন আলোচনায়, বড় দলগুলোর কাছে কদর বাড়ত তাঁর। ভোটের সময় সিদ্ধান্তহীনতা ভোগা তার নিয়মিত বিষয় ছিল। এই বিষয়টি ‘রাজনীতির বিনোদন’ হিসেবেই দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন বাংলাদেশের মানুষ। এরশাদ নিজেও বলতেন, মনে অনেক কষ্ট নিয়েই তাঁকে সিদ্ধান্ত বারবার বদলানোর কাজটি করতে হয়। বলতেন, সময় হলে সব বলবেন তিনি। কিন্তু সেই সময় এল না আর। এসে গেল তার চলে যাওয়ার সময়। তাই জানা হল না তাঁর সেই না বলা কথা।
এরশাদ মারা গেলেন গত ১৪ জুলাই রবিবার বাংলাদেশি সময় সকাল পৌনে ৮টায়। ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ)-এ চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হল। গত ২৭ জুন সকালে অসুস্থবোধ করলে তাঁকে সিএমএইচে ভর্তি করা হয়। তিনি হিমোগ্লোবিনের স্বল্পতা, ফুসফুসে সংক্রমণ ও কিডনির জটিলতায় ভুগছিলেন।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর, আগের সেনাশাসকের মতো এরশাদও রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন। এরশাদের সেই রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টির অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে দেওয়া জীবনবৃত্তান্তে বলা হয়েছে, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৩০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রংপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। আবার বাংলাদেশের কিছু সংবাদমাধ্যমের তথ্য, এরশাদের জন্ম বর্তমান ভারতের কোচবিহার জেলার দিনহাটায়। এরশাদ আবার নিজের আত্মজীবনীতে লিখেছেন, তাঁর জন্ম কুড়িগ্রামে মামা বাড়িতে। রংপুরে কলেজের পড়াশোনা শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৫২ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এরশাদ। পাকিস্তান আমলে চট্টগ্রাম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে অ্যাডজুট্যান্ট, পশ্চিম পাকিস্তানের ৫৪তম ব্রিগেডের মেজর, তৃতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে অধিনায়ক এবং সপ্তম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি। পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর)-এ সেক্টর কমান্ডার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পশ্চিম পাকিস্তানেই ছিলেন এরশাদ। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ ঘুরে যাওয়ার তত্য তুলে ধরে অনেকে তাঁর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। পাকিস্তান থেকে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে ফেরেন। তার পর অন্য অনেকের মত তাঁকেও সেনাবাহিনীর চাকরিতে নেওয়া হয়।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল হন তিনি। তখন তাঁর পদমর্যাদা ছিল কর্নেল। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর, জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান হলে, এরশাদকে উপপ্রধান করেন। মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্তারা সে সময় এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন।
১৯৮১ সালের ৩০ মে সেনা অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমান নিহত হলে, জিয়ার পরিবার থেকে এরাশাদকেই দায়ী করা হয়েছিল। তবে জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়া একাধিকবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন, এ হত্যায় এরশাদকে অভিযুক্ত করে কোনও আইনি প্রক্রিয়াতেই যাননি। এ ছাড়া জিয়া হত্যার ঘটনার পর, নিহত মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল মহম্মদ আবুল মঞ্জুরকে হত্যার দায়েও অভিযুক্ত ছিলেন এরশাদ। সে মামলার রায় এখনও চূড়ান্ত হয়নি। অনেকের ধারনা, জিয়া হত্যায় নিজের জড়িত থাকার বিষয়টি ধামাচাপা দিতেই মঞ্জুরকে হত্যা করান এরশাদ।
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে উৎখাত করে বাংলাদেশে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন এরশাদ। নিজেকে সশস্ত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করে সামরিক শাসন জারি করে সংবিধান স্থগিত করেন। প্রথমে বিচারপতি এএফএম আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতির পদে বসিয়েছিলেন। কিন্তু সব ক্ষমতা ছিল এরশাদেরই হাতে। এক বছর পর আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে সরিয়ে নিজেই রাষ্ট্রপতির চেয়ারে বসেন এরশাদ, যদিও এই ক্ষমতা দখল অবৈধ বলে পরে রায় দেয় আদালত। ক্ষমতা দখল করে এরশাদ গড়ে তোলেন রাজনৈতিক দল ‘জাতীয় পার্টি’। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের উদ্যোগে উপজেলা গঠন, তাতে নির্বাচন এবং উপজেলা নির্বাচনের পর রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন দিয়ে নিজের ক্ষমতা দখলকে পোক্ত করেন এরশাদ। এর পর ১৯৮৬ সালে সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ব্যাপক প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও, অন্যান্য দল ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে। ১৯৮৮ সালে এরশাদ সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী এনে ইসলামকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম করেন, যা বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র বদলে দেয়। এ ছাড়া গণমাধ্যম ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত করা-সহ নানা পদক্ষেপে বিতর্কিত ছিল এরশাদের ক্ষমতার যুগ।
এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে ছাত্র আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। ১৯৮৩ সালে সালে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে গুলিতে প্রাণ হারান জাফর, জয়নাল, দীপালী সাহা-সহ বেশ কয়েকজন। সে সময় শিক্ষার্থীদের মরদেহও গুম করে ফেলে পুলিশ। তার পরের বছরই ছাত্রদের মিছিলে পুলিশ ট্রাক তুলে দিয়ে হত্যা করে সেলিম-দেলোয়ারকে। একের পর এক আন্দোলন আছড়ে পড়তে থাকে এরশাদের মসনদে। শ্রমিক নুর হোসেন, বিএমএ নেতা শামসুল আলম মিলন ও ছাত্রনেতা নাজির উদ্দিন জেহাদকে হত্যা করা হয় এ সব আন্দোলনের নানা পর্যায়ে। ১৯৮ সালের ২৮ নভেম্বর এরশাদ বাংলাদেশে জারি করেন জরুরি অবস্থা। এর পর তুমুল আন্দোলনের মুখে, ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর ঘোষণা করে, তার দু’দিনের মাথায় ৬ ডিসেম্বর এরশাদ ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন।
১৯৯০-এর গণ আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত এরশাদকে বন্দি করে তার বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামলা দায়ের করা হয়। কিন্তু তার মধ্যেই চমক দেখিয়ে ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে রংপুরের ৫টি আসনে বিজয়ী হন এরশাদ। গণ আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হলেও, পরের তিন দশক বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভাল মতোই টিকে থাকেন এরশাদ। বরং বলা যায়, আওয়ামি লিগ ও বিএনপির পাল্টাপাল্টিতে এরশাদ নিজের জায়গা ঠিক পেয়ে গিয়েছিলেন। কখনও আওয়ামি লিগের দিকে ঝুঁকে, কখনও বা বিএনপির দিকে ঝুঁকে নিজের পথ করতে দেখা গিয়েছে তাঁকে।
৪৩টি মামলা হয়েছিল এরশাদের বিরুদ্ধে। যার মধ্যে একটিতে খালাস পান। দুই মামলায় তিনি সাজা খাটেন। বাকি মামলাগুলোর নিষ্পত্তি হলেও মঞ্জুর হত্যা মামলাটি ঝুলে ছিল তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত।
রাষ্ট্রপতি থাকাকালে পাওয়া উপহার রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা না দেওয়ার মামলায় ঢাকার বিশেষ জজ আদালত এরশাদকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেয়। তবে দুই যুগ পর হাইকোর্ট সেই সাজা বাতিল করে। জাপানি নৌযান কেনায় অনিয়মের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় দুই বছরের কারাদণ্ড হয়। জনতা টাওয়ার দুর্নীতি মামলায় এরশাদকে ৫ বছরের কারাদণ্ড এবং ৫ কোটি ৪৮ লাখ ৭০ হাজার ৮০০ টাকা জরিমানা করা হয়। এ ছাড়া সোনা চোরাচালান, টেলিকম দুর্নীতি, পোল্ট্রি ফার্ম দুর্নীতি মামলা, আয়কর ফাঁকি, জাহাজ কেনায় দুর্নীতি, রাজউকের প্লট বরাদ্দে অনিয়ম, হরিপুরে তেল অনুসন্ধানে দুর্নীতি এবং রাডার কেনায় দুর্নীতি-সহ বিভিন্ন অভিযোগে আরও ১৯টি মামলা ছিল এরশাদের বিরুদ্ধে।
১৯৯৭ সালের ৯ জানুয়ারি জামিনে মুক্তি পান এরশাদ। এর পর থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে ট্রাম্প কার্ড হিসেবে ব্যবহৃত হন তিনি। ২০১৪ সালে আওয়ামি লিগের নেতৃত্বে মহাজোট গঠিত হলে তাতে যোগ দেয় এরশাদের জাতীয় পার্টি। নির্বাচনে মহাজোট জয়ী হলে মন্ত্রী পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হন এরশাদ।
বাংলাদেশে প্রতি বারই নির্বাচন এলে উঠে আসতেন আলোচনায়, বড় দলগুলোর কাছে কদর বাড়ত তাঁর। ভোটের সময় সিদ্ধান্তহীনতা ভোগা তার নিয়মিত বিষয় ছিল। এই বিষয়টি ‘রাজনীতির বিনোদন’ হিসেবেই দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন বাংলাদেশের মানুষ। এরশাদ নিজেও বলতেন, মনে অনেক কষ্ট নিয়েই তাঁকে সিদ্ধান্ত বারবার বদলানোর কাজটি করতে হয়। বলতেন, সময় হলে সব বলবেন তিনি। কিন্তু সেই সময় এল না আর। এসে গেল তার চলে যাওয়ার সময়। তাই জানা হল না তাঁর সেই না বলা কথা।
No comments